প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৫
ফিজা সিদ্দিকী
“দিব্য গাঙ্গুলির স্যার, আমি আপনার বেশ বড় ফ্যান। আমি কী একটা সেলফি নিতে পারি আপনার সাথে?”
এডভোকেট গাঙ্গুলির অনুমতির অপেক্ষা না করেই নন্দিতা ঝটপট নিজের ফোন বের করে দিবো গাঙ্গুলির দিকে খানিকটা ঝুঁকে একটা সেলফি তুলে নিলো। সাথে সাথেই অভিযোগের সুরে এডভোকেট গাঙ্গুলি বলে ওঠেন,
“কোর্টের বিচার ব্যবস্থার মাঝে এটা কী ধরনের অসভ্যতামি? আপনি এভাবে কেস লড়বেন?”
নন্দিতা মুচকি হেসে তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সরাসরি তাকায় বিচারকের দিকে। মুখে ক্ষীণ হাসি নিয়ে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ইওর অনার, এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলির সাথে আমার সম্পর্ক আছে। যেন তেন নয়, বেশ গভীর একটা সম্পর্ক। এইযে এই ছবিটা তার প্রমাণ।”
বিচারক ভ্রু কুঁচকে খানিকটা রাগান্বিত স্বরে নন্দিতাকে বলে ওঠে,
“আপনি কী মশকরা করছেন কোর্টের সাথে?”
“একদমই নয় ইওর অনার। মশকরা তো বরং আমার বিপক্ষ দলের এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলি করছেন। কয়েকটা মব করা ছবি দিয়েই তিনি আদালতের সামনে এডভোকেট তুর্জয় আহসানের চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক যেমনভাবে আমি জোর করেই তার সাথে ছবিটা তুললাম। এখানে থাকা প্রত্যেকটা ছবিই তেমন এডভোকেট তুর্জয় আহসানের অজান্তে তোলা, আর কয়েকটা ছবি মব করা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনার হাসবেন্ডকে বাঁচানোর জন্য আপনি আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলছেন, এডভোকেট নন্দিতা আহসান।”
এডভোকেট গাঙ্গুলির কথা শুনে হালকা হেসে তার দিকে তাকিয়ে নন্দিতা বলে ওঠে,
“একজন স্ত্রীর ক্ষমতা দেখাতে এলে আপনি এতক্ষণ ঠিক মত দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না এডভোকেট গাঙ্গুলি। আমি আজ এই আদালতে একজন অ্যাসিসটেন্ট এডভোকেট, এছাড়া এই কোর্টের মধ্যে আমার দ্বিতীয় কোনো পরিচয় নেই।”
“এডভোকেট তুর্জয় আহসানের এইডস রোগের বিষয়ে কী বলবেন আপনি তাহলে?”
“এডভোকেট গাঙ্গুলি, আপনার বোধহয় জানা নেই, এইডস শুধুমাত্র একাধিক নারী সঙ্গমের কারণে হয়না। কোনো এইডস পেশেন্টের ব্লাড অন্য কোনো সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে এই মরণব্যাধি রোগ তার শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট, এবং মিথ্যা একটা রিপোর্ট, ইওর অনার। আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, মেডিকেল টিমের উপস্থিতিতে ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে নতুন করে টেস্ট করা হোক।”
বিচারক কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলেন। অতঃপর পুলিশকে নির্দেশ দিলেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন করে টেস্টের ব্যবস্থা করতে। রিপোর্ট এলে এরপর আবার শুরু হবে এই কারবাহী।
নন্দিতা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। খানিকটা সময় পেয়ে গেল সে এই কেস স্টাডি করার জন্য। তুর্জয় একদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই নতুন রূপের নন্দিতার দিকে। এই নন্দিতাকে সে চেনে না। একেবারে ভিন্নরূপী, ভিন্নধর্মী। নন্দিতা এগিয়ে গেল তুর্জয়ের কাছে। কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
“আপনারই বউ, এভাবে নজর দেওয়ার কিছু নেই।”
তুর্জয়ের কেবিনে বসে নন্দিতা মনোযোগ দিয়ে কেসের ফাইলগুলো স্টাডি করছে। তুর্জয় তার পাশে বসে আর্টিকেলগুলো ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাকে। কথা বলার মাঝে আচমকা বাম হাতে নন্দিতার কোমর আঁকড়ে ধরে তাকে নিজে দিকে ঠেসে ধরে তুর্জয়। নন্দিতা হকচকিয়ে ওঠে তুর্জয়ের থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে তাকে আরও শক্ত করে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে তুর্জয়। অতঃপর নন্দিতার নাকে নাক নাক ঠেকিয়ে বলে ওঠে,
“এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। চোখের সামনে নিজের সবকিছু ধুলিস্যাৎ হতে দেখছিলাম।”
নন্দিতা তুর্জয়ের গালে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলে,
“আমি থাকতে আপনি কখনও হেরে যেতে পারেন না। আমি আছি তো!”
“তুমিও কী এসব সত্যি ভাবছো?”
নন্দিতা মুচকি হেসে বলে,
“সেটা নাহয় সময় হলেই দেখা যাবে। এখন চলুন, লেট হয়ে যাব আমরা।”
শুরু হলো কোর্টের করবাহি। বিচারকের সামনে রাখা রিপোর্টের খাম থেকে রিপোর্টটা বের করে পড়লেন তিনি। অতঃপর এডভোকেট দিব্য গাঙ্গুলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ভূয়া রিপোর্ট পেশ করে কোর্টের সময় নষ্ট করবেন না আপনি। আগামী প্রশ্ন উত্তর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। এডভোকেট নন্দিতা আহসান আপনি শুরু করতে পারেন।”
“ইওর ওনার, আমি কাঠগড়ায় ডেকে নিতে চাই এমন একজনকে যিনি এই ঘটনার অনেককিছুর সাক্ষী। এডভোকেট তনুজা আপনাকে কাঠগড়ায় আস্তে অনুরোধ করা হচ্ছে।”
আনসার চমকে তাকায় পিছনে। কোর্টরুমের মধ্যে বিধ্বস্ত অবস্থায় প্রবেশ করে এডভোকেট তনুজা। বিচারকের অনুমতি পেয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই নন্দিতা বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“এই কেসটা শুরু থেকে শুরু করা যাক ইওর ওনার। আর যার শুরুটা হয় এডভোকেট তুর্জয় আহসানের অ্যাসিসটেন্ট আনসারকে দিয়ে। যার আসল পরিচয় আলোক আনসার, শিকদার বংশের মেয়ে শাহিনার একমাত্র সন্তান। আনসার সাহেব বেশ কৌশলে এতদিন ধরে এডভোকেট তুর্জয় আহসানের অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে যুক্ত হয়ে তারই পিছনে শলা কৌশল করে গেছেন। শুধু তাই নয়, এডভোকেট তনুজা তার ব্যাপারে জেনে যাওয়ায় তাকে কিডন্যাপ করে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।”
“অবজেকশন। এখানে কোর্টকে গুমরাহ করা হচ্ছে। আমরা আসল কেস থেকে সরে যাচ্ছি।”
“এডভোকেট গাঙ্গুলি, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন কেসটা শিকদারদের নিয়ে, এডভোকেট আহসানকে নিয়ে নয়। আপনিই বরং কোর্টের সময় অযথা নষ্ট করছেন। আমাকে আমার কথা রাখার সুযোগ দিন।”
সাথে সাথেই বিচরণ এডভোকেট গাঙ্গুলির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“আপনি বাধা দেবেন না মাঝখান থেকে। কোর্টের নিয়ম লঙ্ঘন করবেন না।”
“সরি স্যার।”
নন্দিতা আবারও তার স্বভাবসুলভ নাক উঁচু ভঙ্গিতে বলে শুরু করে,
“ইওর ওনার, এখন আসি এডভোকেট গাঙ্গুলির এইডস এর গল্পে। এডভোকেট আহসানের সাথে আমার সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে, হঠাৎ করে কিছু লোক আমাকে ফোন করে জানায় এডভোকেট আহসানের জীবন যদি বাঁচাতে চাই তবে আমাকে তাদের কথামত চলতে হবে। শুধু তাই নয়, তারা এডভোকেট আহসানের পরিবারকেও টার্গেট করে। সময়ক্ষেপে জানতে পারি, তারা আর কেউ নয় এই শিকদাররাই। প্রথমে আমাকে জানানো হয় কোনো একটা ভাইরাস ইঞ্জেক্ট করতে হবে এডভোকেট আহসানের শরীরে, এই কেস তারা জিতে গেলে এর অ্যান্টডোজ দিয়ে দেবে তারা আমাকে। কিন্তু এটা যে এইডস নামক মরণব্যধির সংক্রামক ব্লাড স্যাম্পল ছিল, আমার জানা ছিল না। যখন জানতে পারি পুরোপুরি তাদের ট্র্যাপে ফেঁসে গেছি আমরা। আমাদের গোটা ঘর তাদের নজর বন্ধিতে ছিল, এমনকি বেডরুম পর্যন্ত। তাই কাউকে কিছু জানাতে না পেরে এডভোকেট আহসানকে বাঁচাতে গিয়ে এই ভাইরাল আমি নিজের শরীরে ইনজেক্ট করো ফেলি। শিকদাররা ধারণা করে তারা তাদের পরিকল্পনা সফলভাবে করতে পেরেছে। এবং তাদের প্ল্যান ছিল আজকে দিনে কোর্টে এডভোকেট আহসানকে সকলের সামনে অপদস্ত করে তার চরিত্রে দাগ লাগানো।”
“অবজেকশন মাই লর্ড, কোর্ট গল্প নয় প্রমাণ চায়। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে এই পক্ষে?”
নন্দিতা মুচকি হেসে ফাইল থেকে কয়েকটা ফটোকপি বের করে। এরপর বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এগুলো হলো সেসব ম্যাসেজের ফটোকপি, যেগুলো আমাকে তাদের তরফ থেকে পাঠানো হতো। এই নম্বরটা ট্রেস করলেই বাকি তথ্য পেয়ে যাবেন।”
তৈমুর শিকদার ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলো কোর্টে। পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে সিম কার্ড ভেঙে ফেলতে যাবে এমন সময় নন্দিতা আবারও বলে ওঠে,
“তবে তার কোনো প্রয়োজন পড়বে না ইওর ওনার, এই কিসের আইপি এড্রেস সহ সকল প্রকার তথ্য আমি আগেই বের করে রেখেছি। আমি সেটা কোর্টে পেশ করে দিচ্ছি।”
জাওয়াদ শিকদার আজ নিজে উপস্থিত হয়েছেন কোর্টে। তিনি মূলত তুর্জয়ের হেরে যাওয়া স্বচক্ষে দেখতে আজ এখানে এসেছিলেন। কিন্তু খেলা যে এভাবে তিনশ শাট ডিগ্রি ঘুরে যাবে, কে জানত?
নন্দিতার লাগাতার একের পর এক কাউন্টার অ্যাটাকের কোথাও মনোযোগ নেই তুর্জয়ের। প্রথম থেকে বেশ মজা নিয়ে নন্দিতার কাউন্টার অ্যাটাকের খেলা দেখছিল সে। কিন্তু যে মুহূর্তে নন্দিতা স্বীকার করলো, সেই ব্লাড স্যাম্পল সে নিজে শরীরে পুষ করেছে, এরপর থেকে চারিদিকের কোনো কোলাহল, কোনো কৌতূহল তাকে ছুঁতে পারল না। বুকের মাঝে অসম্ভব রকম যন্ত্রণা টের পেল। হাত পা অসম্ভব রকম কাঁপতে কাঁপতে আচমকা নন্দিতার নাম ধরে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে।
জ্ঞান ফিরেছে তুর্জয়ের। তবে হার্ট বিট ভীষণ রকম ফাস্ট। ছলছল চোখে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে না একটি শব্দও। নন্দিতা আচমকা সকলের সামনেই জড়িয়ে ধরলো তুর্জয়কে। তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার ভঙ্গিতে বললো,
“আমি ঠিক আছি তো। এখনও অনেক কিছু জানার বাকি আছে আপনার। শান্ত হন প্লীজ। নিজেকে শান্ত করুন। হায়াত যতদিন আছে, ততদিন শুধু আপনারই আছি। শান্ত হন।”
খানিকটা বিরতি নিয়ে আবারো শুরু হয় নন্দিতার বক্তব্য।
“ইওর অনার, মিস্টার জাওয়াদ শিকদারের দুই হাত অসংখ্য নিষ্পাপ মানুষের তাজা রক্তে রাঙা। মশা, মাছির মতো মানুষ মারেন তিনি, যার মধ্যে একজন আমার বাবা ইন্সপেক্টর নিহান। এক্স পুলিশ অফিসার, সাবডিভিশনাল সিক্রেট লিড অফিসার। ইওর অনার, আমার বাবা সেই মানুষ যিনি প্রথমবার শিকদারদের পাপী লেজে পা দেন। তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ জোগাড়ও করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই কেস কোর্টে ওঠার আগেরদিন রাতে গোটা পুলিশ স্টেশন আগুনে ঝলসে যায়। ইয়েস ইওর ওনার, আমি সেই ২০১৯ সালের বর্ধমান পুলিশ স্টেশনে ঘটা অস্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ডের কথা বলছি।
ইন্সপেক্টর নিহান তখন সিনিয়র অফিসারের নির্দেশ অনুযায়ী নিজের পরিবারকে বাঁচাতে গা ঢাকা দেন, এবং পরবর্তীতে সিক্রেট এজেন্সিতে যোগ দেন। এরপরও গোপনে তিনি শিকদারদের স্মাগলিং, ওষুধের কারচুপি, এমনকি অঙ্গ পাচারের মতো কাজগুলোকে ট্রিগার করেন। কোনভাবে এই খবর যখন জাওয়াদ শিকদারের কানে যায়, সব প্রমাণ লোপাট করার উদ্দেশ্যে মাস দশেক আগে মরিয়া হয়ে চলন্ত গাড়িকে উড়িয়ে ব্রীজ থেকে ফেলে দেন। সেই গাড়িতে ছিলেন আমার বাবা, মা। সেখানেই স্পট ডেড হয় অফিসার নিহানের। কোনমতে প্রাণে বেঁচে যান আমার মা, অফিসার নিহানের স্ত্রী নওরিন।
এতদিন যাবত তাকে বন্ধী করে রাখেন এই শিকদাররা। আমি আদালতের সামনে একটা পেনড্রাইভ পেশ করতে চাই, যেখানে অফিসার নিহানের সংগ্রহ করে যাওয়া সকল প্রমাণ রয়েছে। আমি আদালতের কাছে বিচার চাই। বিচার চাই আমার বাবার খুনের, বিচার চাই আমার মায়ের নিপীড়নের, বিচার চাই আমার স্বামীর মানহানির, বিচার চাই আমার মৃত্যুর কারণ হিসেবে শরীরে বয়ে চলে এই মারণব্যাধির। দেশের, দশের বিচারের সাথে সাথে আমার নিজেরও বিচাই চাই ইওর অনার।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪৪
“তুমি এইডস ইনফেক্টেড না।”
উৎসুক জনতা দরজার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে আগন্তুকের কথার সারমর্ম বোঝার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে তুর্জয়ের দিকে তাকালো।