ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৭
তাজরীন ফাতিহা
মানহা কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রান্না করছে। শাড়ি পড়ে কোনো কাজ করতে পারেনা সে। অভ্যাস নেই তার। তবে উর্মি ভুঁইয়ার ইচ্ছে তারা বউ শাশুড়ি উভয়ই শাড়ি পড়বে। তবে মানহার অস্বস্তির জন্য তিনি সপ্তাহের যেকোনো দুইদিন শাড়ি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আজকে সেই দুই দিনের শেষদিন। শুক্রবার। সকাল থেকেই হেঁসেলে সে। এই একটা দিন পুরো তিন বেলার রান্না মানহা করে। অন্যান্য দিনগুলোতে উর্মি ভুঁইয়া রান্না করেন। গৃহকর্মীরা অবশ্য কাটা বাছা, ধোয়াধুয়ি সবকিছু গুছিয়ে দেয়। রান্নাটা শুধু উর্মি ভুঁইয়া কিংবা মানহা করে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আবার মেইডদের হাতের রান্না খেতে পারেন না। ভীষণ ভোজন রসিক মানুষ তিনি। তাই রান্নাটা খুব আগ্রহের আনন্দের সাথেই করেন উর্মি ভুঁইয়া। তার হাতের রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। মানহাও বেশ কিছু রান্না শিখেছে উর্মি ভুঁইয়ার থেকে। এখন মোটামুটি ভালোই রাঁধতে পারে সে।
ঘর্মাক্ত মুখশ্রী তেল তেলে হয়ে আছে মানহার। শুক্রবারের আয়োজন বিশাল হয় এবাড়িতে। প্রত্যেকদিনই বিভিন্ন পদের আইটেম থাকে তবে আজকের আইটেম গুলো স্পেশাল। তার উপর বাড়িতে মেহমান আছে দুই মামা শ্বশুর। বাড়তি পদ তো থাকবেই। পোলাও, রোস্ট, কাবাব, চিংড়ির মালাইকারি, সরষে ইলিশ, আলু পোস্ত, রুই মাছের কালিয়া, কোপ্তা, গরুর কালা ভুনা, মুড়ি ঘন্ট, সাদা ভাত। ডেজার্ট হিসেবে থাকবে চমচম, রসগোল্লা, মিষ্টি দই আর ক্ষীর। উর্মি ভুঁইয়া আজ বেশ কয়েকটা পদ নিজে করেছেন আর বাকিগুলো মানহাই করেছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
টেবিলে এতো পদ দেখে ইহাবের জিহ্বায় পানি এসে গেছে। আশেপাশে কাউকে না দেখে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো মানহা খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। সব আইটেম শেষে ফ্রোজেন করা কাবাব গুলো ভেজে নিচ্ছিলো সে। ইহাব চট করে রান্নাঘরে ঢুকে গরম কাবাব টিস্যু পেপারে ধরে কামড় বসিয়ে দিলো। এই মাত্র গরম গরম ভেজে টিস্যুতে উঠিয়ে রেখেছিল মানহা আর ঐসময়ই ইহাবের আগমন। মুখে ঢুকাতেই গরমে মুখ পুড়ে গেলো তার। লাফ দিয়ে উঠে মুখেরটা ফেলে দিলো। মানহা খুন্তি হাতে কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো। ইহাব কুলি করে মানহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? চোখ নামাও। স্বামীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায় কেউ?”
মানহা কাবাব উল্টে দিয়ে ভাজা কাবাব গুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
“আরেকবার হাত দুটো এখানে পড়লে কাঁটাচামচ দিয়ে ফুটো করে দেবো।”
“কিহ, আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে থ্রেট দেয় কত্তবড় সাহস!!”
মানহা ভাবলেশহীন উত্তর দিলো,
“এটা আমারও বাড়ি।”
ইহাব তেড়ে এসে বললো,
“তোমার বাড়ি কোত্থেকে হলো? এই দুনিয়ার সব তোমার ভাই আর তোমার। আমরা হলাম ভাড়াটিয়া। যেমন ভাই তেমন বোন।”
মানহা ইহাবের বুকে চাপ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সালাদ কাটার জন্য চপিং বোর্ড নিয়ে এসে বললো,
“বাড়িটা আমার ভাইয়ের না। আমার শ্বশুরের। সুতরাং সেই সূত্রে এটা আমারও।
ইহাব বিড়বিড় করে বললো,
“মেয়ে মানুষের প্যাঁচের কাছে ইবলিশের প্যাঁচও ফেল। কোনোদিন স্বীকার করবে না এটা স্বামীর বাড়ি। একটা কথা প্যাঁচাতেই থাকবে। পেঁচিয়ে নেপচুনে নিয়ে যাবে।”
উর্মি ভুঁইয়ার আগমনে ইহাব রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তিনি মানহাকে গোসল করতে পাঠিয়ে দিলেন। মানহা উপরে এসে ঘরে ঢুকতে নিলেই একটা কথা শুনে থমকে গেলো,
“লাশটা সরিয়ে দে। কাক পক্ষীও যেন টের না পায়। আমি যথাসময়ে পৌঁছে যাবো। আর বাসায় থাকাকালীন ফোন করতে নিষেধ করেছি না? মেসেজ দিবি। এখন ফোন রাখ।”
বলেই ফোন কেটে পিছনে ফিরে মানহাকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো সাথে আতঙ্কিত হলো। মানহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কিছু শুনে ফেলেনি তো আবার। মানহা চিৎকার দিয়ে বললো,
“আপনি কাকে খুন করে লাশ সরিয়ে ফেলতে বলেছেন? কি করছেন সকলের অগোচরে? আল্লাহ…”
বাকি কথা শেষ করতে পারলো না অমনি ইহাব মানহার মুখ চেপে হিংস্র নজরে চাইলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“চুপ, আরেকবার চিল্লালে তোমাকেও লাশের কাছে পাঠিয়ে দেবো।”
মানহা উম উম শব্দ করে যাচ্ছে। তার চোখে ভয়। ইহাব মানহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“চিল্লাবে?”
মানহা ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝালো। ইহাব মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিতেই মানহা আবারও চিৎকার দিয়ে উর্মি ভুঁইয়াকে ডাকতে লাগলো। ইহাব তড়িঘড়ি করে আবারও মুখ চেপে ধরে বললো,
“মন চাচ্ছে গলাটা কেটে দেই। দেখায় যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না এদিকে তিনি উল্টো পাশের মাছ খেয়ে দিব্যি হজম করে বসে আছে সেটা তো কেউ জানে না।”
ইহাবের কথা শেষ হতেই মানহা তার হাতের তালুতে জোরে কামড় বসিয়ে দিলো। ইহাব দ্রুত হাত সরিয়ে ফেললো। মানহা এবার চিৎকার করে বললো,
“সত্যি করে বলুন কী করছেন সবার অগচরে? আমাকে দমিয়ে রাখলেই এসব কথা মিথ্যা হবে না। যতই আমাকে দমিয়ে রাখুন না কেন আমি চিৎকার করে বলতেই থাকবো আমি লাশ সাপ্লাই করেন।”
ইহাব ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো,
“এই একদম চুপ!! বেশি কথা বললে তোমাকেও সাপ্লাই করে দেবো।”
“দিন। ভয় পাই আপনাকে? আমার কিছু হলে ভাইয়া আপনাকে ছিঁড়ে ফেলবে।”
ইহাব দু হাত উঁচিয়ে বললো,
“ওরে বাপ্রে, ভয় পেলাম তো। বোঝে না ছাতার মাথা, জীবনটা আমার তেজপাতা।”
ইহাবের তাচ্ছিল্য শুনে মানহা ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
বিরাট ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার আসর জমেছে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া, ইহাব ভুঁইয়া, উমায়ের ভুঁইয়া, উজান ভুঁইয়া সবাই নামাজ পড়ে এসেই খেতে বসেছে। রান্নার সুঘ্রাণে বসে থাকা দুষ্কর। উমায়ের ভুঁইয়া ভাগ্নের প্লেটে ইলিশ মাছ বেছে দিতে দিতে বললেন,
“কিরে এখনো মাছ বেছে দিতে হয়?”
ইহাব মাথা নাড়িয়ে বললো,
“এখন মোটামুটি ভালোই মাছ বাছতে পারি। তবে ইলিশ মাছ এখনো এভয়েড করি।”
উজান ভুঁইয়া খোঁচা মেরে বললেন,
“এখন আর মাছ নিয়ে ঝামেলা হবে না ভাগ্নের। মাছ বাছার মানুষ তো এসেই গেছে। তাই না মামা?”
ইহাবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। ইহাব কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“ঠিক যেমন তোমার উষ্টা খাওয়ার সঙ্গী হয়েছিল তাই না শালা?”
উজান ভুঁইয়া দুলাভাইয়ের কথা শুনে মুখ লটকিয়ে ফেললেন। খাবার টেবিলে বসা সকলে একযোগে হেঁসে উঠলো। উজান ভুঁইয়া উর্মি ভুঁইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপা দুলাভাইকে নিষেধ করো। বিয়ের আগে উষ্টা খেলেও বিয়ের পর কখনোই উষ্টা খাইনি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মুরগির লেগ পিসে কামড় বসিয়ে বললেন,
“বুঝলে বিয়ের আগে উষ্টা খেতে বউয়ের অভাবে। বউ আসার পর আর নতুন করে কি উষ্টা খাবে এমনিতেই বউরা স্বামীদের যেই প্যারা দেয় কয়েকশো লাথি উষ্টাও এর কাছে কিছু না। বউয়ের চাপে রিয়েল উষ্টার কথাই ভুলে গেছো।”
উজান ভুঁইয়া বলে উঠলো,
“দেখেছো আপা, বউদের কথা বলে ইনডাইরেক্টলি তোমাকে খোঁচা দিলো।”
উর্মি ভুঁইয়া ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে শান্ত চাহনি নিক্ষেপ করলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মনে মনে বললেন, খবিশ গুলো আমার সংসার ভাঙতে এসেছে। মন চাচ্ছে টুটি চেপে ঘর থেকে বের করতে। এদের দুই চক্ষে সহ্য করতে পারিনা। সব জায়গায় ভেজাল লাগাবে। পাছায় লাত্থি মারতে পারলে ভালো লাগতো।
উজান ভুঁইয়া দুলাভাইকে নাস্তানাবুদ হতে দেখে বেশ আনন্দিত হলেন। উমায়ের ভুঁইয়া কথা কম বলেন। তিনি চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার আগে বললেন,
“প্রত্যেকটা রান্নাই মজা হয়েছে। অনেকদিন পর কব্জি ডুবিয়ে খেলাম। মজার খাবার দেখে বেশি খেয়ে ফেলেছি। গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম না হলেই হয়।”
উর্মি ভুঁইয়া ভাইকে বললেন,
“গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দেবো ভাইজান?”
“দে। পেটটা কেমন যেন করছে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“টয়লেট উপরে।”
উমায়ের ভুঁইয়া ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে তাকিয়ে উপরে চলে গেলেন। ইহাব উজান ভুঁইয়াকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“মামু তুমি উষ্টা খেতে কিজন্য? কোনো সমস্যা ছিল নাকি?”
“আর বলিস না। হঠাৎই হাঁটতে গেলে উল্টিয়ে পড়তাম। সোজা রাস্তাতেও এমন হতো। কেন হতো কে জানে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কথা বলবেন না বলবেন করেও মুখ ফসকে বলে ফেললেন,
“ভিটামিনের অভাব ছিল। খুব সম্ভবত পোলিও টিকার ঘাটতি আছে তোমার মামার শরীরে।”
মারওয়ান সন্ধ্যার দিকে এসে গোসল করে একটু ঘুমিয়েছিল। এখন ঘুম থেকে উঠে ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝট করে কোলে তুলে নিতেই হাতে ভেজা অনুভূত হলো। ছেলেকে কোল থেকে নামাতেই দেখলো হাতে মল। মারওয়ান রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“হেগে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোলে নেয়ার সময়েও তো বলতে পারতি বাবা আমি হেগেছি; কোলে নিও না। এখন আবার গোসল করতে হবে।”
তার কণ্ঠে বিরক্তি উপচে পড়ছে। নাহওয়ান সেন্ডুগেঞ্জি তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে ভাব। মারওয়ান আবারও চোখ রাঙালে বাচ্চাটা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“বাইল হয়ে গেচে। মা ডুয়ে ডেয়নি।”
“মা যখন ধুয়ে দেয়নি তখন আমাকে বলিস নি কেন পটলের বাচ্চা? এই জিনিস তোকে মাখিয়ে দেই?”
মারওয়ান হাতের বস্তু দেখিয়ে বললো। নাহওয়ান তার ছোট্ট শরীরটা নিয়ে আধ লেংটা অবস্থায় দৌড় দিতে দিতে বললো,
“ইচ চিহ? টুমি পুচা।”
“এখন ইছ ছিঃ, আমি পঁচা? আরেকটা কথা বললে কিল দিয়ে ডিম পাড়ায় দেবো।”
নাহওয়ান ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশাত ছেলের প্যান্ট নিয়ে এসে বললো,
“ওমা বেরিয়ে এসেছো কেন? বসে থাকতে বললাম না।”
বলতে বলতেই মারওয়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলো। নিশাতের কেন যেন খারাপ লাগার বদলে পৈচাশিক আনন্দ হলো। ছেলেকে পরিষ্কার করে বেরোতেই মারওয়ান গোসল করতে ঢুকলো। নিশাত নাহওয়ানকে প্যান্ট পড়িয়ে বললো,
“এখানে বসে থাকুন। মা চট জলদি রান্নাটা সেরে ভাত খাইয়ে দেবো।”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। নিশাত চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মারওয়ান বেরিয়ে এলো। ছেলের দিকে আবারও চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বাবাকে এরকম চোখ উল্টাতে দেখে বাচ্চাটা গাল ফুলিয়ে বললো,
“বাইল হয়ে গেচে।”
মারওয়ান গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
“হ্যাঁ তোর তো খালি বাইর হয়ে যায়। ঢিলা কোম্পানি।”
নাহওয়ান বাবার কথা বুঝতে না পেরে খেলায় মনোযোগ দিলো। মারওয়ান খাটের উপর শুয়ে বললো,
“দেখি পিছন দেখা, পরিষ্কার হয়েছিস তো ঠিক করে?”
নাহওয়ান দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরে দেখালো। মারওয়ান ছেলেকে ঝট করে বুকে তুলে বললো,
“আয় ঘুমাই।”
“গুমাবো না।”
“তো কি করবি?”
“কেলবো।”
“এত খেলা লাগবে না। আয় বাপ বেটা কোলাকুলি করে ঘুমাই।”
ঘুমের কথা শুনে নাহওয়ান মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে তাকালে ঠোঁট উল্টে বললো,
“ইট্টু সুসু কলবো।”
মারওয়ান ঠেসে ধরে বললো,
“মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না? হাগু মুতু কি তোর মিনিটে মিনিটে আসে ঢিলার বাচ্চা?”
নাহওয়ান বুঝলো বাবার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না। তাই মুখ ফুলিয়ে বললো,
“ভাতু কাবা না?”
“খাবো। দারুন সুঘ্রাণ আসছে। দেখে আসি তোর মা কি রান্না করছে।”
বলে ছেলেকে নামিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো। নিশাত আজকে দুপুরে রান্না করেনি। মাথা ব্যথায় শুয়ে ছিল। তাই রাতে ডাল চাল মিলিয়ে কালকের একটু বেঁচে যাওয়া মুরগির গোশত দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছে। এমনিতেই বাপ, বেটার ভালো মন্দ নাহলে মুখে খাবার রোচে না তাই এই শর্ট টেকনিক ইউজ করলো। সময়ও কম লাগলো সাথে খেতেও সুস্বাদু হয়। এদিকে মারওয়ান রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখলো খিচুড়ি রান্না হচ্ছে তাই আর ভেতরে না গিয়ে রুমে চলে গেলো। নিশাত কয়েকটা আলু ভাজা করে নিলো। খিচুড়ির সাথে মুচমুচে আলু ভাজা কিংবা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে মজাই লাগে। আলহামদুলিল্লাহ রাতের খাবার তৈরি।
রাতের খাবার খেয়ে নিশাত পরীক্ষার খাতা কাটতে বসে গেলো। কয়েকদিন ধরে একেবারেই অন্যদিকে সময় দিতে পারছে না। ইস্তেখারাও করা হচ্ছে না। ইস্তেখারার রেজাল্ট এখনো আসেনি। নিশাত চিন্তায় আছে। আল্লাহ কি তার প্রতি নারাজ? এর আগে ইস্তেখারা করার কয়েকদিনের মধ্যেই ফলাফল পেতো। এবারই বিলম্ব ঘটছে। নাকি ঠিকমতো ইস্তেখারা করা হয়নি বুঝতে পারছে না সে। পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে বেশ রাত হলো। অন্য রুমে বাবা, ছেলে ঘুমিয়ে আছে। নিশাত আর না গিয়ে তাহাজ্জুদ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো। তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তেই জায়নামাজে কখন ঘুমিয়ে পড়লো বলতে পারবে না।
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। ঘেমে একেবারে অস্থির হয়ে গেছে সে। কি স্বপ্ন দেখলো এটা! এটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ইশারা ছিল? ইশারা বুঝি এত ভয়ংকর হয়! আল্লাহ! কান্না গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। বুকটা ধরফর করে কাঁপছে অনবরত। হাপরের মতো বুকটা ওঠানামা করছে। চারদিক কেমন অন্ধকার লাগছে। এত ভয়ংকর স্বপ্ন কোনোদিন না দেখুক সে। জায়নামাজে শুইয়ে আল্লাহ তাকে এ কি স্বপ্ন দেখালো? হাতটা বারবার দেখছে সে। বুকটা ভেঙে কান্না আসছে। শরীর ছেড়ে জায়নামাজে ঢলে পড়ার আগে অস্পষ্টভাবে বললো,
“নাহওয়ানের বা…”
হাইরোডের উপরে ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। উপর থেকে যান্ত্রিক গাড়ি গুলোর চলাচল দেখে চলেছে একমনে। পাশ দিয়ে সাই সাই করে অসংখ্য গাড়ি চলে যাচ্ছে এতে তার কোনো ভাবাবেগ নেই। সে শিকারী নেত্রে এক ধ্যানে কিছু দেখে চলছে। পরনে ওভারকোট তার। বাতাসে উড়ছে। পকেটে ফোন ভাইব্রেট হলে রোবটের মতো ফোন কানে লাগিয়ে আগের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলো। ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো। সব শুনে ফোন কেটে দিয়ে কাউকে কল দিলো। কিছুক্ষণ বাদেই একটি কালো গাড়ি এসে দরজা খুলে দিলে সে চড়ে বসলো। অতঃপর চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। গাড়িটি বিলীন হয়ে গেলেও পিছনে তিনজন জ্বলন্ত চোখের অধিকারী ব্যক্তিদের চক্ষু এখনো সেই বিলীন হওয়া গাড়ির শেষ সীমানায় আটকে আছে। মুনতাজির গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“এই তবে কিলার আজাদ? আইমিন কিলার জাদ?”
জিনানের নীল নয়ন জ্বলজ্বল করছে। যেন শিকারকে ধরার এক অদ্ভুত তাড়া সেই চোখে। নেওয়াজ বললো,
“লোকটার চেহারায় ধার আছে। একে তো কেউই খুনি বলবে না। সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমাদের তীরন্দাজ দৃষ্টি ফাঁকি দেয়া অত সোজা না।”
জিনান রহস্যময় হেঁসে বললো,
“উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কিং জন নাটকের একটা ডায়লগ মনে পড়ে গেলো, Be stirring as the time, be fire with fire অর্থাৎ যুদ্ধ বা হুমকির সময় কোমলতা নয় কঠোর প্রতিক্রিয়া জরুরি।”
মুনতাজির ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি প্রতিক্রিয়া নিতে বলছেন?”
“হেড যেটা অলওয়েজ বলেন। তার গ্যাং বিশাল বড় বোঝাই যাচ্ছে। চেহারা যেহেতু দেখেই ফেলেছি এখন ডিরেক্ট একশনে যাবো তবে ঠান্ডা মাথায় কৌশলে আগাতে হবে। ওদের দলের যাকে ধরা হয়েছে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করে একেবারে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করতে হবে যেন পালানোর পথ না পায়। আমাদের কর্মজীবনে কিলার জাদের মতো ঘোল খাওয়ায়নি কেউ। সে ইচ্ছে করেই নিজেকে ধরা দিচ্ছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়? তাকে ধরতে গিয়েও ধরতে মানা যেন। নাহলে যাকে এতদিন ধরে খুঁজে হয়রান হয়েও সন্ধান কিংবা হদিশ পাওয়া যায়নি হঠাৎ করে তার আস্তানার খোঁজ পাওয়া, চেহারা দেখা দ্যাটস এ বিগ ডিল গায়েজ।”
মুনতাজির ও নেওয়াজ উভয়ই সম্মতি জানালো। আসলেই তো হঠাৎ করেই সবকিছুর খোলাশা হওয়া অদ্ভুত ও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। মুনতাজির মাথা নাড়িয়ে বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৬
“Wait… are you saying this is a trap? (ওয়েট..আপনি বলতে চাচ্ছেন এটা একটা ট্র্যাপ?)”
“সেরকমই মনে হচ্ছে কেন যেন। দেখা যাক কি হয়।”
নেওয়াজ হিংস্র কণ্ঠে বললো,
“আ…..Killer Jad, you’re a deadly player!”