মনের আড়ালে গল্পের লিঙ্ক || লেখনীতে Alisha Rahman Fiza

মনের আড়ালে পর্ব ১
লেখনীতে Alisha Rahman Fiza

~একজন বিধবা মেয়েকে এভাবে মাঝরাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসার মানে টা কি আমাকে বুঝাতে পারবেন?মিস্টার রক্তিম রায়জাদা
এতটুকু বলে আমি সামনে বসে থাকা মানুষটির উপর তীক্ষ্ণ নজরে তাকালাম সে ভাবলেশহীন ভাবে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রাজকীয় ভাবে তার এরূপ আচরণ দেখে রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো।আমার দিকে তাকিয়ে সেই মানুষটি বললেন,
~অধরা,এতো অবুঝ হওয়ার চেষ্টা করবেন না।আপনি ভালো মতো জানেন আপনাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

এই মানুষটির প্রতিটি কথা তীরের মতো লাগছে একটা মানুষ এতোটা অপদার্থ কীভাবে হতে পারে?আমি বললাম,
~আমার মতন একজন মেয়ের সাথে আপনার মতো এতো বড় মনের মানুষ কেন কথা বলছে তাই বুঝতে পারছিনা।
রক্তিম আমার বিদ্রুপ কথা শুনে অনেকটাই আশাহত হয় তবুও নিজেকে সামলে রক্তিম বললেন,
~অধরা,আমার মেয়েটা আপনাকে অনেক ভালোবাসে একবার ওর কথা চিন্তা করে দেখতে পারেন
আমি কাটকাট গলায় তাকে বললাম,
~দেখেন আপনার মেয়েকে অবশ্যই আপনি সামলাবেন আমি নই।আর আপনার বাসায় আমি থাকতে পারবো না কারণ সেই অধিকার আমার নেই আমাকে আপনি মাফ করবেন

আমার এমন রূপ হয়তো সে আশা করে নি রক্তিম চুপ করে বসে আছেন আমি সোফা থেকে উঠে যেই না দরজার বাহিরে যেতে নিবো তখনই পিছন থেকে ছোট ছোট হাত আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।আমি জানি কে এই ছোট ছোট হাতের অধিকারী আমি চোখ মুছে হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে ফিরতেই দেখি
রুপসা আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম তার সামনে রুপসা আমার গলা জড়িয়ে বললো,
~ম্যাম তুমি তো ভালো আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো কেন?
আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে রুপসাকে দুহাতে আকড়ে ধরলাম আর বললাম,
~আমাদের পথ আলাদা সোনা বাচ্চা।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি শুধু এতটুকু মনে রাখবে
বলেই রুপসাকে ছাড়িয়ে চলে আসলাম একবারও পিছে ঘুরে দেখলাম না পিছন থেকে রুপসার চিৎকার শোনা যাচ্ছে মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলনা।আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার নিত্য জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমার নাম অধরা জাহান পরিবার বলতে বাবা-মা আর ছোট বোন। বাবার নাম আমজাদ হোসেন সে ছোটখাটো ব্যবসা করে আর মায়ের নাম মোনোয়ারা বেগম সে গৃহীনি আর ছোট বোন অরুনা জাহান সে অর্নাসের ২য় বর্ষে লেখা পড়া করছে আমরা সুখী পরিবার ছিলাম কোনো একসময় কিন্তু একটা ঝড়সব শেষ করে দিলো আর সেটা হলাম আমি।আমার বিয়ে হয়েছিল আহনাফের সাথে বাবাই বিয়েটা ঠিক করেছিল আমিও বাবার কথায় দ্বিমত করেনি কারণ আহনাফ একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন তাই তো যখন আমার সাথে তার বিয়ে হয় তখন আমি অর্নাস ৩য় বর্ষের ছাত্রী যখন আমি বলি আমার পড়াশোনা শেষ করার ইচ্ছে সে বলেছিল,
~মন পাখি তোমার সকল ইচ্ছে এখন থেকে আমার।

সেদিন মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি কিন্তু আজ জড়িয়ে ধরতে মন চাইছে কিন্তু সেই মানুষটি নেই।অফিসের কাজে তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয় সেদিনই বাস অ্যাকসিডেন্টে তার মৃত্যু হয়।সেদিন আমার শাশুড়ী আমাকে অপয়া বলে বাসা থেকে বের করে দেয় আহনাফের সাথে ৩বছরের সংসারে কোনো সন্তানদি না থাকায় শাশুড়ী অনেক খোঁটাই দিতো কিন্তু যখন আহনাফের এ অঘটন ঘটলো তখন সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।আসলে শাশুড়ী মা ঠিকই বলতেন আমি অপয়া আগলে রাখতে পারেনি নিজের স্বামীকে।
এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম আমার চোখের পানি গাল বেয়ে পরছে কষ্টে পরিমাণটা আজ বেশ ভারি কারণ রুপসাকে আমি অনেক আদর করতাম হয়তো তাকে ভালোবাসি মেয়েটা অনেক মিষ্টি কিন্তু কিছু করার নেই রুপসার সাথে সবসময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।

বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম রিক্সা থেকে নেমে সোজা চলে আসলাম ফ্লাটে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুললাম মা এসময় বাসায় থাকে না সে খালামণির বাসায় যায়।আমি দরজা বন্ধ করে সোজা চলে গেলাম রুমে বোরখা খুলে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলার ঝর্না ছেড়ে দাড়িয়ে পরলাম চোখ দিয়ে শুধু পানি পরছে।
অন্যদিকে রুপসাকে অনেক কষ্টে ঘুম পারিয়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রক্তিম।চোখ বন্ধ করতেই অধরার সেই কাঠিন্য রুপটা সামনে চলে আসে
আজ অধরা যেভাবে কথা বলেছে সেভাবে রক্তিমের সাথে কেউ কথা বলেনি শুধু রাহি ছাড়া।রাহির কথা মনে পরতেই অতীতের দিনগুলো মনে পরে যায়।

অতীতের পৃষ্ঠা খুললেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে রক্তিম চোখ খুলে উঠে বসলো মুখ হা করে শ্বাস নিতে থাকলো সে। নাহ সে আর থাকতে পারছেনা এমন হওয়াটা কী খুব জরুরি ছিল আর রুপসাই কেন অধরাকে এতো ভালোবাসতে গেলো।নাহ মেয়ের জন্য হলেও অধরাকে তার লাগবে যে কোনো মূল্যে লাগবে।

রক্তিমের পুরো নাম রক্তিম রায়জাদা মা-বাবা গত হয়েছে সেই ছোট কালে পরিবার বলতে মামা আছে সেও দেশের বাইরে বিয়ে করে সংসার নিয়ে সুখেই ছিল কিন্তু রুপসা হওয়ার ২বছর পর রাহি মারা যায় ক্যান্সারে।তারপর থেকেই রক্তিমের সকল ভাবনা শুধু তার মেয়েকে নিয়ে কিন্তু ১সপ্তাহ আগে রুপসা যখন আঙ্গুল তুলে অধরাকে দেখিয়ে বললো তার অধরাকে চাই সেদিন থেকে রক্তিম শুধু মেয়ের চাওয়া পূরণ করতে ব্যস্ত হয়ে যায় অধরার সব ইনফরমেশন সে কালেক্ট করা শুরু করে যাতে রুপসা সব ভাবে সেফ থাকে।
কিন্তু অধরা তো এক নিমিষেই সব শেষ করে দিলো রক্তিমের না শোনাটা পছন্দ না তাই আজ তার ইগো হার্ট হয়েছে যে কোনো মূল্যে অধরা তার বাসায় চাই এতটুকু ভেবেই রক্তিম বাঁকা হেসে চলে গেলো তার স্টাডি রুমে।

আমি শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে সোজা চলে যাই রান্নাঘরে ইলিশ মাছের তরকারিটা চুলোয় দিয়ে আমি আরেক চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসাই।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা ৭.১৫ এখনই মা চলে আসবে স্কুলের পরীক্ষারও অনেক খাতা দেখা বাকি ভাবতেই মাথা ধরে যায়।চা নিয়ে চলে আসলাম বারান্দায় এই সময়টা হলে আহনাফের কথা বেশ মনে পরে অফিস থেকে ফিরেই রুমে এসে বলতো,
~মন পাখি তুমি কী আমায় মিস করেছো?

এই মানুষটার জন্য কতো সময় যে লজ্জায় পরতে হয়েছে তার হিসেব নেই ভাবতেই মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো আমার পরক্ষণেই মনে পরলো মানুষটি আর নেই।আমাকে একা রেখে চলে গেছে অচীন পুরে আহনাফের মৃত্যুর ২বছর হয়ে গেলো আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে আছি রুপসার সাথে সেখান থেকেই পরিচয়।নতুন ছাত্রী আমার ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই আমার শাড়ির আঁচল ধরে সে বসে থাকতো।আহনাফ সবসময় রুপসার মতো একটা রাজকুমারী তার মেয়ে হিসেবে পেতে চেতো।কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস তা ভাবলে শরীরের প্রতিটি লোম দাড়িয়ে যায়।আমার মনে হয় জীবনে কোনো ভুল করেছিলাম তাই তো আহনাফের মতো এতো ভালো একজন মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি।হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো আমি চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দরজা খুলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
দরজা খুলে দেখি মা আর অরুনা দাড়িয়ে আছে আমাকে দেখে মুচকি হেসে তারা ভিতরে ঢুকলো আমি তাদের বললাম,

~ফ্রেশ হয়ে এসো আমি চা দিচ্ছি।
অরুনা বললো,
~আপুনি,আজ অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছি ৩টা টিউশনি একসাথে করেছি।
আমি বললাম,
~এতো কাজ একসাথে করিস না শরীর অসুস্থ হয়ে পরবে।
মা আমাকে বললো,
~তুই বড্ড একথা মেনে চলিস।
আমি কিছু না বলে মুচকি হাসি দিলাম।
অন্যদিকে

রক্তিম রুপসাকে সামলাতে পারছে না মেয়েটা জেদ ধরে বসে আছে এতটুকু বয়সে মেয়েটার প্রচন্ড জেদ একদম বাবার মতো।মুখ ফুলিয়ে খাবারের টেবিলে বসে আছে রুপসা তার ঠিক বরাবর রক্তিম বসে আছে গম্ভীর মুখে বসে আছে।রক্তিম খাবারের প্লেটটা রুপসার দিকে এগিয়ে দিতেই রুপসা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~আমি বলেছি যে খাবো না।শুনতে পাওনি তুমি।
রক্তিম নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো,
~রুপসা বাবু আমার পাপার মেজাজ এভাবেই খারাপ তাই এমন কিছু করো না যে আমি তোমাকে বকা দেই।
রুপসা তবুও ভয় পেলো না সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো তারপর বললো,
~আমি রুমে গেলাম তোমার সাথে কথা বলতে চাই না।
বলেই দৌড়ে চলে গেলো তার রুমে রক্তিম রাগে টেবিলে বারি মেরে উঠে পরলো সব সার্ভেন্ট ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে।

রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় বসে পরীক্ষার খাতাগুলো চেক করছি তখনই আমার মোবাইল বেজে উঠলো।আমি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আননোন নাম্বার ফোন রিসিভ করতেই।অপরপাশ থেকে রুপসা বলে উঠলো,
~ম্যাম,তুমি আসবে না আমার কাছে পাপাও আজকে আমাকে বকেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
~সোনা পাখি তুমি তো স্কুলে যাবে তাইনা তখন দেখা হবেই আমাদের।
রুপসা বললো,
~নাহ তোমাকে আমার এখনই চাই আমার বাসায়। আমার সব চকলেট তোমাকে দিয়ে দিবো
আমি হেসে ফেললাম রুপসা আমার হাসি শুনে বললো,

~তুমি হাসছো যাও কথা বলবো না তোমার সাথে।
বলেই খট করে ফোন রেখে দিলো অভিমানী এখন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে।
রুপসা ফোন রেখে তার পাপার দিকে ঘুরে বললো,
~আসবে না সে তুমি বকেছো তাকে তাই আসবে না পঁচা পাপা।
রক্তিম মেয়ের কথায় হতবাক হয়ে রুপসার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সকালবেলা রেডি হয়ে স্কুলের জন্য বের হলাম বাবার সাথে একই রাস্তা তাই একই সঙ্গে বের হলাম।বাবা আমাকে বললেন
~আহনাফের মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
আমি বাবার কথা শুনে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালাম বাবা বললেন,
~আমার সাথে তিনি কথা বলেনি বরং আমাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
একথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো আমি শান্তভাবে বললাম,
~আর কোনোদিন তার সাথে দেখা করতে যাবে না।

স্কুলে পৌছে বাবাকে বিদায় দিয়ে ভিতরে ঢুকে পরলাম টির্চাস রুমে প্রবেশ করে দেখি যে যার কাজে ব্যস্ত আমিও নিজ চেয়ারে বসে কাজে মনোযোগ দিলাম। কিছুক্ষন পর ক্লাসের সময় হয়ে গেলো তাই আমি ক্লাসে চলে গেলাম।এক এক করে সব ক্লাস নিয়ে শেষ করতেই আমার খেয়াল হলো রুপসাকে আজ স্কুলে দেখলাম না সে কি আজ স্কুলে আসেনি এসব ভেবে স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে আছি রিক্সার জন্য তখনই আমার চোখ গেলো রাস্তা ওপাশে সেখানে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে রক্তিম রায়জাদা। তাকে দেখেও না দেখার ভান করলাম সে আমাকে দেখে রাস্তা পার হয়ে আমার কাছে চলে আসলেন তারপর যা করলেন এটার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না

মনের আড়ালে পর্ব ২