ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৮
মিথুবুড়ি
‘সেদিনের ভয়ংকর মুহূর্ত থেকে ফিরে আসার পর তাকবীর আর কোনো ঝুঁকি নেয়নি। পরের দিনের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে ব্যাক করে। নিজের এতদিনের সাধনার সুমিষ্ট ফল হাতছাড়া হয়ে গেলেও, এলিজাবেথের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ফিরে আসার। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাকবীর ছিল ভীষণ ভগ্ন। তাকবীর জানত, যা হারিয়েছে তা শুধুই বস্তু নয়, বরং ওর দুই বছরের সাধনা, ওর নতুন জীবনের সূচনা। যা ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে।
‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল বিয়ান। টার্মিনাল ‘বি’ দিয়ে বেরিয়ে আসে তাকবীর। পাশে এলিজাবেথ—পাতলা চাদরে ঢাকা কাঁধের ক্ষত। পিছনে রেয়ান, ধীর পায়ে তাদের লাগেজ নিয়ে এগিয়ে আসছে। সবাই বাইরে শান্ত, অথচ ভেতরে কেউই আগের মতো নেই। তাকবীর’রা গাড়ির সামনে আসা মাত্র বিয়ার ডোর খুলে দেয়। তাকবীর আর এলিজাবেথ গিয়ে পেসেঞ্জার সিটে বসল। রেয়ান বসল বিয়ানের পাশে, দীর্ঘ দশদিন পর দুই ভাইয়ের দেখা। তবুও দেখা গেল না কোনোরূপ সৌজন্যতার রেশ। গাড়ির চাকা ঘুরল দেওয়ান মঞ্জিলের উদ্দেশ্য।
‘দেওয়ান মঞ্জিল এয়ারপোর্ট থেকে খুব দূরে নয়। তারা খুব সময়ের মধ্যেই এসে পৌঁছায়৷ ওরা সদর দরজায় পা রাখতেই ভেসে এলো তাজুয়ার দেওয়ানের গভীর, গম্ভীর কণ্ঠ। এলিজাবেথ ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল, আশঙ্কায় সেঁটে গেল তাকবীরের পাশে। তাকবীর চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস ফেলে, যেন ও জানত এমন কিছুই হবে। উপরতলা থেকে তাজুয়ার দেওয়ান দৃঢ় পায়ে নেমে এলেন। উনার ভারী উপস্থিতি বাতাসকে আরও থমথমে করে তুলল। এসে সোজা তাকবীরের সামনে দাঁড়ালেন। মুহূর্তের জন্য নীরবতা, তারপর তার গভীর কণ্ঠস্বর ফেটে পড়ল:
“এই মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকবে না।”
“আব্বা আমরা খুব টায়ার্ড। সামনে থেকে সরুন৷”
“বীর।” ~চেঁচিয়ে উঠল তাজুয়ার দেওয়ান।’
‘ভারি হলো তাকবীরের স্বর। এলিজাবেথের শরীরের প্রকম্পিত আন্দাজ করতে পেরে বাবার দিকে চেয়ে চাপা স্বরে বলল,”আব্বা স্বর নামিয়ে।”
“বীর, আমার সাথে বেয়াদবি করবে না একদম। এই মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। ক্যালিফোর্নিয়া আর ইতালিতে যে কী কী হয়েছে, সব খবর আমার কানে এসেছে। এই মেয়ে একটা অলক্ষী—ওর জন্য বারবার বিপদে পড়তে হচ্ছে তোমাকে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘তাজুয়ার দেওয়ানের কঠোর কণ্ঠের বিপরীতে তাকবীর দাঁতে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে স্থির থাকল,নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। এদিকে এলিজাবেথ পিছনে দাঁড়িয়ে,তাকবীরের দৃষ্টির আড়ালে, নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। তবে তা তাকবীর খুব ভালো করেই ধরে ফেলতে পারে। ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকল তাকবীরের স্বর।
“আব্বা আপনি নিজের পুত্রবধূকে সম্মান দিতে না পারলেও আমার স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমার৷ গিভ হার রেসপেক্ট আব্বা।”
“এই মেয়েকে তুমি এখনো সম্মান দিতে বলছো? এই মেয়ের জন্য তুমি মরতে মরতে বেঁচে এসেছো। আমার একমাত্র ছেলে তুমি বীর, তোমাকে আমি কোনোকিছুর বিনিময়েই হারাতে পারব না।”
“আর এই মেয়ে আমার বাঁচার উৎস। ছেলেকে বাঁচাতে চাইলে এই মেয়েকে তার যথাযথ সম্মান আপনাকে দিতেই হবে আব্বা৷”
‘সংযম হারিয়ে চেঁচাল তাকবীর। এলিজাবেথ ভয়ে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যেতে থাকে। পিছন থেকে তাকবীরের কোট খামচে ধরে। তাজুয়ার দেওয়ানের শূন্য দৃষ্টিতে জমে আছে ক্রোধের পাহাড়। বজ্রপাতের মতো গম্ভীরস্বর ঘর ভেদ করে বলল,
“এটাই আমার শেষ কথা। এই মেয়ে আমার বাড়িতে ঢুকবে না।”
‘এবার তুষ্ট হাসল তাকবীর। তাজুয়ার দেওয়ানের চোখে চোখ রেখে তাকবীর অতি সাবলীল গলায় বলল,
“আব্বা এই বাড়ি কিন্তু আপনার নামে না। আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেমে আমার নামে করে দিয়েছিলেন আমার নামে৷ তো এখন আমি বাড়ির মালিক কে কিভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলি?”
‘তাজুয়ার দেওয়ানের ললাটে ভাঁজ সংকুচিত হলো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে সরু গলায় বলল,
“মানে?”
“মানে এই বাড়ি এখন আমার নামেও নেই। বিয়ের দিনই দেনমোহর হিসেবে এলিজাবেথের নামে করে দিয়েছি আমি, এই বাড়ি৷”
‘মাথায় ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন অনুভূত করল তাজুয়ার দেওয়ান। তাকবীর কলার চেপে ধরে গলা ছেড়ে চেঁচাল,
“তুমি এটা কি করেছ? কোন সাহসে?”
‘তাকবীরের অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাজুয়ার দেওয়ানের অভিব্যক্তি দেখে কণ্ঠনালী বেয়ে হাসির উদগীরণ ঘটলো কাশির মাধ্যমে। এলিজাবেথের উদ্ভাসিত হয় দুই নয়নজোড়া বিস্মিত। এই একটা মানুষ আর কতো করবে তার জন্যে,কতো সবার বিরুদ্ধে যাবে? এলিজাবেথ বিহ্বল হয়ে নিজের দিকে তাকাল। কই, তার মাঝে তো এমন কিছুই নেই। সে তো আর সবার মতোই সাধারণ। তবুও কেন একজন মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে তার জীবন ধ্বংস করতে, আর অন্যজন নিজের সবকিছু নিংড়ে দিয়ে তাকে রক্ষা করে চলেছে?
“চলো এলোকেশী।”
‘তাকবীর যখনই এলিজাবেথের হাত ধরতে যাবে, ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে কাজের বুয়ার হাত থেকে একটা ফুলদানি পড়ে যায়। বিকট শব্দে ঘরের নীরবতা ভেঙে যায়। তাকবীর শক্ত চোখে বুয়ার দিকে চেয়ে বলল,
“কাজ ঠিকমতো করতে না পারলে অবসরে চলে যান, খালা। এলোকেশী, উপরে যাও।”
‘তাকবীরের গলায় ধীর অথচ দৃঢ় একটা সুর ছিল, যেখানে কোনো ভুল বরদাশত করার জায়গা নেই। এলিজাবেথ মাথা নুইয়ে নীরবে উপরে চলে যায়৷ তাকবীর তাজুয়ার দেওয়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে এলিজাবেথের পিছন পিছন গেল ওর লাগেজ নিয়ে৷ এলিজাবেথের লাগেজ ওর রুমে দিয়ে যখন তাকবীর ঘুরে দরজার দিকে হাঁটা দেয় তখনই শোনা গেল পিছন থেকে এলিজাবেথের ভাঙা স্বর ,
“আর কতোদিন এভাবে সবার বিরুদ্ধে যাবেন আমার জন্য?”
‘তাকবীরের পা থামে,তবে পিছন ফিরে না। শুধু গ্রীবা বাকিয়ে দৃঢ় গম্ভীর গলায় বলল,
“যতোদিন না তোমাকে নিজের করে পাই।”
‘তাকবীরের কণ্ঠে ছিল এক অদম্য প্রতিজ্ঞার সুর, যা বাতাসের ভারী নীরবতাকেও বিদীর্ণ করে দিল। আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না তাকবীর। এলিজাবেথ পিছন থেকে বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল।
‘সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি এলিজাবেথ। মনের মধ্যে অজানা এক অস্থিরতা, অদৃশ্য কোনো টানাপোড়েন সারাক্ষণ তাড়া করে যাচ্ছে। জানালার পাশে বসে রাত পার করল এলিজাবেথ। ভোর হতে না হতেই হঠাৎ দেখতে পাই, পুলিশের কয়েকটা জিপ একে একে দেওয়ান মঞ্জিলে ঢুকছে। কৌতূহলে দমিয়ে রাখতে পারে না এলিজাবেথ,নগ্ন পায়ে সিঁড়ির কোণ নিরবে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিকে দরজার কলিং বেল অনবরত বেজে চলেছে। শেষমেশ তাকবীর নিজেই দরজা খুলতে আসে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এক অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রেম, তার হাতে ঝুলছে চকচকে হ্যান্ডকাফ। মুখে কঠোর গলায় বলে উঠল—
“ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট, মিনিস্টার তাকবীর।”
‘তাকবীর হতবাক। প্রেমের চোখে জ্বলজ্বল করছে দৃঢ়তা। কয়েকদিন আগেই প্রেম পুলিশ ফোর্সে যোগ দিয়েছে। তাকবীর কখনো ভাবতেও পারেনি সকাল সকাল তাকে এমব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাজুয়ার দেওয়ান তাদের আশ্রয়ে গিয়েছে সকাল সকাল। তাকবীর একটুও বিচলিত হলো না, বরং গলার ঝাঁঝ বাড়িয়ে বলল,
“গলার আঁচ নামিয়ে। জানেন কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন?”
‘প্রেমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি চুপসে গেল, তার মুখে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু প্রেমের চোখের দৃঢ়তা এতটুকু নড়ল না। তাকবীরের কথার জবাবে প্রেম জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমরা আমাদের ডিউটি করছি, মন্ত্রী সাহেব। ডিউটির ক্ষেত্রে পরিচয়ের চেয়ে দোষটাই আগে দেখা হয়।”
‘তাকবীরের মুখে কটাক্ষ ফুটে উঠল। চোখে তখন ক্ষোভের দহন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কিসের ভিত্তিতে আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন? আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে?”
‘প্রেম এক পা এগিয়ে এল,গলার ভার আরও দৃঢ় হয়ে গেল।
“প্রমাণ যথেষ্ট, মন্ত্রী সাহেব। আপনি জানেন, সময় হলে সবকিছুই পরিষ্কার হবে। এখন আর কাগজে সই দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন না।”
‘তাকবীরের চোখে খেলা করল দ্বন্দ্বের ছায়া। চারপাশে পুলিশের উপস্থিতি আর প্রেমের অটল অবস্থান তাকবীরের অভ্যস্ত অহংকারে চিড় ধরাতে শুরু করে৷ তাকবীর ঠোঁট উল্টে বলল,
“চাকরির জন্য এতটুকু মায়া নেই? এক্ষুনি প্রমাণ দেখান। নাহয় তোমাদের সবাইকে আজই বান্দরবানে ট্রান্সফার করিয়ে ছাড়ব।”
‘প্রেম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বরং ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলল। ধীরে ধীরে পকেট থেকে একটি ছবি বের করে তাকবীরের সামনে ধরে বলল,”এটা দেখুন।”
‘ছবিটি এতটাই ভয়ঙ্কর ও নৃশংস ছিল যে তাকবীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ ঘুরিয়ে নিল। প্রেম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এই মেয়েটিকে কাল খুন করা হয়েছে।”
‘তাকবীর উদাসীন ভঙ্গিতে বলল,”তাতে কী? সেটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?”
‘প্রেম এবার ঠান্ডা হাসি দিল। চোখে রহস্যময় দৃষ্টি।
“সম্পর্ক আপনার স্ত্রীর সম্মানের সঙ্গে, মন্ত্রী সাহেব। এবং আপনি সেটা ভালো করেই জানেন। আমাদের কাছে এয়ারপোর্টের সিসিটিভি ফুটেজ আছে।”
‘তাকবীরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ক্রোধ আর শঙ্কার ছায়া একসঙ্গে খেলে গেল মুখে। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠ বলল,
“কাল সকালের এয়ারপোর্টের ঘটনার সাথে মার্ডারের সম্পর্ক কি?”
‘তাকবীর ও এলিজাবেথের গোপন বিয়ের খবর তাকবীর নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়। খবরটি রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। তরুণ মিনিস্টারের বিয়ের খবরে ভেঙে যায় অসংখ্য তরুণীর মন। তাদের হতাশা এবং ঈর্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এলিজাবেথ।কাল এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে চড়ে বের হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎই এক মেয়ে দৌড়ে এসে তাদের গাড়ির সামনে পড়ে। রেয়ান, মন্ত্রীর বডিগার্ড এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, বুঝে যায় মেয়েটির উপস্থিতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে উগ্র আচরণ না করে মেয়েটিকে শান্তভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। এলিজাবেথ কৌতূহলী হয়ে গাড়ির জানালার কাঁচ নামায়। সেই সুযোগে মেয়েটি আচমকা এলিজাবেথের মুখে পানি ছুড়ে মারে। ঘটনাটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে তাকবীর রাগে ফেটে পড়ে। গাড়ি থামিয়ে নামার চেষ্টা করলে এলিজাবেথ তাকবীরকে থামিয়ে দেয়। রেয়ান পরিস্থিতি সামলে দ্রুত মেয়েটিকে সরিয়ে দেয় এবং গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে যায়।
‘এই ঘটনাটি তখনকার এয়ারপোর্ট সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। প্রেম সেই ফুটেজের কথা বলছিল। এবং সেই মেয়েটিই, যাকে এদিন রেয়ান সরিয়ে দিয়েছিল, কাল রাতে তাকে অমানবিকভাবে খুন হয়েছে। তার মৃত্যু এতটাই নৃশংস যে তাকবীরের মতো শক্ত হৃদয়ের মানুষও ছবিটা সহ্য করতে না পেরে চোখ সরিয়ে নেয়।প্রেমের কণ্ঠে তীক্ষ্ণতার ঝাঁঝ স্পষ্ট ছিল,
“আমরা জানি, এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি আপনার কোনো হাত নেই। তবে আপনার স্ত্রীর সম্মান এবং সেই মেয়েটির আচরণের পেছনের কারণ, সবকিছুর যোগসূত্র আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।”
“কি প্রমাণ আছে তুলে ধরুন।”
‘মেয়েলি স্বরে পিছন ফিরে তাকায় সবাই। এমন উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এলিজাবেথের উপস্থিতি তাকবীরকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। প্রেম নিজের ভ্রু কুঁচকে এলিজাবেথকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয়, যেন এক ঝলকে এলএলিজাবেথকে বিশ্লেষণ করছে। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মনে মনে হাসল,
“এবার সব পরিষ্কার। মিনিস্টার আর এই গ্যাংস্টার মেয়েটিকে নিয়ে এমন পাগলামি করার কারণ।”
‘এলিজাবেথ সোজা হয়ে তাকবীরের পাশে এসে দাঁড়াল। ওর চোখেমুখে আজ কোনো ভয় বা সংকোচের চিহ্নমাত্র নেই। বরং এক কঠিন দৃঢ়তায় প্রেমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওনাকে কি আপনারা ঘটনাস্থলে দেখেছেন? খুনের অস্ত্রে ওনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়েছেন? নাকি মেয়েটির আত্মা এসে আপনাদের বলে গেছে, খুনটা কে করেছে?”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠে ঝাঁঝ, কিন্তু শব্দগুলো পরিষ্কার এবং নির্ভীক। চারপাশের পুলিশদের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। প্রেম ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু মুখে এক ফোঁটা বিভ্রান্তির চিহ্নও ফুটে উঠল না। এলিজাবেথের সাহস সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
“কি হলো বলুন?”
‘প্রেম কোনো জবাব দিতে পারল না। সত্যি বলতে, তার হাতে দৃশ্যমান প্রমাণ কিছুই নেই। সিসিটিভি ফুটেজে মেয়েটির আচরণ আর তাকবীরের উপস্থিতি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু সেই সন্দেহের বশেই সে এতদূর আসা। তার উপর আগে থেকেই মিনিস্টার তাকবীরের প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ। সবার চোখে মানবতার ফেরিওয়ালা হলেও, প্রেমের কাছে তাকবীর ছিল রহস্যময় এক জাল। বহুবার সেই রহস্য ভেদ করতে চেয়েও যথাযথ প্রমাণের অভাবে বারবার ব্যর্থ হয়েছে সে। তাই আজ এই সুযোগ পেয়ে সেটি হাতছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু এলিজাবেথের কঠোর প্রশ্ন এবং অদম্য আত্মবিশ্বাস প্রেমের সমস্ত পরিকল্পনা এলোমেলো করে দেয়। ভেতরে এক অস্বস্তি কাজ করতে লাগল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, উপস্থিত পুলিশ সদস্যরাও কেমন নীরব হয়ে গেছে।
“আমার স্বামী কাল আমার সাথে ছিল। আপনারা আসতে পারুন।”
“আমি আবারও আসব।”
‘চাপা গলায় বলে চলে গেল প্রেম। সেদিকে খেয়াল নেই তাকবীরের। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলো এলিজাবেথের দিকে। “স্বামী” শব্দটা শোনা মাত্র সহসাই এক উজ্জ্বলিত শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো ভিতরে৷ ঠোঁট গহ্বরের ফাঁক গলে ছুঁটে চললো প্রাপ্তির হাসি। যেই হাসি মিশে গেল আকাশে বাতাসে। অধর গলিয়ে কিছু শব্দ আসবে তখনই বসার ঘর থেকে ভেসে আসে নিউজ।
[ব্রেকিং নিউজ : ইতালির বৃহত্তম হাসপাতাল অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন, ড্রাগন গ্রুপের চাঞ্চল্যকর ঘোষণা__
‘সম্প্রতি ইতালির সর্ববৃহৎ হাসপাতালটির রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। এবার ড্রাগন গ্রুপের একজন মুখপাত্র, লিভার রিচার্ড কায়নাতের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা, এক প্রেস কনফারেন্সে ঘটনার সত্যতা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, রিচার্ড কায়নাত সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। ঠিক সেই সময় তার উপর হামলা হয়, যা পরিণত হয় দুই পক্ষের ভয়াবহ সংঘর্ষে। এ সংঘর্ষের মাঝেই বোমা বিস্ফোরণের ফলে হাসপাতালটিতে আগুন ধরে যায়। আগুনের মধ্যেই সাধারণ জনগণকে উদ্ধারে রিচার্ড কায়নাত নিজের জীবন বাজি রাখেন, যার ফলে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। ড্রাগন গ্রুপ থেকে জানানো হয়েছে, হাসপাতালটির পুনর্নির্মাণের সম্পূর্ণ ব্যয় তারা বহন করবে। এই ঘোষণার সাথে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খবর সামনে এসেছে—রিচার্ড কায়নাত বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এই মুহুর্তে। বি আর বি হসপিটালে চিকিৎসারত রয়েছে। আরো জানা যায়, গত চার বছর ধরে সফলতার শীর্ষে থাকা জে.কে এম্পায়ার আসলে রিচার্ড কায়নাতেরই মালিকানাধীন। ড্রাগন গ্রুপ আরও নিশ্চিত করেছে, রিচার্ড কায়নাত এখন থেকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবেন এবং নিজে থেকেই তার ব্যবসা পরিচালনা করবেন।
এই ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ]
‘রিচার্ডের সাহসিকতার গল্প জটিল সত্য আর রহস্যে মোড়া। খবরের বয়ানে সবকিছু স্পষ্ট নয়, রয়েছে মিথ্যা, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—রিচার্ড নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে আটকে পড়া সেই মানুষটি আর কেউ নয়, এলিজাবেথ। তবে রিচার্ড শুধু আগুনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, রহস্যময় ঘাতকের গুলিতেও বিদ্ধ হয়েছিল। তবুও একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে,তাকবীরের ওপর হামলা চালালো কে? এই অমীমাংসিত রহস্য আরও গভীর করে তুলেছে পুরো ঘটনাকে।
‘থমকে রইল এলিজাবেথ। নিজের ভাবনায় ডুবে যেতেই অভ্যন্তর শিউরে উঠল। তাকবীর শক্ত করে রেখেছে চিবুক। এলিজাবেথ বিহ্বলিত ভাবে ফিরল তাকবীরের দিকে। আশ্চর্যজনক ভাবে এলিজাবেথের গলা কাঁপছে।
“সেদিন উনি আমাকে বাঁচিয়ে ছিল?”
‘তাকবীর নিশ্চুপ।
“ভালো মানুষ বলুন না।”
‘তাকবীর নিচু স্বরে প্রত্যুত্তর করল, “হয়তো।”
“আর আমরা ওনাকে ঐ আগুনের ভিতর ফেলে এসেছিল?
” এলোকেশী তখন আমি বা তুমি কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না, আর না জানতাম মানুষটা কে। নিজেকে দোষী ভেবো না।”
‘বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে গেল এলিজাবেথের মন। মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে রাখে।
“তুমি কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাচ্ছো এলোকেশী? যাবে হসপিটালে?”
‘এলিজাবেথ আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না সঙ্গে সঙ্গে ছুটে উপরে গিয়ে দোয়ার আঁটকে। তাকবীর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। সে তো জাস্ট এমনিতে বলেছে। কেউ কখনোই চাইবে না তার প্রতিপক্ষের কাছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে যেতে। কিন্তু না_দুই মিনিটের মাথায় আবার এলিজাবেথ ছুটে আসে। তাকবীর ঘুরে পিছন ফিরল। দূবোর্ধ এলিজাবেথের দিকে তাকাতেই এলিজাবেথ বলল,
“আমাকে নিয়ে চলুন ভালো মানুষ।”
‘তাকবীর চোখ বন্ধ করল। ভারি এক নিশ্বাস ছাড়ল। ভালোবাসার গভীরতা তাকে এমন স্থানে নামিয়েছে, যেখানে “না” শব্দটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আর কিছু বলার পথ রইল না। অগত্যা, রাজি হতেই হলো তাকবীরকে।
‘তাকবীরের গাড়ি বি আর বি হসপিটালের সামনে গিয়ে থামল, কিন্তু তাকবীর নিজে ভিতরে যায়নি, শুধু এলিজাবেথকে পাঠিয়েছে। সে রিচার্ডের সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি হতে চায়নি। যাওয়ার আগে অবশ্য এলিজাবেথকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে দিয়েছে। এলিজাবেথ ভিতরে প্রবেশের আগে মনে মনে ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু বুকের সাহসকে সঞ্চয় করে একে একে এগোতে থাকে। ভিআইপি কেবিনের সামনে পৌঁছাতেই পা থেমে গেল। পুরো জায়গাটা রিচার্ডের গার্ডদের দখলে ছিল, তাদের অনুমতি ছাড়া এক মাছিও ভিতরে ঢুকতে পারবে না। সবার হাতে বড় বড় অস্ত্র। তবে এলিজাবেঝ এক বুক সাহস নিয়ে,জড়সড় হয়ে, এগিয়ে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে, গার্ডরা ওকে কোনো বাধা দিল না। বরং, সবাই মাথা নুইয়ে রাখল। রিচার্ডের কেবিনের সামনে পৌঁছাতেই, ভিতর থেকে বেরিয়ে এল লুকাস। দুজনের মুখোমুখি দেখা৷ এলিজাবেথকে দেখামাত্র লুকাস দৃষ্টি শক্ত করল। ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল,
“এখানে কি?”
‘লুকাসের শক্ত গলায় কেঁপে উঠল এলিজাবেথ। আইঁটাই করতে থাকে। আঙুল কচলাতে কচলাতে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,”ভিতরে যাবো।”
‘লুকাসের কাটকাট জবাব,”ভিতরে এখন যেতে পারবে না।”
‘হতবিহ্বল হয়ে মাথা তুলল এলিজাবেথ, বলল, “কে-কেন?”
”কারণ বস বিজি আছে।”
‘এলিজাবেথও বোকার মতো পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “কি নিয়ে বিজি?”
“বিজনেস।”
“কিসের বিজনেস?”
“অসুস্থতার বিজনেস।” ~বলেই ঠৌঁট কামড়ে হাসতে লাগল লুকাস। বোকা বনে যায় এলিজাবেথ। পরপর মেকি রাগ দেখিয়ে লুকাসের পাশ ঘেঁষে তেজ নিয়ে ভিতরে চলে গেল। তবে তেজ যতো দ্রুত উঠে ছিল ঠিক তত দ্রুতই নেমে গেল, ভিতরে ঢোকা মাত্র। রিচার্ড আধা সোজা হয়ে বসা, গায়ে কিছুই নেই। কাঁধে আড়াআড়ি ভাবে সাদা ব্যান্ডেজ করা। এলিজাবেথকে দেখামাত্র, রিচার্ড গ্রীবা বাঁকিয়ে এক বিকৃত হাসি দিল, যদিও এলিজাবেথের আগমন একেবারেই প্রত্যাশা করেনি। এলিজাবেঝের চোখ, রিচার্ডের নীল চোখজোড়ায় পড়তেই, শরীর কিছুটা কাঁপল। এক মুহূর্তের জন্য, মাথা নুইয়ে ফেলল, যেন কোনো অদৃশ্য ভার ওর ওপর চেপে বসেছে। রিচার্ড ঠোঁট কামড়িয়ে হাসল শুধু, অতঃপর এলিজাবেঝের পুরো শরীরটা চোখের পলকে স্ক্যান করে নিল—পা থেকে মাথা পর্যন্ত। কিন্তু যখনই এলিজাবেঝের চুলের দিকে নজর গেল,মেজাজ তৎক্ষণাৎ বদলে গেল। রাগের আগুন মুহূর্তে চোখে ছড়িয়ে পড়ল। তবুও, নিজেকে সংবরণ করে সে কিছু বলল না রিচার্ড। অযাচিত ভাবে অভিব্যক্তিতে এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল।
“কাম ক্লোজার রেড।”
‘এলিজাবেঝ কেঁপে উঠল রিচার্ডের স্বরের তীব্রতায়। এলিজাবেথের ভাষ্য অনুযায়ী, রিচার্ডের স্বরের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ওজন আছে, যা খুবই ভারি এবং এলিজাবেঝের ধারণক্ষমতার বাইরে।
“রেড কাম।”
‘রিচার্ডের এবারকার স্বরে কিছুটা রাগ ছিল, এক ধরনের অগ্রাহ্যতা, যা এলিজাবেঝকে বাধ্য করল সামনে এগোতে। বেডের পাশে যেতেই, রিচার্ড হঠাৎই এলিজাবেথকে এক হাতেই হেঁচকা টান দিয়ে নিজের ওপর ফেলে দিল। তৎক্ষণাৎ, মুখ এলিজাবেঝের ঘাড়ে গুঁজে দিল। পুরো শরীর জুড়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো একটা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল এলিজাবেথের। দেহের প্রতিটি কোষ ছুটতে চাইছিল, কিন্তু শরীর স্থির হয়ে জমে রয়েছে, আটকে গিয়েছিল এক অদৃশ্য শক্তিতে।
“কি-হ,, কি করছেন?”
“হিসসস !! আমি অসুস্থ রেড, আমাকে মেডিসিন নিতে দাও।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের ঠৌঁটে ওর তর্জনী রেখে থামিয়ে দিল। রিচার্ডের সেই হাস্কি স্বর এলিজাবেথের প্রতিটি লোমকূপে শিহরণ তুলে দিতে থাকে। চোখমুখ কুঁচকে শক্ত হয়ে থাকল এলিজাবেথ। রিচার্ড ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে এলিজাবেথের শ্বাসনালী।
“কেন এসেছো?”
‘রিচার্ড নিজের কাজে অনড় থেকে প্রশ্ন ছুড়ল। কিন্তু এলিজাবেঝ কোনো উত্তর দিতে পারল না। কিছু একটা যেন ওর কণ্ঠনালিতে আটকে রয়েছে, অজানা এক বাধা। রিচার্ড এবার এলিজাবেঝের গলায় কামড় বসায়। দন্তের দাগ বসিয়ে তবেই মুখ সরাল। ব্যথায় এলিজাবেথ কুঁচকে গিয়ে, রিচার্ডের বাহু খামচে ধরে। রিচার্ড এলিজাবেথকে আরো কাছে টেনে নিল, ওর মাথায় চুড়ো করা চুলগুলো এক হাতে খুলে কাঁধে ছড়িয়ে দিল। ঢেকে দিল উন্মুক্ত কাঁধ। চুলগুলো আঁচড়ে পড়ে এলিজাবেঝের পিঠে, এক ঝাঁক অনুভূতি হয়ে। রিচার্ড নাক ডোবাল এলিজাবেঝের ঘন লাল কেশে, এক গভীর শ্বাসে শুষে সব ঘ্রাণ টেনে নিল। পুরো পৃথিবীকে যেন রিচার্ড এক মুহূর্তে নিজের মধ্যে শোষণ করছে। এলিজাবেথের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।
“ডোন্ট বি অবসেসড উইথ মি ডার্লিং। আই অ্যাম ডেমন আই ক্যান হার্ট ইউ উইদাউট এনি রিগ্রেট।”
‘সহসাই মুখ থেকে এবার শব্দ বের হয় এলিজাবেথের।
“করুন না আঘাত।”
” উমহু,,এখন শুধু আদর করব।”
‘বলে আবারও রিচার্ড এলিজাবেথের কাঁধে মুখ গুঁজতে যায়। তখনই দরজা খোলার শব্দ শোনা যায়। ডক্টরকে দেখামাত্র এলিজাবেথ লজ্জায় রিচার্ড বুকে মুখ গুঁজে। ডক্টর নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বিগড়ে গেল গ্যাংস্টার বসের মেজাজ। ডক্টরের দিকে চেয়ে রুষ্ট গলায় চেঁচিয়ে বলল,
“শালা তোকে ডক্টরেট ডিগ্রি কে দিয়েছে? প্রাইভেসি বলতে কি, বুঝিস না? ঘরে বউ নেই?”
‘চুপসে গেল ডক্টর। এমনিতে তো রিচার্ডের আশেপাশে আসতেই ভয় লাগে, তার উপর আবার রিচার্ডের এই ঝাঁঝালো স্বর। আমতাআমতা করতে লাগল ডক্টর,
“স্যার, আপনার মেডিসিন ছিল।”
“মুড নেই এখন,,গো, গেট আউট।”
‘বেকুব বনে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে গেল ডক্টর। সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথ রিচার্ডের বুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে যায়। রিচার্ড হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে তাকায় এলিজাবেথের দিকে। ক্রোধে চেঁচাল এলিজাবেথ,
“একদম ছুঁবেন না আমাকে। কি ভেবেছেন আমি কিছুই বুঝতে পারি না?কেন মেরেছেন ঐ মেয়েটাকে? নিজের খুনের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন,লজ্জা লাগে না।”
“লজ্জা তো তোমার লাগবে। প্রতিদিন সকালে নিজের নগ্ন শরীরের পাশে যখন আমাকে দেখবে।”
‘এলিজাবেথ এবার করে বসল এক দুঃসাহসিক কান্ড। রিচার্ডের হাতে লাগানো ক্যানোলা এক হ্যাঁচকায় টান দিয়ে খুলে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত গলগল করে বেরোতে শুরু করল হাত থেকে। এলিজাবেথ এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকল না। গলা ছেড়ে চেঁচাতে শুরু করল, চিৎকারে পুরো কেবিন কেঁপে উঠে।
“একদম নাটক করবেন না। কেন এমন করছেন? কেন নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে আমাকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন?
‘এলিজাবেথের চিৎকার চেঁচামেচিতে গার্ডরা সর্তক হয়ে ভিতরে এলে আসে। গান পয়েন্টে নিয়ে নেয় এলিজাবেথ। তাৎক্ষণিক রিচার্ডের হাতের গৌড় বর্ণের শিরা উপশিরা গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠল। গার্ডদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধরিত্রী কাঁপানো ঝংকার তুলে চেঁচাল,
” শুয়োরের বাচ্চারা, গান নামা। সবগুলোর হাত আমি ভেঙে গুড়ো করে দিব ৷”
‘সকল গার্ডের চোখে মুহূর্তেই ঝিলিক দিয়ে উঠল মৃত্যুর ভয়। এক মুহূর্ত দেরি না করে তারা তটস্থ হয়ে দ্রুত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এলিজাবেথ ধপ করে নিজেকে ধাতব মেঝেতে ছেড়ে দিল। মাথা ঠেকিয়ে বেডের কোণে ডুকরে কেঁদে উঠল। রিচার্ডের শূন্য দৃষ্টি তবুও জ্বলছে ক্রোধে, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের অপেক্ষা। তবে ঠোঁটের কোণে জমে থাকা রহস্যময় হাসিটা মুছে যায়নি। পরক্ষণেই, রিচার্ড হঠাৎ করে এলিজাবেথের হাত ধরে এক হেঁচকায় সোজা করে তুলল। দু’হাতে এলিজাবেথের কোমর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নিপুণ দক্ষতায় শূন্যে তুলে নিজের তলপেটের উপর বসিয়ে দিল। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে, এলিজাবেথ পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেল।
‘রিচার্ড গ্রীবাদ্বয়ের পিছনে হাত বাঁকিয়ে মুঠোয় নিল এলিজাবেথের চুল। একটানে এলিজাবেথের মুখ নিয়ে এলো নিজের মুখের কাছে। এলিজাবেথ অনুভব করল রিচার্ডের উত্তপ্ত নিশ্বাস, যা ওর নিজের শ্বাস ভারি করে তুলল। রিচার্ড চুলের মুঠিটা শক্ত করে ধরে এক টানে বলল, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“মাথা থাকবি আমার আর সংসার করবি অন্যজনের সাথে? আমাকে কী তুই জান্নাতের বাম পাশের দরজা, আর ডান পাশের ফেরেশতা ভেবেছিস?”
‘এলিজাবেথের কান্নার তোড় কমে এলো। কণ্ঠ ভাঙা হলেও গলার মধ্যে অসীম তেজ, বলল,
“আপনি আমাকে কখনোই পাবেন না মি. রিচার্ড কায়নাত।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের নাকে নাক ঘষতে ঘষতে তুষ্ট হাসল। অপর হাতে এলিজাবেথের গালের নরম মাংসে স্লাইড করতে করতে হাস্কি স্বরে বলল,
“হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকলেও শরীরের শক্তি একফোঁটাও কমেনি এলি জান, তুমি চাইলে আমি এখনই প্রমাণ দিতে পারি, আমি কি পারি, না পারি।”
‘বলার পরপরই রিচার্ড কামড় বসিয়ে দিল এলিজাবেথের নাকের ডগাল। এলিজাবেথ এবার ইচ্ছাকৃতভাবে খামতে ধরলো রিচার্ডের গুলিবিদ্ধ জায়গায়। সাদা ব্যান্ডেজ ছোপ ছোপ রক্তে সিক্ত হতে থাকল। তবুও নিটল রিচার্ড। এলিজাবেথ রাগলও না কাঁদলও না, বরং রিচার্ডের কথার পারদে ফিচলে হেসে বলল,
“আপনি তো আসলে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই এগিয়ে এসেছেন, তাই না? আচ্ছা, তাহলে আপনি আমার কাছে ক্ষমা চান প্লিজ। আপনি এটা মানুন বা না মানুন, কিন্তু আপনি জানেন—আপনি আমার সাথে খুব অন্যায় করেছেন। এখন, ক্ষমা চান আমার কাছে। আমি নিঃশেষ হওয়ার আগে, আপনাকে মাফ করে দিয়ে যেতে চাই।”
‘থমকে যাওয়া মস্তিষ্কটা এক লহমায় ফিরে গেলো তার ভয়ংকর রূপে। সব কিছু আছড়ে পড়লো এক দানবীয় শক্তিতে। গুমোট পরিবেশ কেঁপে উঠল রিচার্ডের হুংকারে, যেন বাতাসও থমকে দাঁড়ালো। নিজের ইস্পাত-দৃঢ় কপালের সাথে এলিজাবেথের কপাল রিচার্ড। কাঁপল পুরো কক্ষ,
“মাফ? আমি মাফ চাই না, আর তুই তা দিতে গেলেও নিতে চাই না। মাফ মানে হলো মন থেকে মুছে ফেলা, আর আমি তোকে সেই শান্তিটা দিতে আসিনি। তোর রক্তে, তোর শ্বাসে, তোর প্রতিটা ঘৃণার কণিকায় আমি থাকতে চাই। ভুলে যাওয়ার কথা ভাববি না। ঘৃণার আগুনে পুড়বি, আর আমি সেই আগুনের ইন্ধন হবো। তুই বাঁচবি, মরবি, কাঁদবি—সবকিছুতেই শুধু আমি থাকব। মনে রাখ, মুক্তি তোর কপালে নেই, কারণ সেটা আমি কখনোই দেব না।”
‘এলিজাবেথ ভয় পেল না, অবাকও হলো না। রিচার্ডের কাছ থেকেও এরথেকে ভালো কিছু আশা করাও পাপ। চোখবুঁজে নিশ্চুপ রইল। কিছু মুহুর্ত নিরবতা কাজ করল তাদের মাঝে। মিশে থাকল দু’টো কপাল একসাথে। কমলো রিচার্ডের হিংস্রতার প্রভাব। নিস্তব্ধতা ভাঙল রিচার্ডের মৃদু স্বরে,
“এলি জান।”
‘এলিজাবেথ চোখবুঁজা অবস্থায় ধীম স্বরে বলল,” হুম।”
‘অবাক করে দিয়ে এবারও রিচার্ডের শান্ত স্বর,
“একবার আপনি বলো।”
‘এলিজাবেথ কোনো প্রশ্ন ছাড়ায় বলল,”আপনি।”
‘এবার সোজা হলো রিচার্ড। নিজের দুহাতের শক্ত আজলায় চেপে ধরল এলিজাবেথের দু’টি গাল। বলল,
“হ্যাঁ, তুই আমাকে আপনি বলবি। তোর মুখ থেকে আমি-তুমি শুনলে নিজ হাতে তোর জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলব। তোর “আপনি” ডাক আমার রক্তে যে শান্তি ঢালে, তা তোর সর্বস্ব ধ্বংস করেও পাই না।”
‘এলিজাবেথ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। কোনো প্রত্যুত্তর করল না। রিচার্ড এলোমেলো ভাবে এলিজাবেথের সারা মুখে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। তারপর হঠাৎ এলিজাবেথের মাথা শক্ত করে চেপে ধরল ওর শক্ত বুকে। এতোই শক্ত করে, যেন ছেড়ে দিলেই কোথায় পালিয়ে যাবে। এলিজাবেথ নড়াচড়া করে না একটু। তবুও রিচার্ড আগ বাড়িতে নিরেট ঠান্ডা গলায় বলল,
“নড়বে না রেড। তিনদিন ধরে আমার ঘুম হয় না। আমি একটু ঘুমাবো।”
‘টু শব্দ অব্ধি করল না এলিজাবেঝ। রিচার্ড এলিজাবেঝকে দু’হাতের শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর ঘুমে চলেও গেল। এলিজাবেথ নিরবে রিচার্ডের বুক ভিজিয়ে দিতে লাগল। যখন বুঝল রিচার্ড ঘুমিয়ে গেছে, এলিজাবেথ চেষ্টা করল রিচার্ডের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। তবে রিচার্ডের হাত ছিল অদ্ভুতভাবে দৃঢ়। এলিজাবেঝ অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে তুলল, উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিস্প্রভ, দ্বিধাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিচার্ডের ঘুমন্ত অবয়বে। এলিজাবেথের চোখের কোণে একঝাঁক অশ্রু বেয়ে পড়ল, সময় থেমে রয়েছে, আর ওর সমস্ত যন্ত্রণা গালে বসে গেছে অশ্রুধারার মতো।
“আমি ভাঙা নদীর, ভাঙা কূল। যে কূল ধরতে চাই, সে কূলই আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। দুনিয়ার সবথেকে নিকৃষ্ট আর অসহায় নারী বোধহয় আমি। আমি আর পারছি না এভাবে, মনের সাথে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি বারবার।”
‘অস্পষ্ট স্বরে বিরবির করে সঙ্গে সঙ্গে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল এলিজাবেথ। এটা যেন এক অবশ অবস্থা, যেখানে তুমি খুঁজে পেতে চাও কিছু ভালো, কিছু সমর্থন, কিন্তু সেই আশা তোমাকে বারবার ভেঙে পড়ে। তুমি বুঝতে পারছো, একে একে সব কিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর সেই ভাঙা জায়গাগুলোর সাথে যুদ্ধে তুমি হারিয়ে যাচ্ছ। এই কষ্টের মধ্যে, তুমি নিজেকে একা এবং নিকৃষ্ট করে তুলছ। মনের মধ্যে উল্টোপাল্ট হয়ে ঘুরতে থাকতে কথা গুলো। অথচ দৃষ্টি সেই নিচে। ছাদের রেলিঙের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ। মনে ভরে দেখে নিচ্ছে ধরিত্রীকে শেষবারের মতো।
“তুমি ভাঙা, কিন্তু তোমার ভাঙনেই তোমার শক্তি। তুমি হেরে গিয়ে, জিতার প্রস্তুতি নিচ্ছো অগোচরে।”
‘ভারী গম্ভীর স্বরে চকিতে এলিজাবেথ পিছনে ফিরে। চোখের পানি ছিটকে পড়ল নিচে। রিচার্ড সাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর মানে রিচার্ড তখন সব কথা শুনেছিল? এলিজাবেথের উতপ্ত খরখরে মরুভূমির পানে চেয়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলল,
“কেন এসেছেন?”
‘রিচার্ড অতি স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে সাবলীল ভাবে জানতে চাইছে, “মরতে চাচ্ছো?”
“হয় আমি থাকব, নয় আপনি। একে অপরের থেকে দূরে থাকার জন্য একজন কে মরতেই হবে।”
‘রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে ভ্রু কুঁচকে দেখলো এলিজাবেথকে। অভিব্যক্তি এমন যেন সে খুব মজা পেয়েছে। স্বস্তঃস্ফূর্ত কদমে ভ্রু নাচাতে নাচাতে বলল,
“দূরে থাকতে চাচ্ছে কেন? প্রেমে পড়ে গিয়েছো নাকি?”
“ঘৃণা করি আমি আপনাকে ঘৃণা। এছাড়া আপনি আর কোনোকিছুর ই যোগ্য নন।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের খুব কাছে এসে যায়। এলিজাবেথ পিছন ঘুরে রেলিং এ উঠতে যাবে, তার আগেই রিচার্ড লম্বা পা ফেলে দু’কদমে গিয়ে ধরে ফেলল এলিজাবেথকে। নিজের দিকে ঘুরিয়ে এলিজাবেথকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল। রুষ্ট গলায় দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“খুব শখ নাহ?”
‘এলিজাবেথ রিচার্ডের বুকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে হাত-পা ছুঁড়ে। আকুতিভরা টলটলে চোখে বলতে থাকে,
“ছেড়ে দিন আমাকে, মরতে চাই আমি মরতে। এই যন্ত্রণা
আমি আর নিতে পারছি না। আপনি যা চাচ্ছেন, সেই সত্য দুনিয়া কখনো মানবে না।”
“আমি সেই নায়ক হতে চাই না, যে আত্মত্যাগের নামে ভালোবাসা বিসর্জন দেয়। আমি ভিলেন, যে সত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে সারা দুনিয়াকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে নিজের ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়।”
‘এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল এলিজাবেথ। ভেজা চোখজোড়া স্থির হলো রিচার্ডের উপর। বলল,
“মানে,,!! ভালোবাসেন আপনি আমাকে?”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২৭ (২)
‘রিচার্ড নিজের থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল এলিজাবেথকে। এলিজাবেথ ছিটকে গিয়ে পড়ল নিচে। রিচার্ড হাঁটু মুড়ে বসে এলিজাবেথের সামনে। ওর ভেজা চিবুক চেপে ধরে উপরে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“না না না বাসি না। তোকে আমি হাসতেও দিব না, কাঁদতেও দিব না। তুই শুধু ছটফট করবি, আর আমি তোর ভেতরের অন্ধকারে রাজত্ব করব।”