প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১১
Drm Shohag
মাইরা ইনায়ার ঘরে এসে ইনায়াকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। ইনায়ার সামনে অনেকগুলো চকলেট দেখে মাইরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“আপু এগুলো তোমাকে কে দিয়েছে?”
ইনায়া হাতের চিরকুট মাইরার দিকে এগিয়ে দিলে মাইরা দেখে বলে,
“আয় হায় আপু, এটা তো তোমার প্রেমিক পুরুষ মনে হচ্ছে।”
ইনায়া বিরক্ত হয়ে বলে,
“কচু।”
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
“কি বলছো? আচ্ছা তোমার প্রেমিক এর নাম কি?”
“এই লোক আমার প্রেমিক না।”
“কিন্তুু এখানে বলছে, ফিরে এসেছে। মানে আগে ছিল। তোমাদের ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল তাই না?”
“আরে না রে বোন। এই লোক চরম বেয়া’দব।”
মাইরা মুখে হাত দিয়ে বলল,
“বখাটে ছেলে তোমাকে ডিস্টার্ব করছে? দাঁড়াও, আমি তোমার ভাইয়াকে বিচার দিচ্ছি।”
ইনায়া মাইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি যাবে ভাইয়ার কাছে?”
মাইরা আমতা আমতা করে বলল,
“তোমার ভাইয়া এখন আমাকে থা’প্প’ড় মারে না। কিন্তুু অদ্ভুদ আচরণ করে বুঝলে? থাক যাব না।”
ইনায়া হেসে বলল,
“বিচার দিয়ে লাভ নেই। এই বখাটে উন্নতমানের।”
“কি বলো, সত্যি?”
“হুম। ভাইয়ার ফ্রেণ্ড।”
মাইরা বিছানার উপর পা তুলে বসে ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
“এইবার বুঝলাম, আসলে তোমার ভাইয়া বখাটেদের সাথে ঘুরে ঘুরে এমন খ’বি’শ হয়েছে। দাঁড়াও আমি বাবাকে বিচার দিচ্ছি।”
ইনায়া একটা চকলেট ছিঁড়ে খেতে খেতে বলল,
“পাগলি মেয়ে, সে আমার উডবি।”
মাইরা অবাক হয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার মনে হচ্ছে তুমি সেই বখাটে ছেলে, উডবিকে ভিতরে ভিতরে পছন্দ কর। উপরে উপরে ভাব নিচ্ছ।”
মাইরার কথায় ইনায়া থতমত খেয়ে তাকায়। কি ধড়িবাজ মেয়ে মাইরা। মাইরা হেসে বলে,
“তোমরা আমাকে বাচ্চা ভাবলেও আমি কিন্তুু অনেক বুঝি বুঝলে? আসলেই লোকটা বখা’টে? নাকি শুধু তোমার পার্সোনাল খাতায় সে বখা’টে?”
ইনায়া অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে। চকলেটে একটা কাম’ড় বসিয়ে বলে,
“তুমি যা ভাবছ তাই। কিন্তুু ওই লোকটা ভাইয়ার মতো। গম্ভীর ভাইয়াকে মানা যায়, কিন্তুু বরকে না।”
মাইরা হেসে বলল,
“ওদের মন ভালো হয়।”
ইনায়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি কিভাবে জানলে?”
“তোমার ভাইয়ার মন ভালো না?”
“ভাইয়া তো খা’রা’প না। শুধু তোমার সাথেই কেন এমন করে বুঝি না।”
মাইরা মাথা নিচু করে মলিন মুখে বলে,
“আসলে আমি উনার দিক থেকে ভেবেছি আপু। বিয়ে জিনিসটা জোর করে হয় না। উনার পছন্দের মানুষ থাকতে পারে। সেখানে তার বাবা জোর করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে আমার সাথে। আসলে কাউকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলে কখনো বিয়ে করা উচিৎ না। আর এভাবে জোর করে কোনো বাবা মায়ের বিয়ে দেয়াও উচিৎ না। তোমার বাবা কাজটা ঠিক করেনি।”
মাইরার কথা শুনে ইনায়া অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলে,
“আমায় তো জোর করে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলতে গেলে, তার সেই রাগ থেকে ধুপধাপ দু’একটা থা’প্প’ড় খাওয়াই যায়, আপু।”
ইনায়ার চোখ ভিজে গিয়েছে মাইরার কথা শুনে। মৃদুস্বরে বলে,
“তুমি নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছিলে ভাইয়াকে?”
মাইরা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
“হুম আপু। আসলে আমার বাড়িতে জায়গা নেই আমার জন্য। কিন্তুু তোমার ভাইয়ার চুল বড় তো, তাই আমার কাজিনরা বলেছিল আমার বর বুড়ো। কিন্তুু এখানে এসে দেখলাম বুড়ো নয়। আমি ভেবেছিলাম ৫০-৬০ বছরের কারো সাথে আমার বিয়ে হয়েছে,, সে জায়গায় ভিলেন সুন্দর বর পেয়ে অবাক হয়েছি, সাথে ভালোও লেগেছে।”
ইনায়া নিজের গালে হাত দিয়ে মন খা’রা’প করে বলে,
“আসলে ভাইয়ার রাগ বেশি। তুমি কিছু মনে কর না মাইরা। ভাইয়া এমনিতে খুবই ভালো। শুধু তোমার ক্ষেত্রেই কেমন যেন। বুঝতে পারছি না।”
মাইরা মন খা’রা’প করে বলে,
“আমি তো বললাম-ই আপু, উনার জায়গা থেকে উনি অনেকটা ঠিক-ই আছেন। বাবা আর তুমি আমায় কত ভালোবাসো। এই বাসায় এসে তোমাদের ভালোবাসা পেয়ে আমি অনেক ভালো আছি বুঝলে?”
ইনায়া চুপ করে রইলো। মাইরা নিজেকে স্বাভাবিক করে মৃদু হেসে বলে,
“আপু চকলেট গুলো কি খেতে পারি?”
ইনায়া রেগে বলে,
“তুমি পারমিশন কেন নাও মাইরা? বড় বোন বলো, অথচ পরদের মতো আচরণ কর।”
মাইরা ফটাফট চকলেটের প্যাকেট ছিঁড়ে হেসে বলে,
“এতো বেশি ভাবলে তোমার ভাগে একটাও পৌঁছাবে না।”
ইনায়া হেসে বলে,
“না থাকলে তোমার কান টানবো। তুমি বড় বোনের কান মলা খাবে।”
মাইরা হাসতে লাগলো। ইনায়াও হাসলো মাইরার দিকে তাকিয়ে। মাইরা মেয়েটাকে ৯০% সময় বাচ্চা লাগলেও মাঝে মাঝে অনেক বেশিই বড় লাগে ইনায়ার কাছে।
মাইরা ফিজিক্স বই নিয়ে বসে আছে। তার মাথা কেমন যেন ভারি লাগছে। আর ২০ দিন পর পরীক্ষা, কিন্তুু পড়া তো সব গুলে খেয়েছে। অন্য সাবজেক্টগুলোর অবস্থা এতো করুণ নয়, যতটা ফিজিক্সের অবস্থা। বই নিয়ে ইনায়ার ঘরে গেল। ইনায়া ফোন স্ক্রোল করছিল। মাইরাকে বই হাতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে মাইরা?”
মাইরা মনমরা হয়ে ইনায়ার পাশে বসে বই এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপু আমাকে কয়েকটা অধ্যায় বুঝিয়ে দিবা? আমি পড়েছিলাম। এখন কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।”
ইনায়া মাইরার বই নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। এরপর মাথা তুলে বলে,
“আমি বোঝাতে পারব, কিন্তুু তুমি হয়তো কিছুই বুঝবে না।
একটু ভেবে বলল,
ভাইয়া পারবে। জাহারা আপুকে তো ভাইয়াই পড়িয়েছিল।”
মাইরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“উনি তো ভার্সিটির ইংলিশ টিচার।”
“হ্যাঁ, কিন্তুু তোমাকে ফিজিক্স বোঝাতে পারবে। নো প্রবলেম। এসো।”
মাইরা দ্রুত বলে,
“না না আপু। দরকার নেই। তোমার ভাইয়ার থা’প্প’ড় খাওয়ার চেয়ে ফেল করা ভালো।”
ইনায়া অসহায় মুখ করে বলল,
“মাইরা, ভাইয়া কিছুই বলবে না। উল্টে তুমি একটা অধ্যায় বুঝতে চাইলে ভাইয়া একটার জায়গায় দু’টো অধ্যায় খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবে।”
মাইরা বিছানা থেকে নেমে বলে,
“তুমি তোমার ভাইয়াকে চিনতেই পারোনি আপু। ধর, আমি উনার সামনে পড়তে বসেছি। এখন উনি কিভাবে শুরু করবেন আমি দেখাচ্ছি তোমায়, ওয়েট।
এরপর দু’হাত কোমড়ে রেখে ইনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ডান হাত উঁচিয়ে গম্ভীর মুখের এক্টিং করে বলে,
” ব্লা ব্লা ব্লা….. স্টুপিট. ব্লা.ব্লা. ইডিয়েট…..ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা. ইডিয়েট.ব্লা ব্লা ব্লা….স্টুপিট ব্লা ব্লা……
বুঝেছ স্টুপিট?”
ইনায়া চোখ বড় বড় করে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরা হঠাৎ-ই হাত এগিয়ে থা’প্প’ড় মারার ভঙ্গি করে বলে,
“থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব, স্টুপিট।”
ইনায়া তব্দা খেয়ে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা তার এক্টিং শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলে। এরপর মুখে হাত দিয়ে হাওয়া খাওয়ার ভঙ্গি করে বলে,
“তুমি কিছু বুঝেছ আপু? বোঝোনি তো? বুঝবে কি করে, উনি স্টুপিট আর ইডিয়েট ছাড়া কথা বলতে পারে না বুঝলে? এতো এতো স্টুপিট আর ইডিয়েট এর মাঝে পড়ার লাইনই খুঁজে পাবো না। বুঝবো কি করে বলো? আসলে তোমার ভাই একটা গণ্ডার। অনুভূতি নেই,, জানো সেদিন আমার গায়ে যত শক্তি ছিল সব শক্তি দিয়ে কা’ম’ড় দিলাম, তার কোনো রিয়েকশন-ই নেই। আরে মানুষকে মশা কা’ম’ড় দিলেও তো একটু আ, উ করে। ওই লোকটা তাও নয়। কি একটা অবস্থা!”
ইনায়া চোখ বড় বড় করে থেমে থেমে বলে,
“ভাইয়া”
মাইরা বাম হাত কোমড়ে রেখে ডান হাতে কপালে একটা আলতো থা’প্প’ড় দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ আপু, তোমার ভাইয়ার কথাই তো বললাম।”
ইনায়া ঢোক গিলে বলে,
“তোমার পিছনে ভাইয়া।”
ইনায়ার কথা শুনে মাইরার মুখ শুকিয়ে যায়। মুহূর্তেই মুখটা অসহায় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালে দেখল তার থেকে দু’হাত দূরত্বে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। মাইরা ঢোক গিলে। ইরফানের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“আপনি কেন আসলেন?”
ইরফান তীক্ষ চোখে চেয়ে মাইরার পানে। গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমাকে থা’প’ড়াতে।”
সাথে সাথে মাইরার দু’হাত দু’গালে চলে যায়। কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
“না, আমি ওসব আপনাকে বলিনি। আপনার জমজ ভাইকে বলেছি, বিশ্বাস করুন।”
ইরফান বিরক্ত হলো। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফাইজের কল রিসিভ করবি।”
ইনায়া মাথা নিচু করে থাকলো। কিছু বলল না। ইরফান ধমকে বলে,
“কথা কানে গিয়েছে?”
ইনায়া মাথা নিচু করেই মুখ বাঁকায়। উপর থেকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
ইরফান মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার ঘরে এসো।”
মাইরা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
“কেন?”
ইরফান রেগে বলে,
“থা’প্প’ড় দিব তাই,, ইডিয়েট।”
কথাটা বলে গটগট পায়ে ইনায়ার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ইনায়া মাইরার দিকে বই এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ভাইয়ার ঘরে যাও। বুঝিয়ে দিবে।”
মাইরা মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বলে,
“না আপু, শুনলে না তোমার ভাইয়া আমাকে মারবে বলে যেতে বলেছে।”
ইনায়া বই নিয়ে বিছানা থেকে নেমে বলে,
“আরে বোকা, তোমাকে বুঝিয়ে দিবে এজন্য যেতে বলেছে। মারলে এখন-ই মারতো।”
মাইরা ভাবলো তাও ঠিক। অতঃপর ইনায়ার হাত ধরে বলল,
“তুমি আমার পাশে বসে থাকবে, আচ্ছা?”
ইরফানের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাইরা। ইনায়াকে দরজা খুলতেও দিচ্ছে না। নিজেও খুলছে না। মাইরা তখনকার তার বলা কথাগুলো শুরু থেকে ভাবছে। সে সিইওর আজ থা’প্প’ড় পড়বে তার গাল। ইনায়া হাই তুলছে বারবার। রাত বাজে ১১ টা। এদিকে মাইরা স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইনায়া ঘুমে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে। মাইরার পাশে বসার সুযোগ তার হবে না। এখন তাকে ঘুমাতে হবে।
উপায় না পেয়ে ইরফানের ঘরের দরজা বা হাতে ধাক্কা দিয়ে ডান হাতে মাইরাকে ঘরের ভিতরে ধাক্কা দেয়।
মাইরা বুঝতেই পারেনি ইনায়া এমন করবে। মিটিমিটি আলোয় ঘেরা ঘরে মাইরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, কিন্তুু মেঝেতে নয়, ইরফানের উপর। মাইরার পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইনায়াও এখন তাকে আর সঙ্গ দেয় না। বাঘের মুখে ধাক্কা মেরে চলে যায়।
ইরফান গম্ভীর গলায় শক্ত কণ্ঠে বলে,
“সারারাত এভাবেই থাকার ইচ্ছে নিয়ে এসেছ? স্টুপিট!”
মাইরা দ্রুত ইরফানের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। ইরফানের পরনে শার্ট নেই। মাইরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
“আপনার জামা-কাপড় নেই?”
ইরফান কফির মগে চুমুক দেয়। কিছু বলে না। মাইরার মনে হলো, সে ফেল করবে, একবার ফেল করলে কিছু হবে না। এই গণ্ডারের কাছে পড়ার ইচ্ছে নেই। উল্টো ঘুরে যেতে নিলে ইরফান তার আগেই এগিয়ে গিয়ে তার ঘরের দরজা লক করে দেয়। মাইরা থতমত খেয়ে তাকায়। ইরফান ঘরের বড় লাইট জ্বালিয়ে সোফায় বসে সামনের টেবিলে কফির মগ রেখে বলে,
“কাম।”
মাইরা এগিয়ে গেল, সোফার ছোট টুলে বসে ইরফানের দিকে বই এগিয়ে দিয়ে কোমড়ে ডান হাত দিয়ে বলল,
“আপনি শার্ট পড়ুন, নয়তো আমি আপনার কাছে পড়ব না।”
ইরফান মাইরার কথা পাত্তা দিল না। বই উল্টেপাল্টে দেখে রেগে বলে,
“জীবনে বই খুলেছিলে?”
মাইরা আমতা আমতা করে বলে,
“হ্যাঁ, আমি পড়েছি। শুধু দাগাই নি। এর পিছনে একটা মহৎ কারণ আছে। আর সেটা হলো, বইটা অনেক কষ্ট করে ছাপিয়েছে মানুষ। আমি তাদের কষ্ট করে করা কাজকে সম্মান করতেই বইটা নতুন রেখেছি বুঝলেন? একটাও দাগ লাগতে দিইনি।”
ইরফান বিরক্ত হয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের স্বরে বলল,
“থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব, স্টুপিট। এক্সাম ২ সপ্তাহ পর। আর তুমি ফা’জলা’মো করছ এখনো?”
ইরফানে ধমকে মাইরা কেঁপে ওঠে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বলে,
“কখনো শুনেছেন, কোনো টিচার তার স্টুডেন্ট কে খালি গায়ে পড়ায়? আপনিও তো পড়ানোর নাম করে খালি গায়ে বসে আমার দাঁত ফেলে দিতে চেয়ে ফা’জলা’মো করছেন।”
ইরফান রাগে হাতের বই ছুঁড়ে মারলো। মাইরা ভয় পেয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। ইরফান চোখ বুজে কয়েকবার শ্বাস নিল। বা হাতে ঘাড় ডলে খানিক চুপ করে রইল। এরপর চোখ খুলে শক্ত কণ্ঠে বলে,
“সিট।”
মাইরা ঢোক গিলে আবারও আগের জায়গায় বসে। মুখে হাত দিয়ে আছে। কথা বলা যাবে না। সে মুখ খুললে যে ব্রেক থাকে না।
ইরফান একটা জেল পেন নেয়, সাথে একটা খাতা মেলে মাইরাকে ইম্পর্ট্যান্ট চ্যাপ্টারের মৌলিক ব্যাপারগুলো থেকে বোঝাতে শুরু করল। মাইরা ভীষণ মনোযোগী হয়ে শুনছে। বোঝার ফাঁকে ফাঁকে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান ভীষণ সিরিয়াসভাবে বোঝাচ্ছে। মাইরা আড়ালে একটু হাসে। ইরফানের দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে,
“বুড়ো জামাই থেকে ভিলেন জামাই,, মূর্খ থেকে চরম লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট জামাই বের হয়ে আসলো,, আয় হায় আমার তো কপাল খুলে গেল রে!”
সেসময় ইরফান মাইরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাইরাকে একা একা বিড়বিড় করতে দেখে রেগে বোম হয়ে যায়। এই ইডিয়েট কে সে বোঝাচ্ছে, আর এ একা একা কথা বলছে। ধমকে বলে ওঠে,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
মাইরা থতমত খেয়ে বুকে থুতু দিয়ে বলে,
“কিছু না কিছু না।”
ইরফান আড়াআড়িভাবে দু’হাত গুঁজে গম্ভীর গলায় বলে,
“বোঝাও।”
মাইরা অসহায় মুখ করে খাতার দিকে তাকায়। একটুর জন্য মনোযোগ দেয়নি, তাতেই লোকটা ধরে নিল। বাকি ২ ঘণ্টা যে মনোযোগ দিল। ইরফান রেগে বলে,
“কিছু বলেছি আমি।”
মাইরা খাতার দিকে তাকায়। বর্তনীর অধ্যায় এটা। সিরিজ সার্কিট, আর প্যারালাল সার্কিট এর আঁকাবাঁকা চিত্র। মাইরা তো এসব ভুলে গিয়েছিল বলেই এসেছিল। কিন্তুু এই জায়গায় এসেই মনোযোগ টা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাথা তুলে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে মাইরার দিকেই চেয়ে। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,
“বিসমিল্লাহ.
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
“হোয়াট?”
মাইরা মেকি হেসে বলে,
“প্রিপারেশন নিলাম। শুনুন আমি আপনাকে বোঝাচ্ছি। প্যারালাল মানে হলো,
গম্ভীর, রাগী, বদমেজাজী, লালিত চোখজোড়ার এক টিচার তার স্টুডেন্টকে প্রতিনিয়ত বলতে থাকবে, স্টুপিট, ইডিয়েট, থা’প্প’ড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। এভাবেই সেই লাল টিচার স্টুডেন্টকে প্যারা দিতে থাকবে। এটাই হলো প্যারালাল।”
কথাটা বলে ইরফানের দিকে তাকালে দেখল, সত্যি সত্যি ইরফানের চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। মাইরা ঢোক গিলল। আমতা আমতা করে বলে,
“উদাহরণস্বরূপ, আপনি লালিত চোখের অধিকারী টিচার, আর আমি সেই অসহায় প্যারাময়ী স্টুডেন্ট।”
ইরফান ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। চোখমুখ অস্বাভাবিক শক্ত। মাইরা আবারও আমতা আমতা করে বলল,
“আমি জানি আমার সঙ্গা ভুল, কিন্তুু আমি তো যৌক্তিক কথা বলেছি। আর বিজ্ঞান মানেই যুক্তি। যুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান কথা বলে না। আমিও বলিনি।”
ইরফানে রাগে চিৎকার করে বলে,
“হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ?”
কথাটা বলে টেবিলের উপর একটা পাঞ্চ মারে।
মাইরা কেঁপে ওঠে। দ্রুত বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। ইরফান রাগে মাথার চুল টেনে ধরল। আর নিতে পারছে না এই বাঁচালকে।
মাইরা বুঝেছে তার মুখের ব্রেক ভেঙে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। আর এখানে থাকা যাবে না।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে যায়, কিন্তুু দরজা খুলতে পারছে না।
ইরফান বসা থেকে দাঁড়িয়ে মাইরার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাইরা বুঝতে পেরে দরজার সাথে লেগে যায়। ইরফান ঝটকা মেরে মাইরাকে তার দিকে ফেরায়। মাইরার চোখে পানি জমে গিয়েছে। ইরফানের রাগ দেখেই মেয়েটা এতো ভ’য় পাচ্ছে। না জানি তাকে কি করবে। মাইরা ইরফানের লাল চোখ দেখে আবারও চোখ সরিয়ে নেয়।
ইরফান কিছুই বলল না। মাইরার হাত ধরে টেনে এনে জোর করে সোফায় বসালো। এরপর মাইরার গা ঘেঁষে সেও বসলো। টেবিলের উপর থেকে স্কচটেপ নিয়ে খুবই শান্তভাবে মাইরার মুখে লাগিয়ে দিল। মাইরা বাঁধা দিতে চায়, ইরফান মাইরার দু’হাত পিছনে নিয়ে তার বা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে।
মাইরা ঘাঁড় বাঁকিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ইরফানের দিকে। ইরফান ডান হাতে খাতা এগিয়ে আনে, জেল পেন তুলে নিয়ে শান্তস্বরে বলে,
“সব কমপ্লিট করে তবেই ঘরের বাইরে পা রাখবে। দ্যাট’স ফাইনাল।”
মাইরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। ইরফানের বা পাশে বসায় মাথা তুললে ইরফানের মুখের বা পাশটাই তার চোখে পড়ে।
ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে রেগে বলে,
“আমার মুখে বোঝাচ্ছি? স্টুপিট।”
মাইরা চোখ সরিয়ে নেয়। তার চোখে জমানো অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইরার মুখ থেকে স্কচটেপ খুলে দেয়। তবে হাত ছাড়ে না। মাইরাও আর কথা বলে না। দৃষ্টি খাতার পানে রাখে। ইরফান চুপচাপ বোঝানো শুরু করে।
ভার্সিটি ক্লাস শেষে ফারাহ ক্লাসরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছুদূর হাঁটলে ইরফানের সঙ্গে দেখা হলে ইরফানকে সালাম দেয়। ইরফান উল্টো ঘুরে ফারাহ কে দেখে সালাম এর উত্তর নেয়। অতঃপর বলে,
“ফাইজ কোথায়?”
ফারাহ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“ভাইয়ার আমাকে নিতে আসার কথা। কিছু বলবেন?”
ইরফান পকেটে হাত রেখে বলে,
“আমার কল রিসিভ করছে না। ওকে বলবে ফোন চেক করতে।”
ফারাহ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলে,
“জ্বি আচ্ছা ভাইয়া।”
এই বলে এগিয়ে যায়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তুু তার ভাইকে দেখে না। বিরক্ত হয়। তার পাশে ক্লাস এর একটা মেয়ে এসে দাঁড়ায়।
“কার জন্য অপেক্ষা করছ?”
ফারাহ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া।”
কথাটা বলতেই কয়েক হাত দূরত্ব থেকে শুদ্ধ ডাকে,
“এই যে মেয়ে, এসো।”
ফারাহ বিরক্ত হয়ে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় সাথে সাথে। তার পাশের মেয়েটা অবাক হয়ে বলে,
“এটা তো আমাদের স্যার। তোমাকে ডাকছে কেন?”
“আমার ভাই হয়, তাই।”
এরপর ফারাহ হাত নেড়ে বলে, “আসছি, বাই।”
ততক্ষণে শুদ্ধ ফারাহদের অনেকটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফারাহ এর পাশের মেয়েটা শুদ্ধ কে সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“লেট করছ কেন?”
ফারাহ মাথা নিচু করেই বলল,
“কেন ডাকছেন?”
শুদ্ধ ফারাহ এর দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
“চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়, এটা ভদ্রতা।”
ফারাহ মাথা নিচু করেই বলে,
“মানুষকে অকারণে ব্লেইম না দেয়াটাও ভদ্রতা।”
শুদ্ধ ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসল। গতকাল ইরফানের উপর বিরক্ত হয়ে এই মেয়েকে একটু ত্যাড়া কথা বলেছে। অমনি আর তাকাচ্ছে না। গলা ঝেড়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“শোনো আমি তোমার টিচার। তাই আমার ভুল না ধরে নিজের ভুল শুধরাও।”
এবার ফারাহ মাথা তুলে রেগে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ ফারাহের দিকেই চেয়ে আছে। ফারাহ রেগে বলে,
“সেটা ভার্সিটির গণ্ডিতে,, এখানে নয়। আপনি যান তো। আমায় বিরক্ত করছেন কেন?”
শুদ্ধ রাগান্বিত স্বরে বলে,
“থা’প্প’ড় খাবে মেয়ে। উঁচু গলা আমার পছন্দ নয়।”
ফারাহ মাথা নিচু করে নেয়। শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,
“গাড়িতে গিয়ে বসো।”
“ভাইয়া আসবে।”
“আসবে না। নিষেধ করে দিয়েছি। তুমি আমার সাথে যাবে।”
ফারাহ ভীষণ রেগে যায়। আবারও মাথা তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আমি আপনার সাথে যাব না।”
শুদ্ধ প্যাণ্টের পকেটে হাত গুঁজে আরও খানিকটা এগিয়ে আসে ফারাহের দিকে। ভাবলেশহীনভাবে বলে,
“তোমাকে আমার সাথেই যেতে হবে।”
ফারাহ আবারও রেগে বলে,
“আমি জীবনেও আপনার সাথে যাব না।”
শুদ্ধর মেজাজ বিগড়ে যায়। ফারাহের হাত ধরে শক্ত করে। ফারাহ অবাক হয়ে বলে,
“আরে আমার হাত ছাড়ুন।”
শুদ্ধ শুনলো না। পায়ের গতি বাড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে বলে,
“উঠে বসো।”
ফারাহ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শুদ্ধ রেগে শক্ত কণ্ঠে বলে,
“ফারাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে চুপচাপ বসো।”
ফারাহের চোখ টলমল করে ওঠে। শব্দ করে গাড়িতে উঠে বসে। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। আড়চোখে একবার ফারাহের দিকে তাকায়। এরপর গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ-ই শুদ্ধ আবেগি স্বরে বলে ওঠে,
“মেয়ে?
যার ভেতর পোড়ে, সেই বোঝে
যে পোড়ায়, সে বোকা সাজে।”
ফারাহ চোখ বুজে আছে। শুদ্ধ গাড়ির স্পিড বাড়ায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা।
~
“লং ড্রাইভে যেতে চাইছ?”
শুদ্ধর কথা শুনে ফারাহ চোখ মেলে তাকায়। শুদ্ধ স্টিয়ারিং-এ ডান হাত রেখে ফারাহের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার বউ এর হকে আবারও ভাগ বসাতে চাইছ? কি সাহস! কি সাহস!”
ফারাহের ইচ্ছে করল এই লোকের সবগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলতে। গাড়ি থামানো। ফারাহ বাম দিকে তাকালে দেখল তাদের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। শুদ্ধর দিকে তাকালোই না আর। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। শুদ্ধ কিছু বলল না। ফারাহ তার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
শুদ্ধ সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে শব্দ করে গেয়ে ওঠে,
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ১০
“পাখি আমার, নিঠুর বড়ো
মনও বোঝে না
আমার ভাঙা খাঁচা পড়ে আছে
সেতো আসে না
পোড়ামনে ভালোবাসা, বাসা বাঁধে না।”
ফারাহের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। বা হাতে সে পানি মুছে নেয়। পায়ের গতি বাড়ায়। এক সময় দৌড়ে চলে যায় বাসার ভিতর। পিছন থেকে মৃদু সুরে কণ্ঠ ভেসে আসে,
পোড়ামনে ভালোবাসা, বাসা বাঁধে না।’