প্রেমপিপাসা পর্ব ১১
সুমাইয়া সুলতানা
সকালের সূর্যের নরম আলো ছাদে ছড়িয়ে পড়েছে। শীতের সকালের হালকা ঠান্ডা হাওয়া চারপাশে একটা স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে। ছাদের একপাশে তিশা দাঁড়িয়ে গাছে পানি দিচ্ছে। অরুর যত্নে লাগানো টবভর্তি গাছগুলো যেন কথা বলছে তার সাথে। সবুজ পাতাগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে পানির সংস্পর্শে।
পাশেই ছোট্ট তুবা দাঁড়িয়ে আছে। তার গোলগাল মুখটা আজ একটু মলিন। হাতের পুতুলটা মাটিতে রেখে সে টলমলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি বারবার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে।
তিশা তুবা’কে লক্ষ্য করল। গাছে পানি দিতে দিতে মমতার সুরে প্রশ্ন করে,
” কী হয়েছে বোনু? এত চুপচাপ কেন? ”
তুবা মুখ তুলে মিহি কন্ঠে বলল,
” অরু আপু কোথায়? সকাল থেকে তাকে দেখছি না। তুমি তো বলেছিলে অরু আপু আজ আসবে আমাদের বাড়িতে। ”
তিশা লম্বা শ্বাস টানল। মলিন হেসে বলল,
” অরু আসতে পারবে না। ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে তার। মন খারাপ করিস না। গাছে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে দেখেছিস? ”
তুবা কিছুক্ষণ গাছের দিকে তাকাল। তারপর গাল ফুলিয়ে বলল,
” গাছ সুন্দর কারণ এগুলো অরু আপু লাগিয়েছে। আমার অরু আপু এই ফুলের চেয়ে আরও বেশি সুন্দর। আমি ওর কাছে যাব। ”
তিশা হেসে ফেলল। পানি দেওয়া শেষ করে, বোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
” ইউ নো হোয়াট? ধৈর্য্য একটি মহত গুণ, রাইট? অপেক্ষা কর, অরু নিজেই তোকে দেখতে আসবে। ”
তুবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে স্পষ্ট, সে অরু আপুকে মিস করছে। ঠিক তখন সিঁড়ি দিয়ে রাহাত উঠে এলো। রাহাত, এসে তুবা’কে গাল ফুলিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলো তার কারণ। সবসময় হাসিখুশি আর দুষ্টুমি করে বেড়ানো তুবার অরু আপুর জন্য, মন ভালো নেই। তুবার গাল টিপে দিল রাহাত। তুবা’কে হাসানোর জন্য মজা করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমাদের ছোট্ট তুবা রানী এত চুপচাপ? এটা কি মেনে নেওয়া যায়? আজ কি সূর্য পশ্চিমে উঠেছে? ”
তুবা মুখ ফিরিয়ে বলল,
” মজা সবসময় পছন্দ না ভাইয়া। আমি অরু আপুকে খুঁজছি। ”
রাহাত হাসতে হাসতে কাছে এসে, এক হাতে বোনকে আলিঙ্গন করল। বলল সবেগে,
” একটা গল্প শুনবি? এক দেশে ছিল এক ছোট্ট রাজকুমারী। তার নাম ছিল তুবা! ”
তুবা অবাক হয়ে তাকাল। কন্ঠে বিস্ময়,
” আমার নাম কেন? গল্পটা সত্যি নাকি? ”
রাহাত নাক চেপে ধরে বলল,
” একদম সত্যি! আর সেই রাজকুমারীর মন খারাপ থাকলেই নাকি তার চারপাশের ফুলগুলোও শুকিয়ে যেত। রাজকুমারী যখন হাসত, তখন সারা ছাদে আরও সুন্দর ফুল ফুটে উঠতো। এখন বল, তুই কি হাসবি না? ”
তুবা কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। ভাইয়ের বোকা বোকা মজায় কন্ঠ ফুঁড়ে আপনা-আপনি হাসির ঝলক বেরিয়ে আসে। ও জানে, ইচ্ছে করে রাহাত এরকমটা বলেছে। ছোট হলেও তবুও এতটা অবুঝ নয়। নিজেও বাচ্চাদের মতো অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” সত্যি? আমার হাসি দেখে ফুল ফুটবে? ”
রাহাত অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলল,
” অবশ্যই! তুই যদি এখন হাসিস, দেখবি এই গাছের টব থেকে একগাদা ফুল বেরিয়ে আসবে!”
তুবা শব্দ করে হেসে উঠল। হাসল তিশাও। রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে নিস্পৃহ গলায় বলে,
” এই যে! দেখলি তো, ফুলগুলো খুশি হয়ে গেল।”
তিশা পাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে শুধাল,
” ভাইয়া, অরুর এখন কি অবস্থা? ক্ষত শুকিয়েছে? ”
রাহাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,
” কাল আঘাত পেয়েছে। এত তাড়াতাড়ি আঘাত ঠিক হয়? ”
তিশা হতাশ কন্ঠে মলিন চোখে চেয়ে বিড়বিড়ায়,
” শরীরের আঘাত শুকাতে সময় লাগে না। কিন্তু মনের আঘাত এত জলদি কি শুকায়? ”
উড়নচন্ডি মিষ্টি একটুও ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। রাহাতের কিছু কথায় মাঝে মাঝে কষ্ট পেলেও পাত্তা দেয় না। অঘাত বিশ্বাস রাখে, একদিন রাহাত ঠিক তার ভালোবাসা বুঝবে। তবুও প্রিয় মানুষটির অবহেলা কি প্রাণে সয়? মন মানতে চায়?
কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে কিছু নজর পড়তেই, সে নিজের মতো হাসল। কপালের মসৃণ চামড়া টানটান করে ভাবল,
” ওই খাটাশ রাহাত আমাকে পাত্তা না দিলেও, আমি আমার ভবিষ্যৎ জানতে পারি। দেখি, জ্যোতিষী কী বলে! ”
মিষ্টি রাস্তার ধারের এক জ্যোতিষীর কাছে গেল। তখন তাকে দেখেই বিড়বিড়িয়ে ছিল। জ্যোতিষী ছিলেন মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক বৃদ্ধ। ভ্রু কুঞ্চিত করে ভাগ্য নির্ধারণের বিভিন্ন কার্ড নাড়াচাড়া করছেন। মিষ্টি তার সামনে গিয়ে উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে সুর টেনে বলল,
” জ্যোতিষী গো জ্যোতিষী?
হাতটা ধইরা কও দেখি।
মনে মনে যারে চাই,
তারে পামু কি?
আমি মনে মনে যারে চাই,
তারে পামু কি? ”
জ্যোতিষী নাকের উপরে থাকা চশমা আঙুল দিয়ে ঠেলে, কিঞ্চিৎ ভ্রুর দিকে নিলেন। হাতের ইশারায় মিষ্টি’কে সম্মুখে বসতে বললেন। মিষ্টি বসলো। জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করল কিয়ৎপরিমাণ। কিন্তু তার পরখ করা শেষ হচ্ছে না। এদিকে মিষ্টির ভার্সিটি যেতে হবে। ধৈর্য্য শক্তি কুলোয় না। অধৈর্য সহিত জ্যোতিষী হাত চাওয়ার পূ্র্বে নিজে থেকে হাতের তালু এগিয়ে দিল। চনমনে কন্ঠে বলে উঠলো,
” ভাগ্যরেখা দেখে ফটাফট বলুন তো, আমার বিয়ে কবে হবে? আমার মনের মানুষ আমাকে কবে বুঝবে? কিংবা আজও বুঝবে কি-না? ”
জ্যোতিষী চশমার আড়ালে, চক্ষুদ্বয় বড়ো করে মিষ্টির হাত দেখে একটু চুপ থাকলেন। তারপর হালকা হাসি দিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বেশ দাম্ভিক সমেত বললেন,
” তোমার বিয়ে কবে হবে, সেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি। এই তো একদম সঠিক, নিশ্চিত ভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। ”
মিষ্টির হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা আরও ঝলমলিয়ে উঠল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানতে চাইল,
” জলদি বলুন, বিয়ে কবে হবে? ”
” তবে যাকে নিয়ে তুমি স্বপ্ন দেখছো, তাকে পেতে হলে অনেক ধৈর্য্য ধরতে হবে তোমায়। ”
মিষ্টির মনঃক্ষুণ্ন হলো। বিরক্ত লাগছে। আইঢাই করে বলল,
” আমার যথেষ্ট ধৈর্য্য রয়েছে। আপনাকে যা জিজ্ঞেস করেছি, বলুন। ”
জ্যোতিষী মাথা নেড়ে বললেন,
” সময় হলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তার প্রতি আসল ভালোবাসা দেখালে, সে একদিন নিজেই তোমার দিকে আসবে। ”
মিষ্টির রাগ পাহাড় ডিঙানোর পথে। তিরিক্ষি মেজাজ খারাপ নিয়ে বলে,
” ওরে জ্যোতিষী আপনার জ্ঞান শুনতে ইচ্ছুক নই। ফাস্ট ফাস্ট বলুন, আমার বিয়ে কবে হবে? ”
জ্যোতিষী এবার সরাসরি মিষ্টির মুখবিবরে নজর রাখলেন। গভীর গলায় জবাব দিলেন,
” ঠিক গায়ে হলুদের পরদিন। ”
মিষ্টির চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো হয়ে গেল। অক্ষি যুগল কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। এই জ্যোতিষী বলে কি?
শীতের সকাল, ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক ৯ টা ছুঁইছুঁই। আকাশ জুড়ে ধূসর মেঘের আস্তরণ, সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলছে। আচমকা জোরে জোরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, যেন প্রকৃতির রূঢ় রূপ। গাছের পাতাগুলো কাঁপছে তীব্র তাণ্ডবের দাপটে, মাটিতে পড়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে পরিবেশটা আরও গা ছমছমে লাগছে। হালকা শীতের ঠাণ্ডা হিমেল বাতাস যেন চারপাশের নীরবতাকে ভেঙে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কোনো ঘরের জানালা বন্ধ হতে দড়াম শব্দ করছে। প্রকৃতির এই তাণ্ডব যেন শীতের এক অন্যরকম ঘোষণা।
শোঁ শোঁ তীব্র বাতাসের দাপটে হ্যাভেনের পরিপাটি গোছানো চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অল্পসংখ্যক চুল ললাটে লুটোপুটি খাচ্ছে। ভ্রু কুঞ্চিত করে সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। হিংস্র জন্তুর ন্যায় হুংকার ছেড়ে, কাউকে শাসাচ্ছে। সুগভীর ভাসা ভাসা চক্ষুদ্বয় স্থির বেলকনির গ্রিল ভেদ করে শোরগোল রাস্তায়। মস্তিষ্কের পুরো মনোনিবেশ ফোনের ওপর প্রান্তের মানুষের ভীতিকর বচনে। অযাচিত রক্তিম নেত্রদ্বয়ে ভেসে উঠেছে ধ্বংসাত্মক লেলিহান। ক্রোধের দাবানল পুরো মুখমন্ডল জুড়ে। দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণ করে। কন্ঠ খাদে এনে আদেশ সহিত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার এনি এক্সকিউজেস। লিসেন কেয়ারফুলি, হ্যাভেন ইজ বোথ অ্যান আইডিয়াল পারসন অ্যান্ড অ্যা মনস্টার। দলের লোকদের বলে দিবি, আমার সাথে কোনো রকম চালাকি না করতে। আদারওয়াইজ, দ্য কন্সিকোয়েন্সেস ওউন্ট বি গুড। ”
ফোনের ওপর পাশ থেকে মানুষটা কি বলেছে শোনা যাচ্ছে না। তবে তার উত্তরের প্রেক্ষিতে হ্যাভেনের মুখশ্রী কাঠিন্যে রূপ নেয়। তেজি গলায় কাটকাট জবাব দিল,
” হড়বড়িয়ে নিখুঁত ভাবে স্বীয় কার্য হাসিল করে, একজন মানুষ কি পৃথিবীতে থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে? ডেফিনিটলী পৃথিবীতে আছে। খুঁজতে থাক। অ্যান্ড কিপ এন আই দেয়ার। মিত্র সেজে কোনো সূত্র ঘুরছে নাকি। ”
কল কেটে গেল। লোহার গ্রিল শক্ত খসখসে হস্তে মুঠো করে, চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাল হ্যাভেন। বক্ষস্থলে ঝড় বইছে পরাজয়ের নিশানে। কিছু ঘটনার দৃশ্যপট মস্তিষ্ক ক্যাচ করতেই, অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ চাহনি ফট করে খুলল। বিচক্ষণ নিগূঢ় দৃষ্টি তৎক্ষনাৎ সচল হয়। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে স্বীয় মনে বিড়বিড়ালো,
” আমার কেন মনে হচ্ছে, শিকারী আমার আশেপাশে জাল পেতে বসে আছে? কেন মনে হচ্ছে, সে আমার চোখের সামনে ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? অথচ আমি ধরতে পারছি না। তাকে চিনতে পারছি না। ইজ দিস ট্রু, অর ডাজ ইট ফিল দিস ওয়ে বিকজ অভ ওভারথিঙ্কিং? ”
অরু বালিশে মুখ গুঁজে নিরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ফোপাঁনোর দরুন নাজুক শরীরটা ধীর গতিতে কাঁপছে। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম ব্যথায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। মুহুর্তে সমাপ্তি ঘটলো জীবনের প্রথম আবেগ। গগন কাঁপিয়ে আর্তচিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লজ্জার ভয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অরুর বাঁধন ছাড়া অশ্রু বিসর্জনের কারণ, নিখিল। ভোর সকালে বিরতিহীন বেজে চলা ফোনের শব্দে অরুর যখন তন্দ্রা কাটে, তখন কল রিসিভ করে শুনতে পায়, পায়ের নিচ হতে মাটি সরে যাওয়ার মতো ঘটনা। নিখিল নাকি বিয়ে করে ফেলেছে। না, অরু সেজন্য কাঁদছে না। অরুর এক বান্ধবী আছে, যে নিখিলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সেই বান্ধবীর সাথে নিখিল হোটেলে রাত কাটাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পাবলিক জুতা পিটা করে, সেখানে কাজী ডেকে তাদের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। এরকম হীনমন্যতা, কুরুচিপূর্ণ মনোভাবের লম্পট একজন মানুষকে ভালোবেসেছিল, সেটা ভাবতেই অরু কাঁদছে। এই খবর অরু’কে জানিয়েছে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মিষ্টি। অরুর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখন। নিজের পছন্দের উপর ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে।
অভিমান, রাগ, ঘৃণা মিশ্র অনুভূতি মেশানো জোড়ালো আওয়াজে আপন মনে আওড়াল অরু,
” অবশেষে আমিও মেনে নিলাম, তুমি আর কখনোই ফিরবে না! স্বাগতম আমাদের দুজনের আলাদা পথ চলার। ”
গুনগুন করে কান্নার শব্দ কর্ণগোচর হতেই, হ্যাভেন বেলকনি থেকে রুমে আসে। অরু বিছানায় উপুড় হয়ে, বালিশ কামড়ে কাঁদছে। অরুর চোখের অশ্রুজলে হ্যাভেন’কে বিচলিত হতে দেখা গেল না। তার মুখবিবর সাবলীল। কেন কাঁদছে, হ্যাভেনের অজানা নয়। অরু জানার আগে হ্যাভেন নিখিলের ধরা পড়ার ঘটনা জেনে গিয়েছিল। হ্যাভেন পারতো অরু’কে বিষয়টা জানাতে। কিন্তু জানায় নি। তার ধানিলংকা বউয়ের যা স্বভাব। দেখা গেল, হ্যাভেন নিজে থেকে এই খবর দিলে অরু উল্টো টা বুঝে হ্যাভেন’কে খোঁচাত। বলতো, নিশ্চয়ই এসব কিছু হ্যাভেনের কারসাজি! সেজন্য ইচ্ছে করে জানায় নি।
অরুর দিকে একপল চেয়ে, হ্যাভেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। বিদেশি ভালো ব্রান্ডের পারফিউম গায়ে স্প্রে করতে লাগলো। দর্পণে অরু’কে লক্ষ্য করে বিদ্রুপ সরূপ বলে উঠলো,
” বালিশ কামড়ে প্র্যাকটিস করে, পরে আমাকে কামড়ানোর ধান্দা করছো না তো? ”
অরু সচকিত হয়ে, চোখের অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো। ধড়ফড়িয়ে সহসা ওঠে বসলো। বারকয়েক নাক টেনে নিজেকে সামলে নেয়। ভ্রু কুঁচকে হ্যাভেনের দিকে তাকায়। ভাঙা গলায় মৃদুস্বরে বলে,
” সবসময় বাজে কথা না বললে, আপনার পেটের ভাত হজম হয় না? ”
পারফিউম নিজস্ব জায়গায় রেখে, অরুর সামনে সটান হয়ে দাঁড়ায় হ্যাভেন। পকেটে হাত গুঁজে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
” আমি কখনো কারো সাথে বাজে কথা বলি না। কিন্তু তোমাকে দেখলে এরকম হাজার কথাবার্তা মুখ ফসকে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে। আমার কি দোষ? ”
অরু উঠে দাঁড়ায়। কোমরে হাত রেখে কটমটিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,
” আপনার এই মুখ একদিন আমি সেলাই করে দেবো। ”
হ্যাভেন বাঁকা হাসল। নিগূঢ় দৃষ্টি ফেলল অরুর রাগান্বিত মুখবিবরে। নিস্প্রভ নিরেট স্বরে আওড়াল,
” যখন ইচ্ছে সেলাই করো। তবে শর্ত একটাই। সেলাইয়ের ধারালো সুক্ষ্ম সুঁই যেন, তোমার কোমল কোষের ন্যায় মাখন নরম ঠোঁট হয়। ”
অরু আড়ষ্টতায় কিছুটা মিয়িয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। মুখে রাগত্ব ভাব ফুটিয়ে বলে,
” লাগামহীন পুরুষ! পুরুষ মানুষ মানেই বেঈমান। আস্ত একটা ধোঁকার মার্কেট। এদের সঠিক বিচার উপর ওয়ালা করবেন। ”
অরুর কথায় স্পষ্ট বাড়ন্ত কচি ডাল ঝড়ে ভেঙে যাওয়ার মতো, ভগ্নহৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস। হ্যাভেন একটুও রাগ করল না। যদিও কথাটা হ্যাভেনের সাথে বলেছে। তবে হ্যাভেন উপলব্ধি করতে পেরেছে এই দোয়া, ভৎসনা নিখিলের উদ্দেশ্যে ছিল। হ্যাভেন ভাবুকতা চিত্তে ভ্রু নাচালো। ফিচেল হেসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানতে চাইল,
” যেখানে প্রেম করাই হারাম, সেখানে ছ্যাঁকা খেয়ে আল্লাহর কাছে বিচার কিভাবে দেও? ”
অরু মনের মধ্যে কোথাও হোঁচট খেলো। বিতৃষ্ণা প্রকাশ করল নিজের পছন্দের। ফোঁস ফোঁস করতে করতে বিছানায় বসলো। হ্যাভেন ঠোঁট টিপে হাসে। অরুর রাগ আরও বাড়িয়ে দিতে এই গা জ্বালানো হাসি যথেষ্ট ছিল। বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে হ্যাভেন’কে সমান তালে মেরে যাচ্ছে। আর নিজের কালনাগিনী রূপ ধারণ করে চেঁচামেচি করছে। হ্যাভেন’কে বকাঝকা করছে। অরু থামছে না দেখে হ্যাভেন অরুর কোমর জড়িয়ে ধরল। হাত দুটো মুঠো বন্দি করে ব্যঙ্গাত্মক করে বলে,
” বিয়ে যে কি পরিমাণ প্যারা, সেটা তোমাকে না করলে বুঝতে পারতাম না। ”
” ছাড়ুন। গা ঘেঁষা পুরুষ মানুষ! ”
অরু বিরক্ত কন্ঠে বলে। হ্যাভেন ছাড়ল না। বরং অরুর সরু গোল নাকে নাক ঘষলো। দুর্বোধ্য হেসে চনমনে গলায় জবাব দিল,
” তোমার থেকে হাজার গুণ ভালো আছি। তুমি তো বিয়ের আগেই প্রেমিকের সাথে হাত ধরাধরি করতে। ”
অরু চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। টানা টানা হরিণী নেত্র স্থির করল হ্যাভেনের চোখে। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
” আপনি কত ভালো জানা আছে আমার। খুব তো বড়ো বড়ো কথা বলেন। অথচ যৌবনের ঠেলা সামলাতে না পেরে, পাগল হয়ে তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলেন। তাই আমাকে কথা শোনানোর রাইট আপনার নেই। ”
হ্যাভেনের দুষ্টুমি ভরা চোখ কপালে উঠে গেল। হতবিহ্বল অক্ষিপট বড়ো করে ফেলল নিমেষে। ডার্ক রেড ঠোঁট জোড়া ফাঁকা হয়ে গিয়েছে কিঞ্চিৎ। কন্ঠে অবিশ্বাস্য ঢেলে শুধায়,
” হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক? তেইশ বছরে অনার্স কমপ্লিট করার পর, মাস্টার্স এ পড়াশোনা করার পাশাপাশি অফিস সামলানো এসব করবো, নাকি বিয়ে? তেইশ বছরে কেউ বিয়ে করে? তাও যদি উচ্চ বংশের কোনো সনামধন্য ফ্যামিলির মানুষ হয়! বুদ্ধি কি হাঁটুতে নিয়ে ঘোরো? ”
অরুর কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকালো। হ্যাভেনের মুখাবয়ব সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। নজরে নজর মিলিয়ে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
” টুটুলের বয়স পাঁচ। যতটুকু জানি, আপনার বয়স ত্রিশ। তারমানে টুটুলের জন্ম তখন হয়েছিল, যখন আপনি পঁচিশ বছরের ছিলেন। তাহলে হিসাব কি দাঁড়াল? আপনি বিয়ে করেছেন তেইশ কিংবা চব্বিশ বছর বয়সে। ”
সহসা হ্যাভেনের সম্বিত ফিরল। মস্তিষ্ক সচল হয়। আলগোছা অরু’কে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। হালকা গলা খাঁকারি দিল। থমথমে বিরশ মুখে উত্তর দেয়,
” ও, হ্যাঁ। ওই আর কি। ”
” আশ্চর্য লোক! কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন, সেটাই মনে রাখতে পারেন না? ”
অরুর হতবাক প্রশ্ন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হ্যাভেন আমতা আমতা করল। আইঢাই করে ওয়ালেট নিয়ে রুম ত্যাগ করতে উদ্যত হয়।
প্রেমপিপাসা পর্ব ১০
” শুন… ”
” তুমি শোনো। আজকে ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে থেকে রেস্ট নাও। ”
অরু’কে কথা বলার সময় দিল না হ্যাভেন। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে, নিজ বক্তব্য শেষ করে, ত্রস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল।