ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৭
তাজরীন ফাতিহা
নিশাত মাগরিবের নামাজের পর উঠোনে খোলা আকাশের নিচে মাটির চুলোয় কাচ্চি রান্নার আয়োজন করছে। তার সাথে সাহায্য করছে রাবেয়া খাতুন আর ছোট বোন নাজিয়া। রাবেয়া খাতুন অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“এতো রাতে কাচ্চি রান্নার কি দরকার? পাতিল ভরা গোশত রান্না আছে সেগুলো তো থেকে যাবে তার চেয়ে বরং আগামীকাল রাঁধবো নে।”
উত্তরে নিশাত বলেছে,
“তোমাদের জামাইয়ের খেতে ইচ্ছে করেছে এখন যদি না খাওয়াই বলবে তোমাদের পরিবার জামাই আদর করতে পারেনা। জানোই তো কেমন সে আর তার স্বভাব।”
নিশাতের কথা শুনে রাবেয়া খাতুন আর কিছু বলেননি। শত হলেও জামাইয়ের অ্যাপায়নে ত্রুটি রাখা যাবে না। নিশাত বিকেলের দিকে নাসির উদ্দিনকে দেড় কেজির মতো খাসির গোশত আনতে বলেছিল সাথে কাঁচা পেঁপে আর কাচ্চির মশলা। নাসির উদ্দিন মেয়ের কথা অনুযায়ী দেড় কেজির বদলে তিন কেজি খাসির গোশত সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি এনে দিয়েছেন। তার ধারণা মেয়ের খেতে ইচ্ছে করছে তাই বেশি করেই এনেছেন। নাতিটাও খাবে। এই কয়দিনে বুঝেছেন তার নাতি গোশত খুব পছন্দ করে।
নিশাত বিকেলেই গোশত মেরিনেট করে রেখে দিয়েছিল এখন শুধু রান্নাটা বাকি। মারওয়ান সেই বিকেলে কোথায় যেন বেরিয়েছে এখনো আসার নাম গন্ধ নেই। নিশাত বেশি মাথা ঘামায়নি। এই লোক কোথায় যায়, কোথা থেকে আসে তাকে কিছুই জানায় না। এটা আর নতুন কি? এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। নাহওয়ান খালামনির কোলে বসে মায়ের রান্না দেখছে। নাজিয়া ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে টুপটাপ আদর করছে আর চিপস খাচ্ছে। নাহওয়ানের হাতেও চিপস, চকলেট। নাহওয়ান মাথা ঘুরিয়ে খালামনির দিকে তাকিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মুনি?”
নাজিয়া এই আদুরে ডাক শুনে ভাগ্নের গালে আবারও টপাটপ চুমু বসিয়ে বললো,
“জ্বি আব্বা বলেন।”
নাহওয়ান মেরিনেট করা খাসির গোশতের দিকে আঙুল তুলে বললো,
“ইট্টু গুস্ত কাবো।”
নাজিয়া হাসতে হাসতে বললো,
“কাঁচা গোশত খাবেন?”
“কাচা গুস্ত কি?”
“যেটা রান্না হয়নি সেটাকেই কাঁচা গোশত বলে।”
নাহওয়ান কান চুলকে বললো,
“কাবো।”
নাজিয়া হাসতে হাসতে ভাগ্নের ফুলো ফুলো গালে চুমু খেতেই থাকলো। নাহওয়ান খালামণিকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো কয়েকবার কিন্তু পারলো না। পরে না পারতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। নিশাত মাটির চুলোয় লাকড়ি ঠেলে পেঁয়াজ বেরেস্তা করছিল এর মধ্যে ছেলের কান্নার শব্দে সেদিকে তাকালো। বললো,
“কি হয়েছে?”
নাহওয়ান মায়ের কণ্ঠ শুনে হাত বাড়িয়ে বললো,
“মা কুলে কুলে।”
“এখন না আব্বা, মা রান্না করছি না? মনির কোলে বসেন। রান্না শেষ হলে নিবো।”
নাহওয়ান মায়ের কথা শুনে কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। নাজিয়ার ঠোঁট তার গাল থেকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
“মা চুমায়। উফফু দূর হ।”
নাজিয়া এবার হাসতে হাসতে মরেই যাবে মনে হয়। এত্তো কিউট কেন হবে একটা বাচ্চা? মাশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা তার বোনকে একটা জাদুর বাক্স দিয়েছেন। যার চেহারার দিকে তাকালে, কথা শুনলে মনটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। মনে চায় সারাক্ষণ কেবল বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে নাহলে সারাদিন কণ্ঠে চড়ুই পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দ শুনতে। মাশাআল্লাহ নজর না লাগুক। বড় আপু মনে হয় এই জাদুর বাক্সের জন্যই সংসারটা ছেড়ে আসতে পারেনি। নাজিয়া ভাগ্নের গালে ঠোঁট চেপেই রাখলো। নাহওয়ান শেষে পরাজিত ভঙ্গিতে চিপস খেতে লাগলো। সে বুঝে গেছে এই চুম্বকের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে কেউ আসবে না তাই কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে চিপস খাচ্ছে ওদিকে নাজিয়া এখনো গালে ঠোঁট চেপে আছে।
এরমধ্যে মারওয়ানকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখা গেলো। উঠোনে এতো আয়োজন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সে। নাহওয়ান বাবাকে দেখে একেবারে ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে শুরু করলো। ছেলের কান্না শুনে মারওয়ানের ভাবনার ছেদ ঘটলো। নাজিয়া দুলাভাইকে দেখে নাহওয়ানকে ছেড়ে দিলো। নাহওয়ান ছোট্ট শরীরটা নিয়ে দৌঁড়ে আসতে আসতে ডাকতে লাগলো,
“বাবা, বাবা কুলে কুলে।”
মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিলো। নাহওয়ান শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছে। ছেলেকে নিয়ে আবারও বাইরে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে পান্ডা হাতে তো চিপস, চকলেট সবই আছে তাহলে বাবা বাবা করে দৌঁড় মারলি কেন? কি খাবি আবার?”
নাহওয়ান গলা জড়িয়েই বললো,
“কিচু কাবো না।”
“তাহলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসেছিস কেন?”
নাহওয়ান গাল দেখিয়ে বললো,
“মুনি কালি চুমায়। তুতু লাগিয়ে ডিচে। সব্বনাচ কলে ফেলচে।”
কপালে হাত দিয়ে বারি দিয়ে আবারও কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা। মারওয়ান ছেলের কান্না থামাতে বললো,
“থাক আর কেঁদে কি হবে। যা সর্বনাশ করার তা তো করেই ফেলেছে। বুঝলি এই বাড়ির সব কটার মৃগী ব্যারাম (রোগ) আছে। একজন খেউ খেউ করে, একজন চুমায় আরেকজন তামশা দেখে। আমাদের বাপ, বেটার জন্য এই মৃগী বাড়ি না।”
নাহওয়ান বাবার কথা শুনে কান্না থামিয়ে বললো,
“মিগি বারি ককোনো আচবো না।”
তারপর চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে চিপস খেতে লাগলো। মারওয়ান ছেলের কথা শুনে মাথা নাড়ালো। অতঃপর বললো,
“একা একা খাচ্ছিস কেন? আমার মুখেও দে।”
নাহওয়ান প্যাকেট থেকে দুটো চিপস বের করে বাবার মুখে দিলো। মারওয়ান চিবুতে চিবুতে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির সামনে বেশ কিছুদূর হাঁটলো। তারপর ছেলেকে ঠান্ডা করে বাড়িতে ঢুকলো। এসে দেখলো নিশাত উঠোনে একাই আছে। শাশুড়ি, শালী কেউ নেই। হয়তবা কোনো কাজে গিয়েছে। নাহওয়ান মাকে দেখেই লাফ দিয়ে উঠে বললো,
“বাবা, মা উকানে।”
মারওয়ান আশপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ছেলেকে নিয়ে নিশাতের পাশের টুলে বসলো। নিশাত একমনে আলু ভাজছে। নাহওয়ান আলুর দিকে চেয়ে বাবার মুখের দিকে চাইলো। মারওয়ান ছেলেকে নিজের দিকে চাইতে দেখে বুঝলো বাচ্চাটা আলু খাবে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“লিলিপুট দুই পিস আলু দিও তো।”
নিশাত চমকে তাকালো। ঘাড় ফিরিয়ে মারওয়ান ও নাহওয়ানকে বসে থাকতে দেখে বললো,
“কখন আসলেন?”
“এই মাত্রই। দুই টুকরো আলু দিও।”
নিশাত ভাজতে ভাজতেই বললো,
“উহু রান্না শেষ হলে খাবেন। পরে আলু কম পড়বে।”
“আরে দুই পিসে কয়টাই বা কমবে। আমার ছাও খাবে। দাও।”
কথাটা শুনে নিশাত ছেলের দিকে তাকালো। নাহওয়ান মায়ের দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিশাত একটা প্লেটে ভাজা দুই পিস আলু তুলে মারওয়ানের হাতে দিয়ে বললো,
“শুধু ছেলের খেতে ইচ্ছে করছে নাকি ছেলের বাবারও?”
মারওয়ান গরম আলু চামচ দিয়ে কেটে ফুঁ দিতে দিতে বললো,
“ছেলের সাথে বাপ ফ্রী।”
নিশাত কিছু না বলে বাকি রান্না করতে লাগলো। একটু পর মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। রাবেয়া খাতুন এতক্ষণ জামাইকে মেয়ের পাশে বসা দেখে এদিকে আসেননি। এখন মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন,
“হ্যাঁ রে নিশাত একটা কথা বলতাম।”
নিশাত বাসমতি চাল সেদ্ধ দিয়ে মায়ের দিকে ঘুরে বললো,
“কি কথা মা?”
“শুনেছিলাম তোরা একবার গ্রামে আসতে চেয়েছিলি, আসিস নি কেন?”
নিশাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“তোমার জামাইয়ের জন্য। সেবার বাস কাউন্টারে ঝগড়া বাঁধিয়ে চলে এসেছিল। তাই আর আসা হয়নি। আমার এক কলিগও দেখেছিল আমাদের ওইবার।”
রাবেয়া বেগম দুঃখী মুখ করে বললেন,
“ও। নিশাত শোন, ঢাকা গেলে প্রতি বছর একবার হলেও গ্রামে আসিস। মায়েরা সন্তানকে চোখের সামনে না দেখলে কেমন লাগে এখন তো মা হয়েছিস বুঝিস। আর বলতে হবে না।”
নিশাত ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাবেয়া খাতুন মেয়ের পাশে চুপচাপ বসে আছেন। নিশাত মাকে পাশ থেকে জড়িয়ে বললো,
“আর ঢাকায় যাবো না। তোমার সাথেই থাকবো। আমার ঢাকায় ভালো লাগে না মা।”
রাবেয়া খাতুন জানেন মেয়ে এসব তাকে খুশি করতে বলছে দিনশেষে সবাই নিজের কর্মস্থানে ফিরে যায়।
পাটি বিছিয়ে নাসির উদ্দিন, মারওয়ান, নাহওয়ানকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে নিশাত। কাচ্চির সুঘ্রাণে পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে সবার। নাসির উদ্দিন সুঘ্রাণেই বলে দিলো,
“আমার মায়ের রান্না হান্ড্রেড পারসেন্ট মজা হয়েছে আমি হলফ করে বলতে পারি।”
নিশাত বাবার প্লেটে সালাদ, লেবু দিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর মারওয়ানের প্লেটে কাচ্চি দিলো বেশি করে। সাথে সালাদ ও লেবু পাশে দিয়ে দিলো। নাসির উদ্দিন খেতে খেতে বললেন,
“বুঝলি মা রত্নের কদর সবাই করতে পারে না। কিছু কিছু বেক্কল না চাইতেও রত্ন পেয়ে যায় তাই হেলায় ফেলে রাখে। যেদিন হারিয়ে যাবে সেদিন আর চাইলেও পাবে না।”
বলেই আরেক লোকমা মুখে পুড়লো। শ্বশুরের কথা শুনে মারওয়ানের কাশি উঠে গেলো। নিশাত মাথা, পিঠ ডলে দিয়ে পানির গ্লাস হাতে দিলো। মারওয়ান পানি খেয়ে একটু শান্ত হলো। নিশাত জগে পানি ভরতে রান্নাঘরে গেলো। নাহওয়ান নাসির উদ্দিন আর মারওয়ানের মাঝখানে বসা। নাসির উদ্দিন নাতির মুখে আলু ও গোশতের টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছেন। নাহওয়ান পা দুটো ছড়িয়ে আয়েশ করে খাচ্ছে আর মাথা ঘুরিয়ে বাবা, নানার দিকে চাচ্ছে। নাসির উদ্দিন আবারও বললেন,
“উচিত কথা বললেই অনেকের হাঁচি, কাশি শুরু হয়। দোষ করতে পারবে কিন্তু কথা শুনতে পারবে না।”
মারওয়ান কিছু না বলে উঠে চলে গেলো।
রাবেয়া খাতুন তা দেখে বললেন,
“আপনার সমস্যা কি? ছেলেটা কত সাধ করে কাচ্চি খাবে দেখে মেয়েটা এই রাতের বেলা রাঁধলো আর আপনি ছেলেটাকেই খেতে দিলেন না। খাওয়ার সময় অন্তত চুপ থাকা গেলো না।”
“ও..ও রেঁধেছে তাহলে ঐ মাহাবুবের বেটার জন্য। আমি আরও ভাবলাম মেয়েটা খাবে তাই বেশি করে আনলাম এখন শুনি সিরাজউদ্দৌলার জন্য রান্না হয়েছে। বাহ বাহ চমৎকার!”
নিশাত পানি এনে দেখলো মারওয়ান নেই। প্লেটে খাবার আগের মতোই। রাবেয়া খাতুন মেয়েকে দেখে বললেন,
“দেখেছিস কাণ্ড নিশাত? ছেলেটাকে খেতে দিলো না। খোঁচা মারা কথা বলে ছেলেটাকে উঠিয়ে দিয়েছে।”
নিশাত বাবাকে কিছুই বললো না। প্লেটটা নিয়ে সোজা রুমে চলে গেলো। নাসির উদ্দিন তা দেখে বললেন,
“মেয়েটাকে আমার বলদ পেয়েছে। ওকে তোষামোদ করে এখন খাওয়াতে হবে। বেটা মানুষ হয়ে বেটি মানুষের মতো আচরণ। সারাক্ষণ বসে বসে খেতে চায়। আমার ছেলে হলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলতাম, ত্যাড়ামি ছুটিয়ে দিতাম একেবারে।”
নিশাত ঘরে ঢুকে দেখলো মারওয়ান চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। নিশাত প্লেট টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
“উঠুন। খেয়ে নিন।”
মারওয়ান জবাব দিলো না। নিশাত মারওয়ানকে ওঠাতে চাইলো কিন্তু পারলো না। স্বাভাবিকভাবেই একজন পুরুষের শক্তির সাথে একজন নারী পারবে না। নিশাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে লাগলো,
“কোনোদিন যদি মেয়ের বাবা হন সেদিন আপনার মতো চরিত্রের একজনের জন্য মেয়েকে আমানত হিসেবে লালন পালন করবেন তারপর তার হাতে মেয়েকে তুলে দিবেন। আমি দেখতে চাই বাবা হিসেবে আপনার সেদিনের ভূমিকা।”
মারওয়ান চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বললো,
“নিজের মেয়েকে বদদোয়া দিচ্ছিস?”
নিশাত মারওয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ একদম টকটকে লাল হয়ে আছে। নিশাত ঘাড় ফিরিয়ে বললো,
“বদদোয়া না। আপনার মেয়ে দেখে আপনার যেমন পুড়ে ঠিক তেমনই আমার বাবারও তার মেয়ের জন্য পুড়ে। কোনো বাবাই তার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। প্রত্যেক বাবার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা। তাই রাগে দুয়েকটা কথা বললে এরকম রিয়েক্ট দেখানোর কিছু নেই। আপনার দোষে আপনি কথা শুনছেন এটা মেনে নিন। খাবারের সাথে রাগ দেখালে নিয়তি বদলে যাবে না।”
মারওয়ান কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে থাকলো। নিশাত মারওয়ানের হাত ধরে টেনে উঠালো। তারপর টেবিল থেকে প্লেট এনে মারওয়ানের মুখের সামনে লোকমা তুলে ধরলো। মারওয়াম খাবে না বলে জিদ দেখালো কিছুক্ষণ পরে নিশাতের চোখ রাঙানিতে খেলো। খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে তা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠলো। নিশাত মুখ ধুইয়ে প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
রাতে ঘুমাতে গেলে মারওয়ান নিশাতকে বললো,
“আগামীকাল ঢাকা যাবো। তৈরি থেকো।”
নিশাত বললো,
“আপনি একা যান। চিঠির বিষয় কিন্তু ভুলে যাইনি। যেদিন চিঠির রহস্য খোলাশা করবেন সেদিনই ঢাকা যাবো এর আগে না।”
“তোমার স্কুলের ছুটি যে পার হয়ে গেছে ভুলে গেছো। সাত দিনের জায়গায় দশ দিন ধরে গ্রামে। চাকরি থাকবে আর?”
নিশাত ঘুমোতে ঘুমোতে জবাব দিলো,
“না থাকুক। আমার ঠেকা পড়েনি চাকরি করে আপনাকে খাওয়ানোর। আপনার মতলব আমি বুঝিনা ভেবেছেন? এখান থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে আপনার আশিকার সাথে প্রেম করবেন আর আমি আপনার এসব দেখবো। কখনো না। ডিস্টার্ব করবেন না। আমি যাবো না মানে যাবো না।”
মারওয়ান নিশাতকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“নিশাত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো আমি তুমি বাদে অন্য কোনো নারীর দিকে তাকিয়েছি কখনো?”
নিশাত কি বলবে ভেবে পেলো না। লোকটার সব দোষ মেনে নিলেও এই একটা জায়গায় নিশাত আটকে যায়। লোকটার খারাপ গুণ থাকলেও নারীঘটিত কোনো ব্যাপার আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মেয়েদের থেকে সবসময় দুরত্ব রেখেই চলে। তাই চিঠির বিষয়ে সে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছে না। আবার এমন নয় তো লোকটা উপরে উপরে ভন্ডামি করে কিন্তু ভিতরে আরেকরকম। হতেই তো পারে। নিশাত মুখ শক্ত করে বললো,
“তাহলে চিঠিটা কে দিয়েছে আপনাকে সাফ সাফ বলবেন নাহলে ঢাকায় আমাকে কোনোভাবেই নিতে পারবেন না।”
মারওয়ান নিশাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সময় হলে বলবো। আমার সাথে চার বছরের সংসারে যদি একটুও বিশ্বাস তৈরি হয় তাহলে তুমি আমার সাথে ঢাকা যেতে পারো নাহয় আমি ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবো।”
“আমার ছেলেকে কোথাও দিবো না।”
মারওয়ান হেঁসে বললো,
“তুমি দেয়ার কে? ফাইয়াজ আমার রক্ত, আমার অংশ। ওকে আমার কাছে রাখার হাজারটা অপশন আছে। আদালতে গেলেও আদালত আমার দিকে রায় দেবে।”
নিশাত চোখ, মুখ শক্ত করে বললো,
“আপনি আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন।”
মারওয়ান নিশাতের পাশে শুতে শুতে বললো,
“উহু অফার দিচ্ছি। হয় আমাদের সাথে যাবে নাহয় ছেলেকে হারাবে।”
বলেই চোখ বুঝলো মারওয়ান। নিশাত মারওয়ানের বাহুতে খামচি মেরে ধরলো। তারপর মারওয়ানকে ডেঙিয়ে নাহওয়ানকে কোলের মধ্যে নিয়ে কাদতে লাগলো। মারওয়ান কিছু বললো না। উল্টো ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে নিশাত ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোকে আমি কোথাও যেতে দিবো না নাহওয়ান। তুই আমার কাছে থাকবি। তুই শুধু মায়ের ছেলে।”
ঘুমের মধ্যে ঝাঁকি লাগায় নাহওয়ান ঘুমিয়ে ঘুমিয়ই বললো,
“বাবা, বাবা।”
নিশাতের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের পানি চোখের কোণা বেয়ে পড়তে লাগলো। মারওয়ান নিশাতের ঘাড়ের উপর দিয়ে মুখ নিয়ে হেঁসে উঠে বললো,
“দেখলে ছেলে কি বললো? বাপকা বেটা।”
এই কথা শুনে নিশাত মারওয়ানকে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থেকে সরালো। কঠিন ভঙ্গিতে ছেলেকে ছেড়ে বালিশ কাঁথা নিয়ে নিচে ঘুমিয়ে পড়লো। মারওয়ান হাসতে হাসতেই নাহওয়ানের ফুলো গালে চুমু দিয়ে বললো,
“তোর মা রাগ করেছে রে পান্ডা।”
নাহওয়ান ঘুমের মধ্যেই বাবার একটা আঙুল ধরে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“মা, বাবা।”
মারওয়ান ছেলের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে শুয়ে থাকলো।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে নিশাত নিজেকে বিছানায় পেলো। তার এক আঙুল নাহওয়ান ধরে আছে। মারওয়ান ওই পাশে ঘুমানো। ছেলে মাঝে। দুজনের দু আঙুল ধরে নাহওয়ান ঘুমিয়ে আছে। নিশাত ছলছল চোখে তাকিয়ে আঙুল ছাড়িয়ে ওযু করতে চলে গেলো।
জায়নামাজে বসে রাতের কথা ভাবছিল নিশাত। রাতে মারওয়ান স্কুলের কথা তুললেও নিশাত স্কুলের বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিল কারণ সে স্কুলের প্রিন্সিপালকে ফোন দিয়ে সাত দিনের দিনেই ছুটি আরও কয়েকদিন বাড়িয়ে নিয়েছে। প্রিন্সিপাল রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু নিশাতের কিছু সমস্যা হয়েছে শুনে না চাইতেও ছুটি দিয়েছেন তবে বেশি দেরি করলে বেতনের টাকা কেটে রাখবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। নিশাত সায় জানিয়েছে।
নাসির উদ্দিন উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছেন। গাছ থেকে কচি ডাব পাড়িয়েছেন আজ। সেটাই দা দিয়ে কাটছেন। এরমধ্যেই গেট দিয়ে দুজন অপরিচিত নারী, পুরুষকে ঢুকতে দেখে বললেন,
“এই কারা রে?”
নিশাত বাবার হাঁক শুনে বুঝলো মানহা এসেছে। মারওয়ানকে ডেকে বললো,
“দ্রুত বাইরে যান। মানহা এসেছে।”
মারওয়ান ভারী অবাক হলো। মানহা এখানে আসবে কেন? নিশাত তাকে ঠেলে বাইরে পাঠালো। মারওয়ান বেরিয়ে এসে দেখলো ইহাব আর মানহা দাঁড়ানো। সে লুঙ্গি ধরে কপাল কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“এখানে কি তোদের?”
মানহা ভোর ভাইকে দেখে সালাম দিলো। তারপর মিনমিন করতে করতে বললো,
“উনি এনেছেন।”
মারওয়ান কপাল কুঁচকে রেখেই ইহাবের দিকে চাইলো। ইহাব মারওয়ানকে দেখে লম্বা সালাম দিয়ে বললো,
“ভালো আছেন শ্লা ব্রো? ভালো তো অবশ্যই থাকবেন জামাই আদর বলে কথা।”
বলেই নিজের সানগ্লাসটা খুলে শার্টে গুঁজলো। মানহা এখানে না থেকে ঘরে চলে গেছে। মারওয়ান বললো,
“বালের আদর। মুখটা খারাপ করতে চাই না। এমনিতেই ঝামেলায় বাঁচি না আরেকটা ঝামেলা চলে এসেছে। মন চাচ্ছে লাত্থি দিয়ে এখান থেকে বার করতে।”
ইহাব নাসির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোর শ্বশুর নাকি? হেব্বি দেখতে কিন্তু শ্লা ব্রো।”
বলেই নাসির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে হেঁসে মারওয়ানকে টাইট করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ব্যাগ পত্র নিয়ে নাসির উদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম কাক্কু। ভালো আছেন?”
নাসির উদ্দিন বললেন,
“তুমি কে?”
ইহাব মারওয়ানকে দেখিয়ে বললো,
“আপনার জামাইয়ের জানে জিগার আর তার একমাত্র বোনের হাজব্যান্ড।”
এটুকু বলে পরক্ষণে আবার বললো,
“কাক্কু থাকবো কোথায়?”
এতবার কাক্কু বলায় নাসির উদ্দিন বেজায় বিরক্ত হলেন। উঠে দ্রুত মেহমানের ঘর দেখিয়ে দিয়ে আবার উঠোনে বসলো। একে চোখের সামনে টলারেট করতে পারছেন না তিনি। মারওয়ান ঘরে যেতে যেতে শুনলো নাসির উদ্দিন বলেছেন,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৬
“একটা দিয়ে হচ্ছিলো না এখন আরেক নমুনা জুটেছে। দুটোই এক ক্যাটাগরির মনে হচ্ছে। দু’নম্বর জিনিস। চাহনির মধ্যে চোর চোর ভাব স্পষ্ট।”
মারওয়ান সাথে সাথেই বললো,
“সহমত। এই প্রথম আপনার কথা আমার মনে ধরেছে। চালিয়ে যান।”
নাসির উদ্দিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মারওয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি হলো এটা?