ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৩
তাজরীন ফাতিহা
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্টাডি রুমে বসে মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র ঘাটছেন। টেবিলের উপর কফির মগ রাখা। কাগজপত্র ঘাটাঘাটির চক্করে তা ঠান্ডা প্রায়। উর্মি ভুঁইয়া আরেক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ওই কক্ষে হাজির হলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে আবার চলে যেতে চাইলেন কিন্তু ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার ডাকে তার চলন্ত পা জোড়া থেমে গেলো।
“উর্মি চলে যাচ্ছো যে?”
উর্মি ভুঁইয়া কিছুটা কাঁপলেন মনে হলো। একটু নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় কোনো কাজ নেই দেখে বই পড়তে এসেছেন। তাই কিছু কথা বলতে এসেছিলাম কিন্তু আপনি তো কাজ করছেন এজন্য চলে যাচ্ছিলাম পরে বলবো ভেবে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কাগজপত্র বন্ধ করে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলেন। স্ত্রীর হাত থেকে কফির মগ নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে স্টাডি রুমের বিশাল বারান্দায় গেলেন। স্ত্রীকে দোলনায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলেন। তারপর বললেন,
“তোমার পাশে বসেছি দেখে রাগ করেছো?”
উর্মি ভুঁইয়া কথা বললেন না। চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে রইলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
“উর্মি তুমি এতো রাগী কেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উর্মি ভুঁইয়া এবারও কথা বলতে পারলেন না। তার মুখ দিয়ে কথা মূলত বের হচ্ছে না। তিনি ঢোঁক গিললেন। এখন সে যে কথাটা বলবেন সেটায় ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ঠিক কি রিয়েক্ট করবেন সেটাই তিনি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। তার কিছুটা ভয়ও লাগছে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার রাগ মারাত্মক ভয়ানক। একবার উঠলে থামানো মুশকিল। এখন তাকে জিজ্ঞেস করছে রাগী কেন? একটু পর নিজেই না ফায়ার হয়ে বসে থাকে তখন সামলাবে কে? উর্মি ভুঁইয়ার মনে হচ্ছে কথাটা বলা ঠিক হবে না। কি করবেন না করবেন এসবই ভেবে চলছেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে ঝাঁকিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে উর্মি? এতো আপসেট কিজন্য? কি যেন বলতে চেয়েছিলে বলো। তোমার জন্য আমি সদা প্রস্তুত।”
উর্মি ভুঁইয়া এবার মুখ খুললেন,
“না থাক অন্যদিন বলবো। আপনি নিজের কাজ করুন।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কফি মগে চুমুক দিয়ে স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। উর্মি ভুঁইয়া ভ্রু কুঁচকে নিলেন। বললেন,
“আমি কারো এটো খাই না। আপনি খান।”
“অথচ একসময় তুমি প্রচুর এটো খেতে উর্মি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কথাটা বলেই মগ রেখে স্ত্রীর পাশ থেকে উঠে গেলেন। উর্মি ভুঁইয়া মগটা হাতে তুলে চুমুক দিলেন। তার মাথা অলরেডি ব্যথা করছে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে কফি খেতে দেখে মনে মনে খুশিই হলেন তবে মুখে কিছু বললেন না। তিনি বললেন,
“কি বলতে এসেছিলে বলো উর্মি? তোমার এরকম থতমত ভাব অদ্ভুত লাগছে।”
উর্মি ভুঁইয়া নিজেকে ঠান্ডা করলেন। কফির মগ পাশে রেখে বললেন,
“ইহাবের বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবছেন?”
“কি ভাববো আর ভালো মেয়ে দেখা শুরু করতে হবে। ঘটককে বলেছি আমাদের স্ট্যাটাস অনুযায়ী মেয়ের সন্ধান দিতে। ঘটক মেয়েদের বায়োডাটা হাজির করলেই পছন্দ করে যাচাই বাছাই করে মেয়ে সিলেক্ট করবো আমাদের আদরের পুত্রের জন্য ব্যাস।”
উর্মি ভুঁইয়া এবার আসলেই ভয় পাচ্ছেন কিছু বলতে। যদিও ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে তিনি ভয় পান না তবে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার রাগটা মারাত্মক ভয়ানক। যেটা তিনি সামলাতে পারেন না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে অদ্ভুতভাবে বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে বসলেন। বললেন,
“উর্মি কি হয়েছে তোমার? এমন অদ্ভুত বিহেভিয়ার করছো কেন? তোমার পছন্দের কোনো মেয়ে আছে?”
উর্মি ভুঁইয়া শক্ত হয়ে বললেন,
“হ্যাঁ আসলে, আছে একজন।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার ভ্রু কুঁচকে গেলো। বললেন,
“কে সে? নাম বলো। তাহলে সেই মেয়েকেই বউ করবো তোমার যেহেতু পছন্দ।”
উর্মি ভুঁইয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল একটু মুছে নিলেন। তার হাসফাঁস লাগছে কথাটা বলতে। শক্ত হয়ে রোবটিক গলায় বললেন,
“মাহাবুব ভাইয়ের মেয়েকে আমার পছন্দ।”
ইহাবের নাম নেয়নি কারণ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ইহাবকে মারতে দ্বিধা করতেন না। অতো বড় ছেলের গায়ে মা হয়ে মার খেতে কিছুতেই দেখতে পারবেন না তিনি। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কথাটা শোনা মাত্র স্ত্রীকে ছেড়ে দিলেন। শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কি বললে?”
উর্মি ভুঁইয়ার বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। আল্লাহ জানেন কি ঘটবে আজকে ঘরে। চোখ বন্ধ করে আবারও খুললেন। বললেন,
“মাহাবুব ভাইয়ের মেয়েকে আমার পছন্দ। মেয়ে যথেষ্ট ভদ্র। হয়তবা স্ট্যাটাস মিলে না আমাদের সাথে কিন্তু ওকে আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। কফির মগ এক আছাড়ে ভেঙে ফেললেন। উর্মি ভুঁইয়া ভয় পেলেন না তবে কেঁপে উঠলেন। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই হলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে শক্ত করে চেপে বললেন,
“তুমি কি বলছো ভেবে বলছো কি? ওই পরিবার আমার দুই চোখের বিষ? তুমি কোন জ্ঞানে ওই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে চাও উর্মি? ইনফ্যাক্ট ইহাবও ওই পরিবারকে দুই চোখে সহ্য করতে পারেনা তুমি তবুও ওই পরিবার থেকে মেয়ে আনার কথা ভাবলে কি করে?”
উর্মি ভুঁইয়ারও মনে এই প্রশ্ন যে আসেনি তা না। কয়েক বছর আগে ইহাব একটা নাম যেন তার সামনে কখনো না নেয়া হয় এ নিয়ে তুমুল গ্যাঞ্জাম করেছিল। উর্মি ভুঁইয়া সঠিক জানেন না ঠিক কি কারণে ইহাব ও ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ওই পরিবারকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না যেখানে ইহাবের সাথে ছিল ওই পরিবারের একজনের আত্মার সম্পর্ক। ইহাব হঠাৎ করে ওই পরিবার থেকে মেয়ে আনতে চাচ্ছে কেন? এই বিষয়ে আরও খোলাশা করে ইহাবের সাথে কথা বলবেন ভাবলেন।
নিশাতের ঘুম ভাঙলো রাতে। রাত আটটা বাজে। সেই যে দুপুরে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়েছে এখন চোখ খুললো সে। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড খারাপ লাগছে তার। দুপুরের ঘটনা মনে করলেই বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। কেমন যেন দুনিয়াটা ঘুরে ওঠছে তার। পেটে ভীষণ রকমের ব্যথা করছে। সে পেটে হাত চেপে গোঙাতে লাগলো। মারওয়ান রুমে প্রবেশ করে দেখলো নিশাত পেটে হাত চেপে আছে। দ্রুত নিশাতের কাছে গিয়ে বললো,
“কি হয়েছে তোমার?”
নিশাত আস্তে করে বললো,
“পেটে প্রচণ্ড ব্যথা।”
“হঠাৎ পেটে ব্যথা কেন?”
“জানি না।”
মারওয়ান কি করবে ভেবে পেলো না। হঠাৎ বিছানার দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলো। নিশাতকে কানে কানে আস্তে করে কিছু বললো। নিশাত চমকালো কিছুটা। মারওয়ান নিশাকতে ধরে টয়লেটে নিয়ে গেলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিয়ে ছেলের কাছে গেলো। নাহওয়ান কতগুলো খেলনা ছড়িয়ে খেলছে আর ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করছে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছে এটা নিশ্চয়ই। মারওয়ান ছেলেকে কাঁধে চেপে ঘোরাতে লাগলো। নাহওয়ান মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসলো।
নিশাত রুম থেকে বেরিয়ে কোনো রকম হেঁটে রান্নাঘরে আসলো। যতই খারাপ লাগুক রাঁধতে তো তাকেই হবে। নিশাত দেখলো চুলোর উপরে দুটো পাতিল রাখা। এগুলো এখানে কে রেখেছে? ভাবতে ভাবতে পাতিলের ঢাকনা উঠিয়ে দেখলো ভাত আর তরকারি রান্না করা। নিশাতের কপাল কিছুটা প্রশস্ত হলো। কে রান্না করলো? মারওয়ান পিছন থেকে বললো,
“আমি রেঁধেছি। একটু কষ্ট করে খাও আজকে। হয়তবা অতটা ভালো হয়নি তবুও আজকে চালিয়ে নেয়া যায় কিনা দেখো।”
নিশাত আজকে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। মারওয়ানকে চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎ এরকম অদ্ভুত আচরণের কারণ কি? এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলো মারওয়ান চুলোয় ছোট একটা পাতিলে পানি বসিয়ে দিয়েছে। মারওয়ান নিশাতকে এরকম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“যাও শুয়ে থাকো। আমি গরম পানি নিয়ে আসছি।”
নিশাত কোনো কথা না বলে আস্তে করে হেঁটে চলে গেলো। নাহওয়ান মাকে দেখে দৌঁড়ে আসলো। মায়ের পা জড়িয়ে ফিক করে হেঁসে মায়ের দিকে তাকালো। নিশাত ছেলের চোখের ভাষা বুঝলো। ছেলেকে কোলে নিলো। অনেকক্ষণ পর মায়ের কোল পেয়ে আরামে বাচ্চাটা কাঁধে মাথা ফেলে পড়ে রইলো। নিশাত বললো,
“আব্বা ভাত খেয়েছেন?”
“কেয়েছি। বাবা কাইয়ে ডিচে।”
নিশাত মন ভরে তার ছানাকে আদর করলো। তার কলিজার টুকরা এই বাচ্চাটা। আরেকটু শক্ত করে ঝাপটে ধরলো ছেলেকে। ছেলেও মায়ের ওম পেয়ে আরো সেটে গেলো মায়ের বুকে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণেই সবকিছু ভুলে যায় সন্তানরা। নিশাতের আজকে অনেক মায়ের কথা মনে পড়ছে। কতদিন হলো মা, বাবার খোঁজ নেয়া হয়না। খোঁজ নিলে আরেক বিপদ তারা নিশাতকে মারওয়ানের সংসার ছেড়ে চলে আসতে বলেন। নিশাত এসব শুনতে চায়না বিধায় ফোন দেয়া বন্ধ করেছে। তারা ফোন দিলেও এড়িয়ে চলে। ফোন ধরে না। সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। সবাই যতটা সহজ ভাবে বলে সংসার ছেড়ে চলে আসতে সংসার ছাড়া কি অতটা সোজা?
নিশাতের বাবা মায়ের প্রতি অদৃশ্য একটা ক্ষোভ আছে। তখন ছেলেকে যাচাই বাছাই না করে কেন বিয়ে দিলো আর এখন বা তাকে সংসার ছেড়ে আসতে বলে কেন? তার একটা সন্তান আছে ওকে বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার নিশাতের নেই। এতে আল্লাহ তায়ালা ভীষণ নারাজ হন। তালাক হলো আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল কাজ। এই নিষ্পাপ ফুলের মতো বাচ্চার কি দোষ? ওর তো বাবা মা দুজনকেই প্রয়োজন। এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশাত।
মারওয়ান পানি নিয়ে এসে দেখলো ছেলে মায়ের কোলে ঘাপটি মেরে আছে। গামছা ভাঁজ করে গরম পাতিলে ছ্যাঁকা দিলো। তারপর নাহওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওই পান্ডা তুই মায়ের কোলে উঠেছিস কেন?”
নিশাত ও নাহওয়ান উভয়ই চমকে উঠলো। মারওয়ান তাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“আমার কোলে আয় নাটবল্টু।”
নাহওয়ান মাথা একটু বের করে আবারও মাকে ঝাপটে ধরলো। মাথা নাড়িয়ে না বললো অর্থাৎ সে যাবে না। মারওয়ান কিড়মিড় করতে করতে বললো,
“তুই আসবি তোর মাও আসবে। দ্রুত কোলে আয় চিলোমচির বাচ্চা। ”
নিশাত চোখ রাঙিয়ে বললো,
“ও থাকতে চাইছে থাকুক। আপনি আমার বাচ্চাকে উল্টাপাল্টা নামে ডাকা বন্ধ করুন।”
“হ্যাঁ নিজের একার বাচ্চা। আমিতো দুধ ভাত।”
বলেই নাহওয়ানকে জোর করে কোলে নিলো। নাহওয়ান হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য। মারওয়ান গরম গামছাটা নিশাতের হাতে দিয়ে বললো,
“এটা পেটে চেপে ধরো। আর এইযে গরম পানি এটা খেও।”
বলেই গ্লাস আর গামছা নিশাতের দিকে এগিয়ে দিলো। তারপর ছেলেকে নিয়ে বাইরে বের হতে হতে বললো,
“তোকে কিন্তু মারবো ফাইয়াজ।”
নাহওয়ান কেঁদে হাত পা ছুড়তে লাগলো আর বললো,
“মার কাচে যাবো।”
“না বাবার কাছে থাক। মা মধু নিয়ে বসে নি। তোর মা যা দিতে পারবে তা আমিও পারবো। সুতরাং সুন্দর করে কোলে ঘাপটি মেরে থাক।”
নাহওয়ান বাবার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“ডুডু কাবো। ডুডু ডাও।”
মারওয়ান এতোই অবাক হলো যে মুখ থেকে কথা বের হলো না কোনো। কিছুক্ষণ পর চোখ রাঙিয়ে বললো,
“দুই দিনের আন্ডা আমার সাথে ইয়ার্কি করিস? কত বড় বদ!”
নাহওয়ান বাবার কোনো কথা কানে ঢুকালো না। দুধ খাওয়ার বায়না করেই যেতে থাকলো। শেষে আর না পেরে মারওয়ান নিশাতের কাছে দিয়ে বললো,
“খা যতো খুশি। আর আসিস বাবার কাছে তোকে আলু ভর্তা বানাবো।”
নাহওয়ান মায়ের কোলে ঘাপটি মেরে ছোট্ট ছোট্ট চোখ বের করে উঁকি দিয়ে বাবার দিকে চেয়ে ফিচফিচ করে হাসলো। মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে তাকালো।
ইহাব বাসায় ঢুকে বাসার পরিবেশ একেবারে থমথমে দেখলো। উর্মি ভুঁইয়াকে সোফায় বসে থাকতে দেখে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো। মায়ের পাশে বসে বললো,
“কিছু হয়েছে আম্মু?”
উর্মি ভুঁইয়া ছেলের দিকে শীতল চোখে চাইলেন। ইহাব মায়ের চাহুনি দেখে কিছুটা ভড়কালো। বললো,
“কি হয়েছে আম্মু?”
“তোমার মাহাবুব আলমের মেয়েকে বিয়ে করার রিজন কি ইহাব?”
ইহাব কেঁপে উঠলো ভিতরে। বললো,
“কোনো রিজন নেই আম্মু। তার মেয়েকে পছন্দ ব্যাস এইটুকুই।”
“কিন্তু আমি যতটুকু জানি তুমি ঐ পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারো না তাহলে হঠাৎ করে ওই পরিবারের মেয়েকে পছন্দ করার কোনো কারণ তো আমি দেখি না। আর তোমার সাথে ঐ ফ্যামিলির কি হয়েছিল যার জন্য ওদের তুমি দেখতে পারো না?”
ইহাবের চোখের কোণা লাল হয়ে গেলো। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আবার খুলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। নরম সুরে মাকে বললো,
“একটু ঝামেলা চলছিল তখন, এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। তুমি তোমার ছেলেকে অবিশ্বাস করো আম্মু?”
উর্মি ভুঁইয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন,
“অবিশ্বাস করিনা কিন্তু বিশ্বাসও পুরোপুরি করতে পারছি না। কোথাও বাঁধছে মনে হচ্ছে।”
বলেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“শোনা তোমার বাবার সাথে আমার এই বিষয়ে বিরাট ঝগড়া হয়েছে। তোমার বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছেন ওই পরিবারের মেয়েকে বউ করতে চাই শুনে। কাপ, মগ, ড্রেসিং টেবিলের আয়না সব ভেঙেছেন তিনি। এখন তুমি কিভাবে তাকে ম্যানেজ করবে বা রাজি করাবে এটা একান্তই তোমার ব্যাপার। তোমাদের বাপ, ছেলেকে যেন আমার ত্রিসীমানায়ও না দেখি।”
বলেই উপরে চলে গেলেন তিনি। ইহাব মনে মনে তার পরবর্তী পরিকল্পনা ভেবে ফেললো। বাবাকে রাজি করাতেই হবে।
মাহাবুব আলমের বাড়িতে ঢাকা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে পাত্রের মা ও তার পরিবার। মাহাবুব আলম মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে এখনই ভাবেন নি কিন্তু পাত্র পক্ষ কিভাবে যেন খোঁজ নিয়ে চলে এসেছেন। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে শুনতে ভালোই। হাইক্লাস ফ্যামিলি। কিন্তু মাহাবুব আলমের মেয়েকে অতো দূরে পাঠাতে দারুন আপত্তি। তাই পাত্রের পরিবার থেকে কিছুদিন সময় চেয়ে নিয়েছেন তিনি। এখনই বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলেননি। মেয়েকেও দেখান নি। মানহা নিজেও বাবা মাকে ছেড়ে অতদূর যেতে রাজি না। কলেজ যাওয়ার আগে মাকে বার বার বলছে,
“আমি অতদূর কিছুতেই বিয়ে করবো না। তোমরা যদি আমার বিয়ে দাও তাহলে আমি আর কোনোদিন তোমাদের এখানে আসবো না।”
বলেই হনহন করে হেঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মায়মুনা বেগম নিজেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না তাই মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন।
মানহা মন মেজাজ খারাপ করে কলেজে যাচ্ছে। পথিমধ্যে বাইক নিয়ে ইহাব তার পথ আটকে দিলো। মানহা কিছুটা ভয় পেলো। সে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে ইহাব বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১২
“শুনলাম তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে?”
মানহা কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরে ‘ফালতু লোক’ বলে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে গেলো। ইহাব তা দেখে হাসলো। বললো,
“যাও কলেজে। খুব শীগ্রই দেখা হবে আমাদের। তখন এই ফালতু লোক তোমায় মন ভরে দেখবে। তুমি হবে শুধুই আমার অধিকার। আর কারো তোমার উপর কোনো অধিকার থাকবে না। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় মানহা আফরিন। যত খুশি ছটফটিয়ে নাও। ধরা তুমি আমার খাঁচায়ই দিবে।”