প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৫

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৫
রাজিয়া রহমান

স্টেজে পারফরম্যান্স শেষ করে ক্লারা হাঁপিয়ে উঠেছে। ব্যাক স্টেজে এসে ক্লারা নিজের কস্টিউম চেঞ্জ করে নেয়।তারপর বাহিরে এসে নির্ধারিত চেয়ারটার সামনে এসে এদিক ওদিক তাকায়।
কি ব্যাপার!
বুঝতে পারে না ক্লারা।ইখতিয়ার কোথায় গেলো হঠাৎ করে?
এখানেই তো দেখেছিলো ক্লারা খানিকক্ষণ আগেই।
চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ে ক্লারা।ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।এদিক ওদিক তাকাতেই ক্লারার চোখে পড়ে ইখতিয়ারকে।
আনন্দিত হওয়ার বদলে কেমন মেজাজ খারাপ হয়ে উঠে ক্লারার।ইখতিয়ার আরেকটা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকলে ক্লারার সমস্যা হতো না কিন্তু দুজনের ঠোঁট এক হয়ে আছে।
এই ঠোঁটেই ইখতিয়ার আবার এসে ক্লারাকে চুমু খাবে!

ক্লারার গা ঘিনঘিন করে উঠে।
ইখতিয়ার এলো মিনিট দশেক পরে।এসেই ক্লারাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে নিলো।
হাত দিয়ে ক্লারা ইখতিয়ারকে বাঁধা দেয়।ক্লারার অনামিকায় একটা হিরের রিং জ্বলজ্বল করছে। এক সপ্তাহ আগেই ইখতিয়ার গিফট করেছে।
কপাল কুঁচকে তাকায় ইখতিয়ার ক্লারার দিকে।
“অ্যালিসের সাথে কি করছিলে?”
ক্লারার সোজাসাপটা প্রশ্নে ইখতিয়ার হাসে।
“তুমি তো বিজি ছিলে,একা একা বোর হচ্ছিলাম তাই একটু টাইম পাস করছিলাম।”
ক্লারার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ইখতিয়ার বললো, “কী হয়েছে?”
“জানি না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“না বললে কীভাবে জানবো বেবি?”
“আমি তোমাকে কারো সাথে শেয়ার করতে চাই না ইখতিয়ার।”
ইখতিয়ারের হাসি পায়।ক্লারা রাশিয়ান মেয়ে,ওর মুখে ইখতিয়ার নামটা ভীষণ হাস্যকর লাগে। ইখতিয়ার ওকে বলেছিলো ইখতিয়ার না বলে ইকু বলে ডাকতে কিন্তু ক্লারা তবুও ইখতিয়ারই বলে।
ক্লারার হাতে চুমু খেয়ে ইখতিয়ার বললো, “মনটাকে বড় করো ডার্লিং।”
ক্লারা কথা বলে না। অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মোছে।ইখতিয়ার আর ক্লারা লিভ ইন করছে।তাদের মধ্যে এমন কোনো কমিটমেন্ট নেই যে ওরা কেউ অন্য কারো সাথে ক্লোজ হবে না।অথচ কেনো জানি ক্লারা আজকাল ইখতিয়ারকে নিয়ে একটু একটু পসেসিভ হয়ে যাচ্ছে।

ইখতিয়ার ক্লারার হাত ধরে এর হলো বার থেকে।ক্লারা এখানকার বার ডান্সার।এখানেই ইখতিয়ারের ক্লারার সাথে পরিচয় হয়।ক্লারা মেদহীন ফর্সা দেহটার প্রতি ইখতিয়ার আকৃষ্ট হয় ভীষণভাবে। যেমন মৌমাছি আকৃষ্ট হয় ফুলে।ইখতিয়ার অবশ্য নিজেকে মৌমাছি মনে করে।এক ফুলের মধু তার ভালো লাগে না। বিভিন্ন ফুলের মধু টেস্ট করে তাই। কোনো কাজ না করে এভাবে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানোতেই ইখতিয়ারের আনন্দ।
হাসিবুল শেখ দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ী। আর অঢেল অর্থ।ছেলেমেয়েদের অলমোস্ট সবকিছুই অঢেল দিয়ে রেখেছেন। দুই ভাইই লন্ডনে থাকে।

একই শহরে থাকলে ও দুই ভাই আলাদা থাকে।ইখতিয়ারের এই জীবনটাকে ভীষণ উপভোগ্য মনে হয়। জীবন তো এমনই হওয়া উচিত যেখানে মদ আর মেয়েমানুষের ছড়াছড়ি থাকবে।
ইখতিয়ারের করুণা হয় ছোট ভাইয়ের জন্য। সে বেচারা কেনো যে একটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া জীবন কাটাচ্ছে।গাধার মতো খাটুনি খেতে টাকা উপার্জন করছে আর বাকিটা সময় সিগারেট ফুঁকছে।
আরে ব্যাটা মানুষ তুই!
কীসের এতো মেয়েদের মতো এতো নখরা নিয়ে থাকছিস!তোর অঢেল টাকা আছে,বাপের আছে।চারপাশে অসংখ্য মেয়েমানুষ আছে যারা একটু ইশারা করলেই বিছানায় এসে *** হয়ে গড়াগড়ি করবে।
তা না করে কি-না সিগারেট টেনে জীবন কাটায়।এই পানসে জীবন দিয়ে কী হবে!
জীবন হবে মশলাদার,নানান ফ্লেভার ট্রাই করা।
গাড়িতে উঠে বসতেই শায়লা ভিডিও কল দিলো।ক্লারা ততক্ষণে ইখতিয়ারের কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ইখতিয়ার সেই অবস্থায় কল রিসিভ করলো।

স্বল্পবসনা ক্লারাকে এরকম চিপকে থাকতে দেখে শায়লা বিরক্ত হয়ে বললো, “ইকু,তোমার কী কোনো কাজ নেই আর?সারাক্ষণ একটা না একটা মেয়ের সাথে আঠার মতো লেগেই আছো।এভাবে জীবন চলবে তোমার?”
“মা,স্বয়ং হাসিবুল শেখ থাকতে আমার, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো প্যারা নেই।জীবন একটাই,চিল না করলে হবে?তুমি তো বলতে!”
শায়লা ঢোক গিলে। কি আশ্চর্য, এই কথাগুলো বলে বলে এক জীবনে তিনি কি না করেছেন!
ফলাফল একটা ছেলে তার মতো হয়েছে আরেকটা ছেলে তার থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
“সামনে তোমার বিয়ে সেটা নিশ্চয় মাথায় আছে?যা করছো তা লন্ডনে সমাপ্ত করেই দেশে যাবে।মনে রাখবে ওখানে তোমার ইমেজ একেবারে ক্লিন।সেটা নষ্ট করো না।”

“ইখতিয়ার এতো বোকা না মা।তারিনের সাথে আমার কথা হয়,ও আমাকে ভীষণ কেয়ারিং, লাভিং, পজেসিভ মানুষ হিসেবে জানে যে কি-না শুধু তারিনের মোহে অন্ধ।আমি পাকা অভিনেতা মা,কোন রোল কিভাবে প্লে করতে হবে আমার জানা আছে।আমাকে নিয়ে না ভেবে ইশুকে নিয়ে ভাবো।”
শায়লা কল কেটে দিলো।
ইশতিয়াক সবে অফিস থেকে ফিরলো।অফিস থেকে ফিরেই চেঞ্জ করে ইশতিয়াক আগে এক মগ গ্রিন টি পান করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
গ্রিন টি নিয়ে বসতেই দরজায় কলিং বেলের শব্দ পায়।
অফ ডে ছাড়া ইশতিয়াকের বন্ধুরা কেউ আসে না।হঠাৎ কে এলো!
না ভেবে ইশতিয়াক উঠে যায় দরজা খুলতে।
হুইলচেয়ারে বসে আছেন ইশতিয়াকের বাবা হাসিবুল শেখ। বাবাকে দেখে ইশতিয়াক কিছুটা অবাক হলো।এই ঠিকানা বাবার জানার কথা না।
হাসিবুল শেখ বললেন, “ভেতরে যেতে বলবি না”

“হোয়াই নট?প্লিজ ওয়েলকাম।”
হাসিবুল শেখের বুকে একটা সুক্ষ্ম তীরাঘাত অনুভব হলো।এতো ফরম্যাল ব্যবহার!
নিজের জন্মদাতা বাবার সাথে!
হাসিবুল শেখ নিজের বিস্ময় গোপন না করে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সাথে আমার প্রায় ৫ বছর পর দেখা হলো অথচ তুমি বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বসিত হলে না আমাকে দেখে!”
ইশতিয়াকের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।
“বাবা শব্দটা বললে মানুষের মানসপটে যেই দৃশ্য ফুটে উঠে আপনার সাথে তা মেলে না।জোর করে যখন ১৫ বছর বয়সে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দিলেন সেদিনই আমি ভুলে গেছি বাবাকে।”
রুমের চারিদিকে নজর বুলায় হাসিবুল শেখ। দেয়ালে একটা ফ্রেম ঝুলছে শুধু। ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি সাদাকালো। একটা সাদা শার্ট কাল প্যান্ট পড়ে পেছনে সোফার সাথে দুই কনুই রেখে মাথা কিছুটা উপরে উঠিয়ে রেখেছে, বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ভাসছে।এক মাথা এলোমেলো চুল ছেলেটার।
কোথাও একটা খুবই আঘাত লাগে হাসিবুল শেখের বুকে।

“দেশ থেকে পাঠিয়ে দিয়ে তোমার কী খুব ক্ষতি করেছি?”
“না,ক্ষতি অবশ্য হয় নি।বরং উপকার করেছেন যাতে আপনার স্ত্রীর বেহা….”
ইশতিয়াক কথা শেষ করতে পারে না। হাসিবুল শেখ হাত উঠিয়ে ইশতিয়াককে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “উনি তোমার জন্মদায়িনী, তোমার মা।তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলো।”
ইশতিয়াক এক দলা থুতু ছুঁড়ে মারে বিনে।
“রেসপেক্ট! মাই ফুট!সি ইজ ডেড টু মি।”
অস্থির হয়ে উঠে ইশতিয়াক। জানালার পর্দা সরিয়ে চোখ রাখে বাহিরে।নিচে রাস্তায় অসংখ্য কার,ব্যস্ততা, মানুষ অথচ সবকিছু ছাড়িয়ে ইশতিয়াকের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে
“আমি তোমার সাথে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে আসি নি এখন।তোমাকে কোনোভাবেই ফোনে রিচ করা যাচ্ছিলো না।বাধ্য হয়ে আমাকে এখানে আসতে হলো।”
“আমি কী তৃতীয় চার্লস নাকি যে আমাকে খুঁজে পাওয়া আপনাদের এতো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে!”
“ইখতিয়ারের বিয়ে জানো নিশ্চয়!”
“না জানি না।”

“আশ্চর্য! একই শহরে থাকো অথচ তোমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে যোগাযোগ নেই?”
“এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।সম্পর্ক শব্দটা শুধু অভিধানে আছে।আমার জীবনে নেই।এই জীবনে আমার কেউ নেই।আমার আমি ছাড়া কেউ ছিলো না কখনো।এই শহরে এমন একটা ও দরজা নেই যেটা ভেতর থেকে খুলে কেউ বলবে, আমি আছি তোমার জন্য। তোমার সবাই আমার চেনা মানুষ, কেউ আমার নও।”
“আগামী সপ্তাহে আমরা দেশে ফিরছি।একই ফ্লাইটে তুমি ও যাচ্ছো আমাদের সাথে।”
ইশতিয়াক হাহাহা করে হেসে উঠে।
“বাংলাদেশ থেকে যেদিন এই দেশে এসেছি সেদিনই শপথ করেছি,বাংলাদেশকে আর কখনো দেখবো না।না তো কখনো ওই দেশ আমাকে দেখবে।”
“আমার জন্য ও যাবে না?”
“না।”
হাসিবুল শেখ হতাশ হয়ে উঠেন।
খানিক সময় দুজনেই চুপ করে থাকেন।
“আমার মৃত্যু সংবাদ পেলে কী যাবে ইশতিয়াক?”
ইশতিয়াক নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।২০ বছর ধরে হুইলচেয়ারে বন্দী জীবন কাটানো মানুষটার জন্য ইশতিয়াকের মনে এখনো একটু হলেও বোধহয় মায়া রয়ে গেছে।

ইরা এসেছে রিপাকে পড়াতে। কলিং বেল বাজতেই রাফি দরজা খুলে দিলো।ইরা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এই ছেলেটা এখানে!
মুহূর্তেই হিসাব মিলে যায় ইরার।সালাম দেয় ইরা বাহিরে দাঁড়িয়ে।
ইরার আওয়াজ পেয়ে হাবিবা বের হয়ে আসে।ইরাকে রিপার রুমে নিয়ে যায়।
রাফি বিকেলেই ফিরে এসেছে ঘরে। হাবিবা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলায়।সন্তান যতোই নিজেকে বড় ভাবুক বাবা মা সন্তানের মনের খবর টের পায় আগেই।
হাবিবার মেজাজ খারাপ হয়।মেয়েটার পাল্লায় কবে থেকে পড়েছে কে জানে!
এরজন্যই বোধহয় কোনো কাম-কাজ করে না ছেলেটা।
ইরা রিপাকে মনোযোগ দিয়ে পড়াতে পারে না। রাফি বারবার বাহানা দিয়ে এই রুমে আসছে।বিরক্ত হয়ে ইরা রিপাকে বললো দরজা ছিটকিনি দিয়ে দিতে।

পড়ানো শেষ করে ইরা বের হলো ৮টা ১৫ তে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় ইরা চমকে উঠে রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
রাফি ইরার হাত টেনে ধরে বললো, “এতো লুকোচুরি খেলছো কেনো?আমাকে দেখকে নাক সিঁটকানোর মানে কী?”
“আপনি এতো রাতে আমার পথ আটকে দাঁড়ালেন কেনো?সাহস হলো কীভাবে আমার হাত ধরার?”
“আমার প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে যে ইরা।”
“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।আগামীকাল থেকে আমি আর আসবো না পড়াতে।সরুন।”
“না ইরা,একথা বলো না।আমি মরে যাবো। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য আমি এতো কলকাঠি নাড়লাম সেই তুমি যদি না আসো আমার হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাবে।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৪

“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।এসব আজেবাজে কথা আর কখনো বলবেন না আমার সামনে।সরুন।”
ইরা রাফিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।
রাফি হাসে।সে পাকা শিকারী। শিকার কীভাবে করতে হয় তা রাফি জানে।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৬