মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪০

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪০
মুসতারিন মুসাররাত

নীবিড়ের রুমটা ধুয়ে-মুছে একদম ঝকঝকে তকতকে করে তোলা হয়েছে। নতুন বিছানার চাদর, দরজা-জানালায় পর্দা। মনে হচ্ছে তালাবদ্ধ ধুলোভর্তি সেই ঘরটা মুহূর্তেই নতুন রূপ পেয়েছে। পরী সেই সন্ধ্যে থেকে রুমটা গোছগাছ করে মাত্র বেরোল। দুপুরে ইচ্ছে ভিডিওকলে দিদুনের সাথে কথা বলার সময় আসার জন্য আবদার করে। একমাত্র নাতনির আবদার রাখতে নীহারিকা রাগ-ক্ষোভ একপাশে ঠেসে প্রীতির সাথে ফোনে স্বাভাবিক ভঙিতেই বলেন— আসার কথা। যদিও কেউ ভাবেনি প্রীতি সত্যিই আসবে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে প্রীতি এসেছে।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে মুখ আকাশের দিকে তোলা প্রীতির। এসেছে মাত্র ক’ঘণ্টা। সবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করার চেষ্টা করছে, তবু নীরবের সঙ্গে অল্পের জন্য বড়সড় ঝগড়া বাঁধা এড়ানো গেছে। এই তো সবাই যখন বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইচ্ছে দৌড়ে নীরবের কাছে এল। নীরব পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে রুম থেকে বেরোচ্ছিল। ইচ্ছে বলে,

-” পাপা, আমাকে সুন্দর লাগছে?”
ইচ্ছের গায়ে হুলুদ শাড়ি। একদম সর্ষেফুলের মতো ঝিকিমিকি করছে। নীরব গাল টেনে বলল,
-” প্রিটি গার্ল, তোমাকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। মাশা-আল্লাহ! মাশা-আল্লাহ!”
-” ছোটো দিদুন পড়িয়ে দিয়েছে।”
শাড়ির দুই কোণা আঙুলে ধরে হেলতে হেলতে বলল ইচ্ছে। তন্মধ্যে প্রীতির গলা এল,
-” ইচ্ছে?”
ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রীতি কয়েক পা এগিয়ে এসে মেয়ের গালে আঙুল ঢলে বলল,
-” মুখে এসব কী লাগিয়েছো? এত সস্তা ফাউন্ডেশন, লিপগ্লস। এসব তোমার সফট স্কিনের জন্য ক্ষ*তি হবে তো।”
প্রীতির বলার ভঙি তাচ্ছিল্য মেশানো খোঁচা। নীরবের মুখাবয়বের পরিবর্তন হলেও উপরে উপরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। ইচ্ছে মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” মাম্মা, আনিশা যাচ্ছে, সব্বাই যাচ্ছে, আমিও যাবো।”
-” আমি যাচ্ছি না।”
-” আমি যাই?”
প্রীতি ঠান্ডা অথচ দৃঢ় গলায় স্রেফ বলল,
-” না, এখন তুমি কোথাও যাচ্ছ না। আমি যাচ্ছি না, আর তোমাকে কারও সঙ্গে পাঠাবও না।”
প্রীতি এখন অবধি একবারো নীরবের দিকে তাকায়নি। পাশে কেউ আছে দেখেও দেখছে না এমন ভাবভঙ্গি নিয়ে আছে।‌ ওদিকে সবাই বেরোতে ব্যস্ত। প্রীতিকে উপেক্ষা করে সরাসরি বলল নীরব,

-” ইচ্ছে, চলো।”
প্রীতি সাথে সাথেই বিরোধীতা করে উঠল,
-” ইচ্ছে যাবে না।”
নীরব উত্তর না দিয়ে ইচ্ছের হাত ধরল,
-” চলো।”
প্রীতিকে বারবার উপেক্ষা করায় মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁলো। প্রীতি গলাটা শক্ত করে কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলল,

-” নীরব, তোমার যা ইচ্ছে তাই তোমার পরিবারের ওপর প্রয়োগ করো। ভুলেও আমাদের ক্ষেত্রে নয়। আমার আর আমার মেয়ের উপর তো নয়ই। শোনো, আমি যাচ্ছি না, তাই ইচ্ছেও যাবে না। আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো; নেহায়েৎ ইচ্ছের দিদুন আসার জন্য অত করে বললেন। রিকোয়েস্টটা ফেলতে না পেরে বাধ্য হয়ে এসেছি। ভুলেও ভাববে না, তোমার বিয়ে খেতে নিজ ইচ্ছায় এসেছি। না তো এক ফোঁটা ইচ্ছে ছিল এখানে আসার।”
এখন প্রীতির সাথে তর্কাতর্কি করে মুড ন’ষ্ট করতে চাইছে না নীরব। তারউপর বাড়ি ভর্তি লোকজন। শোভনীয়ও দেখায় না। এরমধ্যে নিভান সবাইকে তাড়া দিচ্ছে। নীরব সেদিকে তাকিয়ে ডাকল,
-” ভাইয়া?”
নিভান এগিয়ে আসতেই নীরব নির্লিপ্ত ভঙিতে বলল,

-” ভাইয়া ইচ্ছেকে নিয়ে যাও তো। আমার একটু কাজ আছে। আমার বোধহয় যেতে একটু দেরি হতে পারে।”
-” আচ্ছা।”
বলে নিভান হেসে ইচ্ছের গাল টিপে নিয়ে গেল। প্রীতি ভিতরে ভিতরে রাগে অজগরের মতো ফোঁসফোঁস করল। মূলত যে উদ্দেশ্যে এ বাড়ি আসা সেই লক্ষ্যে স্থির থাকতে প্রীতি চুপচাপ সয়ে নিল। নীরব এগিয়ে যেতে গিয়েও দু’পা ফিরল। উল্টোদিক হয়েই শুধু বলল,
-” মাত্রারিক্ত রাগ, বেহিসাবি জেদ আর ফুলে ওঠা ইগো। কাউকে শেষ করে দিতে যথেষ্ট। তুমি যে ব্যবহার হয়েছো, এন্ড হচ্ছো, সেটা বোঝার সামান্য বুদ্ধিটুকু, ক্ষমতাটুকু কি আছে তোমার? যাইহোক, নিজেকে শুধরে নেয়ার লাস্ট সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে। এখনো টাইম আছে নিজের মধ্যে চেঞ্জেস আনো। আনলে নিজেরই ভালো, নইলে___”
প্রীতি ফুঁসে ওঠে ঠোঁট চেপে বলল,

-” নইলে..?”
-” ধ্বংস অনিবার্য, যা খুব খুব সন্নিকটে।”
প্রীতি তাচ্ছিল্য হাসল। মনেমনেই বলল— নতুন করে ধ্বং*স হওয়ার তো কিচ্ছু নেই। ধ্বংস তো আজ থেকে ক’বছর আগেই হয়েছি।
তখনকার কথাগুলো মনে উঠতেই শুণ্যে তাকিয়ে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল প্রীতির। মেজাজটাও তিরিক্ষি হয়ে আছে। ও বাড়ি যাওয়ার কথা অনেকে বললেও অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে যায় প্রীতি। প্রীতির কথা রাখতে তানিয়া নীহারিকার সাথে নীবিড়ের চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলেন ফোনে। নীহারিকা একদম স্রেফ জানিয়ে দেন,
-” যেভাবেই হোক না কেনো ছেলে ওটা তো আপনাদেরকে দিয়েই দিয়েছিলাম। কোনো খোঁজখবর রাখিনি, অবশ্য ছেলেও রাখেনি। এখন অসুস্থ ছেলেকে মা কী করে ছাড়ে? সন্তান মা’কে পর করতে পারলেও মায়েরা পারে না। আর বলছেন সুস্থতার কথা, আল্লাহ ছেলের হায়াত দারাস করলে এদেশের চিকিৎসাতেও ভালো হবে। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু দিয়েই ছেলের চিকিৎসা করাব। শাশুড়ির টাকায় ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দরকার নেই। শুধু মন থেকে দোয়াটুকু চাই। এতটুকু হলেই চলবে।”

নীহারিকার কথাটা মনে পড়তেই মাথায় রাগ চিড়বিড় করে উঠল প্রীতির। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আওড়ালো—- কথায় আছে না কু’কু’রের পেটে ঘি মজে না। এরাও ঠিক তেমন। সবকিছু ভুলে যখন তাদের ছেলে সুস্থ হোক চাইলাম। মা’কে অবধি রাজি করালাম। সেখানেও বাঁধ সাধল ওই ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলা আর ওনার ছোটো ছেলে দুইটাই আমার জীবনটাকে হেল বানিয়ে ছেড়েছে। উফ্! যাইহোক আপাতত এখানে যে কটা দিন আছি। এদের মন যুগিয়ে, বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আর নীরব? প্রতিটি থা”প্প”ড়ের জবাব ভালোবাসার ফুল হয়ে যাবে না। ব*ন্দুকের গু*লি হয়েও ফিরতে পারে।
প্রীতি একটা ডায়েরি বের করল। কথাগুলো সেদিন ডায়েরিতে লিখেও রেখেছিল সে। আজ আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দিল গোটা গোটা অক্ষরে লেখাটার উপরে।
-” ভালোবাসা তো শখ নয়… শ্বাসের মতো। আমার ভালোবাসা থামবে মানে তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ।”
-” পুরো দুনিয়া বলবে…..’আদার্স ওয়ান সাইড লাভ ইট’স ওকে। বাট প্রিয়স্মিতা খান প্রীতি ইজ ডিফারেন্ট।’
প্রীতির চোখদুটো ছলছল করে উঠল। বুকের ভেতরটা তুষের আ*গু*নের মতো জ্ব”ল”তে লাগল।

ও বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে সবাই আসার খানিকক্ষণ পরে নীরবের আগমন ঘটে। নীরবের পা ছাদে পড়তেই নাহিদ গান পাল্টে “আইলারে নয়া দামান” গানটা চালু করে দেয়। নীরবের সাথে আবির ছিলো। আবির এগিয়ে এসে একগাল হেসে বলল,
-” নতুন ভাবি কী খবর? দেবরের কথা মনে-টনে আছে নাকি? সেদিন যে কড়া টাস্ক দিলে। হাফ টাইম তো পেরেছিলাম, সেই হাফ টাইমের জন্য হলেও কী হাফ কিছুমিছু পাওয়া যাবে?”
নীরব ভ্রুকুটি করে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির ঝটপট বলল,
-” আরে ছোটো দাদান দেবর ভাবীর মধ্যে কথা হচ্ছে, তুমি কান দিচ্ছো ক্যান? তুমি বুঝবে না। আমার আর ভাবীর মধ্যে ডিল হবে।”
নীরব ঠোঁট চেপে বলল,

-” গালের উপর একটা পড়লে বুঝতে পারবি, আমি বুঝব কী, বুঝব না।”
প্রত্যাশা তড়িঘড়ি বলল,
-” আরে আরে আপনি শুধু শুধু ওকে ক্যানো বকছেন। ঠিকই তো বলেছে আবির। দেবর-ভাবীর মধ্যেকার সিক্রেট কথাবার্তা। আপনি কেনো শুনবেন?”
পাশ থেকে একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা সেভেন আপের বোতল হাতে নিয়ে আবিরের দিকে বাড়িয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” যদিও বলতে আমার এক সমুদ্দুর কষ্ট হচ্ছে, তবুও বলতে যে হচ্ছে; হাফ কিছুমিছুর আশা ছেড়ে সেভেন আপ খাও দেবরজি।”

প্রত্যাশা আর নীরব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হলুদ সাজে সজ্জিত বউকে কোণা চোখে দেখতে ব্যস্ত নীরব। হলুদ সাজে প্রত্যাশাকে মোহনীয় লাগছে। নীরবের পলক নড়ছে না। নীরবের গায়ে শুভ্ররঙা পাঞ্জাবী, উপরে কারুকার্য করা হলুদ কোটি। সাদা পাঞ্জাবিতে স্নিগ্ধ আর আকর্ষণীয় লাগছে নীরবকে। দু’জন যখন দু’জনের দিকে তাকিয়ে ঠিক তক্ষুনি নাহিদ ফা’জ’লা’মি করে গান পাল্টে ফেরদৌস, শাবনূরের সেই বিখ্যাত গান ছেড়ে দেয়। বেজে উঠল,
-” আসসালামুলাইকুম বেয়াইনসাব, ওয়ালাইকুম আসসালাম বেয়াই সাব। কেমন আছেন বেয়াইন সাব?”
এতটুকু বাজতেই প্রত্যাশা একহাতে মুখ চেপে ধরে হাসতে লাগল। নীরবও বোধহয় একটু অপ্রস্তুত হলো। প্রত্যাশা হাসি সামলে বলল,

-” আমার ফ্রেন্ডরা ফা’জ’লামি করে বাজাচ্ছে।”
-” বুঝতে পেরেছি। তোমার এখন কী অবস্থা বলো? আর বমি হয়নি তো? এখন কেমন ফিল করছো?”
-” নাহ আর বমি হয়নি। এখন বেটার ফিল করছি। আপাতত কোনো সমস্যা নেই।”
-” গুড।”
এরমধ্যে “শুভ হলুদ” লেখা হলুদের জন্য আনা কেকটা স্টেজে রাখা হয়। নীলা এসে ডাকল,
-” নীরব এসো কেকটা কাটতে হবে। তারপর ফটোশুটও তো বাকি। ওদিকে মা বারবার ফোন দিচ্ছেন। বেশি দেরি করতে বারণ করেছেন। তাড়াতাড়ি যাতে তোমাদেরকে ছাড়ি।”
নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল,
-” শিওর।”

আবিরের গলায় ক্যামেরা। একের পর এক ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ছবি তুলছে সে। নীরব-প্রত্যাশা কেক কা”টে। দু’জন দু’জনের গালে দেয় সেই দৃশ্যও ক্যামেরায় বন্দি করা হয়। হলুদের গিফট হিসেবে নীরব পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিং বক্স বের করে। আজ নীরব আসবে সেই হিসেবে এদিক থেকেও প্রস্তুতি নেয়া ছিলো।
ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে প্রত্যাশার বাম হাতটা আলতো করে ধরে নীরব। তারপর আলগোছে স্বর্ণের ডিজাইন করা রিং প্রত্যাশার অনামিকায় পড়িয়ে দেয়। নীলা বক্স খুলে প্রত্যাশার দিকে ধরে। প্রত্যাশা রিং নিয়ে নীরবের আঙুলে পড়িয়ে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ ফটোশুট চলে।
কোয়েল হলুদের বাটি এগিয়ে বলল,
-” জিজু আপনার বউয়ের গালে ছুঁইয়ে দিন।”
নীরব সময় নিচ্ছিল। আবির তাগাদা দিল,
-” আরে ছোট দাদান তাড়াতাড়ি করো, এদিকে ক্যামেরা হাতে আমার হাত লেগে এলো।”
নীরব ইতস্তত বোধ নিয়েই দুই আঙুলে হলুদের প্রলেপ নেয়। আলতোভাবে প্রত্যাশার ডানগালে তারপর বাম গালে ছুঁইয়ে দেয়। লজ্জায় প্রত্যাশার চোখের পলক নুইয়ে যায়।

হালকা মিউজিক বাজছে, কেউ মগ্ন আড্ডায়, কেউবা নাস্তায় ব্যস্ত। প্রত্যাশা-নীরব একপাশে। পাঞ্জাবির কলার একটু সরিয়ে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিল নীরব। প্রত্যাশার দিকে চেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মৃদুস্বরে বলল নীরব,
-” উমম! গরম লাগছে, সাথে তেষ্টাও পেয়েছে। আমি নিচে যাচ্ছি। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো জলদি।”
প্রত্যাশার দৃষ্টি গেল খানিকটা দূরের টেবিলে। ঝটপট বলল,
-” ওই তো টেবিলেই শরবত রাখা আছে। একটু ওয়েট করুন…. আমি আনছি।”
নীরব ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বলল,
-” এখানে গরম লাগছে। রুমে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসব।”
চারদিকে স্ট্যান্ড ফ্যান ঘুরছে। অতটাও গরম লাগার কথা নয়। প্রত্যাশা সরল মনে বলল,

-” এমা গরম লাগছে আপনার! চলুন ওপাশে ফ্যানের সামনে বসবেন। নয়তো আমি এক্ষুনি কাউকে বলছি, এখানে আরেকটা ফ্যান সেট করতে। ছোটো মামাকে ডাকছি। ওয়েট..”
নীরবের মে’জা’জ চটল। এতটা অবুঝ বউ হলে হয়? বলল চিবিয়ে চিবিয়ে,
-” এই তুমি কিছু বোঝো না? নাকি সবসময় না বোঝার অ্যাক্টিং করো?”
আর বাড়তি কথা না বলে নীরব বিরক্তির শ্বাস ফেলে গটগট করে নিচে নামে। কয়েক মূহুর্ত পর প্রত্যাশা উপায়ান্তর না দেখে পিছুপিছু নামল। ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঠান্ডা পানির গ্লাস নিয়ে রুমে গেল। নীরবের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল,
-” নিন পানি।”

নীরবের হাসি পেল। মেপে স্বল্প হাসল। প্রত্যাশার গ্লাস ধরা হাতের উপর হাত রেখে গ্লাসটা মুখের সামনে নিল। এক ঢোক নিয়ে তারপর গ্লাস নামাল। পরপর আচমকা একহাতে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনল। প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
-” মাত্র তো এক ঢোক খেলেন। এমন করে বললেন…মনে হলো এক সমুদ্দুর পিপাসা পেয়েছে। শুধু শুধু রাগ দেখালেন।”
ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে বলল নীরব,
-” হ্যাঁ, এক সমুদ্দুরই পিপাসা পেয়েছে। তবে পানির নয়, অন্যকিছুর‌।”
এই বলে নীরব অন্য হাতে পকেট থেকে বসুন্ধরা সুগন্ধযুক্ত টিস্যু বের করল। মুচকি হেসে প্রত্যাশার ঠোঁটে আলতো করে ঘষল। প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,

-” এই এই কী করছেন?”
-” লিপিষ্টিক বেশি গাঢ় হয়েছে। এতটা গাঢ় হলে অন্যের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষ*তিক*র।”
-” আরে আ…”
প্রত্যাশার কথা থেমে গেল। নিজেকে নীরবের খুব কাছে আবিষ্কার করল। একটানে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবায় নীরব। প্রত্যাশার চোখদুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ছাড়া পেয়েই প্রত্যাশা শ্বাস টেনে নিল। নীরব হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছল। প্রত্যাশা বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,
-” বাহ! লিপস্টিকটা আপনি এমনভাবে মুছলেন, যেন ঠোঁটটা আপনার ব্যক্তিগত হোয়াইটবোর্ড!”
-” ভুল কিছু বলোনি। ব্যক্তিগতই। তুমি পুরোটাই আমার ব্যক্তিগত।”
প্রত্যাশা কোনো কথা কানে না ঢুকিয়ে আফসোস করে বলল,

-” ধূর দিলেন তো লিপিস্টিকটা ন’ষ্ট করে।”
বৃদ্ধা আঙুল প্রত্যাশার ঠোঁটে ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বলল নীরব,
-” তোমার ঠোঁটে লিপস্টিকের রং না থাকলেও, আমার স্পর্শ তো রইল।”
প্রত্যাশা অল্প-স্বল্প মেকি রাগ করে তাকাল। প্রত্যাশার নাকে আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে নীরব আরেকটু ঝুঁকে প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশার গালের সাথে গাল ছুঁইয়ে গেল। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি সফট গালে শিরশিরানি বয়ে দিল। প্রত্যাশার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। নীরব মুখটা প্রত্যাশার কানের পাশে টেনে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” পানসে মুখে কী করে যাই বলো? তাই হালকা একটু মিষ্টি মুখ করেই যাচ্ছি। আসছি, ফ্রেশ হয়ে আজ পর্যাপ্ত ঘুম দেবে। রাত জাগবে না, বুঝেছো? আগামীকালকের ঘুমটাও আজ পুষিয়ে নিবে। বাই।”
লাজে প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে নিল। নীরব বউকে আর লজ্জা না দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়। প্রত্যাশা হঠাৎ তড়িঘড়ি ব্যস্ত হয়ে বলল,

-” শুনুন?”
নীরব ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যাশা নিজের গালে আঙুল ধরে ইশারা করে বলল,
-” আপনার গালে হলুদ লেগেছে। আমার গাল থেকে গিয়েছে। মুছে নিন।”
প্রত্যাশাকে অবাক করে নীরব বলল,
-” নো প্রব্লেম। থাকুক।”

নীরব অধরার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। প্রত্যাশা রুম থেকে পানির গ্লাস হাতে বেরোতেই অধরা শুধালেন,
-” নীরবকে নাস্তা দিয়েছিলি? উপরে নাস্তা করেছিল? চলে গেল যে?”
-” নাস্তা করেনি তো। পানি চাইলো।”
অধরা মেয়ের উপর রাগঢাক করে বললেন,
-” তোকে নিয়ে আর পারি না। পানি চেয়েছে ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে শুধু পানি নিয়ে দিয়েছিস। সাথে নাস্তা দিসনি ক্যানো? উপরে সবার মাঝে হয়তো লজ্জায় বসেনি। রুমে দিতে পারতি। কবে যে তোর বুদ্ধি শুদ্ধি হবে?”
প্রত্যাশা বিড়বিড় করে বলে—- ধূর! আম্মুকে কী বলি? তার জামাইয়ের পানিটানি কিছুই পিপাসা পায়নি।
-” আর নীলা কই? আত্মীয়-স্বজন সবাই ঠিকঠাক খেলো কী না ও একটু দেখবে না। কোথায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে ও? আমি একা কতদিক দেখব। ওই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না।”
অধরা প্যাঁচাল পারতে পারতে ওদিকে গেলেন। এরমধ্যে প্রত্যাশা সিঁড়িতে পা রাখবে তখুনি নিভানের গলা এলো,

-” প্রত্যাশা?”
-” হুঁ?”
প্রত্যাশা ঘুরে নিভানকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল,
-” জিজু কিছু দরকার?”
-” তোমার আপু কই?”
-” আপু? কী জানি? আমি তো এতক্ষণ রুমে ছিলাম। নিচে আপুকে দেখছি না উপরে আছে হয়তো।”
-” নীলাকে একটু পাঠিয়ে দাও তো। এক গ্লাস পানি আনতে বলো।”
পানির কথা শুনে আচমকা প্রত্যাশার বেষম খাওয়ার যোগাড় হলো। চোখ বড়বড় করে বলল,
-” পানি?”
-” হ্যাঁ একটু জলদি আনতে বলো।”

প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে —- লে বাবা, এদের ভাইদের দেখছি একই অবস্থা। বউকে দেখলেই ইস্ক উঠে গলা শুকিয়ে যায়। পানির অজুহাতে স্বার্থ হাসিল করা। তবে কি এএসপি সাহেবের মতো জিজুরও এখন সেইম প্রয়োজনে পানি চাই, থুক্কু চুমু চাই।
প্রত্যাশা নিজেকে তটস্থ করে বলল ফট করে,
-” রিল্যাক্স জিজু, আপনি রুমে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুনি আপুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
-” থ্যাংকিউ। আসলে ইচ্ছের ঝাল লেগেছে। ইচ্ছে ঝাল খেতে পারে না আমি জানতাম না। রুমে দেখছি পানি নেই।”
শেষ কথাগুলো শুনে প্রত্যাশা দাঁত দিয়ে জিভ কা”টে। এইরে সে কীসব ভাবছিল! ভেতরে ভেতরে লজ্জায় পড়ল। দ্রুত উপরে এসে আপুকে নিচে পাঠিয়ে দিল।

ঘড়ির কাঁটা ঠিকঠিক রাত এগারোটার ঘরে। প্রত্যাশা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কানে এয়ারপড গুঁজে নীরবের সাথে কথা বলছে। চারিদিকে হৈচৈ তো আছেই বান্ধবী দুটোর জন্য ব্যালকনিতে আসছে কথা বলতে। ওরা যা পাজি। সবসময় জ্বালিয়ে মা*রছে। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
-” কী করছেন?”
-” ছাদে বসে আছি।”
-” একলা?”
-” হুম। ভেতরে লোকজনের কোলাহল। বিরক্ত লাগছিল।”
-” ওহ্।”
-” আমি তো সময় কাউন্ট করছি। তবে সেকেন্ডগুলোকে আমার কাছে ঘণ্টা মনে হচ্ছে।”
প্রত্যাশা বিনিময় শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
-” এতটা অধৈর্য হলেন কবে থেকে?”
-” শুরু থেকেই অধৈর্য। তবে তুমি ছোট ছিলে বলে, ছাড় দিয়ে এসেছি।”
-” তাই বুঝি?”
-” হুঁম।”
প্রত্যাশা আকস্মিক চঞ্চল গলায় বলে উঠল,

-” এএসপি সাহেব জানেন?”
-” না বললে জানব কীকরে?”
-” আমার না টুইনস বেবির খুব শখ। আমি অলরেডি ছেলে মেয়ের নামধাম ঠিক করে ফেলেছি। আমাদের ছেলে হলে নাম রাখব ‘নীড়’ আর মেয়ে হলে ‘প্রাপ্তি’ উফ্! দারুণ হবে না? টুইনস হলে একবারেই সব কষ্ট, ঝামেলা চুকে যাবে।”
নীরব নিঃশব্দে হাসল। বলল,
-” সবই ঠিক আছে। নীড়-প্রাপ্তি একসাথে না এসে আলাদা-আলাদা আসলেও প্রব্লেম নেই। তবে এক্ষুনি বেবি প্লানিং করছি না। আরো পাঁচ বছর পর।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” উঁহু।”
নীরব নরম-কোমল স্বরে বলল,

-” মাই লাভ তুমি এখনো ছোটো ইমম্যাচিউর। তোমাকে সামলাতেই আমি হিমশিম খাচ্ছি।”
প্রত্যাশা দুইহাত বুকে ভাঁজ করে বলল,
-” শুনুন আপনি বলছেন আমি ছোটো! তাহলে ছোট আমিটার কাছে আপনি ঘেঁষতে পারবেন না। ঠিক পাঁচ
বছর পরেই আমাকে ছোঁবেন। এর একদিন আগেও নয়, হুঁ। মনে থাকে যেনো?”
-” তাহলে তো ধৈর্য্যর উপর আমাকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।”
প্রত্যাশার হাসি চওড়া হলো। কিছু বলবে তার আগেই হুড়মুড় করে দুইটা হাজির হলো। অগত্যা ব্যস্ত হয়ে কল রাখল প্রত্যাশা।

বিয়ের হলটা ঝকঝকে আলোয় আলোকিত। চারিদিকে রুচিশীল আভিজাত্যের ছোঁয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পুরো হল খুবই সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। চারিদিকে অনেক লোকজনের ভিড়। বরপক্ষ, কনেপক্ষ সবাই উপস্থিত। দোতলা থেকে প্রত্যাশা সিঁড়ি ভেঙে ধীরেধীরে নেমে আসছে। পাশে দুই বান্ধবী। ওদের পরনে লেহেঙ্গা, ভারী সাজগোজ। আশেপাশে আরো অনেকেই আছে। নীরব ফ্রেন্ডদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। গায়ে সাদা শেরোয়ানি, গলার কাছে সোনালী সুতোয় সুক্ষ্ম কারুকাজ করা। মাথায় সোনালী রঙের পাগড়ি। হঠাৎ নজর গেল সিঁড়ির দিকে। প্রত্যাশার গায়ে লাল-খয়েরি বিয়ের ভারী শাড়ি। মাথায় ইয়াবড় ঘোমটা। ঘোমটার আড়ালের মুখটা নীরব কল্পনা করল এক সেকেন্ড।

প্রত্যাশা ঘোমটার আড়াল থেকেই আবছা নীরবকে দেখল একপল। বর বেশে এএসপি সাহেবকে হ্যান্ডসাম লাগছে খুব। কিছু একটা ফেসে আলাদা লাগল। ও হ্যাঁ, ক্লিন শেভ করেছে। তবে মন্দ লাগছে না। ভালোই লাগছে। প্রত্যাশার ধ্যান ছুটল। কোয়েলের কথায়। কোয়েল বলল,
-” জিজু এখুনি বউয়ের মুখ দেখা বারণ আছে। আগে বিয়ে হবে, তারপর শালিকাদের ডিমান্ড পূরণ করে, দেন বউয়ের ঘোমটা সরাবেন।”
নীরব বিনিময় মৃদু হাসল।‌ অতঃপর প্রত্যাশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-” চলো।”
চুড়ি পরা হাতটা নাড়াতেই টুং টুং ঝনঝন শব্দ হলো। প্রত্যাশা হাতের উপর হাত রাখতেই লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে আলগোছে আঁকড়ে ধরল নীরব। পরপর দু’জনে স্টেজে বসল।

লাল ভেলভেট ঢাকা টেবিলের ওপর রাখা রেজিস্ট্রার খাতা। পাশে রাখা কলমটা আলাদা নজর কাড়ছে। সোনালি গায়ে ময়ূরের খোদাই, লেজের পালক রঙিন পাথরে সাজানো। কলমটা হাতে নিলে মনে হয় যেন রাজকীয় কিছুতে সই করা হবে। নীরব মনোযোগ দিয়ে সুন্দর করে সই করল। দৃঢ় অথচ শান্ত হাসি নিয়ে সই শেষ করে কলমটা বাড়িয়ে দেয় প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা সোনালি গহনার ভারে নত, মাথায় বড় করে টানা ঘোমটার নিচে তার চোখ শুধু একটু উঁকি দিল। কোয়েল টিপ্পনি কে”টে বলল,
-” আস্তে কর। তাড়াহুড়ো নেই।”
প্রত্যাশার হাতটা মৃদু কাঁপল। নীরবের সইয়ের পাশাপাশি গোটাগোটা অক্ষরে সময় নিয়ে সই করল। সই শেষ হতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়ল।

কোয়েলদের দাবি মেনে পনেরো হাজার টাকা ঘু*ষ দিয়ে বউয়ের ঘোমটা তোলার সুযোগ পায় নীরব। চারিদিকে লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের মতো অবস্থা। সবাই মুখিয়ে আছে। নীরব দুই হাতে প্রত্যাশার মুখের ঘোমটা আস্তে করে সরিয়ে দেয়। প্রত্যাশার থুতনি চিবুক ছুঁয়ে আছে। প্রত্যাশা ধীরেধীরে চোখের ঘন পল্লব তুলে তাকাতেই দুই জোড়া চোখে নীরব-প্রত্যাশার প্রকাশ্য দৃষ্টি মিলল। চোখে গাঢ় কাজলের টান, ঠোঁটে গাঢ় রঙ; যেন যত্নে আঁকা এক নিখুঁত ছবি। নীরবের ঠোঁটে মৃদু হাসি, চোখে এক ঝলক প্রশংসার দৃষ্টি নিয়ে অস্ফুটে বলল,
-” মাশা-আল্লাহ! আজ তো সত্যিই চোখ ফেরানো দায়।”
প্রত্যাশার গাল লাল হয়ে ওঠে, ঝট করে চোখ নামিয়ে ফেলে। গহনার নরম ঝনঝন শব্দে ওর লজ্জা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিয়ের ভেন‌্যুতে না আসলে আবার কথার সৃষ্টি হতো, অগত্যা প্রীতিকে আসতে হয়েছে। এতটা সময় নিচে থাকলেও ভালো লাগছিল না। মনটা বিক্ষিপ্ত। দোতলায় করিডোর দিয়ে হাঁটছিল বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে। হঠাৎ আচমকা কটা কথা কানে আসে,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৯

-” মেয়েটাকে পেলে পুষে মানুষ করেছিস, বিয়ে দিয়েছিস ভালো কথা। বিয়ে আগেই হইছে, এখন আবার বেহুদা এত্তগুলান টাকা পয়সা খরচা করে রংঢং করে অনুষ্ঠান করা লাগবো ক্যান? তোর ছেলে নেই। একটা মাত্র মাইয়া, শেষ বয়সে তোরা কী খাবি? সে হুঁশ আছেনি? খাইয়ে-দাইয়ে কাজকাম নাই, বেহুদা এত বড় অনুষ্ঠান করে মানুষ খাওয়াতে গেলি। বিয়ে হয়েছে বালাই গেছে। ভালো ঘর পায়ছে, ভালো জামাই পায়ছে সেইডা তারছিড়া মাইয়ার কপাল ভালো।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪১