প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৭
রাজিয়া রহমান
উপমার কল বেজে উঠে। আব্বার ফোন থেকে কল এসেছে। উপমা আস্তে করে কলটা ডিক্লাইন করে দেয়।নিজের অভিমান বুঝাতে হবে এখন।
ভীষণ উল্লাসিত হয় উপমা।লোকে বলে চেহারা ভালো না হলে স্বামীকে বশ করা যায় না।উপমা এসব বিশ্বাস করে না। দম থাকা লাগে,জেদ থাকা লাগে।
নিজেকে প্রিন্সেস লাগে উপমার।সাগরের চিৎকার শুনে আশেপাশের বাসা থেকে কয়েকজন ছুটে আসে।
বাহিরে অনেক মানুষের শোরগোল শুনে উপমা দরজা খোলে। নিজের পেট চেপে ধরে বের হয়ে আসে।
সাগর কিছু বলার আগে উপমার বেদনার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে।
উপমার দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
সাগর ব্যতিব্যস্ত হয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
“আমার পেট ব্যথা করছে খুব।”
“হঠাৎ পেট ব্যথা কেনো করছে!”
“আমি রাগ করে পেটে আঘাত করছি।এই সংসারে আমি তোমাদের কাছে ভীষণ ফেলনা।আমার চাইতে ময়লার ঝুড়িটা তোমাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়।তাই আমি আমার অনাগত সন্তানকে এই দুনিয়ায় আনতে চাই না।আমি মরে যেতে চাই।তোমার মা বোন শান্তি পায় যদি তাতে।তুমি ও শান্তি পাবে।”
আশেপাশের মানুষদের দেখে উপমা বিলাপ জুড়ে দিলো।ইরার কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না তার আসলে দোষটা কী!
শুধু এই বাসায় থাকে বলেই কী সে দোষী!
সাগর উপমার কপালে চুমু খেয়ে বলছে, “শান্ত হও প্লিজ।এমন কেনো করলে?আমাদের বেবির যদি কিছু হয়ে যায়? চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উপমা একটা ফ্লোরে বসে পড়ে। বসে বসে বিলাপ করে।সাগর যতো চেষ্টা করে উপমা তত বিলাপ করে। ইরা সহ্য করতে না পেরে মা’য়ের রুমে যায়।শারমিন জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।
ইরা বিরক্ত হয়ে বললো, “কেনো এমন করলে মা?কি দরকার ছিলো? তোমাকে কি আমি বলি না মা চলো আমরা বাহিরে একটু হেঁটে আসি,কই তখন তো আমার সাথে যাও না।উল্টো বিরক্ত হও।তাহলে ভাবী আর ভাইয়ার সাথে কেনো এরকম করলে?কেনো ওদের সবকিছুতে তুমি ইন্টারফেয়ার করতে যাও?”
“১০০ বার করমু।পোলা জন্ম দিছি আমি আর আমার পোলার সাথে আমি যেতে পারবো না?”
“আমার বাবাকেও তো দাদী জন্ম দিছিলো মা।আমি তো কখনোই দেখি নি দাদী তোমার সাথে এরকম করতে।দুনিয়ার নিয়মই এটা।সন্তান জন্ম দিয়েছো বলে কী সন্তান বাধ্য বাবা মা’য়ের সব অন্যায় আবদার শুনতে?”
“অন্যায় আবদার কিসের?মা’য়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত জানোস না তুই?”
“মা,তেমনই সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। তুমি মা বলে তোমার জন্য বউকে অসম্মান করবে এখন?কেনো একটু কম্প্রোমাইজ, স্যাক্রিফাইস এসব করতে জানো না তুমি?”
“তোদের তিন ভাই বোনরে যখন মানুষ করছি তখন কে আমার লগে স্যাক্রিফাইস করছে?কম্প্রোমাইজ শেখাতে আসছস তুই আমাকে?সারা বছর দুই কাপড়ে কাটাইছি পোলাপান মানুষ করার জন্য। এখন আরেক বেডি আইসা ফুটানি করতো?”
“আমি কিংবা ভাইয়া আমরা কি তোমাদের বলেছি আমাদের দুনিয়ায় আনো?তোমরা নিজের ইচ্ছেয় সন্তান দুনিয়ায় আনো,নিজেরাই কেনো আবার সন্তানকে এভাবে খোঁটা দাও? তুমি কি চাও না ভাইয়া সুখে থাকুক?যারে এতো কষ্ট করে মানুষ করছো তার সুখ তুমি চাও না মা?”
“চামু না কেনো,চাই।”
“ভাবীকে তাহলে প্রতিপক্ষ ভাবা বন্ধ কর।ভাবীকে মেয়ের মতো একটু ভালোবাসো।ভাবীর সাথে যদি ভাইয়া শান্তি না পায় ভাইয়া কখনোই সুখী হবে না।তুমি কি সেটা হলে খুশি হবে মা?”
“আসছে ভাবীর চামচা। বের হ আমার রুম থেকে।ভাবী ভাবী করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।ওই ভাবী তোরে লাথি মেরে বের করতে চায় তা বুঝস তুই?”
“সংসারে সবাই চায় নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে। আমি হোস্টেলে উঠে যাবো।তুমি ভাবীর সাথে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করো।”
“তুই হোস্টেলে যাবি ক্যান?এইটা তোর বাপের কেনা ফ্ল্যাট। উপমার বাপের না।তুই এখানেই থাকবি।”
“আমার ক্লাস করতে অসুবিধা হয়।”
“আজকে থেকে তুই টিউশনি শুরু করছস আবার এখান থেকে চলে যাবি বলস কেনো?”
“এই টিউশন আমি ছেড়ে দিবো মা।আমার পক্ষে সম্ভব না।”
শারমিন চিৎকার করে বলে, “আমাকে টাকা দিতে বলছি দেইখা এই টিউশন ছেড়ে দিতেছস তুই?পেলেপুষে কালসাপ বড় করছি আমি। আল্লাহ আমার মরন দাও।”
ইরার হতভম্ব হয়ে গেলো মায়ের কথা শুনে।
রাফির কথা মা’য়ের কাছে ইরা বলতে পারবে না।মা পুরো বিল্ডিংয়ের সবাইকে জানাবে।পুরো মহল্লা জানবে।
“আস্তে কথা বলো মা,এরকম চিৎকার করে কথা বলছো কেনো?”
“সব বুঝি আমি।বিধবা হওয়ার পর থেকে এই সংসারে আমার কোনো দাম নাই।আজরাইল আমারে চোখে দেখে না কেনো?আমি মরে গেলে তোরা সবাই শান্তি পাবি।”
শারমিনের চিৎকারের মধ্যে বাহিরে হম্বিতম্বি শোনা যেতে লাগলো। ইরা ছুটে গেলো সেদিকে।
শফিক এসে হাজির হয়েছে।
উপমাকে কল করার পর উপমা রিসিভ না করায় উপমার মা কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন।নিশ্চয় মেয়ের কিছু হয়েছে এজন্য কল রিসিভ করে না।শফিক তাই ছুটে এলো।এসে দেখে উপমা কাঁদছে।
শফিক বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে ওর,কেনো কল করেছিলো তখন?”
উপমা খেলা ঘুরিয়ে দিলো।
“আমার খুব শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ায় তোমাকে কল করি।অতজচ সেসব শুনে ভাবী আমাকে….।”
কান্নার জন্য উপমা আর কথা বলতে পারে না।
মুহুর্তেই শফিকের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। চিৎকার জুড়ে দিলো।ওর বোনের শরীর খারাপ জেনেও সাগর নিশ্চয় কোনো ব্যবস্থা নেয় নি তাই বোনটা বাধ্য হয়ে ভাইকে কল করেছে।
আরো ভীড় জমেছে বসার ঘরে। সদর দরজা খোলা থাকায় চিৎকার শুনে আশেপাশের বাসার সবাই আসছে মজা নিতে।
সাগরের ও এবার রাগ উঠে। উপমা তার বাবার বাসায় কল করেছে!
কেনো?
শরীর খারাপ হয়েছে এরজন্য?
সাগরকে না জানিয়ে আগে তাদের জানানোর মানে কী ছিলো? বাবু পেটে আসার পর থেকে প্রতি মাসে চেকাপে নিয়ে যায় সাগর।কখনো তো দায়িত্বে হেলাফেলা করে নি।তাহলে উপমা আগে ভাইকে জানিয়ে কেনো তাকে ছোটো করলো?
ওর ভাই যেহেতু এসেছে তাহলে সে-ই করুক যা করার।সাগর কিছুই করবে না।
শফিক সাগরকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে গলা টিপে ধরে বললো, “আমার বোনের উপর তোরা অত্যাচার করার সাহস পেলি কোথায়?”
ইরা এসে দেখে সাগরকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে রাখছে উপমার ভাই।সবাই তাকিয়ে দেখছে।ইরার দুই চোখ ভিজে উঠে মুহূর্তে।সেই সাথে মাথায় রক্ত উঠে যায়।ছুটে এসে শফিককে ধাক্কা দেয় ইরা।
ইরা জানে না এতো শক্তি কোথায় পেলো সেই মুহূর্তে। তবে ইরার ধাক্কা খেয়ে শফিক গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের সাথে মাথায় আঘাত পায়। কপালে প্রমাণ সাইজের একটা আলু ফুটে উঠে মুহূর্তে।
“আপনার সাহস হলো কিভাবে আমার ভাইয়ের গায়ে হাত দেওয়ার?কোন অপরাধে?এটা কি আপনার থানা ভেবেছেন আপনি?”
শফিক হকচকিয়ে যায় ইরার কথা শুনে। ইরাকে এতো দিন তার কাছে হাবাগোবা মেয়ে বলেই মনে হতো। আজ হঠাৎ করে কেমন প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মতো আঘাত করছে!
ইরা সাগরকে পানি এনে দেয়। উপমা চিৎকার শুরু করে দেয় ইরা শফিককে ধাক্কা দেওয়ায়।
এগিয়ে এসে ইরার চুল ধরতে যায় উপমা।সাগর সেই মুহূর্তে জীবনে প্রথম উপমাকে দুইটা থাপ্পড় মারে।
স্পষ্ট গলায় বলে, “বিয়ে করে বাসায় এনেই তোমাকে যদি দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম আমার মা বোনদের কথার উপর কথা বলবে না তাহলে তুমি সোজা হতে।আমি তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি, তুমি আমাকে দুর্বল ভেবেছো।আজ তোমার ভাইয়ের সামনে তোমাকে থাপ্পড় দিলাম,যা ইচ্ছে করো যাও।”
উপমা স্বপ্নে ও ভাবে নি সাগর এই দুঃসাহস করবে।এক ঘর মানুষের সামনে লজ্জায়, অপমানে উপমার মুখ কালো হয়ে গেলো।
শারমিন ইরার পেছন পেছন বের হয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসে সবটা দেখে ভীষণ শান্তি লাগে শারমিনের।
ইরা সবাইকে বললো, “যান আপনারা।অযথা ভীড় করবেন না।যান বাসায় যান।”
শফিকের দুই চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে। তার সামনে তার বোনের গায়ে হাত তুলেছে সাগর!
এতো বড় স্পর্ধা!
শফিক উঠে এসে উপমাকে বললো, “চল তুই আমার সাথে। এখানে আর এক মুহূর্ত ও থাকবি না।এদের শরীরে খুব চর্বি জমেছে।ভাইবোন দুইটাকেই যখন জেলে পুরে প্যাদানী দিবো তখন বুঝবে কতো ধানে কতো চাল!
সাগর শান্ত সুরে বললো, “আইন কারো বাপদাদার সম্পত্তি না যে চাইলেই কেউ তার অপব্যবহার করবে।যা করার করুন আপনারা। অনেক সহ্য করেছি।”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৬
উপমা ভাবতে পারে নি ঝামেলা এতো বড় আকার নিবে।কিন্তু এখন খেলা উপমার হাত থেকে বের হয়ে গেছে। সাগরের হাতে চলে গেছে।
উপমা এক কাপড়ে শফিকের সাথে বের হয়ে গেলো।