ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫
তাজরীন ফাতিহা
অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ঘরে মোমবাতির মৃদু আলো জ্বলছে। ভিতরের ইজি চেয়ারটা দুলছে। তার উপরে বসে আছে কেউ একজন। যুবকটির হাত ব্যান্ডেজ করা। ব্যান্ডেজকৃত হাতে শক্ত কিছু চেপে ধরে আছে। মাথায় ক্যাপ পড়া। একটু পর ঘরের দরজায় টোকা পড়ায় চেয়ারটি দোলা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো। যুবকটি গম্ভীর মুখে উঠে দরজা খুললো। দরজার ওপাশে একজন মধ্যবয়সী নারী দাঁড়িয়ে। নারীটি বললেন,
“ইহাব এই অসময়ে দরজা আটকে রুম অন্ধকার করে রেখেছো কেন?”
ইহাব নামক যুবকটি কিছু বললো না। নারীটি আবার বললেন,
“কথা বলছো না কেন? তোমার নেতাগিরি খবরদার আমার সামনে দেখাবে না। মনে আছে আমি তোমার কি হই?”
ইহাব নামক যুবকটি এবার কথা বলে উঠলো। বললো,
“কি সমস্যা আম্মু? কথা বলতে ভালো লাগছে না দেখে কথা বলছি না। সব সময় তোমার ইমোশনাল কথা না বললেই না?”
কথাটুকু বলে ইহাব ইজি চেয়ারে গিয়ে বসলো। পিছনে পিছনে প্রবেশ করলেন উর্মি ভুঁইয়া। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে? হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কার সাথে মারামারি করে আসলে?”
“কারো সাথে না। বিরক্ত কোরো না তো। একটু একা থাকতে চাই।”
“শামীম বললো তুমি উত্তরপাড়ার নিহালের সাথে লেগেছো আজ? কথাটা সত্যি?”
ইহাব ভ্রু কুঁচকে শামীমের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছে। ওর খবর আছে আজকে। উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তোমার বাবা তোমাকে প্রশ্রয় দিয়ে বেশি মাথায় উঠিয়েছে। তার মতো পুরো গ্রামে নেতাগিরি করতে চাও। শোনো তোমার বাবা চেয়ারম্যান দেখে সবাইকে পায়ের নিচে রাখবে এরকম ভুলেও ভেবো না। তোমার বাবাও তোমার মতো ছিল। মারামারি, নেতাগিরি করে বেড়াতো। বাবার হিস্ট্রি আর ছেলেকে শোনাচ্ছি না। তবে আমি চাই তুমি তোমার বাবার মতো না হও। কথাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নিও।”
কথাটুকু বলে উর্মি ভুঁইয়া প্রস্থান করলেন। ইহাব ফোঁস করে উঠলো। শামীম তার হাতে একচোট খাবে তার বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। তার চোখে বছর কয়েক আগের কিছু দৃশ্য উঁকি দিলো। কেউ তার দিকে তাকিয়ে উপহাসমাখা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরলো সে। এই গ্রামে আসলে ওর চিহ্নই নিশ্চিহ্ন করে দিবে। নাহলে তার নাম ইহাব ভুঁইয়া না। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
নিশাতের আজকে সাপ্তাহিক ছুটি। খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠা তার নিত্যদিনের স্বভাব। ফজর পড়ে সে কখনো ঘুমায় না। ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ সারে।শুক্রবারে একটু ভালোমন্দ রান্নার চেষ্টা করে সে। সারা সপ্তাহ তো স্কুলের পিছনেই সময় চলে যায়। নিজের পরিবারের জন্য এই একটি দিনই একটু স্বস্তির। কাজের প্রেশার না থাকলেও কাজ নেহাতই কম নয়। বাজার করে রান্না চড়াতে হয়। বিড়ি’খোরটা একটু বাজারও করে না। এতোটা অলস সে তার জন্মেও দেখেনি।
রান্নাঘরে সব বাজার গুছিয়ে রাখছে নিশাত। আজকে ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন করবে। সব কিছুর যা দাম! চড়া মূল্য সওদাপাতির। ফার্মের মুরগি এক কেজির দাম দুইশো নিয়েছে। এতো দাম দেখে মুরগি কেনার সাধই মিটে গেছে নিশাতের। সপ্তাহে একদিনও যদি মাংস জাতীয় কিছু না রাখে তাহলে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। তাছাড়াও ছেলেটা একটু গোশত পছন্দ করে। শাক সবজির চেয়ে গোশতের প্রতি আগ্রহ বেশি বাচ্চাটার। নিশাত বটি নিয়ে মুরগি পিস পিস করতে লেগে পড়লো।
নাহওয়ান ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে মাকে খুঁজলো। বাবার বুকের উপর থেকে নেমে ছোট বুকে ভর দিয়ে খাট থেকে নামলো। চোখ ডলে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মাকে ডেকে উঠলো। রান্নাঘরে এসে নিশাতকে কাজ করতে দেখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“মা, কুথায় চিলে?”
নিশাত মুরগি কাটতে কাটতেই বললো,
“ঘরেই তো ছিলাম আব্বা। আপনি উঠে গিয়েছেন?”
“হু।”
“একটু অপেক্ষা করো। মার মুরগি কাটা হয়ে গেলেই তোমাকে ফ্রেশ করাবো।”
“আচ্চা। মুগ্গি নানবে?”
খুশি খুশি গলায় নাহওয়ান জিজ্ঞেস করলো। নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলের ঘুমু ঘুমু আদুরে বদনে চুমু খেয়ে বললো,
“জি আব্বা। আপনি খাবেন?”
নাহওয়ান উপরনিচ মাথা নাড়ালো। নিশাত বললো,
“মুখে বলো।”
“কাবো। মা কুদা লাগচে।”
নাহওয়ান আবারও চোখ ডলে বললো। নিশাত বললো,
“তাহলে বাবাকে ডেকে তোলো। তুলে বলো বাবা আমাকে ফ্রেশ করে দাও। তারপর দুজন নাস্তা করে নাও। আজকে তোমার পছন্দের পাউরুটি আর ডিম পোচ করেছি। যাও দ্রুত ফ্রেশ হও। মায়ের হাতে অনেক কাজ বাবা নাহলে মা’ই তোমায় ফ্রেশ করাতাম। বাবাকে তুলো যাও।”
নাহওয়ান আচ্ছা বলে রুমে দৌঁড়ে আসলো। খাটের উপরে বহু কসরত করে উঠলো। যেহেতু সে ছোট তাই খাটের নাগাল পায়না। টুলে পা রেখে উঠলো বিছানায়। বাবার মুখ ছোট ছোট হাত দিয়ে ধরে বললো,
“বাবা বাবা, ওটো। তালাতালি ওটো। কাবার কাবে না?”
মারওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো ঘুমের ঘোরেই। নাহওয়ান বাবার বুকের উপর উঠে কানে ফিশ ফিশ করে বলতে লাগলো,
“বাবা, ওটো। কুদা লাগচে। আমাল মুখ দুইয়ে ডাও।”
মারওয়ান চোখ বুজেই বললো,
“ঘুমোতে দে বাপ। তোর মাকে বল তোকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে।”
“মা কাজ কলে। টুমাকে বলেচে দুইয়ে দিটে।”
নাহওয়ান বাবার মুখে বারি দিয়ে বললো। মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে পাশ ফিরে শুতে শুতে বললো,
“উফফ লিলিপুটের বাচ্চা জ্বালাস নাতো।”
“নিনিপুট কি?”
“তোর মা।”
ঘুম ঘুম কণ্ঠে মারওয়ানের উত্তর। নাহওয়ান বাবাকে উঠাতে না পেরে মায়ের কাছে গেলো। নিশাত ততক্ষণে সবজি ধুচ্ছিলো। নাহওয়ান গিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরলো। নিশাত হেঁসে বললো,
“বাব্বা মুখ ধোঁয়া শেষ এতো তাড়াতাড়ি? ক্ষুধা কি বেশি লেগেছে আমার বাচ্চার?”
“মুখ ডোয়া ওয়নি। বাবা আমাকে নিনিপুটের বাচ্চা বলেচে। নিনিপুট কি মা?”
নিশাত অবাক হয়ে তাকালো। সে বললো,
“ওটা কিছু না বাবা।”
“কিনটু বাবা যে বননো নিনিপুট টুমি?”
নিশাতের চোখ মুখ কঠিন হলো নিমিষেই। বললো,
“বাবা মিথ্যা বলেছে। আসো তোমার মুখ ধুইয়ে দেই।”
নিশাত ছেলের মুখ ধুইয়ে দিয়ে খেতে দিয়ে বললো,
“তুমি খাও। মা একটু আসছি।”
নাহওয়ান মাথা নাড়ালো। রান্নাঘর থেকে পাতিল নিয়ে রুমে গেলো নিশাত। রুমে গিয়ে তা জোরে জোরে ফেলতে লাগলো। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কার আমার ঘুমের সাথে এতো শত্রুতা রে?”
“আপনি যদি আর এক মিনিটের মধ্যে ঘুম থেকে না ওঠেন তাহলে বাসায় আজকে সাইক্লোন বয়ে যাবে বলে দিলাম।”
এই বলে ঠাস করে পাতিলে বারি দিলো নিশাত। মারওয়ান চোখ খুলে নিশাতের অগ্নিমূর্তি রূপ দেখে কিছুটা থমকালো। বললো,
“কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে তাই না? ছেলেকে লিলিপুটের বাচ্চা বলেছেন কোন সাহসে?”
“কখন বললাম?”
মারওয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইলো। নিশাত বললো,
“ঢং করবেন না। আপনি না বললে ও লিলিপুট কথা জানলো কিভাবে? ওর সামনে আলতু ফালতু কথা বলতে একদিন নিষেধ করেছি না। আপনি বুঝতে চান না কেন এই বয়সী বাচ্চার সামনে এসব বললে ওরা এগুলো ব্রেইনে দ্রুত ক্যাপচার করে নেয় আর এসবই সারাক্ষণ আওড়াতে থাকে।”
মারওয়ান শরীর, হাত-পা মুচড়ে হামি দিলো। যেন নিশাতের কথা সে শুনতে পায়নি এমন ভাব করলো। নিশাত আবারও চিল্লালে মারওয়ান এবার ধমক দিয়ে বললো,
“বকবক করে মাথা খাবি না বলে দিলাম। খারাপ কোনো শব্দ তো ব্যবহার করিনি। এমন রিয়েক্ট করার মানে কি? হুদাই আমার ঘুম ভাঙানোর নাটক যত্তসব।”
“আপনার কাছে এটা নরমাল লাগছে। ও আপনার ন্যাওটা। আপনি যা করেন বেশিরভাগই ও করার চেষ্টা করবে। ও যদি এখন আমাকে লিলিপুট ডাকে তখন?”
নিশাত রাগী কণ্ঠে বললো। মারওয়ান আবারও হামি দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালালো। ধোঁয়া উড়িয়ে বললো,
“ডাকলে ডাকবে। সমস্যার তো কিছু দেখি না। আফটার অল তার মা তো লিলিপুটই। ডাকলে খুব একটা মন্দ লাগবে না। কত্ত আদুরে ডাক লিলিপুট। আহা!”
মারওয়ান কিছুটা মস্করা করে বললো। নিশাত হাত ভাঁজ করে মুচকি হেঁসে বললো,
“আচ্ছা তাই। আসলেই অনেক আদুরে ডাক।”
এটুকু বলেই প্রস্থান করলো। মারওয়ান গর্বের হাসি হাসলো। এই মহিলার সাথে সে জীবনেও কথায় জিততে পারে না। আজকে জিততে পেরে ভালোই লাগছে। তবে ঘাপলাও লাগছে। এতো সহজেই সব কিছু মেনে নিলো। ব্যাপারটা কেমন গণ্ডগোল লাগলো। যাইহোক এতো ভেবে কাজ নেই। জিতেছে এতেই খুশি সে।
মারওয়ান হাত, মুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখলো নাহওয়ান বিছানায় খেলছে। সে ছেলেকে আদর করে বললো,
“কি করিস ফাইয়াজ?”
“কেলি।”
“খেয়েছিস?”
“কেয়েচি। টুমি ককোন কাবে হাম্বা?”
নাহওয়ান গাড়ি চালাতে চালাতে বললো। মারওয়ানের কপাল কুঁচকে গেলো। তাকে ফাইয়াজ কি ডাকলো? সে নিশ্চিত হতে বললো,
“কি বললি ফাইয়াজ আবারও বল তো?”
“টুমি ককোন কাবে হাম্বা?”
মারওয়ানের চোখ কপালে উঠে গেলো। বাচ্চাটা তাকে কি আদুরে স্বরে বাবা ডাকতো তার মুখে হাম্বা ডাক শুনে রীতিমত চমকে গিয়েছে সে। এটা ওকে শিখালো কে? নিশাতের কথা মনে আসতেই রাগে চোখ মুখ উল্টে যেতে চাইলো। সে রাগান্বিত হয়ে রান্নাঘরে গেলো। নিশাত রান্না করছে তখন। নিশাতের পিছনে গিয়ে জোরে বলে উঠলো,
“ওই ছেলেকে কি শিখিয়েছিস?”
নিশাত রাঁধতে রাঁধতেই জবাব দিলো,
“কই কিছুই তো শিখাইনি।”
“তাহলে ও আমাকে হাম্বা ডাকলো কেন?”
নিশাত তরকারি ঢেকে পিছন ফিরে বললো,
“আর বইলেন না। বলেছি খাম্বা ডাকবি। ও বলে হাম্বা বেশি সুন্দর মা। তাই বলেছি ডাক যা ডাকার। হাম্বা টাও তোর বাপের সাথে যায়।”
মারওয়ান নিশাতের দিকে কটমট করতে করতে বললো,
“হাম্বা আমার সাথে যায় মানে? ওকে খাম্বা, হাম্বা শিখিয়েছিস কেন? কি বিশ্রী ডাক! ফাইয়াজ আমাকে এই বিশ্রী নামে ডাকবে?”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪
নিশাত মুচকি হেঁসে বললো,
“ডাকলে ডাকবে। সমস্যার তো কিছু দেখি না। আফটার অল তার বাবা তো খাম্বাই থুক্কু হাম্বাই। ডাকলে খুব একটা মন্দ লাগবে না। কত্ত আদুরে ডাক হাম্বা। আহা!”
মারওয়ান বুঝলো তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে নিশাত। এভাবে রিভেঞ্জ নিবে বুঝতে পারেনি। তাই সে নিরাশ হয়ে বললো,
“আর জীবনেও ওর সামনে লিলিপুট ডাকবো না। ডাকলে চুপিচুপি ডাকবো। এবার হয়েছে?”
“কথাটা মাথায় ভালোভাবে সেট করে নিলেই ভালো নাহলে..”
“বুঝেছি।”
মারওয়ান সেখান থেকে প্রস্থান করতে করতে বললো,
“সাংঘাতিক বেত্তমিজ মহিলা।”
নিশাত ফিক করে হেঁসে দিলো। হাম্বা বেচারা ভালোই জব্দ হয়েছে।