ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৮
তাজরীন ফাতিহা
আজকে মানহাকে উঠিয়ে নেয়া হবে। সম্পূর্ণ ঘরোয়া আয়োজন। মারওয়ান থাকতে থাকতেই রিসিপশন করতে চান চেয়ারম্যান বাড়ির সদস্যরা। মারওয়ান গতকালও এ নিয়ে রাগারাগি করেছে। এখনই বোনকে উঠিয়ে দিতে রাজি নয় সে কিন্তু ইমতিয়াজ ভুঁইয়া তার পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ নিয়ে ইহাব ও মারওয়ানের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে। মারওয়ান বলেছে,
“আমার বোনকে কিছুতেই তোর কাছে পাঠাবো না। তোর নজর আমার বোনের উপর পড়লো কবে? তোর মতো বেয়াদব, লাফাঙ্গা, জোচ্চোরের হাতে আমি মানহাকে দিবো না মানে না।”
“আপনি দেয়া না দেয়ার কে শ্লা ব্রো? নিজে তো চার বছর ধরে দিব্যি বউয়ের সাথে সংসার করছেন সাথে আন্ডা ফ্রী আমার বুঝি বউ, বাচ্চার প্রয়োজন নেই?”
মারওয়ান রাগে প্রতিত্তর করতে পারেনি। কত বড় নির্লজ্জ হলে আবার বলে আমার বুঝি বউ, বাচ্চার প্রয়োজন নেই? মানহাকে ইহাবের হাতে তুলে না দিলে সে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে বলে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। মারওয়ান তবুও বোনকে দিতে নারাজ। পরবর্তীতে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার এক ঘেয়েমি আচরণে মাহাবুব আলম কন্যা সম্প্রদানে সম্মতি জানিয়েছেন। তাই আজকে চেয়ারম্যান বাড়ির কয়েকজন সদস্যদের আনাগোনা মারওয়ানদের বাড়িতে। মারওয়ান সকাল থেকে নিজের দরজায় খিল দিয়েছে। আজকে সারাদিনে না বেরোনোর পণ করেছে। এসব দেখে মানহা বাবাকে বলেছে,
“বড় ভাইয়ার অমতে আমি কিছুতেই ভুঁইয়া বাড়ি যাবো না বাবা। আমাকে জোর করবে না বলে দিলাম। ওনাদের ফিরে যেতে বলো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাহাবুব আলম দুই ভাইবোনের জেদের কাছে অসহায়বোধ করলেন। মানহা আজকে বাবার কথা শুনতে নারাজ। আজকে সে একপাও নড়বে না। যখন ভুঁইয়া বাড়ির লোকজন জানতে পারলো মেয়ে শশুরবাড়ি যাবে না বড় ভাইয়ের অমতে ঠিক তখনই ইহাব রেগেমেগে মারওয়ানের দরজা বারি দিতে লাগলো। নিশাত এদের এরকম যুদ্ধে খেই হারিয়ে ফেলছে। বাড়িতে এতবড় অনুষ্ঠান অথচ লোকটা তাকে নিয়ে ঘরবন্দী হয়েছে। সে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে আর তিনি নিশ্চিতে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।
এতবার দরজায় বারি পড়ায় মারওয়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। মেজাজ অত্যাধিক খারাপ করে ফোঁস করে উঠলো। জোরে বললো,
“কে রে?”
ইহাব কোনো কথা না বলে দরজা অবিরাম পিটিয়ে যাচ্ছে। নিশাত উঠে দরজা খুলতে চাইলে মারওয়ান নিশাতকে দরজা খুলতে মানা করলো। তারপর সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিলো একটা।নিজেই উঠে হামি দিয়ে চোখ কচলে দরজা খুললো। ইহাব মারওয়ানকে টেনে বের করলো। মারওয়ান ছ্যাঁত করে বললো,
“থাপড়ে তোর ত্রিশটা দাঁত ফেলে দিবো।”
ইহাব ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“ত্রিশটা কেন? দাঁত তো বত্রিশটা।”
মারওয়ান নিজের হাত ছাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে শুধালো,
“সামনের দুটো ফেলবো না দয়া করে যেন ভিক্ষা করে খেতে পারিস। ও দুটো দিয়ে সার্কাস দেখাবি গ্রামের মানুষদের। এতে তোর আয়ের উৎসও হবে আর দাঁত নেই দেখে আফসোসও হবে না।”
বলে আবার হামি দিলো। আরও ঘুমানো যেতো কিন্তু সামনে দাঁড়ানো অকেজো মাল’টার জন্য ঘুমানো হলো না। মাহদী, মাহফুজ বড় ভাইয়ের কথা শুনে ফিক করে হেঁসে দিয়েছে। ইহাব রেগে বললো,
“তোর বোনকে বল আমার সাথে যেতে নাহলে আজকে কিন্তু সেদিনের মতো খালি হাতে যাবো না। এক ইঞ্চিও নড়বো না। তোর বোন ত্যাড়ামি করে না গেলে ওর ঘরেই কিন্তু থাকবো তখন ব্যাপারটা ভালো হবে না।”
মারওয়ান ঘাড় বেঁকিয়ে বললো,
“কত বড় কলিজা তোর, আমার সামনে দাঁড়িয়ে মানহাকে নিয়ে বাজে কথা বলছিস।”
“বাজে কথা কোনটা? এক ঘরে থাকবো সেটা? তাহলে শোন আমি ওর স্বামী। এখন আমার কথাই সব। ওর উপর তোদের থেকে আমার অধিকার বেশি।”
“হ্যাঁ তো নিয়ে যা। দেখি তোর কত বড় বুকের পাটা।”
ইহাব ঘাড় ম্যাসেজ করতে করতে বললো,
“থ্রেট দিলি নাকি?”
মারওয়ান মুখের ধোঁয়া ইহাবের দিকে ছেড়ে বললো,
“তো কি চুমু দিলাম?”
“ছ্যাহ্ ওসব তোর বউ, বাচ্চাকে দিস। আমাকে দেয়ার জন্য তোর বোন আছে।”
বলেই ইহাব মারওয়ানের হাত থেকে তার আধ খাওয়া সিগারেটটা আচমকা নিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া আকাশের দিকে ছড়িয়ে বললো,
“কতদিন সিগারেট ভাগাভাগি হয় না?”
মারওয়ান লাল চোখে চেয়ে ছিল। কথাটা শুনে চোখের লালিমা ভাব কিছুটা কমে এলো। পরক্ষণেই আবার রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো। ইহাব আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে মারওয়ানের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান সিগারেট নিয়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। তারপর হেসে বললো,
“Sorry to say, আমি কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাই না।”
ইহাবের বুকে ধাক্কা লাগলো। মারওয়ানের দিকে চেয়ে মলিন হাসলো। তারপর নিজের আগের রূপে ফিরে গিয়ে বললো,
“বাদ দেই, আসল কথায় আসি। তোর বোনকে ভালোয় ভালোয় দিবি কিনা বল শ্লা?”
“তোরে আমার বা**ল দিবো। নিবি?”
ইহাব যেন মজা পেলো কথাটায়। বললো,
“দে।”
মারওয়ান রেগে ফায়ার হয়ে যাচ্ছে। এতো পরিমাণে বেহায়া জিন্দেগীতে দেখেনি সে। মুখ থেকে আরও গালি উৎরিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। গালি গুলো কণ্ঠনালীতে টোকা দিয়ে যেন বলছে, “এক্সকিউজ মি, মে আই কামিং?” মাহদী, মাহফুজ বড় ভাইয়ার মুখে গালি শুনে চারপাশে তাকালো। দেখলো দূরে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছে। মাহদী গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“ভাইয়া, মুখ খারাপ কোরো না। আশেপাশে মানুষ আছে। আব্বা শুনলে রাগ করবেন।”
মারওয়ান বহু কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করলো। তারপর ওখান থেকে সরে মানহার ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। পিছে পিছে ইহাবও যেতে লাগলো। মাহদী, মাহফুজ তার পথ আটকে বললো,
“ভাই, বোনের আলাপ আলোচনায় আপনি অ্যালাউ না।”
ইহাব কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“আমার বউয়ের কাছে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে আর আমি যাবো না? সামনে থেকে সরে দাঁড়াও শালারা। অহেতুক আমার সাথে লাগতে যেও না। তোমাদের বড় ভাইয়ের বাড়াবাড়ি, বেয়াদবি ক্ষমা করলেও তোমাদেরটা করবো না। ডিরেক্ট একশনে চলে যাবো। হাটো।”
মাহদী, মাহফুজের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। উঠোন ভরা মানুষের সামনে এতো বড় অপমান গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো যেন। কোনো কথা না বাড়িয়ে আস্তে করে সরে দাঁড়ালো। ইহাব হেঁটে মানহার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াতেই শুনলো,
“আমি লোকটাকে পছন্দ করিনা ভাইয়া। কেমন যেন নজর। আমার ভালো লাগে না।”
মারওয়ান মানহার মাথায় ঠোঁসা মেরে বললো,
“বিয়ে করার সময় মনে ছিল না তা? ঢেং ঢেং করে কবুল বলে দিয়েছিলি কেন?”
মানহা মন খারাপ করে বললো,
“আমি কি ইচ্ছে করে বলেছি। বাবাই তো বললো।”
মারওয়ান কপাল কুঁচকে বললো,
“বাবাই বললো মানে? তোর বিয়েতে সম্মতি ছিল না? সম্মতি না থাকলে এই বিয়েই তো হয়নি।”
মানহা মুখ নামিয়ে বললো,
“ছিল সম্মতি কিন্তু লোকটাকে কেন যেন দেখলেই শরীর জ্বলে।”
“তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার বলিস বাবার জন্য আবার বলিস সম্মতি ছিল। তো সম্মতি থাকলে যা শ্বশুর বাড়ি। তারা তো তোকে নিতেই এসেছে।”
“ভাইয়া;;”
“ভাইয়া বলে লাভ নেই। বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু তোকে আটকে রাখার সাধ্য নেই। আর তোর শ্বশুরবাড়ির লোকদের সাথে তো ঝামেলাও করা যাবে না। সোজা জেলে ঢুকিয়ে দিবে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। যেহেতু চেয়ারম্যান তারা।”
“এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইনা ভাইয়া। তারা এমন করছে কেন? আব্বা তো বলেছিলেন, আরও পরে ওই বাড়ি পাঠাবে তাহলে এখন কেন এতো তাড়াতাড়ি পাঠাতে চাইছে।”
বলেই ঝরঝর করে কেঁদে দিলো মানহা। মারওয়ান কিছুই বললো না। ঠিক সেই মুহূর্তে ইহাব ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই বললো,
“আমার বউকে কাঁদাচ্ছিস কেন?”
ইহাবকে দেখে মানহা ঘোমটা বড় করে দিলো। ওই লোককে তার মুখ দেখতে দিতে আপাতত ইচ্ছুক না সে। মারওয়ান আবারও রেগে গেলো। বললো,
“ভাইবোনের আলাপে তোর কি কাজ? মানার্স নেই কোনো?”
ইহাব কানের পিঠ চুলকে বললো,
“না নেই। এখন দ্রুত আমার পত্নীকে আমার হাতে তুলে দে। আমি ভালোয় ভালোয় বউ নিয়ে বিদেয় হই। আর আমার পত্নীর সাথে একটু কথা বলতে চাই। অনুগ্রহ করে আপনি কি একটু বাহিরে যাবেন শ্লা ব্রো? স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত আলাপ, আলোচনায় অন্য মানুষ থাকাটা শোভনীয় নয়।”
মারওয়ান ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। উঠে চলে যেতে চাইলে মানহা ভাইয়ের গেঞ্জির কোণা এক আঙ্গুলে টেনে ধরলো। মারওয়ান তাকালে অতঃপর ইশারায় মাথা নেড়ে তাকে একা রেখে যেতে নিষেধ করলো। ইহাব তা দেখে বললো,
“ওরে নাটক। একটু পর তো ঠিকই আমার সাথে থাকবে এখন এমন ঢং করছো কেন? তোমাকে খেয়ে ফেলবো নাকি?”
মানহা লোকটার কথায় পাত্তা না দিয়ে ভাইয়ের দিকে ছলছল নয়নে চাইলো। মারওয়ান বোনের মাথায় ভরসার হাত রাখলো। বললো,
“যাচ্ছি না। কাঁদিস না।”
কথাটুকু বলে ইহাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখন ও তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং আউট।”
ইহাব মুখ লাল করে বের হয়ে গেলো। এতো বড় অপমান। সেও এর প্রতিশোধ নেবে।
রাত আটটা। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানহা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আজকে সারাদিন মারওয়ানের সাথে তর্ক করতে করতেই চেয়ারম্যান বাড়ির লোকেরা কাহিল হয়ে গেছে। অবশেষে মাহাবুব আলমের সাথে মারওয়ানের গোপন বৈঠকে সমস্যার সমাধান হলো। মারওয়ান যদিও নারাজ তবে বোনকে আর আটকায় নি। মানহা বড় ভাই রাজি হয়েছে শুনে নামাজের বিছানায় অনেকক্ষণ কেঁদেছে। নিজের বাবার বাড়ি ছেড়ে আজকে নাকি তাকে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হবে? এতো কষ্ট কেন? একটা মেয়ের জীবন এমন কেন? কেন তাকে বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়? এতো এতো মায়ার বাঁধন ছেড়ে কিভাবে মেয়েরা পরের বাড়ি যায়? মেয়ে বলেই বোধহয় পারে।
নিশাত মানহাকে বুকে জড়িয়ে সান্তনা দিচ্ছে। নাহওয়ান ফুপির কোলে বসে আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুপি আর মাকে দেখছে। ফুপিকে কাঁদতে দেখে বাচ্চাটা ভয়ে মায়ের কোলে চলে গেলো। মায়মুনা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মেয়ের ঘরে এলেন। মেয়েকে নিশাতের বুকের উপর পরে থাকতে দেখে বুকটা তার কামড় দিয়ে উঠলো। এইতো তার নাড়িছেঁড়া ধন। সেদিন না জন্মালো? এতো বড় হয়ে গেলো কবে? মেয়েরা বুঝি এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়? সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়েটা নাকি আজকে শ্বশুরবাড়ি যাবে? তার বুকে কে যেন পাথর উঠিয়ে দিয়েছে।
মানহা মাকে দেখে আবারও কেঁদে উঠলো। মায়মুনা বেগম দ্রুত মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজেও কাঁদলেন। নিশাতের হঠাৎ চোখ ছলছল করে উঠলো। একদিন সেও তো এভাবে মায়ের বুকে পড়ে কেঁদেছে। সবাইকে ছেড়ে সেও তো শ্বশুরবাড়ি এসেছে। আজ কয়েকটা বছর বাবা, মাকে সরাসরি দেখে না সে। সংসারের এতো এতো চিন্তা, প্রেশারে ঠিকমতো পরিবারের কথা মনেও করতে পারেনা। কিন্তু দিনশেষে মা, বাবা, পরিবার পরিজনের কথা মনে করে কত বালিশ ভিজিয়েছে তা একমাত্র সে আর তার রব্বে করীম জানেন। মেয়েরা আসলেই ত্যাগী জাত। কখনো মেয়ে হয়ে ত্যাগ করে কখনো স্ত্রী হয়ে আবার কখনো মা হয়ে। মহান রব সেই জন্যই মায়ের জাতকে এতো সম্মানিত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ!
মারওয়ান ঘরে ঢুকে দেখলো মা, বোন পাল্লা দিয়ে কাদঁছে। অদূরে নিশাত আর তার একমাত্র ছাও অসহায় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“কান্নাকাটি থামান তো আম্মা। আপনি এভাবে কাঁদলে মানহা আরও বেশি কাঁদবে। ওর সামনে এভাবে কাঁদবেন না এতে ওর কষ্ট বাড়বে।”
মায়মুনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন,
“মায়ের মন তোরা বুঝবি না। সন্তানের জন্য প্রতি সেকেন্ড মায়ের মন পোড়ে।”
মারওয়ান কিছু বললো না। সে নিশাতের থেকে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহওয়ান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“বাবা?”
“বল পান্ডা।”
“পুপি, ডাডুমুনি কাডে।”
“কাঁদুক। তুই না কাঁদলেই হলো।”
নাহওয়ান বাবার মুখ ধরে বললো,
“কান্না পাচ্চে।”
“কেন?”
“চবাই কাডে তাই।”
“তুই কাঁদলে তোকে চটকে খেয়ে ফেলবো মনে রাখিস।”
“ইননা।”
“হ্যাঁ।”
“ডাডু মাব্বে।”
“ভয় দেখাচ্ছিস কাকে? তোর দাদাকে আমি ভয় পাই না।”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেঁসে বললো,
“বয় নাই?”
“না।”
“আচ্চা।”
বলে বাবার ঘাড়ে মাথা ফেলে চোখ বুঝলো।
মেয়েকে বিদায় দিতে মাহাবুব আলমের বুক ফেটে যাচ্ছে। মানহা বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদলো। মাহবুব আলম শক্ত হয়ে ছিলেন। তার কলিজাটা কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে আজ। মাহদী, মাহফুজ বোনকে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে। সব চেয়ে কষ্টের মুহূর্ত ছিল মানহা যখন দুই ভাইকে বললো,
“যাই ভাইয়া, তোদের আর কেউ জ্বালাবে না। কেউ আর সকালে ফজরের নামাজ পড়তে ডাকবে না। মসজিদে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবি, মেসওয়াক, জুতো, আতর এগিয়ে দেবে না। কল চেপে দেবে না। খেতে ইচ্ছে না করলে কেউ আবদার করবে না মেঝো ভাইয়া একটু খাইয়ে দে তো। বলবে না সেঝো ভাইয়া ফুচকা নিয়ে বাসায় না আসলে ঘরে ঢুকতে দেবো না। কেউ আর তোদের শার্টে আঁকাবুকি করবে না। তোরা খুশি হয়েছিস তো? তোদের অনেক জ্বালিয়েছি।”
মাহদী, মাহফুজের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝড়ছে। বোনকে বুকে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করলো তিন ভাই। মারওয়ান না কাঁদলেও বোনকে বিদায় দিতে গিয়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। সকলকে কাঁদিয়ে মানহাকে নিয়ে চেয়ারম্যানদের গাড়িটি সাঁই করে চলে গেলো। নাহওয়ান দাদার কোলে। এতক্ষণ কিছু না বুঝলেও ফুপিকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতে দেখে চিৎকার করে কেঁদে দিলো সে। মাহাবুব আলম নাতিকে আদর করতে করতে কান্না থামাতে চাইলেন কিন্তু বাচ্চাটা কান্না আরও বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“ওই কবুতরের ছাও কান্দিস কেন?”
“পুপিকে নি চলি গেচে।”
“তো কি রেখে যাবে।”
“হুম।”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৭
মারওয়ান ছেলের কান্নামাখা চেহারার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উদাস দৃষ্টিতে বললো,
“তুই বড় হলি না কেন ফাইয়াজ? তাহলে আমরা দুজন মিলে তোর ফুপিকে আজ রেখে দিতাম।”
নাহওয়ান বাবার কথা না বুঝলেও মাথা নাড়ালো।