মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৬
মুসতারিন মুসাররাত
ঢিলেঢালা লাল টি-শার্ট পরা ছেলেটা শক্ত হাতে প্রত্যাশার কবজি মুচড়ে ধরে রেখেছে। প্রত্যাশার ছটফটানি দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” ভাই, মাইয়াডা তো দেহি কুরবানির গরুর মতো ছটফটানি শুরু করছে! ধইরা রাখা কষ্ট হইতেছে। আশেপাশে গাড়িঘোড়া, লোকজন, সামনে ব্রিজের ওপর পু’লিশ ভ্যানও আছে। এখানে থাকা রিস্ক। তাড়াতাড়ি মুখ বাইন্ধা ফালান।”
গাল চেপে ধরে রাখা ছেলেটা বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তড়িঘড়ি করে মুখ বাঁধতে লাগল। এক সেকেন্ডের জন্য মুখটা একটু ছেড়ে দিতেই প্রত্যাশা হাঁপাতে হাঁপাতে একটা শ্বাস নিতে চাইল। এতটা জোরে গাল দুটো চেপে ধরেছে যে, দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কিন্তু শ্বাসটুকু নেওয়ার আগেই মুখটা শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেল। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু টপটপ গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল প্রত্যাশার। প্রতিটা ফোঁটা মেয়েটার অসহায়তার নীরব সাক্ষ্য হয়ে ঝরছিল।
স্কুটি থেকে নেমে একটু পাশে এসে দাঁড়ানো আরো বেশি বো’কামি ছিলো। কুৎসিত দৃষ্টি আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘৃ”ণা আর অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে উঠেছিলো। মাথাভর্তি চিন্তায় একটু নিঃশ্বাস নিতে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। ভাবছিলো কীভাবে বাড়িতে জানাব! কে জানত, শকুনেরা ওঁত পেতেই ছিলো?
ছেলেদুটো প্রত্যাশাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল আরও দূরে। যেখানে আলো নেই, কোলাহল নেই, আছে কেবল বড় বড় গাছ আর অন্ধকারে ডুবে থাকা নির্জনতা। একটুখানি আশার যে আলো ছিল, তাও যেন এই অন্ধকারেই নিভে গেল। দপ করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ড্রয়িংরুমে বসে থাকা প্রতিটি মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অধরা ফোনে প্রত্যাশার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। জানতে পারল প্রত্যাশা বন্ধুদের সঙ্গেই ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু কোয়েল বিস্মিত হয়ে জানাল–প্রত্যাশা তো ওদের আগেই রওনা দিয়েছিল! অনেক আগেই তো বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এই খবরে সবাই আরও উদ্বিগ্ন হয়। শফিক সাহেব মেয়ের সব বন্ধুদের বাসায় ফোন করে খোঁজ নেন, কিন্তু কোথাও প্রত্যাশার সন্ধান মেলে না। আত্মীয়দের কাছেও খোঁজ নেওয়া হয়, সেখান থেকেও মেয়ে সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া যায় না। তবে শোনা গেল; ওই রাস্তায় এক্সি’ডেন্টের কারণে রাস্তা বন্ধ রয়েছে।
এরমধ্যে নিভান আসে। সন্ধ্যায় মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওর। মাহবুব সাহেব চিন্তিত বদনে নিভানকে বললেন,
-” নিভান, নীরবের কাছে ফোন দাও।”
-” হ্যাঁ, বাবা।”
নীহারিকা বেগম গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে আছেন। মনের ভেতরে ক্ষোভ, রাগ আর আফসোস একসাথে নাড়া দিচ্ছে। বেয়াই-বেয়াইনের উপর তার ক্ষোভ কম নয়। মেয়েকে দড়ি ছাড়া গরুর মতো ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন। আগে থেকে লাগাম টেনে ধরেননি। উড়নচণ্ডী বানিয়েছেন। আজকের দিন যে আসারই ছিলো। এইজন্য! এইজন্য! কস্মিনকালেও ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করতে চাননি। স্বামীকে কম তো বারণ করেননি। কিন্তু কী করার! কপালই খারাপ! তার আদরের পুত্র ছোট দু’জনের ক্ষেত্রেই এরকম হলো। যে মেয়েগুলোকে বউ করতে রাজি ছিলেন না। অথচ তাড়াই ছেলেদের বউ হলো। একজন তো নিজে পা’গল হয়েছিল। আবার এখানে অসুস্থ স্বামীর বিরুদ্ধে যেতে না পেরে রাজি হলেন। এখন টের পাচ্ছেন। রাজি না হলেই বুঝি ভালো হতো। নীরবের উপরও রাগ হচ্ছে। সেদিন বললেন। নীরব গায়ে মাখল না। ওইযে বললেন, অঘটন ঘটলে তখন মায়ের কথার দাম দিবি। সেই কথা যেনো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে।
নিভান একটু বাইরে এসে কল দিলো। রিং হওয়ার দ্বিতীয় বারের মাথায় কল তুলল নীরব। নীরবের কথার আগেই হৈচৈ আর গাড়ির শব্দ আসতে থাকল। নিভান বলল,
-” হ্যালো, নীরব তুই কই?”
-” হ্-হ্য- হ্যা-লো…ভ-ভাই-য়া।”
কথাগুলো বেঁধে বেঁধে আসল। নিভান বলল,
-” নীরব, এদিকে তো সমস্যা হয়ে গিয়েছে।”
-” হ-হ্যা-লো , ভাইয়া আমি শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে আর তাড়াতাড়ি বলো। আমি ব্যস্ত আছি।”
-” প্রত্যাশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও এখনো বাড়ি ফেরেনি। বন্ধুদের সাথে…..”
আশেপাশে ভিড়, গাড়ির হর্ন সব মিলিয়ে নীরব ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলো না। প্রত্যাশা নামটা বুঝল। বাকি কথা স্পষ্ট শোনা গেল না। ডিউটির জন্য ওকে জরুরী এ’ক্সিডেন্ট স্পটে আসতে হয়েছে। বাসটা ক্যান্টনমেন্টের হওয়ায়, উপর মহল থেকেও বেশ চাপ আসছে। ঘটনাস্থলে দুই বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে এসেছে। অসুস্থদেরকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
-” ভালো করে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।”
বিপদের সময় সবদিক থেকেই যেন একেবারে আঁটঘাট বেঁধে বিপদ নামে। এমনি সময় নেটওয়ার্কে কোনো প্রব্লেম হয় না। কথা তেলতেলে চলে আসে। আর এখন জরুরী মূহুর্তে নেটওয়ার্কও নাটক শুরু করেছে। নীরব এদিকটায় নেমে আসল। একটু রাস্তার পাশে ফাঁকে দাঁড়াল–হ্যালো…হ্যালো করতেই ওপাশ থেকে নিভানের উচ্চস্বর আসল,
-” প্রত্যাশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুদের… এখনো বাড়ি ফেরেনি।”
নীরব এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। জোড়াল শ্বাস ফেলে দৃষ্টি জোড়া নিচু করে, কিছু বলবে; তার আগেই পিচের রাস্তার ধারে, সবুজ ঘাসের উপর, ঠিক নিজ পায়ের সামনে দৃষ্টি পড়ল। হালকা আলোয় নীল রঙের ওড়নাটার একপাশ বাতাসে উড়াউড়ি করছে। ওড়নার পাশ দিয়ে থাকা সোনালী সুতোর কারুকাজ চিকচিক করছে। কেমন চেনাচেনা লাগছে। উবু হয়ে ত্রস্ত এক হাতে ওড়নাটা তুলল নীরব। মস্তিষ্ককে চাপ দিয়ে মনে করল। হ্যা সেইম এমন ওড়না প্রত্যাশার জন্য কেনা ড্রেসে ছিল। ওড়নাটা ঝকঝকে নতুন। নতুন জিনিস এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকার কথা নয়।
সেকেন্ডেই মন-মস্তিষ্ক অনেক কিছুই ভেবে নিল। ওপাশ থেকে নিভানের কথা আর একটাও কানে ঢুকছে না নীরবের। মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে আসছে। নিভান হ্যালো…হ্যালো করতে করতে ফোন কাটল।
প্রত্যাশার নম্বরে কল করে বন্ধ পেল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে নীরবের। কপালের ঘাম মুছে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত গুছিয়ে নিল নিজেকে। পরপর কাংখিত নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ হতেই বলল,
-” আমি এক্ষুনি একটা নম্বর সেন্ড করছি। জরুরি ভিত্তিতে লোকেশন ট্রেস করতে হবে। অবিলম্বে। সময় ন*ষ্ট করার সুযোগ নেই। টাইমলাইন, শেষ একটিভ স্পট, সবকিছু। আর হ্যাঁ, এটাকে অফিসিয়াল না, আমার পার্সোনাল হিসেবে ধরো। কিন্তু গুরুত্ব যেন অফিসিয়ালের চেয়েও বেশি হয়। খুব জরুরি।”
-” ওকে স্যার।”
-” বাবা, নীরব যেখানে আছে সম্ভবত সেখানে নেটওয়ার্কের খুব প্রবলেম। ট্রাই করলাম। ও বোধহয় ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। আমি আবার ট্রাই করে দেখছি।”
নিভান বলল। শফিক সাহেব আর বসে না থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন। নিভান সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল,
-” আমি বাবার সঙ্গে যাচ্ছি। চিন্তার কিছু নেই। প্রত্যাশাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেহেতু ওখানে এক্সি’ডেন্ট হয়েছে। গাড়ি সব আঁটকে আছে। প্রত্যাশা মেবি ওখানে আছে।”
নীহারিকা উদ্বেগমিশ্রিত আশঙ্কা নিয়ে বলে উঠলেন,
-” খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সুস্থ অবস্থায় তো? এখন এমনিতেই দিনকাল ভালো নয়। তারপর রাত হয়ে গিয়েছে।”
নীহারিকা কিসের ইঙ্গিত দিলেন সবাই বুঝে নেয়। নিভান কথা না বাড়িয়ে শ্বশুরের সাথে বেরিয়ে গেল। নীহারিকা মুখ গম্ভীর করে নানান কিছু ভাবতে লাগলেন। আজ কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে, ওই মেয়েকে মেনে নিবেন না। আসলে মেয়েটা তার ছেলের যোগ্যই নয়। কোনদিক দিয়েই না। রাগে-ক্ষোভে নানান নেগেটিভ চিন্তা ভাবনাই আসছে মাথায়।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে যত এগোচ্ছে তত সবার চিন্তা বাড়ছে। রাত আটটা বাজতে চলছে। অধরা চোখে এক প্রস্থ জল নিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে বসে। মেয়ের জন্য দোয়া করছেন। মনে হচ্ছে নিজেরও কিছু গাফিলতি আছে। ভালোবেসে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছিল প্রত্যাশাকে। সেইজন্য আজ এমন দিন। না জানি মেয়েটা কোথায়? কোন হালে আছে? সন্ধ্যা পেরিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে। দিন হলে তাও চিন্তা কম ছিলো। দিনেই যেখানে মেয়েরা সেভ নয়, এখন তো রাত নেমেছে। ভ’য়ে গা শিউরে উঠল অধরার।
এরমধ্যে ডোর বেলের শব্দ আসতেই ছুটে এলেন দরজা খুলতে। নীলা মায়ের পিছুপিছু এলো। এমনিতে প্রত্যাশাকে দেখতে না পারলেও, আজ কেনো জানি একটু হলেও মন খারাপ করছে। ওইযে, যখন কেউ থাকে না। তখন তার কথা মনেহয়।
দরজা খুলতেই দরজার সামনে নীরব দাঁড়িয়ে। অধরার আশার আলো মিইয়ে আসলো। ভেবেছিল সাথে মেয়েকে দেখবে। নীরবকে একা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে একসাথে প্রশ্ন করলেন,
-” নীরব তুমি একলা! প্রত্যাশা…. প্রত্যাশাকে খুঁজে পাওনি? তোমার শ্বশুর, নিভান গেল। ওরা পেয়েছে কী প্রত্যাশাকে?”
নীরব কিছু বলার আগেই অধরা ঘনঘন বলতে থাকে,
-” নীলা তোর আব্বুকে ফোন কর। শোন তো কতদূর? ওরা নিশ্চয় প্রত্যাশাকে খুঁজে পেয়েছে। প্রত্যাশা ওদের সাথেই ফিরছে। তাই না নীরব?”
নীরব জোড়াল শ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” আন্টি… চিন্তার কিছু নেই। প্রত্যাশা… প্রত্যাশা আমার সাথেই আছে।”
এই বলে নীরব ডান পাশে একটু সরে দাঁড়াল; পিছনে নত মস্তকে প্রত্যাশা। চোখের পাতা ভার, ঠোঁট চেপে ধরে, শরীরটা গুটিয়ে আছে ভিতরের কোনো ভ”য়ে। পা দুটো একসাথে জড়ো করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। মাহবুব সাহেব আর নীহারিকা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার সামনে। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রত্যাশার আপাদমস্তক দেখলেন। পরপর কণ্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বললেন,
-” কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমার কোনো আক্কেল নেই। ফোন বন্ধ করে কোথায় ছিলে, শুনি? আর সবাইকে না বলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাও। বাড়িতে চিন্তা করতে পারে, এতটুকু সেন্স নেই? রাত হয়ে যায় বাড়ি ফেরার নাম নেই?”
প্রত্যাশা মাথাটা নুইয়ে আছে। শাশুড়ির একেকটা কথায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবটা শুনলে, সবাই তো আরো ব”কবে। নীহারিকা এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” নীরব তুই চুপ করে আছিস কেনো? কোত্থেকে আনলি? সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ। এতটা সময় ও কোথায় ছিলো?”
মাহবুব সাহেব বললেন,
-” আহ্! নিভানের মা থাম তো। মাত্র আসলো। ভেতরে এসে বসুক। বলবে ধীরেসুস্থে।”
অধরা চোয়াল শক্ত করে কঠিন স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,
-” প্রত্যাশা চুপ করে না থেকে বল। কোথায় ছিলি? কী হয়েছিল বল?”
নীরবের একবাক্যে উত্তপ্ত পরিবেশটা মূহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে আসল। বিস্ময়ে সবাই ওর দিকে চাইল! নীরব বলল,
-” প্রত্যাশা আমার সাথে ছিলো।”
প্রত্যাশা সাথেসাথে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। কান দু’টোকে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। ভাবল–উনি মিথ্যে কেনো বলল। খানিক আগে উনি নিজেই তো কত কড়াকড়া কথা বলল। আর এখন আবার, সবার সামনে আমার জন্য মিথ্যে বলছে।
নীহারিকা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-” তোর সাথে ছিলো মানে?”
নীরব মাথাটা নুইয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর সাবলীল গলায় বলল,
-” প্রত্যাশা বন্ধুদের সাথে ঘুরে ফেরার সময়, হঠাৎ আমার সাথে ওর দেখা হয়। সন্ধ্যা থেকে ও আমার সাথেই ছিলো।”
অধরা অবিশ্বাস্য বদনে চেয়ে অস্ফুটে বললেন,
-” তোমার সাথে ছিলো?”
নীরব জবাব দেওয়ার আগেই নীহারিকা বললেন,
-” ও তোর সাথে ছিলো! তা বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায়নি কেনো? ওর ফোন না হয় বন্ধ বলছে। তোর ফোন দিয়ে কেনো জানায়নি?”
নীরব দু সেকেন্ড ভাবে, কী বলবে! মাহবুব সাহেব প্রশ্ন করলেন,
-” নিভান না তোমাকে ফোন দিলো?”
এরমধ্যে পিছন থেকে কয়েক জোড়া জুতোর মসমসে শব্দ আসলো। খানিকটা দূর থেকেই নিভান এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” বাবা তখন বললামই তো নীরবের ফোনে নেটওয়ার্কের প্রব্লেম হচ্ছে। কথা বোঝা যাচ্ছিল না।”
বসার রুমে সবাই বসে। চোখেমুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস। তবে সবার প্রশ্নবানে বিদ্ধ নীরব। প্রত্যাশাকে পাওয়ার পর নীরব নিভানকে জানিয়ে দেয়। ওর সাথে প্রত্যাশা আছে। বাড়ি ফিরছে। নিভান আর শফিক সাহেব মাঝরাস্তা থেকে ব্যাক করে। নিভান ধারণা করে নেয়, নীরব যখন বলছে, কোনো না কোনো কারন আছে। আর মাকে তো ভালো করেই চেনে। তাই হয়তো! সেইজন্য নিভান পা রাখতেই নিজ থেকে নেটওয়ার্কের কথাটা বলল।
প্রত্যাশা রুমে ঢুকে দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ড্রয়িংরুমের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মাহবুব সাহেব বললেন,
-” নীরব, প্রত্যাশা না হয় ছোট, তুমি তো ছোট নও। ওর বুঝ কম। তুমি তো অবুঝ নও। তুমি যথেষ্ট বুঝদার। তবে তুমি হঠাৎ এরকম বো’কামি কী করে করলে? একবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেই হতো। আমরা চিন্তা করতাম না। প্রত্যাশার বাবা-মা কতটা চিন্তা করছিলো তুমি বুঝতে পারছো? তোমার থেকে আমি এমনটা আশা করিনি।”
নীহারিকা ছেলের দিকে তেরছা চোখে চাইলেন। অতীষ্ঠ গলায় বললেন,
-” তুইও কী ওর সাথে থেকে ওর মতো হচ্ছিস। তোর কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এক মিনিটের একটা কল দেওয়ার সময় তোদের হলো না। একটা কল দিয়ে জানিয়ে দিলেই হয়ে যায়। সবাই হয়রানি হয় না।”
অধরা বললেন,
-” আপা বাদ দিন না। নীরব ভেবেছিলো প্রত্যাশা হয়তো জানিয়েছে। প্রত্যাশাটা নিজেই তো বেখেয়াল।”
ভেতর থেকে সব কথাশুনে প্রত্যাশার নিজেকে আরো বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। সবটা শুনলে আর কেউ না হলেও নীহারিকা অনেক কিছুই বলবে। এমনিতেই বাবা-মায়ের শিক্ষা নিয়ে আগেও বলেছেন। নীরব আজ সবটা নিজের গায়ে নিয়ে প্রত্যাশাসহ আব্বু-আম্মুর সম্মানও বাঁচিয়ে দিল।
” প্রত্যাশা আমার সাথে ছিলো” এই কথাটার ভার কত তা প্রত্যাশা টের পাচ্ছে। এই একটি কথার জন্য ওর সম্মানে, ওকে নিয়ে কোনো সন্দেহ হয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। যখন শুনতো, দু’টো বাজে ছেলের খপ্পরে পড়েছিল; তখন নিশ্চয় চিন্তা হতো– প্রত্যাশাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে। ওরকমটা না হলেও, কেউকেউ ভেবে নিতো, অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু নীরবের একটা বাক্যে, কেউ সেই সুযোগটা পায়নি। নীরব দেয়নি। চায়নি অন্যের কাছে প্রত্যাশা এতটুকু ছোট হোক। নীরবের প্রতি প্রত্যাশার সম্মান শ্রদ্ধা হাজারগুণ বেড়ে যায়। প্রত্যাশা চোখদুটো বুজতেই ঝরঝরিয়ে পানি পড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠল; সেই দৃশ্য। আর সাথে সাথে গায়ে কাঁ*টা দিয়ে উঠল।
টেনেহিঁচড়ে অন্ধকারে নেওয়ার সময় লাল টিশার্ট পড়া ছেলেটি প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে একপাশে যায়। প্রত্যাশার হাত দু’টো অন্যজন ধরে। ডেকে বলল,
-” এই তাড়াতাড়ি কর বেডা। কাজের সময় তোর হাগা-মুতা চাপে।”
প্যান্টের জিপার তুলতে তুলতে বলল,
-” আইছি, ভাইজান আইছি।”
ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
-” ভাই বাংলা মা’ল আছে তো?”
-” সব আছে। তয় আজ বাংলা মা’ল না। অত গুলান চকচকে নোট পাইলাম। তাই দিয়া বিদেশি মা’ল খাবো।সাথে এই চিকনা-চিকনি ময়না। আহা…”
-” ভাই তাড়াতাড়ি চলেন। এই মাইয়া হাত ছাড়া হলে, সব দিক দিয়াই লস। বাকি টাকা পাব নানে। কয়দিন ধরে সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে পাখিরে ধরছি। আমাগো খাঁচায় বন্দী। এহন তো মজাই মজা।”
প্রত্যাশা স্তব্ধ হয়। মনের ভেতর প্রশ্ন চলছে একের পর এক। প্রত্যাশা চোখ বুঁজে বাঁচার জন্য বুদ্ধি খোঁজে। নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা আর ঘৃ’ণা এক করে দাঁতে দাঁত চাপল; সামনেরটার মেইন পয়েন্ট বরাবর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে লা’থি দেয়। সারা জীবনের সুড়সুড়ি শেষ করবে। এতটা রাগ নিয়ে লাথি মা”রে। সামনের ছেলে দু’কদম পিছিয়ে যায়। ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে। পিছনের জন হকচকাল। পায়ের তলায় বালু। প্রত্যাশা এবার খিচে চোখ বন্ধ করে। নিজের মাথা একপাশে নুইয়ে নিল। বালুর মাঝে পা ডুবিয়ে দেয়। তারপর পায়ের উপর বালু তুলে পিছন দিকে মা’রে। পিছনের জনের এক চোখে কিছু বালু ঢোকে। ছেলেটা প্রত্যাশার হাত ছেড়ে চোখ ডলতে থাকে। প্রত্যাশা এক মূহুর্ত দেরি না করে দৌড় লাগায়। রাস্তার দিকে। ওইযে আলো দেখা যাচ্ছে, সেদিকে।
চোখের বালু ঢলতে ঢলতে ছেলেটাও পিছু নিলো। আরেকজন ব্যথা নিয়েই পিছুপিছু ছুটছে। এই মেয়ে গেলে খবর আছে। অতগুলো টাকা হাত ছাড়া হবে। টাকা দিয়ে ব্যথা সারানো যাবে। তবুও এই মেয়েকে ছাড়া যাবে না।
প্রত্যাশা ছুটছে… হঠাৎ সামনে থাকা শুকনো ভাঙা ডালে উষ্টা খায় প্রত্যাশা। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরে বালুর উপর। ছেলে দু’টো ওইতো দৌড়ে আসছে। প্রত্যাশার ঘাম ছুটছে কপাল, মুখ বেয়ে। তবুও ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠার চেষ্টা করে। উঠার শক্তি এক চুল নেই শরীরে। হাঁপাতে হাঁপাতে একহাতে টেনে মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলে। চিৎকার করে,
-” ক-কেউ আছেন?”
গলা দিয়ে কথাও যেন বেরোচ্ছে না। এরমধ্যে ছেলে দুইটা সামনে চলে এসেছে। ইশশ্! মনে হচ্ছে; বাঁচার একটা সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলল। এবার হতাশ প্রত্যাশা একদম ভেঙে পরল। ছেলে দু’টো সামনে দাঁড়িয়ে গা’লি দিয়ে বি’শ্রী হাসল। পরপর প্রত্যাশার দিকে উবু হয় গাল চেপে ধরল। বলল,
-” আরে “”” তোর সাহস তো কম না।”
প্রত্যাশার ঠোঁটের দিকে নজর যায়। সেদিকে এগোতে এগোতে বলে,
-” ভাবছিলাম, ধীরেসুস্থ ভোগ করব। এতো সেই সুযোগই দিতাছেই না। এখানেই শুরু করি।”
এই বলে মুখ এগিয়ে আনতে থাকে। ঠিক এমন সময় কারো লা”থিতে সামনের ছেলেটি ছিটকে দূরে সরে পরে। বুট পায়ে লা:থিটা গাল বরাবর পড়ল। ফিনকি দিয়ে র”ক্ত গড়িয়ে পরতে থাকল। প্রত্যাশা পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে, তার আগেই একটা হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। প্রত্যাশা মুখ দেখেনি, তারপরও আগন্তুককে ওর জন্য সাহায্যকারী হিসেবে ধরে নিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতটা রাখল; রুক্ষ, শক্ত হাতে। আগন্তুক শক্ত করে হাত ধরল। একটানে প্রত্যাশাকে তুলল। প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে থমকে যায়। ও কিছুই বলতে পারে না। আচমকা বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। দুই হাতে পিঠের কাছের আয়রণ রঙা ইউনিফর্মটা শক্ত করে ধরে রেখেছে প্রত্যাশা।
উফ্! প্রশস্ত বুকটা নিজের জন্য সেফ মনে হচ্ছে। এতক্ষণে একটু শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে। প্রত্যাশা আঁকড়ে ধরে ব্যক্তিগত মানুষটিকে। এটাই মনে হচ্ছে ওর জন্য একমাত্র নিরাপদ, শান্তির আশ্রয় স্থল।
নীরব নিজের থেকে প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর বাম হাতে থাকা ওড়নাটা প্রত্যাশার গায়ে জড়িয়ে দিল।একজন তো এক লা’থিতেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরেকটা পালিয়ে যাচ্ছিল। নীরব পা দিয়ে ভাঙা ডালটা তুলল, হাতে এসে পড়ল। তারপর ছুঁ’ড়ে দিতেই, লাঠিটা গিয়ে ছেলেটির ঘাড়ের দিকে বা’রি লাগতেই অমনি ছেলেটি মাটিতে পরে গেল ।
ছেলে দুটোর মুখ বরাবর একের পর এক ঘু*ষি দেয়। তারপর দু’টোর মাথা ধরে একসাথে বারি দিল। কপাল গড়িয়ে র”ক্ত পড়ছে। দু’টো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আর আর্তনাদ করতে থাকল। নীরবের রাগ কমেনি, দুইজনের হাতের উপর বুট পায়ে চেপে ধরে রাখে। এইহাত দিয়ে প্রত্যাশার গাল চেপে ধরছিলো না, ইচ্ছে করছে এই হাত কে”টে ফেলতে।
প্রত্যাশার গা থরথরিয়ে কাঁপছে। এরমধ্যে তানভীর আসতেই নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-” ব্লা”ডি বিচ দুটোকে নিয়ে যাও। কী কেস দিবে, আমি বলে দিবো।”
ওকে স্যার বলে তানভীর দায়িত্ব পালন করে। আড়চোখে একবার প্রত্যাশার দিকে চাইল। মেয়েটি কে? স্যারের পরিচিত? জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না।
ফোনে লোকেশন ট্রেস করার কথা বলে, আরেকটু নিচে নামতেই হঠাৎ দূরে কাউকে দৌড়তে দেখা যায়, পিছুনে আরো কেউ। এই দেখে নীরব তানভীরকে মেসেজ দিয়ে এগিয়ে আসে। তারপর যা দেখল… মাথায় খু*ন চেপে যায়। নিজে হাতে দু’টোকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে।
প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল নীরব। মুখটা খুব ঠান্ডা। প্রত্যাশা কম্পিত পল্লব তুলে তাকাল। প্রত্যাশার মাথার পিছে হাত দিয়ে বাঁধা রোমাল খুলে দিল নীরব। প্রত্যাশার বুকটা এখনো কাঁপছে। এক দন্ড স্বস্তি পেতে সামনের মানুষটার বুকে মুখ গুজতে ইচ্ছে করছে। যেটুকু ভ’য়, দুরুদুরু কম্পন আছে, সব ওই বুকে মাথা রেখে উবে দিতে মনটা খুব করে চাইছে। প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে অস্ফুটে বলল,
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৫
-” নীরব..নীরব আপনি না__”
আর বলতে পারল না। প্রত্যাশার গলার স্বর ভারী হয়ে আসল। কাঁদতে কাঁদতে নীরবের দিকে আরেক পা এগোল। নীরব শান্ত চোখে চেয়ে তৎক্ষণাৎ একহাত সামনে ধরে বজ্র কণ্ঠে বলল,
-” স্টপ।”
এক শব্দেই প্রত্যাশার পুরো দুনিয়া যেন থেমে গেল। নীরব দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করে রাগটা কমানোর চেষ্টা করল।