প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৩

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৩
ফিজা সিদ্দিকী

হাত নাড়াতে গিয়েও ভীষণ জ্বালা যন্ত্রণা হচ্ছে নওরীনের। বেঁধে রাখা রশির দাগ বরাবর কালশিটে দাগের সাথে জ্বলনও কম নয়। ছেলেটাকে সে চেনে না, কী তার পরিচয় তাও জানে না। তবুও কেমন যেন মায়া মায়া তার কণ্ঠ। বুকে কতটুকু কষ্ট জমিয়ে রেখেছি, কে জানে?
আলতো কণ্ঠে নওরীন বললো,
“হাতটা খুলবে একটু? ব্যথা করছে ভীষণ।”
ধূসর মাথা তুললো। ভেজা চোখের পলক রাখলো মমতাময়ী সেই মানুষটার দিকে। অতঃপর ব্যস্ত হাতে দুই হাতের বাঁধন মুক্ত করলো। এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেন নওরীন। কতদিন, কতোমাস পর যেন মুক্ত বাতাস ভুরভুর করে নাকে এসে ঠেকছে তার। অথচ সে বন্দী। আচ্ছা এমন হালকা হালকা অনুভূতি কেন হচ্ছে তার? কেমন নির্ভার, নিঃসঙ্কোচ।

ধূসর নওরীনের মলিন দুইহাতে নিজের চকচকে মোলায়েম হাতের মাঝে নিলো। এরপর দৃষ্টি নত করে অপরাধী ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আপনাকে ফেরানোর বিনিময়ে আমি কী কাউকে নিজের করে চাইতে পারি? এমন কেউ, যাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নিতে গিয়েও বুকে শীল বিঁধে।”
নওরীন ভ্রু কুঁচকে তাকালো অল্পবয়সী এই ছেলেটার দিকে। পোশাক আশাকের ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে সে এই বাড়ির মালিকানার অংশ। চাকর বাকরের পোশাকে এতখানি আভিজাত্য লেপ্টে থাকে না। তাদের ত্বক এতখানি মোলায়েম হয়না।
নওরীনকে চুপ করে থাকতে দেখে মাথা তুলে তাকালো ধূসর। তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“বলুন না, আমি কী আপনার বিনিময়ে আমার সুখ কিনতে পারি?”
“তুমি অসুখী?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নওরীনের হাত তখন আলতো করে রাখা ধূসরের মাথায়। বড্ডো ধীর গতিতে তা ঘোরাফেরা করছে মাথার চারিপাশে। ধূসর ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এমন মমতার ছায়া পেয়ে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কান্নারা লুটিয়ে পড়তে চাইছে। বুকের মাঝের এতো ভার সহ্য হচ্ছে না তার আর। একটু নির্ভার হতে চাইছে। ধূসর আচমকা লুটিয়ে পড়লো নওরীনের কোলে। ময়লা কাপড়, অচেনা মানুষ, অস্থির পরিবেশ সবকিছু অগ্রাহ্য করে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো সে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“আমি পারবো না, পারবো না মমতার সওদা করতে।”
“নিজে ভালো থাকতে গিয়ে যদি দুনিয়া ধ্বংস করতে হয়, তবে তাই করো। কারন এ দুনিয়া তোমার ভালো থাকার খবর রাখবে না। বরং নিজের লাভের ভাগটুকু বুঝে তোমাকে সরিয়ে ফেলতে গিয়েও তার একটুও দ্বিধা হবে না। তাই নিজেকে ভালো রাখার সবটুকু দায়িত্ব তোমার নিজের।”
নওরীনের কন্ঠ খানিকটা কঠোর শোনালো। ধূসর মাথা তুললো না। আগের মতো কোলে মাথা রাখা অবস্থায় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,

“আমার ভালো থাকা যদি অন্য কারোর খারাপ থাকার কারণ হয়, তবে সেই ভালো থাকা চাওয়া কী অন্যায় নয়?”
“একজন ভালো থাকলে অন্যজন খারাপ থাকবে, এটাই তো দুনিয়ার নিয়ম। তুমি সী-সো দেখোনি? একপাশ নামলে তবেই অপরপাশ উপরে ওঠে। দুজন মাঝামাঝি থাকলে দুজনেরই বিপদ। একজনকে হারতে হয়, তবেই অন্যজন জেতে। আর নিজেই নিজেকে হারিয়ে দেওয়া সবচেয়ে বড় বোকামি।”
“আর তার হেরে যাওয়া যদি নিজের হেরে যাওয়ার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার হয়?”
“তবে নিজে হেরে যাও।”
নওরীনের দীর্ঘশ্বাসটুকু সরাসরি আছড়ে পড়লো ধূসরের মাথায়। সে মাথা তুলে তাকালো। নরম কণ্ঠে বললো,
“আমার মায়ের গায়ের গন্ধ আমার মনে নেই, তবে আপনার শরীরের গন্ধে আমার মা মা লাগে। আমি আপনাকে মা ডাকলে রাগ করবেন?”

নওরীন মলিন হাসলো। স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
“আমার ছেলের অভাব পূরণ হলো বুঝি আজ।”
ধূসর দূর্বোধ হাসলো। এক জীবনে সব প্রাপ্তি ঝুলিতে কেন আসবে? কিছু না পাওয়াতেও সুখ আছে। কিছু না পাওয়া অন্যকিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র করে। তাই এই না পাওয়া জিনিসটা আমাদের জীবনের ইন্ধন, বেঁচে থাকার অবলম্বন।
বেলা বেশ গড়িয়েছে, নওরীনের পায়ের বাঁধন খুলছিল ধূসর। তাদের বের হতে হবে এবার। বেশি দেরী হলে কেউ চলে আসতে পারে। নওরীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কোঁকড়া চুল, উস্কখুস্ক পোশাকের সুন্দর এই ছেলেটার দিকে। পরপর প্রশ্ন করলো,

“তুমি কে?”
“এতদিন যারা তোমার উপর নির্মম অত্যাচার করেছে, আমি সেই পরিবারের ছোটো ছেলে।”
“কেন এসেছ এখানে? কী লাভ তোমার?”
“ধরে নাও, পরিবারের দেওয়া জখমের মলম হতে। আর লাভের গল্প নাহয় পরে একদিন জেনে নিও। আপাতত আসো, মা।”

রিং হতে হতে তুর্জয়ের কল কেটে গেল, নন্দিতা রিসিভ করলো না। আবারও কল দিলো তুর্জয়। এমনভাবে প্রায় দশটা কল দিয়ে গেল সে একইভাবে। শাওয়ার নিতে নিতে, রেডি হতে হতে কল করা থামায়নি সে। নন্দিতার একরোখা জেদ কতক্ষণই বা টিকে থাকতে পারে, সে দেখতে চায়। অতঃপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফাইলগুলো হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়লো ঘর ছেড়ে। ঘড়ির কাঁটা সবেমাত্র নয়টা দশ। কোর্টের এখনও ঢের টাইম বাকি। সকালের খাওয়াটাও সারা হয়নি তার। সাথে সাথে তার মাথায় খেলে গেল এক অভিনব বুদ্ধি। ফাইলগুলো হাতে নিয়ে সেভাবেই বেরিয়ে গেল সে গেট ছেড়ে রাস্তায়। অতঃপর সাবধানে রাস্তা পার হয়ে হাঁটা ধরলো ফুটপাত ধরে।
সারা ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে নন্দিতা। গার্ডকে তো সে বলেছিলো তুর্জয়ের গাড়ির সব কয়টা চাকা থেকে হওয়া বের করে দিতে। লোকটা কাজটা ঠিকমতো করতে পারল কিনা কে জানে? যদি না করতে পারে? তাহলে তো ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়বে তুর্জয়। অস্থিরতায় তার হাত পা কাঁপছে। যেন কোনো এক অঘটন ঘটতে চলেছে আজ।

হোটেল রুমের দরজায় করাঘাত পড়ায় নিজেকে শান্ত করে দরজা খুললো নন্দিতা। সকালের ব্রেকফাস্ট দিতে কোনো স্টাফ এসেছে নিশ্চয়ই! কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথেই নন্দিতার মুখ হাঁ হয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিতে চাইলে দরজা ঠেলে জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে তুর্জয়। শুধু ভেতরে প্রবেশ করেই বসে নেই, ফাইলগুলো সাইড টেবিলে রেখে সরাসরি বেডে শুয়ে পড়ে সে। নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। অতঃপর দরজা লক করে বিছানার কাছে এসে তুর্জয়কে শাশানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“এখানে কেন এসেছেন আপনি? কী চাই?”
“বউ যেখানে, আমিও সেখানে। বউ চাই আমার।”
“ফাজলামি বাদ দিয়ে সরাসরি উত্তর দিন।”
“এক দফা, এক দাবি, বউ চাই! বউ চাই!”

“আস্ত নির্লজ্জ মানুষ তো আপনি! বলা নেই কওয়া নেই, জোর করে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে পড়েছেন। আমি এখনই রিসেপশনে কল দিচ্ছি, তারা কিভাবে একজন অচেনা মানুষকে তাদের হোটেলে অ্যালাউ করে, আমিও দেখতে চাই।”
পাশের টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে উঠিয়ে নন্দিতা রিসেপশনে কল করতে যাবে, এমন সময় আচমকা তুর্জয় তাকে হ্যাঁচকা টানে ফেলে দেয় বিছানায়। অতঃপর নন্দিতার গলায় মুখ গুঁজে নেশাগ্রস্থ কণ্ঠে বলে,
“বলবে, আমার হাসবেন্ড জোর করে আমার রুমে ঢুকে এসেছে। এসেই আমাকে বিছানায় ফেলে আমার উপর চড়ে শুয়ে আছে। শুধু তাই নয়, আমার গলায়, বুকে, সারা শরীরে চুমু দিচ্ছে। আর আমার সাথে রোমান্স করছে, আপনি কী এসব লাইভ দেখতে চান? তাহলে চলে আসুন আমাদের রুমে।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২ (২)

তুর্জয়কে নিজের উপর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে নন্দিতা বলে ওঠে,
“লাগাম টানুন মুখে, আমি এখন আপনার ঘরে নেই।”
“আমার ঘরে হোক বা অন্য কোথাও, বউ তো আমার। তাই তার সবকিছুই আমার। বেড কার এটা ম্যাটার করে না। আমার বেড তো আমার বউ, ওটা পুরোটাই আমার।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৪