ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৭ (২)

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৭ (২)
মিথুবুড়ি

_Policlinico Universitario A. Gemelli Hospital_
‘পোলিক্লিনিকো ইউনিভার্সিটারিও এ. জেমেলি হাসপাতাল। ইতালির বৃহত্তম হাসপাতালের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে তাকবীর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিল। মুখে আনন্দের আলো যা অনেক সাধনার পর আজ কিছু অর্জনের বিনিময়। চোখে খুশির ঝলকানি ভাবনায় ঝরে পড়ছে। পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রেয়ান, তাকবীরের কথোপকথনে মনোযোগী। ওর মুখেও প্রশান্তির ছাপ। হঠাৎ করে হাসপাতালের করিডোরে একদল ওয়ার্ডবয় স্ট্রেচার নিয়ে তড়িঘড়ি নিচের দিকে ছুটে গেল। তাকবীর একবার সেদিকে তাকায়, কিন্তু তেমন আমলে নিল না। আবারও ডাক্তারের সঙ্গে কথায় মন দিল। তবুও, এই আনন্দের মাঝেও কোথাও যেন তাকবীরের মনে এক অদ্ভুত অশান্তি। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “এক্সকিউজ মি।”
‘অতঃপর রেয়ানের দিকে ফিরে নিচু গলায় বলল,
“পার্টির কী অবস্থা? তোমার ম্যামের একটা খবর নাও, এখুনি।”
‘রেয়ান যথারীতি মাথা নাড়িয়ে ফোন বের করে সাইডে চলে গেল। তাকবীরের কণ্ঠ নিচু হলেও ডাক্তারের কান এড়ায়নি। ভদ্রলোক হেসে বললেন,
“আপনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?”
‘তাকবীর ফিচলে হাসল। অদ্ভুত ভাবে এলিজাবেথের কথা উঠলেই ওর মুখের রঙ বদলে যায়। চোখেমুখে একধরনের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। তাকবীর হাসি চাপা গলায় বলল,
“খুব। নিজের থেকেও বেশি। তার জন্যই তো এতকিছু করছি।”
‘ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন, “আরেকবার ভেবে দেখুন। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।”
‘তাকবীর দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল, “আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, ডক্টর। আর কিছু প্রয়োজন নেই। আমি সুন্দর একটা জীবন চাই। বাকি সময়টা শান্তিতে কাটাতে চাই।”

‘ঠিক তখনই স্ট্রেচারের চাকার কর্কশ শব্দ করিডোর ভরিয়ে তুলল। অজান্তেই তাকবীরের চোখ সেদিকে চলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তাকবীরের দৃষ্টি আটকে গেল—স্ট্রেচার থেকে ঝুলে থাকা লালচুলের উপর । ডক্টর বারবার ডাকতে থাকলেও তাকবীর শুনতেই পাচ্ছিল না। ওর গভীর, উদ্বিগ্ন দৃষ্টি স্থির অপারেশন থিয়েটারের দিকে অগ্রগামী স্ট্রেচারের দিকে। ডক্টর বাধ্য হয়ে টুরি বাজালো তাকবীরের চোখের সামনে। চমকে উঠল তাকবীর। হতচেতন ভাব কাটিয়ে ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টর ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কি হলো? আপনার মন কোথায়?”
‘তাকবীরের গলা শুকিয়ে গেছে অজান্তেই। শুষ্ক ঢোঁক গিলে স্ট্রেচার যেদিকে গেল, সেদিকে আঙুল তুলে বলল,
“ডক্টর… এখুনি। ”
‘তাকবীরের গলায় অস্বাভাবিক কাঁপন। ডক্টর তাকবীরের বাক্য সম্পূর্ণ হবার আগেই বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“আরে মিস্টার, হসপিটালে এমন কতো রোগীই তো আসে প্রতিদিন!”
‘তবু তাকবীর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। ওর ভেতরে এক অজানা অস্থিরতা। ঘন ঘন গভীর শ্বাস নিচ্ছে। ঠিক তখনই রেয়ান ছুটে এলো। দু’জনের চোখের দৃষ্টি মিলে গেল। রেয়ান তাকবীরের ভীত চোখদুটির দিকে চেয়ে গভীর গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বস, ম্যাম পার্টিতে নেই।”
‘মুহুর্তেই যেন থমকে গেল তাকবীরের দুনিয়া। এক মুহূর্তও দেরি করে না , পাগলের মতো ছুটে গেল অপারেশন থিয়েটারের দিকে। ইতিমধ্যে এলিজাবেথকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লুকাস আগে থেকেই ও.টি. রেডি রাখতে বলে রেখেছিল। তাকবীর পৌঁছেই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কাতে শুরু করে। ধাক্কানোর সাথে সাথে ভাঙা শব্দের মতো কিছু ভেঙে যাচ্ছিল তাকবীরের ভেতরেও। আশপাশের সবাই থমকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত ভাবে। কেউ কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে তাকবীরের ছটফটানি আর অস্থিরতায়।
‘তাকবীর এক মুহূর্তের জন্য থামল না। একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে, যেন দরজা খুললেই ওর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে রেয়ান এগিয়ে গেল। ঝাপটে ধরে তাকবীরকে টেনে বেঞ্চে বসাল। তাকবীর তখনো থামেনি। শরীর ছটফট করছে, কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। ওর ভারি শ্বাস-প্রশ্বাস করিডোরের পরিবেশটাও আরও চাপা করে তুলল। রেয়ান তাকবীরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু তাকবীরের অশান্তি এত সহজে থামার নয়।
‘ দীর্ঘক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতি নিভে গেল। ডক্টর বেরিয়ে আসতেই তাকবীর ছুটে গেল ডক্টরের কাছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে ভাঙা কণ্ঠে ছটফট করে জিজ্ঞাসা করল,

“ডক্টর, আমার এলোকেশী? ইজ শি ওকে?”
‘ডক্টর মুখ থেকে মাস্ক খুললেন। তাকবীরের চোখের গভীর ভীতির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“শি ইজ টোটালি ফাইন। গুলিটা কাঁধের পাশের নরম মাংসের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তেমন কোনো বড় ক্ষতি হয়নি। শুধু সামান্য রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। আশা করা যায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”
‘ডক্টরের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাকবীরের শরীরের সব ভার নেমে গেল। এক গভীর স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। কিন্তু ঠিক পর মুহূর্তেই অদ্ভুত ভাবে চেহারার রঙ বদলে গেল। স্বস্তির জায়গায়, জায়গা নিল ভয়ংকর হিংস্রতা। তাকবীরের চোখে জ্বলতে থাকা ক্রোধের আগুন দেখে রেয়ান হতচকিত হয়ে গেল। তাকবীর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আকষ্মিক ঝাঁপিয়ে পড়ল রেয়ানের উপর। রেয়ানের গলা চেপে ধরে দেয়ালে ঠেসে ধরল। তাকবীর অস্বাভাবিকভাবে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে, আর বন্য প্রাণীর মতো গোঙাতে গোঙাতে বলল,
“আমার এলোকেশীকে তোর ভরসায় রেখে এসেছিলাম। তবে কেন ও হাসপাতালের বেডে? আমি তোকে খুন করব,! খুন করে ফেলব!”

‘তাকবীরের চোখে পাগলামি, হাতে অসহ্য শক্তি। চাপে দৃঢ়তা এতোই ছিল যে নিশ্বাস আঁটকে আসে রেয়ানের। রেয়ান কোনো রকমে ফিসফিসিয়ে বলল,
“বস,, বস শান্ত হোন। আমি রেয়ান, আপনার বডিগার্ড।”
‘কিন্তু এই মুহুর্তে তাকবীরের কানে কোনো কথায় যাচ্ছে না। ওর ক্রোধ যেন সমস্ত পরিবেশকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এবার হয়তো রক্ত ঝড়বে তাকবীরের রক্তিম বর্ণ ধারণ করা চোখ দিয়ে। তাকবীর তখন ক্ষুধার্ত সিংহের মতো রেয়ানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, শিকারকে শেষ করেই ক্ষান্ত হবে আজ। চিৎকার করে বলতে লাগল,
“তুই কি ভেবেছিস, তোকে আমি এতো সহজে ছেড়ে দেব? আমার এলোকেশী শুধু আমার! পুরো দুনিয়াও যদি আমার বিপক্ষে চলে যায়,তাও এলোকেশী আমার, কেউ আমার এলোকেশীকে আমার থেকে দূরে সরাতে পারবে না। তুই আবার কষ্ট দিয়েছিস ওকে! ছাড়ব না তোকে! তুই জানিস না, এলিজাবেথ শুধু আমার ভালোবাসা নয়, আমার সবকিছু। এলিজাবেথ কে তুই ভালোবাসিস না, ও শুধুমাত্রই তোর জেদ।”
‘রেয়ানের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। গলা থেকে কর্কশ গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। ধীরে ধীরে দূর্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“বস… আমি রেয়ান…”

‘তাকবীরের শরীর হঠাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো কেঁপে উঠল। ওর হাত থেকে রেয়ান হঠাৎই পড়ে গেল মেঝেতে। গলা চেপে রেয়ান হাঁপাতে লাগল। তাকবীর আর কিছু না বলে পাগলের মতো ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকল। পানি ছেড়ে মাথা পানির নিচে ধরে রাখল। হাত দিয়ে মাথায় আঘাত করতে করতে ফিসফিস করে বলল,
“এ আমি কী করছি… কেন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না… এলোকেশী…”
‘পানির স্রোত তাকবীরের মুখ আর চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা আর অপরাধবোধ থামছে না। চোখে রাগ, কপালে ভাঁজ, কিন্তু গলার কণ্ঠে হাহাকার। ঘুষি মেরে আঘাত করতে থাকল দেয়ালে। তাকবীরের মনে সবকিছু নিয়ে প্রচণ্ড অস্থিরতা। যদিও এখনো অনেক রহস্য অমীমাংসিত, তবে এক ব্যাপারে তাকবীর নিশ্চিত ছিল যে—রিচার্ড হয়তো এলিজাবেথকে ভালোবাসে। আর সেই কারণেই এলিজাবেথের পেছনে এভাবে লেগে থাকা। তবে রিচার্ডের প্রকৃতি সম্পর্কে তাকবীর নিশ্চিত ছিল, আর যায় হোক রিচার্ড এলিজাবেথের ক্ষতি করতে চায় না, বরং কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।

‘রিচার্ড সবসময় মানুষের দুর্বলতা খুঁজে বের করে এবং সেটার সুযোগ নেয়। এলিজাবেথকে নিয়ে রিচার্ডের এই আচরণও ওর সেই বৈশিষ্ট্যেরই অংশ। তাই আজ পার্টিতে রিচার্ডের উপর ভরসা করেই তাকবীর এলিজাবেথকে রিচার্ডের হাতে রেখে এসেছিল। তাকবীরের ভাবনা ছিল, ফাদারের উপস্থিতিতে রিচার্ড কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু আজ যা ঘটেছে, তা তাকবীরের সমস্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।
এই মুহূর্তে তাকবীর বুঝতে পারছে, এলিজাবেথকে একা রাখা মানেই মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া। তাকবীর যেকোনো মূল্যে এলিজাবেথকে সুরক্ষিত রাখতে চায়, তাই নিজের শত্রুর ভরসায় রেখে আসেছিল এলিজাবেথকে। কিন্তু আজকের ঘটনাগুলো তাকবীর কে হতবাক করে দিয়েছে। তাকবীরের চিন্তার প্রতিটি স্তরে প্রশ্ন, আর প্রতিটি উত্তরই ওকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছে।

‘আর আজ রিচার্ডের পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রিচার্ড ইচ্ছাকৃতভাবেই এলিজাবেথের উপর গুলি চালিয়েছিল, তবে এর পেছনে ছিল একটি সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য। রিচার্ড জানত, যদি ও এলিজাবেথকে ওদের হাত থেকে সরাসরি বাঁচিয়ে নেয়, তবে এলিজাবেথ সবার নজরে চলে আসবে। আর এতে এলিজাবেথের জীবন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠত। রিচার্ডের শত শত শত্রু, যারা রিচার্ডকে মারতে না পেরে বারবার এলিজাবেথকে টার্গেট করত। এই পরিস্থিতি এড়াতেই রিচার্ড সিদ্ধান্ত নেয় এলিজাবেথের উপর গুলি করার। নিজের নিশানার উপর ছিল চরম আত্মবিশ্বাস। তাই রিচার্ড এমনভাবে গুলি চালায়, যাতে বুলেট কাঁধের মাংসের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায় এবং এলিজাবেথ বড় কোনো আঘাত না পায়। রিচার্ডের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটলও তাই। গুলি এলিজাবেথের শরীরে আঘাত করলেও প্রাণঘাতী হয়নি। রিচার্ড জানত, এই কৌশলই এলিজাবেথকে দীর্ঘমেয়াদে রক্ষা করবে।

__কোবরা ম্যানশন__
‘ম্যানশনটির নাম যেমন রহস্যময়, তার পরিবেশও তেমনই বিভীষিকাময়। চারপাশ জুড়ে থমথমে নিস্তব্ধতা। বিশালাকার গেটটি কিং কোবরার লেজের আদলে তৈরি, তার ধাতব শরীরে কেমন এক শীতল হুমকি জড়িয়ে আছে। লনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পাখির ডানার মতো বড় পাখনা-জোড়া নিয়ে টহল দিচ্ছে সশস্ত্র সিপাহিরা। তাদের পিঠে মরণঘাতী অস্ত্র ঝুলছে, চোখগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিটি ছায়া-আলো স্ক্যান করে চলেছে।

‘হঠাৎ, এক অস্বাভাবিক বিকট শব্দে নিস্তব্ধতা চুরমার হয়ে যায়। কালো রঙের একটি BMW প্রচণ্ড জোড়ে ব্রেক কষে থামে ম্যানশনের গেটের সামনে। টায়ারের কর্কশ ঘর্ষণ কানে লাগতেই গার্ডদের ইয়ারপিসে সতর্ক সংকেত পৌঁছে যায়। সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সশস্ত্র বাহিনী ফটকের সামনে জড়ো হয়ে যায়, তাদের বন্দুকের নলগুলো নিশানায় অটল। ড্রাইভারের দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে আসে লুকাস। কোনো দ্বিধা না করে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দেয়। তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে আসে রিচার্ড। তার পরনে এখনো পার্টি স্যুট,তাতে লেগে আছে কিছুক্ষণ আগের ধ্বংসলীলার ছাপ। ঠান্ডা চোখে চারপাশের গার্ডদের দিকে একবার তাকায় রিচার্ড। বেরিয়ে আসল ন্যাসোও৷
‘তিনটি কালো ছায়ার মতো ফিগার একসাথে এসে থামে, আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে যায়।

তিনজনের পরনেই কালো পোশাক, অন্ধকারের মূর্ত প্রতীক। তাদের উপস্থিতি চারপাশে এক অদৃশ্য হুমকি ছড়িয়ে দেয়। শারীরিক গঠন আর অদ্ভুত শীতল অভিব্যক্তি বলে দেয়—এরা কোনো সাধারণ মানুষ নয়। একসঙ্গে তিনজন সামনের দিকে পা বাড়ায়, পদক্ষেপে একে একে তাদের শক্তির স্বাক্ষর রেখে চলে। রিচার্ডের মুখ ঢাকা কালো মাস্কে, অথচ চোখে লুকিয়ে আছে তীব্র আগুন, ক্ষোভের তীব্রতা এতোই যে_যে কারো স্নায়ু গলিয়ে দিতে পারে। ম্যানশনের গেটের সামনে পৌঁছাতেই প্রধান গার্ড তাদের পথ আটকালো। তবে তার চোখের গভীরে ছিল ভয়ের স্পষ্ট ছাপ। রিচার্ডের দৃষ্টির অগ্নিবর্ণ শীতলতায় সেও ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল। তবুও ডিউটির প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে তাকে দৃঢ় থাকতে হলো।
‘ঠিক তখনই গার্ডটির ইয়ারপিস থেকে সংকেত এলো। গার্ড তর্জনী চেপে ইয়ারপিসে শুনতে লাগল বসের আদেশ। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুখে গম্ভীরতা খেলা করল। অতঃপর এক নিম্ন অথচ গভীর স্বরে বলল,

“ওকে বস।”
‘পরপর রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে শীতল নির্দেশনা ঝরল, “যেকোনো একজন ভিতরে যেতে পারবে।”
‘রিচার্ড মুহূর্তের জন্য থামল। ওর চোখের পলকহীন দৃষ্টি গার্ডের আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করে দিতে উদ্যত। পরপর কোনো কথা না বলেই রিচার্ড এগিয়ে গেল, পেছনে ছায়ার মতো তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে রইল, নিঃশব্দ পাহারায়। ন্যাসো, লুকাস গার্ডটির দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই, গার্ড সাথে সাথে চলে গেল এবং তাদের মুখের উপর গেট লাগিয়ে দিল।

‘রিচার্ড তার স্বতঃস্ফূর্ত কদমে লনের মাঝখানের সরু পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি ভঙ্গিমায় অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস, যেন এ পথ তারই জন্য তৈরি। চোখেমুখে নেই এক ফোঁটা উৎকণ্ঠা। বরং রিচার্ডের চোখের গভীরে হিংস্র শিকারির মতো আত্মবিশ্বাসের ঝলক, যা প্রতিটি পদক্ষেপে ধ্বনিত হয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সশস্ত্র গার্ডদের দৃষ্টি রিচার্ডের ওপর নিবদ্ধ। কেউ কেউ হতবাক হয় রিচার্ডের নির্লিপ্ত অ্যাটিটিউড দেখে। শত্রুর একেবারে গোপন দুর্গে ঢুকে পড়েও তার এমন নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাওয়া তাদের বুঝিয়ে দেয়, এ লোককে থামানো সহজ নয়।
‘ম্যানশনের বিশাল দরজার সামনে গিয়ে থামল রিচার্ড। মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা, তারপর কর্কশ ইস্পাতের ঘর্ষণের মতো শব্দ মাইকে প্রতিধ্বনিত হলো। যা বুঝাল, মাইকটি চালু করা হয়েছে। সতর্কবার্তা আসছে—তেমনটাই আশা করেছিল রিচার্ড। মাস্কের নিচে রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রুপের হাসি ফুটল। মাইকের রোবটিক্স স্বর ধাতব কর্কশতায় ভেসে এলো। মাইকে অনবরত কর্কশ শব্দ তুলতে লাগল। রিচার্ড দৃঢ় গলায় বলল,

“হোয়াটস মাই ট্রাবল?”
‘মাইক থেকে এবার ভেসে এল কর্কশ শব্দ, যেন প্রশ্নবাণ ছুড়ছে,”এ মাস্ক।”
‘কথা শেষ হতেই রিচার্ড সটান হয়ে দাঁড়ায়, কণ্ঠে ঠান্ডা অথচ দৃঢ়তা, “শুড আই এক্সপোজ মাই ফেস?”
“ইয়েস, স্যার।”
‘রিচার্ডের দাপুটে কণ্ঠস্বর,”নেগেটিভ।”
“আর ইউ আনঅ্যাট্রাকটিভ।”
‘রিচার্ডও প্রতিটি কথার জবাব ঠান্ডা মেজাজে, নিখুঁত আত্মবিশ্বাসে উত্তর দিল,”ফার ফ্রম ইট।”

‘এই আত্মবিশ্বাসের সাথে পেরে উঠা কারোর কাম্য নয়। তৎক্ষনাৎ দুই ভাগ হয়ে খুলে গেল বিশাল দরজা৷ সাধারণত ঘরে ঢুকলেই প্রথমে বসার ঘর চোখে পড়ে। কিন্তু এই ম্যানশনে দরজার সামনেই বিশাল একটি অফিস। ভেতরে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। রিচার্ড ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। রিচার্ডের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ডেস্কের সামনে উল্টো ঘুরে বসা লোকটির দিকে। এক মুহূর্ত দেরি না করে, রিচার্ড পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শক্ত হাতে লোকটির ঘাড় মোচড় দিয়ে নিমেষে লোকটার প্রাণ কেড়ে নিল। নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই রিচার্ডের ভ্রু কুঁচকালো। এটা তার শিকার নয়।
‘ঠিক তখনই অন্ধকারে অসংখ্য টার্গেট লাইটের মতো লাল আলোর বিন্দু এসে রিচার্ডের শরীরে আঁচড় কাটতে লাগল। প্রতিটি লাল আলো যেন তাদের নিশানা ঠিক করছে। আশপাশের সশস্ত্র অস্ত্রধারীদের গুঞ্জন মৌমাছির ঝাঁকের মতো ভেসে আসছে। রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করল। তখনই হঠাৎ করেই ঘর ভরে উঠল ঝলমলে আলোয়। আর সেই সঙ্গে ভেসে এলো এক কর্কশ অট্টহাসি—জেমসের। রিচার্ড গর্জন করতে করতে গ্রীবা ঘুরিয়ে দ্বিতীয় তলায় তাকাল। সেখানে সারি সারি গার্ড দাঁড়িয়ে, তাদের বন্দুকের নল রিচার্ডের দিকে স্থির হয়ে আছে। আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জেমস। তার মুখে এক ঘৃণ্য হাসি ঝলমল করছে, যা আরও বেশি ক্রোধ ছড়িয়ে দেয় রিচার্ডের চোখে।

“তুই ডালে ডালে চললে, আমি চলি পাতায় পাতায়। তুই কি ভেবেছিস তোর পরবর্তী পদক্ষেপ আমি জানব না? আমার রাজ্যে এসে আমাকে মেরে যাওয়ার চিন্তা করিস।”
‘রিচার্ড কোনো উত্তর করে না দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাখে। জেমস আরো বলতে লাগল, “প্রতিবার টার্গেট মিস হলেও আজ আর হবে না। গুড বায় গ্যাংস্টার বস।”
‘সকলে ট্রিগারে হাত বসাবে তখনই ভেসে আসলো রিচার্ডের উচ্চশব্দের হাসি। ভরকে যায় সকলে। জেমস অগ্নি চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড হাসল কিছুক্ষণ। অতঃপর ঠাস করে খুলে দিল ওর কোটের বোতাম। তৎক্ষনাৎ সকলের চোখেমুখে ফুটে উঠল ভীতি। রিচার্ডের কোটের ভিতর ফিট করা পারমাণবিক বোমা।
“শা*লা জীবনে শুনেছিস পিঁপড়ে হাতিকে মারতে পারে? তুই কি আমাকে ইন্ডিয়ার চিতাবাঘ ভাবিস, যে সাধারণ পাবলিকের সামনে ধরা পড়ে যাবে? আমার লেভেল এত নিচু না, বুঝলি? মারবি তো,,? আয় মার!”
‘ঘনঘন শুষ্ক ঢোক গিলতে থাকে জেমস। তখনই শব্দে রুম থেকে বেরিয়ে আসে লাড়া। রিচার্ডকে দেখা মাত্র যেন আকাশের চাঁদ দেখতে পেল। চোখ ঘুরাতেই যখন উপরে চোখ গেল সঙ্গে সঙ্গে লাড়া রিচার্ডের সামনে গিয়ে দু-হাত ছড়িয়ে, রিচার্ডের বিস্তৃত দেহ ওর ছোট হাত দিয়ে আড়াল করতে চাইলো। জেমস আর রিচার্ডের পূর্ব শত্রুতা সম্পর্কে লাড়া খুব ভালো করেই অবগত। লাড়া জেমসের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

“ড্যাড তুমি এটা করতে পারো না।”
“লাড়া স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম হিম।”
“ড্যাড ড্রপ দ্য গান। আই সেইড,ড্রপ দ্য গান।”
‘লাড়া গলা ছেড়ে উশৃংখলের মতো চেঁচাল। জেমস বরাবরই মেয়ের জন্য খুবই পাগল। একটা মাত্র আদরের মেয়ে। বাধ্য হয়ে গান নামিয়ে ফেলতে ইশারা করল গার্ডের। তার আগেই রিচার্ড ধাক্কা মেরে লাড়া কে সরিয়ে দিল।
“হাঁট! রিচার্ড কায়নাত নিজেকে নিজে প্রতিরক্ষা করতে জানে।”
‘পরপর জেমসের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুষ্ঠ গলায় বলল,”আজ এসে সাহস দেখিয়ে গেলাম। পরবর্তীতে আর দেখাদেখি চো*** না। ডিরেক্ট উড়িয়ে দিব,আমার জিনিসের উপর হাত বাড়ালে।”

‘হনহনিয়ে চলে গেল রিচার্ড। ওদের মধ্যে সাপে-নেউল যুদ্ধ চিরকালীন। গুপ্তচররা একে অপরের পেছনে লেগেই থাকে সবসময়। এলিজাবেথের উপর পরপর দুইবার হামলা যে করেছে, তা আর কেউ না, জেমসই। এলিজাবেথের ব্যাপারে জেমস এবং তার লোকজন ওরা বাংলাদেশে থাকতেই জানতে পারে, তবে প্রথম আক্রমণটা ইতালিতে আসার পরই করে। রিচার্ড সেটা শুরু থেকেই জানত। ফলস্বরূপ, মরতে হয়েছিল জেমসের সবথেকে বিশ্বস্ত বডিগার্ড কে। নিজের হাতে মেরেছিল রিচার্ড । সেই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে, আজ জেমস এলিজাবেথ এবং রিচার্ড দুজনকে একসাথে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। এক আঘাতে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রিচার্ড, সে কখনও থামবে না—অবশ্যই। রিচার্ডের ইচ্ছাশক্তি এবং ক্ষিপ্রতা তাকে এতোই প্রতিরোধহীন করে তুলেছে, আর কোনো বাধাই তাকে থামাতে পারে না।
‘লাড়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলো রিচার্ড যাওয়ার পানে৷ হঠাৎ করেই ঠৌঁট কামড়ে হাসল।
“আই ওয়ান্ট দ্যাট গাই অ্যাট অল কোস্টস”
“লাড়া।” ~ শোনা মাত্র উপর থেকে চেঁচাল জেমস। লাড়া পিছন ফিরল। জেমসের দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে সরু গলা বলল,
“ইউ নো ড্যাড অলওয়েজ গেট হোয়াট আই ওয়ান্ট”

‘গাড়ি ড্রাইব করছে ন্যাসো। পাশেই বসে আছে লুকাস। পেসেঞ্জার সিটে বসে আছে রিচার্ড, _গম্ভীর, নৈঃশব্দ্য।
লুকাস নিশপিশ করছে কিছু বলার জন্য। আজ আর নিজেকে ধমিয়ে রাখল না লুকাস। মুখে ফুটল ভিতরের কথা। শুষ্ক ঢোক গিলে সকল জড়তা দূর করে নিল৷
“বস।”
“যা বলতে চাও সরাসরি বল।”
‘রিচার্ডের সরু গলার সরাসরি জবাবে ভরকে যায় লুকাস। আমতাআমতা করতে থাকল,
“বলছিলাম কি, এভাবে মেয়েটার উ,
” ম্যাম।”
‘ঠান্ডা গলায় নিরব হুশিয়ারি রিচার্ডের। একেবারে মিইয়ে যায় লুকাস। ন্যাসো ঠৌঁট কামড়ে হাসতে থাকল। লুকাস আবার বলতে শুরু করল ভুল সংশোধন করে।
“ম্যামকে এভাবে সুট করা ঠিক হয়নি আপনার। গুলিটা কাঁধে না লেগে যদি অন্য কোথায় লাগতো, বাঁচানো মুশকিল হয়ে যেত।”

“আমার নিশানা কখনো ভ্রষ্ট হয় না লোকা, আমি যে লক্ষ্যস্থলে আঘাত করি, তা অবশ্যম্ভাবী।”
‘দু’টি লাইনে লুকাসের মুখ বন্ধ করে দেয় রিচার্ড। আজ মুখ খুললো ন্যাসো। ফ্রন্ট মিররে রিচার্ডের দিকে তেরছা নজরে চেয়ে স্টিয়ারিংয়ে হাত চালিয়ে সরু গলায় বলল,
“আমাদের গ্যাংস্টার বস কি তবে প্রেমে পড়েছে?”
‘রিচার্ডের স্বাভাবিক গলা,বলল_ “এমনটা কেন মনে হলো ?”
“আপনার আচরণেই আমি যা বলেছি তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। যেই রিচার্ড কায়নাত তার আশেপাশে কোনো মেয়েকে আসতে দেয়, সেই রিচার্ড এখন বারবার এক সাধারণ মেয়ের কাছে ছুটে যাচ্ছে। মেয়েটির দিকে চোখ পড়া প্রতিটি চোখ উপড়ে ফেলছে। যে লোক মেয়েদের নূন্যতম সম্মান দিতে জানে না, সে বলছে একটা মেয়েকে ম্যাম ডাকার জন্য। এসবের মানে আর কি হতে পারে বস?”

‘শক্ত হলো রিচার্ডের স্বর_,” বেশি বুঝা, এবং ভাবা কোনোটাই আমার পছন্দ নয়।”
‘আজ দমে না ন্যাসো। _” বস আপনি না মানলেও এটাই সত্য হৃদয়হীন,নিষ্ঠুর গ্যাংস্টার বস প্রেমে পড়েছে। ভালোবাসেন আপনি ম্যামকে।”
‘নিরবতা চূর্ণ করে, হিংস্র এক প্রাণীর মতো গর্জে উঠলো রিচার্ড, গাড়ি কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“তোমরা যাকে ভালোবাসা বল, তা আসলে মোহ—বাস্তবতার এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। ভালোবাসা কখনোই বাস্তবতার যুদ্ধে জয়ী হতে পারে না। আমি চাই না সেই হেরে যাওয়া ভালোবাসা, যা শুধুমাত্র আবেগের নরম পর্দায় ঢাকা থাকে। আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তাতে যতই নৃশংসতা থাকুক, তবুও দুটি হৃদয় একত্রিত হোক। হোক—কোনো বাধা, কোনো কোমলতা, আর কোনো ভয় না রেখে। তবে আমার মধ্যে সেই হৃদয় নেই,,নেই।”

_থেমে,
“নারী মানেই মিথ্যা আর ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি। আমি নারীদের প্রতি অপার ঘৃণা অনুভব করি। আমার জীবনে তাদের কোনো স্থান নেই।”
‘এবার মুখ খুললো লুকাস, “তাহলে সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে ম্যামের বিপদের খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন কেন? স্থলপথে দেরি হবে বলে এতগুলো টাকা খরচ করে হেলিকপ্টারে করে কেন গিয়েছিলেন? সত্যিই কি কোনো অনুভূতি ছাড়াই সেদিন এভাবে ছটফট করে ছুটে গিয়েছিলেন?”
“আর একটা কথা বললে দুটোকেই পুঁতে দিব।”
‘চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রিচার্ড । চুপসে যায় ন্যাসো, লুকাস দু’জনেই। রিচার্ড নিজের হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। তার তীক্ষ্ণ, গুরুগম্ভীর, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্জ্বলিত মস্তিষ্ক কিছুতেই এই অনুভূতিগুলোকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। অস্বস্তিকর এই বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করার প্রশ্নই ওঠে না। ওর দৃষ্টিতে, নারী মানেই ধ্বংসের প্রতীক—যারা শুধুই পুড়িয়ে দিতে জানে। ঠিক যেমন এখন কঠোর হৃদয়ের এই মানুষটা ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছে, নিঃশব্দ যন্ত্রণায়।

[ বেকিং নিউজ : সবেমাত্র আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এ পর্যন্ত থানার ভেতর থেকে পঞ্চাশেরও বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে কোনো কয়েদিই বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। আগুন লাগার কারণ এখনো অজানা। ]
‘পাশের সিটে পড়ে থাকা ট্যাবে এতটুকু নিউজ দেখেই রিচার্ড ট্যাবটি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল। লুকাস এবং ন্যাসে হতভম্ব হলেও, এই মুহূর্তে কিছু বলার সাহস কেউ পেল না। রিচার্ডের চোয়াল ক্রোধে মটমট শব্দ করছে। দাঁতে দাঁত চেপে, নিচু গলায় তাকবীরের উদ্দেশে এক নোংরা গালি ছুঁড়ে দিল।’

‘এলিজাবেথের জ্ঞান ফিরে মধ্যরাতে। আশপাশে তাকবীর ছিল না। পিটপিট করে চোখ মেলে নিজের অবস্থান বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল এলিজাবেথ, তবে এর মধ্যে নার্সটির উপস্থিতি লক্ষ্য করল না। নার্সটি ফিসফিসিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। এলিজাবেথের কানে কিছু শব্দ আসে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, জ্ঞান ফেরেনি এখনো। ঐ মিনিস্টারটা এখন একাই আছে। এটাই সুযোগ, খতম করে দিন।”
‘মিনিস্টার বলতে তাকবীর—তাকবীরের নাম মনে হতেই এলিজাবেথ আঁতকে উঠল। নার্সটি পিছন ফিরতেই এলিজাবেথ দ্রুত চোখ বুজে ফেলল। নার্স এলিজাবেথের দিকে এক নজর দিয়ে বেরিয়ে গেল। এলিজাবেথের বুকের ভিতর তীব্র ঝড় উঠে। নার্সটি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এলিজাবেথ সাবধানে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। দিশেহারা হয়ে তাকবীরকে খুঁজতে লাগল। তাকবীর রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
“ভালো মানুষ।”

‘হঠাৎ এলিজাবেথের ডাকে তাকবীর চমকে উঠল। চকিত চোখ খুলে সামনে তাকাল। এলিজাবেথ ছুটে আসছে তার দিকেই , ভয় এলিজাবেথের মুখাবয়বে স্পষ্ট। তাকবীরও দ্রুত এলিজাবেথের দিকে ছুটে গিয়ে এলিজাবেথকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। এলিজাবেথ হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে বসে পড়ল। তাকবীরও হাঁটু গেড়ে বসে গেল।
“এলোকেশী, এলোকেশী, কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?”
“ওরা, ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে।”
‘এলিজাবেথ হাঁপাতে হাঁপাতে এইটুকু বলতেই, হঠাৎ একটি বুলেট তাকবীরের কানের কাছ দিয়ে উড়ে গিয়ে রিসেপশনিস্টের মাথায় ঢুকে যায়। এলিজাবেথ কেঁপে উঠে তাকবীরকে খামচে ধরে। তাকবীর চমকে সামনে তাকালে দেখতে পায়, একটি বন্দুক তাদের দিকে তাক করা। তাকবীর সেই মুহুর্তে কোনোকিছু না ভেবেই এলিজাবেথকে নিজের আড়ালে ঢেকে, ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরল। গুলির নিশানায় পড়লো তাকবীরের পিঠ। কিন্তু ঠিক ট্রিগারে আঙুল বসানোর আগেই, আড়াল থেকে একটি কাঠের খণ্ড ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে এসে ঘাতকের হাতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকটি হাত থেকে পড়ে গেল। এই সুযোগে, তাকবীর এলিজাবেথকে নিজের বুকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। এক হাতে এলিজাবেথের চোখ চেপে ধরে, অন্য হাতে কোমরে গুঁজে রাখা বন্দুকটি বের করে, ঘাতকের কপালের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিল। ঘাতকের নিশানা মিস হলেও, তাকবীরের নিশানা ছিল নিখুঁত। গুলি ঘাতকের মগজে গিয়ে ঢুকে।

‘সাথে সাথে একঝাঁক হামলা শুরু হল তাদের উপর। তাকবীরের জন্য এলিজাবেথের সামনে দাঁড়িয়ে এদের সাথে লড়া সম্ভব ছিল না। তাকবীর দ্রুত এলিজাবেথের হাত টেনে ধরে, সামনের দিকে ছুটতে থাকল। হঠাৎ করেই একটি বিকট শব্দে কেঁপে উঠল হসপিটালের প্রাঙ্গণ। হসপিটালের আপস্টেয়ার ব্লাস্ট হয়েছে। একে একে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। রোগী, নার্স, ডক্টররা যার যার প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকল। গুলির শব্দ, বোমার বিস্ফোরণ আর মানুষের চিৎকার পরিবেশকে আরও উত্তেজিত করে তুলে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া গুলাগুলি হচ্ছে। একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছে,আগুন ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। সকলের লিফটের দিকে ছুটে। সিঁড়িতে আগুন।
‘হঠাৎই তাকবীরের হাত থেকে ভীড়ের মধ্যে এলিজাবেথের হাত ছুটে যায়। সকলের মধ্যে ঠেলাঠেলির কারণে তাকবীর লিফটের শেষ মাথায় চলে যায়। সামনে বের হতে চাইলেও পারে না। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া।তাকবীর ভীড়ের মধ্যে গলা ছেড়ে এলিজাবেথকে ডাকতে থাকে, কিন্তু তার ডাক এলিজাবেথের কান অব্ধি পৌঁছায় না। এলিজাবেথ ধাক্কাধাক্কিতে নিচে পড়ে যায়। সবাই ছুটে লিফটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, এতো মানুষের পাড়াপাড়ের মধ্যে এলিজাবেথ উঠতে পারে না।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৭

‘ব্যর্থতার শেষ পর্যায়ে যখন এলিজাবেথ কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং লিফটের দরজাও এবার বন্ধ হয়ে যাবে, ঠিক তখনই ধোঁয়ার মধ্যে একটি শক্ত হাত এলিজাবেথের হাত টেনে ধরে। ওকে হেঁচকা টানে তুলে লিফটের দিকে ধাক্কা মারে। সঙ্গে সঙ্গেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।এলিজাবেথকে দেখতে পেয়ে তাকবীরের বুকে পানি আসে। দ্রুত এলিজাবেথকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে যায়। তারা লিফট থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে ছুটতে থাকে। তাকবীরের হাতের বাঁধনে এলিজাবেথের হাত। ওকে টেনে রাস্তার দিকে ছুটছে তাকবীর। তবে এলিজাবেথ বার বার শুধু পিছনে তাকাচ্ছে, যেন ভিতরে খুব মূল্যবান কিছু রেখে এসেছে, যা ওকে টানছে, খুব করে। ঠিক তখনই হাসপাতালের পুরো বিল্ডিং বিস্ফোরিত হয়।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৮