ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৫

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৫
তাজরীন ফাতিহা

বিকেল নাগাদ নিশাত তেলের বোতল হাতে নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে ঘরে আসলো। আজ সকালে তার মাথায় একগাদা তেল দিয়ে দিয়েছে তার মা রাবেয়া খাতুন। পুরো মাথা তেল চিটচিটে হয়ে আছে। মায়েরা তেল দিতে গেলে এরকম জবজবে করেই দেয়। নিশাতের চুল দ্বিগুণ থেকে এখন আধাগুনে নেমেছে। আগামীকাল শ্যাম্পু করে ফেলবে। তাই ভাবলো ছেলের মাথাও কিছুটা তেল দিয়ে নিক। তেল দিয়ে শ্যাম্পু করলে চুল সিল্কি সিল্কি দেখায়। ধরলে রেশমের মতো কোমল, ঝরঝরে লাগে। যেই ভাবা সেই কাজ। বিছানায় বসে ছেলেকে সামনে বসিয়ে যত্ন নিয়ে তেল দিয়ে দিচ্ছে। এরমধ্যেই মারওয়ান ঘরে ঢুকে ছেলেকে তেল দিয়ে দিতে দেখে বললো,

“ইয়া মাবুদ আমার ছাওয়ের মাথায় এসব কি ছাইপাশ দেয়া হচ্ছে?”
নিশাত তেল দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বললো,
“ছাইপাশ না তেল দেয়া হচ্ছে।”
“ছেলেরা চুলে তেল দেয় বাপের জন্মে শুনিনি। তেল দিলে মেয়েদেরই বিশ্রী লাগে আর ছেলেদের কথা নাইবা বললাম। লিটারেলি মুরগি মুরগি লাগে।”
“আপনার আজাইরা কথা শেষ হলে ঘর থেকে যান।”
নাহওয়ান মা, বাবার কথা কাটাকাটি দেখছে। মাথায় হাত দিয়ে বাবার দিকে চাইলো। মারওয়ান ছেলেকে ইশারায় ডাকলো। নাহওয়ান হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে নিলে নিশাত আটকে ধরলো। বললো,
“কোথায় যাচ্ছো? তেল দেয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এক ইঞ্চি নড়বে না। দুপুরে নানার লুঙ্গি চুরি করেছিলে কিচ্ছু বলিনি এখন কথা না শুনলে মাইর চলবে।”
নাহওয়ান মায়ের কথা শুনে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বাবার দিকে চাইলো। মারওয়ান ছেলেকে কাঁদতে দেখে রেগে গেলো। জোরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ওই আমার ছেলেকে ছাড়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিক দিয়ে তেলের বোতল বাইরে ফেলবো। আমার এতোটুকু ছাওকে তেল দিয়ে আরও এট্টুক বানিয়ে ফেলছে। ছাওটাকে কোনোমতেই বড় হতে দিচ্ছে না। সব এই লিলিপুট পরিবারের ষড়যন্ত্র।”
মারওয়ানের কথার আওয়াজ নাসির উদ্দিনের কান পর্যন্ত গিয়েছে। তিনি হনহন করে ঘরে এসে নিশাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“নিশাত তেলের বোতল দে তো।”
নিশাত অবাক হয়ে বাবার পানে তাকালো। নাসির উদ্দিন আবারও একই কথা বললেন। নিশাত তেলের বোতল বাবার হাতে দিলো। নাসির উদ্দিন মারওয়ানের এক হাত বগলদাবা করে নিশাতকে বললো,
“ওকে ঐপাশ থেকে টাইট করে ধর।”
নিশাত বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। মারওয়ানকে ওপাশ থেকে শক্ত করে ধরলো। মারওয়ান চিৎকার করে বললো,

“কি করতে চাইছেন আপনি? পুরুষ হয়ে একটা ছেলের বয়সী পুরুষকে এরকম চেপে ধরছেন কেন? লজ্জা নেই আপনার? শ্বশুরবাড়ি এসেছি কি নির্যাতিত হতে?
নাসির উদ্দিন কোনো কথা না বলে বোতল উবু করে মারওয়ানের মাথায় তেল ঢালতে লাগলো। মারওয়ান বোবা হয়ে গেলো। সম্বিত ফিরে এলে চেঁচিয়ে বললো,
“আমার চুল!”
তেল মাথায় ভালোভাবে ডলে নাসির উদ্দিন বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে গেলেন। মারওয়ানের কোকড়া কোকড়া চুল এখনো কয়েকটা খাড়া হয়ে আছে। নিশাত মারওয়ানের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে দিলো। নাহওয়ানও বাবার দিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে হাসতে লাগলো। মারওয়ান কিড়মিড় করতে করতে বললো,
“তোমাদের নামে আমি পুরুষ নির্যাতনের মামলা করবো। আমাকে একা পেয়ে চেপে ধরে ধরেছো, টর্চার করছো? এর শোধ আমি তুলবো।”
নিশাত হাসতে হাসতে মারওনাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। মারওয়ান আয়নায় নিজের বলদ বলদ চেহারার দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
“এই আবুল আমি না। ইয়াক কেমন চোর চোর লাগছে। ছিঃ!”
নিশাত পিছন থেকে বললো,
“শুধু চোর না একেবারে তেলাচোরার মতো লাগছে।”
বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। মারওয়ান খিটমিট করতে করতে বিছনায় চাইলো। দেখলো নাহওয়ান ফোকলা হেঁসে চেয়ে আছে তার দিকে। মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে হাত উঠিয়ে মাইর বোঝালো।

সন্ধ্যা একটু আগেই নেমেছে। তেলের ঘটনার পর মারওয়ান আর ঘর থেকেই বেরোয়নি। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে নিশাত চটপটি বাটিতে বাটিতে বেড়ে নিচ্ছে। পাশে রাবেয়া খাতুন শসা, পিঁয়াজ কুচি, সেদ্ধ আলু, ডিম এনে রাখলো। নিশাত এক এক করে প্রত্যেক বাটিতে ফুচকা ভেঙে দিলো। তারপর সব উপাদান দিয়ে চটপটি তৈরি করে ফেললো। বিয়ের আগে চটপটি সপ্তাহে একদিন বানিয়ে না খেলে নিশাতের পেটের ভাত হজম হতো না। বিয়ের পর সবকিছুই পরিবর্তন হয়েছে। শখ, আহ্লাদ বলতে কিছুই ছিল না তার। এখন বাবার বাড়ি এসে মায়ের উদ্যোগে আবারও সেই পুরোনো দিনে ফিরে পেয়েছে যেন। চটপটির সুঘ্রাণে নিশাতের জিভে পানি এসে গেছে।
নিশাত সব বাটি ট্রেতে করে সাজিয়ে রেখে বসার ঘরের টেবিলে রাখলো। রাবেয়া খাতুন স্বামী নাসির উদ্দিনকে ডেকে এনে বসালেন। সবাই একসাথে খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা। নাসির উদ্দিন দেখেই বললেন,

“আরে তোর চটপটি খাওয়ার স্বভাব এখনো যায়নি? তোর হাতের চটপটি ভীষণ মিস করেছি এতো বছর। আজকে মজা করে খাবো আমার মায়ের হাতের রান্না।”
নিশাত বাবার কথা শুনে হেঁসে বললো,
“তোমার বাচ্চামি এখনো গেলো না বাবা?”
নাসির উদ্দিন ইতোমধ্যেই দুই চামচ পেটে গলধঃকরণ করে বললেন,
“মায়ের রান্না খেলে সব বাচ্চাই বাচ্চামি করবে স্বাভাবিক।”
নিশাত হেঁসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। নাসির উদ্দিন মেয়ের মুখের সামনে এক চামচ ধরলেন। নিশাত মুখে নিলো। তিনি বললেন,
“গুষ্ঠির শত্রুটা কই?”

“ঘরেই আছে। আমি ডেকে আনি। তোমাকে দেখলে আসবে না মনে হয়। দাঁড়াও বলে আসি।”
নিশাত কথাটুকু বলে নিজের রুমে গিয়ে দেখলো মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে খেলছে। নিশাত ঘরে ঢুকে বললো,
“এই বসার ঘরে চলুন। নাস্তা দেয়া হয়েছে আসুন।”
মারওয়ান ছেলেকে কোলের মধ্যে ঢুকিয়ে বললো,
“তোমার ঐ জালিম বাপ থাকলে আমি যাবো না। আমাকে রীতিমত অপমান করছেন উনি। মুরুব্বী আর শ্বশুর না হলে উড়িয়ে ফেলতাম আজ। আমাকে জোকার বানিয়ে ছেড়েছে। সবাই দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে হেসেছে। সব দেখেছি আমি। এতবড় অপমান হওয়ার পর এই বাড়িতে থাকার প্রশ্নই আসেনা। কালকেই চলে যাবো। আজকেই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু যায়নি কারণ তোমার জালিম বাপ ভাবতে পারে আমি তার ভয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়েছি। তাকে বলে দিও আমি ভীতু নই। এমনিতেও জামাইয়ের খাতির, যত্ন করতে পারেনা এই পরিবার।”
নিশাতের এতো হাসি পেলো বলার বাইরে। শ্বশুরের ভয়ে বসার ঘরেই যাচ্ছে না আর এখানে বসে বসে ডায়লগ দিচ্ছে আমি ভীতু নই। কোনোমতে হাসি চেপে বললো,

“ভয় না পেলে বসার ঘরে যাচ্ছেন না কেন?”
মারওয়ান ফুঁসে উঠলো। কত বড় সাহস তাকে ভীতু ইঙ্গিত দিলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে শ্বশুরের বিপরীত চেয়ারে থমথমে মুখে বসলো। নাসির উদ্দিন জামাইকে আড়চোখে দেখলেন। মারওয়ানও আড়চোখে দেখলো। দুজনের কেউই কথা বললো না। নিশাত হালিমের বাটি হাতে ঘরে ঢুকলো। তারপর মারওয়ানের হাতে দিলো। নাসির উদ্দিন ভ্রু কুঁচকালেন। বললেন,
“হালিমও রেঁধেছিস নাকি?”
নিশাত বললো,
“হ্যাঁ তোমার জামাই চটপটি খায়না। তাই তার জন্য আলাদা করে হালিম রাঁধতে হয়েছে। তোমার নাতিরও পছন্দ।”
নাসির উদ্দিন চটপটি খেতে খেতে বিড়বিড় করে বললেন,
“ওরে সিরাজউদ্দৌলার বংশধর! এক টাকা কামানোর মুরোদ নাই কিন্তু খাবার বাছাইয়ের কমতি নাই।”
মারওয়ান শ্বশুরকে বিড়বিড় করতে দেখে বুঝলো তাকেই গালি দিচ্ছে এই বুড়ো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সে আর নাহওয়ান হালিম খেলো। হালিম খাওয়া শেষ করে মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে নাসির উদ্দিন মেয়েকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,

“বুঝলি নিশাত মাহবুবের বেটাকে আমাদের পরিবারের বানিয়ে দিলাম আজ। এসেই বহুত ফটরফটর শুরু করেছিল এখন একটু ঠাণ্ডা করে দিলাম। তেল দেয়াতে মাসুম মাসুম লাগছে বাপ, বেটাকে কি বলিস?”
নিশাত হাসতে লাগলো। বাবাকে হাত উঁচিয়ে বললো,
“একদম।”
বলেই ফাঁকা বাটিগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রাবেয়া খাতুন দুই বাপ, মেয়ের কাণ্ড দেখে বললেন,
“আপনি কি শুরু করেছেন বলুন তো? ছেলেটা এমনিতেই আমাদের বাড়িতে আসেনা এরকম করলে আর আসবে? শত হলেও মেয়ের জামাই। যেমনই হোক যত্নআত্তি, অ্যাপায়নে ত্রুটি রাখা উচিত না কিন্তু আপনি আর আপনার মেয়ে ছেলেটাকে অপমান করছেন। এগুলো কেমন কথা?”
নাসির উদ্দিন হালিম চটপটি শেষ করে হালিম খেতে খেতে বললেন,

“ওর মান আছে যে অপমান করবো? আমার মেয়েটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে গত চার বছর। ওকেও একটু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করি। দেখুক কেমন লাগে জ্বলতে, পুড়তে। মেয়ে আমার ফেলনা নাকি? কত যত্ন করে ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আর সেই মেয়েকে দিয়ে ও রোজগার করিয়ে পায়ের উপর পা তুলে খায়। এসব বাবা হয়ে মোটেও বরদাস্ত করবো না আমি। ওকে যদি ঘোল না খাইয়ে ছেড়েছি আমার নামও নাসির উদ্দিন না।”
রাবেয়া খাতুন হতাশ হলেন। ছেলে, বুড়ো সবাই যদি পাগলামি করে তাহলে কিভাবে হবে?

মানহা টেবিলে বসে বই পড়ছে। ইহাব কালকে তার জন্য বই কিনে এনেছে। তার সেমিস্টার ফাইনাল একমাস পর। পড়ালেখা তার তেমন ভালো লাগেনা।পড়তে বসলেই ঘুম ধরে। আজকেও ব্যতিক্রম নয়। বই খুলে আছে ঠিকই কিন্তু কোনো মনোযোগ নেই তাতে। ইহাব আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলো। রুমে ঢুকে দেখলো থ্রিপিস পড়ুয়া ছোটখাটো গড়নের একটি নারী তার স্টাডি টেবিলে বই খুলে বসে আছে। তবে বইয়ে যে ধ্যান নেই বুঝলো সে। জামাকাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এসে মানহার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। মানহা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। ইহাব বললো,
“কোনটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে বলো?”
মানহা ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“আপনি কি মানবিক বিভাগের? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আপনি কি বুঝবেন?”
ইহাব রহস্যময় হেঁসে বললো,
“মানবিক বিভাগের না হই কিন্তু তোমার চেয়ে আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর ভালোই দক্ষতা আছে।”
মানহা বেশ অবাক হলো। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে না পড়েই কিভাবে দক্ষতা থাকতে পারে? মানহার সামনে তুড়ি বাজিয়ে তার ধ্যান ভঙ্গ করলো ইহাব। মানহা হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ইহাব কিছুই বুঝলো না। অমন তাড়াহুড়ো করে কোথায় গেলো মানহা?
একটু পর একটা প্লেট হাতে ঘরে ঢুকলো সে। প্লেটটা টেবিলে রেখে ইহাবকে বললো,
“নিন খান।”

ইহাব তাকিয়ে দেখলো নাগেটস্ আর সসেজ ফ্রাই। সে একটা মুখে পুড়লো। নাগেটস্ আর সসেজের টেস্টটা ভিন্ন লাগছে আজকে। মানহা উৎসুক নয়নে ইহাবের দিকে চেয়ে আছে। ইহাব সবগুলো খেয়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছলো। মানহা তার খাওয়া শেষেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কিছু শোনার আশায় কিন্তু ইহাব কিছুই বললো না। তার মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেলো। শ্বশুরবাড়িতে আজই প্রথম নাস্তা বানিয়েছে সে। শাশুড়ি বাদে কেউই প্রশংসা করলো না ব্যাপারটা তার মনে খুবই আঘাত করলো। সে চুপচাপ খালি প্লেট হাতে বেরিয়ে গেলো।
উর্মি ভুঁইয়া স্বামীর জন্য চা নিয়ে রুমে যাচ্ছিলেন। মানহাকে মন খারাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে বললেন,
“কি হয়েছে?”
মানহা একটু হেঁসে বললো,
“কিছু না আম্মু।”
“ইহাব কিছু বলেছে নাকি?”
“জ্বি না।”
উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“আচ্ছা যাও।”
মানহা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। উর্মি ভুঁইয়া সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে নিজেদের রুমে চলে এলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গ্রামের একটা রাস্তার কাজ ধরেছেন। সেটারই কাগজ পত্র ঘাটছিলেন মনোযোগ দিয়ে। উর্মি ভুঁইয়া চায়ের কাপ স্বামীর হাতে দিলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,

“তুমি খাবে না?”
“উহু, এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আর কিছু না বলে চা খেতে লাগলেন। উর্মি ভুঁইয়া বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন,
“গ্রামে যে কয়েকমাস আগে খুন হয়েছিল এটার মেইন কালপ্রিটের বিচার হয়েছিল?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,
“ওই কেস তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে।”
উর্মি ভুঁইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“বন্ধ হলো কেন? দুজোড়া মার্ডার রেপ কেস কীকরে বন্ধ হতে পারে?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চা অর্ধেক খেয়ে স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“সবই টাকার খেল। হয়তবা যারা খুন করেছে তারা প্রশাসনের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এদেশে এসব অস্বাভাবিক তো না।”

উর্মি ভুঁইয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
“তাই বলে ধর্ষণ হয়ে মারা যাওয়া লাশ চারটার কোনো বিচার হবে না?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া অনেকক্ষণ পর বললেন,
“এ দেশে লাশের বিচার কবেই বা হয়েছে? জীবিতদের বিচারই হয় না আর লাশের বিচার হওয়া তো বিলাসিতা।”
“আপনি না চেয়ারম্যান। দেখুন কোনোভাবে কেসটা আবার রিওপেন করা যায় কিনা।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর কথার বিপরীতে কিছু বললেন না।

মানহা টেবিলে বসে বইয়ের ভাঁজে খুলে দেখলো হাজার টাকার দুটো নোট রাখা। সে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ঘাড় ঘুরিয়ে ইহাবের দিকে তাকিয়ে দেখলো ল্যাপটপে টাইপিং করছে সে। মানহা টাকাটা হাতে নিয়ে ইহাবের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“এটা কিসের টাকা?”
ইহাব টাইপিং করতে করতেই বললো,
“নাস্তা খাওয়ালে তার বখশিস।”
মানহা গম্ভীর মুখে টাকাটা ইহাবের কোলে রেখে বললো,
“আমি কোনো ওয়েটার নই যে আমাকে বখশিস দিতে হবে।”
ইহাব অবাক হয়ে বললো,
“ওয়েটার হতে যাবে কেন?”

“একজন ওয়েটারকে যেমন খাওয়া শেষে বখশিস দেয়া হয় ঠিক তেমনই আপনি জাস্ট টাকা রেখে ফর্মালিটি পূরণ করেছেন। এটা আমাকে বেশ অপমানিত করেছে। বাবার বাড়িতে থাকতে বিকেল বা সন্ধ্যে হলেই নানা রকম আইটেম বানিয়ে পরিবারের লোককে খাওয়াতাম সেই প্রেক্ষিতে পরিবারের একটু প্রশংসা বাক্য আমার মনে আনন্দের ঝড় বইয়ে দিতো কিন্তু আপনাদের পরিবারে আম্মু বাদে সবাই অনুভূতিহীন। যেন একটু প্রশংসা করলে আপনাদের বংশে দাগ লেগে যাবে। আর শুনুন টাকা দিলেই সবাই খুশি হয়না। খুশি করতে একটু মিষ্টি বাক্যই যথেষ্ট।”
বলেই মানহা পড়ার টেবিলে গিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো। ইহাবের মনে হলো আসলেই কাজটা ঠিক হয়নি। এভাবে কিছু না বলে টাকা রেখে আসা আসলেই অপমান। বেচারি তো যত্ন নিয়ে খাবারটা বানিয়েছে তাদের জন্য অথচ সে ভেবেছে শুধু টাকা দিলেই খুশি হবে।

মানহা এশার নামাজ পড়ে দোয়া, দুরুদ পড়ে উঠলো। আজকে খিদে লাগছে না তার। সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। নামাজ শেষে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মাথাটাও ব্যথা করছে। ইহাব কয়েকবার ভাত খেতে সাধলেও মানহা ওঠেনি। অগত্যা ইহাব ঘরেই তার খাবার নিয়ে আসলো। মানহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,
“ভাত না খেলে তোমার ভাই বলবে তোমাকে না খাইয়ে অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছি। পরে আমাকে ব্লেম দেবে শ্রদ্ধেয় শ্লা ব্রো। এমনিতেই আমাকে দেখলে সিংহের মতো তর্জন গর্জন শুরু করে এখন যদি শোনে তার বোনকে ভাত না খাইয়ে রেখেছি তাহলে বাঘের মতো থাবা দিয়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলবে। নিজের স্বামীকে ছেঁড়াবেড়া দেখতে না চাইলে দ্রুত ভাতটা খেয়ে নাও।”
‘ছিঁড়ে ফেলবে’ কথাটা শুনে মানহার গম্ভীর মুডেও হাসি পেয়ে গেলো। মানহা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে অর্ধেকেরও কম ভাত খেলো বাকিটুকু ছুঁয়েও দেখলো না। প্লেটেই রেখে দিলো। তারপর মুখ ধুয়ে আবার কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ইহাব আর নিচে গেলো না। মানহার প্লেটেই খেতে বসলো। বাকি ভাতটুকু খেয়ে প্লেট রেখে এসে নিজেও শুয়ে পড়লো।

ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের হেডের রুমে তিনজন গম্ভীর মুখে বসে আছে। হেড তিনজনকেই ডেকে পাঠিয়েছেন আজ। অনেকক্ষণ একটা ফাইল ঘেঁটে হেড তিনজনকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,
“জিনান আদহাম, নেওয়াজ শাবীর আর মুনতাজির জায়েদ তোমাদের তিন জনকে কিছু তথ্য জোগাড় করতে হবে। এবারের মিশনটা রাফ এন্ড টাফ হতে পারে। তোমাদের আন্ডারের সবাইকে এবিষয়ে জানিয়ে দিবে। উপর থেকে অর্ডার এসেছে খুবই গোপনে প্রত্যেকটা ডেটা কালেক্ট করবে। তোমরা তিনজন আমার বিশ্বাসভাজন। আশা করি তিনজনই সফল হবে। তিনজনের কাজ ভিন্ন ভিন্ন ধারায় এগোবে। মনে রাখবে কোনোভাবেই কেউ যেন সন্দেহ না করে। তোমাদের এর বেশি ইন্সট্রাকশন দিতে হবে না আশা করি।”
জিনান পেপার ওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“কিন্তু এই ডেটা সংগ্রহ তো অন্য গ্রুপের করার কথা। আমাদের তো অলরেডি হাতে একটা কাজ আছেই। দুটো দায়িত্ব আমাদের হাতে দেয়াটা রিস্ক এন্ড হার্ড হয়ে গেলো না?”
হেড মুচকি হেঁসে বললো,

“এজন্যই তো তিনজনকে ভাগ ভাগ করে কাজ দেয়া হয়েছে। তবে তোমাদের জন্য সুখবর আছে।”
নেওয়াজ শাবীর ভ্রু বাকিয়ে বললো,
“কেমন সুখবর স্যার?”
হেড টেবিলে হাত দুটো রেখে বললেন,
“এটা জায়েদ বলবে।”
জিনান আদহাম ও নেওয়াজ শাবীর উভয়ই মুনতাজির জায়েদের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলো। মুনতাজির গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“আমাদের সাথে আরেকজন যুক্ত হবেন এই মিশনে। তার ফাইটিং স্কিল মারাত্মক এবং বিধ্বংসী ইন্টিলিজেন্ট এজেন্ট। খুব শীগ্রই সে আমাদের সাথে অ্যাটেন্ড হবেন। সে আগে অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছে। মাঝখানে সে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছিল। সাসপেন্ড শেষে আবারও ব্যাক করেছেন তিনি।”
জিনান আদহামের নীল চক্ষু জ্বলজ্বল করে উঠলো। নেওয়াজ শাবীর অবাক হয়ে শুধালো,

“সাসপেন্ড হয়েছিল কেন?”
“কোনো এক অভিযোগ তার উপর আরোপিত হয়েছিল। যদিও শোনা যায় ওই অভিযোগ তাকে ফাঁসাতে করা হয়েছিল। তার ট্যালেন্টের জন্য তিনি আবারও ব্যাক করতে পারছেন নাহলে আজীবনের জন্য সাসপেন্ড করে দেয়া হতো। তার স্কিল দেখে IMF (Impossible Mission Force) ডিপার্টমেন্ট এই সিদ্ধান্ত নেন নি।”
জিনান পেপার ওয়েট মুঠ করে ধরে বললো,
“ইন্ট্রেসটিং!”
নেওয়াজ নড়েচড়ে বসে বললো,
“আপনি তার সম্পর্কে এতো তথ্য জানেন কিভাবে?”
“কারণ তার সাথে আমার একটা মিশনে কাজ করতে হয়েছিল।”
নেওয়াজ বললো,
“আচ্ছা। আমরা তাকে অবশ্যই সম্মানের সহিত গ্রহণ করবো। তার নামটা কি?”
মুনতাজির গম্ভীর স্বরে বললো,
“Azarak Cipher.”
জিনান ও নেওয়াজ দুজনেই চমকে গেলো। নেওয়াজ বললো,

“উনি কি বিদেশী?”
“No.”
“তবে নাম এমন রহস্যময় বিদেশীদের মতো কেন? আজারাক সাইফার।”
“এটাও একটা রহস্য হয়তবা।”
বলেই মুনতাজির জায়েদ থামলো। ডিপার্টমেন্টের হেড এবার মুখ খুললেন,
“তো বয়েজ তোমরা তোমাদের কাজে লেগে পড় তাহলে। অবশ্যই সাবধানে করবে সবকিছু। আজারাক সাইফার দ্রুতই জয়েন হয়ে যাবে তোমাদের সাথে। তোমাদের টেবিলে ফাইল চলে গিয়েছে। সব তথ্য ভালোভাবে পড়ে নিবে। এবার যাও।”
তিনজনই উঠে দাঁড়ালো। মুনতাজির জায়েদ ও নেওয়াজ শাবীর বেরিয়ে গেলেও জিনান দাঁড়িয়ে রইলো। হেড তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
“কিছু বলবে আদহাম?”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৪

জিনান তার হাতের ফাইল হেডের দিকে বাড়িয়ে বললো,
“স্যার এই ফাইলে কিছু সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ আছে। আমার পরবর্তী টার্গেট এরা। আপনার মতামত কি?”
“আগাতে পারো তবে যে মিশনটা দেয়া হয়েছে ওটার দিকে ফোকাস বেশি দিতে হবে মনে রেখো? তাই এসব কাজ দ্রুত সমাধান করে ফেলো তিনজনে মিলে। বেস্ট অফ লাক।”
“ওকে স্যার।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে নীল চক্ষুদ্বয় রহস্যময় করে বাঁকা হেঁসে মনে মনে বললো,
“ইন্ট্রেসটিং ক্যারেক্টার। আয়েম ওয়েটিং।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৬