বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব ৭

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব ৭
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

একটা চেয়ারে হাতপা বাঁধা অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে আছে ডক্টর রাজিব হোসেন। তার ঠিক সামনে বসে আছে তাজ। এসব করতে তার মোটেও ভালো লাগছে না৷ পর্দায় একশন মুভি করলেও বাস্তব জীবনে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সব ঝামেলা। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এসব করতে বাধ্য করছে। চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরলো রাজিবের। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। সামনে তাজকে বসে থাকে দেখে অবাক হলো।
এসব কী তাজ ?

তাজ নির্লিপ্ত গলায় বললো, আমিও সেটাই বলছি আঙ্কেল। এসবের মানে কী ? আপনি আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, বলতে গেলে ফ্যামিলির একজন মেম্বার। আপনি কীভাবে পারলেন নির্দ্বিধায় এমন একটা মিথ্যা বলতে।
এবার মাথা নিচু করে ফেললো রাজিব।
তাজ বললো, টাকার জন্য এতো বছরের বিশ্বাস বিক্রি করতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না।
রাজিব এবার তাকালো তাজের দিকে, পৃথিবীতে টাকার থেকে অধিক মূল্যবান অনেক কিছু আছে তাজ। তার মধ্যে আপনজন একটা। ছোট একটা মিথ্যার জন্য আমি আমার আপনজনদের মৃত্যু দেখতে পারবো না নিশ্চয়ই।
তাজ অনেকটাই অবাক হলো, মানে ?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাজিব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, মিথ্যা বলার জন্য হয়তো তুমি আমাকে শাস্তি দিবে এখন। কিন্তু মিথ্যাটা না বললে আমাকে আমার পুরো পরিবার হারাতে হতো। তুমি আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিতে পারো আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তাজ গম্ভীর গলায় বললো, লোকটা কে ?
সেটা আমি নিজেও জানি না। তোমাদের বাড়ি থেকে ফোন আসার পর আমি যখন তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। তোমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিট আগে আমার কাছে কিছু ছবি আর একটা ম্যাসেজ আসে। পরিবারের জীবন বাঁচাতে আমি বাধ্য হই মিথ্যা বলতে।
তাজের মাথা হ্যাং করছে। সে ভেবেছিলো রাজিবের থেকে কিছু অন্তত জানতে পারবে কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। ম্যাসেজ আর ছবি তাজকে দেখালো রাজিব। পরিবারের প্রতিটা মানুষের গলায় ছুরি ধরে রাখা হয়েছে। সাথে ছোট একটা ম্যাসেজ, সারাদেশের মানুষ যেটা জানে সেটাই যেনো বলে রাজিব। নাম্বারটা নিয়ে কল করে দেখলো বন্ধ। একটা ক্রাইম করে এখনো নাম্বারটা ইউজ করার মতো বোকা নিশ্চয়ই তারা নয়। নাম্বারের ডিটেইলস বের করতে বলে রাজিবকে বাসায় পৌঁছে দিতে বললো তাজ৷ তারপর বের হয়ে গেলো গোডাউন থেকে।

নিজের ফ্ল্যাটে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে তিতির। মনে হচ্ছে এখনই বিকট শব্দে বেজে উঠবে তার ফোনটা আর রায়হানের থেকে শুনতে হবে ভয়ংকর কিছু। সারা রুম জুড়ে পাখির টেডিবিয়ার, খেলনা, জিনিসপত্র রাখা। রুমের আনাচকানাচে পাখির হাজারো স্মৃতি। তিতিরের মনে হচ্ছে পাখি বলছে আপুনি আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।

তিতির নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, তোর কিছু হতে দিবো না বোনু। আমি তোর কিছু হতে দিবো না। এতে যা করতে হয় করবো কিন্তু তোর কিছু হতে দিবো না। কেনো এমন করছেন রায়হান চৌধুরী কেনো ? আমি মুক্তি চাই এসব থেকে।
অনেকটা সময় পরেও রায়হানের কোনো ফোন না পেয়ে ভয় বাড়তে লাগলো তিতিরের। রায়হানের তো এতো শান্ত থাকার কথা নয়। এ যেনো ঝড়ের পূর্বাভাস। তিতির দু’হাতে চোখমুখ মুছে উঠে দাড়ালো। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলো খান ভিলার উদ্দেশ্যে। গতরাতে যে রুমে ছিলো সেই রুমেই গেলো, সে ঠিক করেছে সেখানেই থাকবে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। যত সময় যাচ্ছে ভয়ে তিতিরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাকি দিন তিতির বন্ধ রুমেই কাটিয়ে দিলো, সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলেও গলা দিয়ে তা নামলো না।

বেলকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো তিতির। এশারের নামাজ পড়েই বেলকনিতে গিয়ে বসেছে। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারা দেখা যাচ্ছে দুয়েকটা। পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠলে চমকে উঠলো তিতির। স্কিনে রায়হানের নাম দেখে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কাঁপা হাতে ফোন তুলে রিসিভ করলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলো না শত চেষ্টা করেও।
তোকে বলেছিলাম আমার কথার বাইরে গেলে তার চরম মূল্য দিতে হবে তোকে।
রায়হানের শান্ত গলায়ও ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তিতিরের, আ,,আমার ভুল হয়ে গেছে। দয়া করে পাখির কিছু করবেন না।
আমি ঠিক সময়ে না গেলে আমার দুই বছরের সাজানো খেলা এক মিনিটে শেষ করে দিতি তুই। এমন একটা কাজের শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে তিতির। নাহলে তোর সাহস বেড়ে যাবে। আজ মৌকে বলতে গিয়েছিলি কাল সরাসরি তাজকেই বলে দিবি। তোর সাহসটা কমানোর জন্য হলেও শাস্তি তো পেতে হবে।
তিতির ব্যস্ত হয়ে উঠলো, ন,,না না আমি কাউকে কিছু বলবো না আর। মরে গেলেও মুখ খুলবো না, দয়া করে আমার পাখিকে কিছু করবেন না।

রায়হান উচ্চস্বরে হেসে বললো, বড্ড দেরি হয়ে গেলো যে বোনটি। আমি তো যা করার করে ফেলেছি।
তিতিরের কলিজা কেঁপে উঠলো রায়হানের কথা শুনে, ক,,কী করেছেন আপনি ?
ওয়েট এখনি দেখাচ্ছি।
তিতিরের ফোনে একটা ভিডিও সেন্ড করে দিলো রায়হান, এনজয় দ্যা ভিডিও।
তিতির কাঁপা হাতে ভিডিও ওপেন করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, পাখি।
পাখির হাত থেকে টপটপ রক্ত পড়ছে। পাখি হাতের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁদছে আর আশেপাশে তাকিয়ে আপুনি বলে ডাকছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাতটা। তিতিরের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। ইচ্ছে ফোনের ভেতরে ঢুকে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিতে।
তিতির ফোনের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো, আমার জন্য হয়েছে বোনু। আমাকে মাফ করে দে আমি তোর পঁচা আপুনি। আমি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

পাখিকে কত অসহায় মনে হচ্ছে, আশেপাশে আপুনিকে খুঁজছে সে। তিতিরের বুক চিঁড়ে যাচ্ছে কষ্টে৷ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে তার কাছে। ভিডিও শেষ হলে ফোনটা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো তিতির। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না সে। তিতির পাগলের মতো রুমে ছুটে এলো, কিছু খুঁজতে লাগলো। সাইড টেবিলে পেয়েও গেলো কাংখিত জিনিস। ফলের সাথে রাখা ছুরিটা নিয়ে নিজের হাতে একটা টান দিলো। মুহূর্তে চামড়া কেটে লাল টকটকে তরল বের হয়ে এলো। আরো একবার ছুরি বসাবে তার আগেই বেলকনিতে থাকা ফোনট আবার বেজে উঠলো। ছুরি ফেলে দৌড়ে গেলো বেলকনিতে।
রায়হানের কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করলো, আমি আমার বোনুর সাথে কথা বলতে চাই এখনই। আ,,আমি আর কিছু বলবো না কাউকে। সত্যি বলছি একটা শব্দ বের করবো না মুখ থেকে।

তিতির কথা শেষ করে মুখে হাত চেপে কান্না করতে লাগলো। এদিকে হাতের রক্তে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।
ওয়েট পাখির সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আর আজকের মতো ভুল দ্বিতীয়বার করার সাহস করিস না।
তিতির অপেক্ষা করতে লাগলো পাখির সাথে কথা বলার। হাতের কথা তার মাথা থেকেই বের হয়ে গেছে।

মেয়েটার হাত কাটলো কীভাবে ন্যান্সি ?
ন্যান্সি ভয়ে ভয়ে বললো, রায়হান স্যার সকালে কল করে জানালো পাখিকে নিয়ে বাইরে গিয়ে যেনো একটু হাঁটিয়ে আনি। রুমে থেকে থেকে ডেস্পারেট হয়ে যেতে পারে। আমি সকালে সামনের রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলাম তাকে নিয়ে। হঠাৎ একজন আমাকে সে বললো কেউ ডাকছে আমাকে। পাখিকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি পাখির হাত থেকে রক্ত পড়ছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে এলাম।
আহান রেগে গেলো ন্যান্সির কথা শুনে, কেউ ডাকলো আর মেয়েটাকে একা রেখে আপনি চলে গেলেন।
ন্যান্সি মাথা নিচু করে ফেললো, সরি।

আহান বেডে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা পাখির দিকে তাকালো। বাসায় আসার পর ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে আহান। হাতের কাটা গভীর না হলেও মেয়েটা ভয় পেয়েছে প্রচুর। শান্ত করতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে মাত্র। ভাগ্য ভালো আহান বাসায় ছিলো নাহলে কী হতো আল্লাহ জানেন। আহানের ফোন বেজে উঠলে স্কিনে রায়হানের নাম্বার দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে তো পাখির খেয়াল রাখতে পারেনি। এখন কী বলবে ভাইকে ?
ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো আহান, হ্যালো ভাইয়া।
রায়হান শান্ত গলায় বললো, পাখি কোথায় ?
আহান আমতা আমতা করে বললো, আসলে ভাইয়া।
আমি সবই জানি তাই বাহানা করার প্রয়োজন নেই। তুই পাখির কাছে দে আমি কথা বলবো।
পাখি তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া।

ডেকে বল ওর আপুনি কথা বলবে।
আহান অবাক হয়ে বললো, কিন্তু ?
যেটা বলছি সেটা কর, বেশি কথা পছন্দ নয় আমার।
ন্যান্সি নিচু স্বরে ডেকে তুললো পাখিকে। মেয়েটা এখনো কেমন ভয়ে গুটিয়ে আছে।
রায়হান বললো, ফোনটা পাখির কাছে দিয়ে তোরা চলে যা।
আহান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কথা না বাড়িয়ে পাখির কাছে ফোন দিয়ে চলে গেলো আহান আর ন্যান্সি। ভিডিও কলে পাখি স্কিনে রায়হানকে দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, আপনি কে ? আমার আপুনি কোথায় ?
রায়হান কিছু না বলে তিতিরকে এড করে দিলো কলে। তিতিরকে দেখে কেঁদে দিলো পাখি।
আপুনি তুমি আসছো না কেনো ? দেখো আমি ব্যাথা পেয়েছি। একটা পঁচা লোক আমাকে ব্যাথা দিলো তো।
তিতির কেঁদে উঠলো বোনের কথা শুনে। কতদিন পর বোনটাকে দেখতে পেলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, কাঁদে না সোনা। আমি চলে আসবো তো, তুমি একদম ভয় পাবে না। তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকো আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।

আমি দুষ্টুমি করবো না, তুমি চলে আসো। আমার একা থাকতে ভালো লাগে না তো।
খুব বেশি ব্যাথা লেগেছে বোনু ?
হ্যাঁ তো, ব্যাথা করছে তো। প্লিজ তুমি চলে আসো ব্যাথাও চলে যাবে।
পাখির কথা শুনে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তিতিরের। ইচ্ছে করছে বোনকে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে যাতে আর কেউ কেঁড়ে নিতে না পারে, দু’বোনে কাঁদতে লাগলো। আরো কিছু সময় কথা বলার পর রায়হান কেটে দিলো কল। সে চুপচাপ দু’বোনের কথা শুনে গেছে। তবু পাথর মনে একটু দয়া হয়নি তার। তিতির ফোনটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো বেলকনিতে। হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলো একাই, শুকিয়ে যেতে লাগলো।

আহান থম মেরে বসে আছে নিজের রুমে। তার মাথায় কিছুই আসছে না। নিজের রুমে থেকে তিতির আর পাখির কথোপকথন শুনেছে সে। রায়হানের মাথা থেকে হয়তো এই ব্যাপারটা বেরিয়ে গেছে। আহান কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না। রায়হান তাদের বলেছিলো পাখির আপুনি মারা গেছে তাহলে পাখি কথা বললো কার সাথে। দু’জনের কথায় তো মনে হয়নি অন্যকেউ। ল্যাপটপের স্কিনে তিতিরকেও দেখেছে আহান।

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব ৬

পাখির সাথে তার চেহারায়ও অনেক মিল আছে। প্রথম থেকেই পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে আহানের কাছে কিন্তু মনে করতে পারেনি কোথায় দেখেছে। রায়হান যখন বললো পাখি তাদের আপন কেউ তখন আর মাথা ঘামায়ন, ভেবেছে আত্নীয় কেউ হবে। আগে দেখেছে তাই চেনা লেগেছে। কিন্তু আহান এখন বুঝতে পারছে পাখিকে তার চেনা চেনা লাগার কারণ। সে পাখিকে নয় বরং তিতিরকে আগে কোথাও দেখেছে আর তিতিরের সাথে পাখির চেহারায় মিল থাকায় পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে। আহানের বুঝতে অসুবিধা হলো না এখানে অন্য কোনো গল্প আছে, রায়হান কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না আহান।
আহান বিড়বিড় করে বললো, কে এই তিতির আর পাখি ?

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব ৮