মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৩

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৩
নওরিন কবির তিশা

সকালের সোনালি রোদ্দুর একটানা পড়ে ছিল জানালার কাঁচে।মায়াবী রোদ্দুরের উষ্ণ আলোর কণাগুলো যেন চুপিচুপি এসে তার গালের ওপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।স্নিগ্ধ আলোয় জেগে উঠল তার ঘুমন্ত চোখের পাতা। নেত্রদ্বয় পিটপিট দিয়ে একবার চারিপাশে চোখ বুলালো ফারিন।
সুক্ষ রৌদ্র কিরণ চোখে এসে লাগায় ভালো কিছুই করে দেখা যাচ্ছে না, কিছুটা সরে ব্যালকনির দিকে তাকাতেই শ্বাস আটকে আসলো ফারিনের,

‌নির্ঝরের পরনে ব্ল্যাক ট্রাউজারের সাথে ট্যাঙ্ক টপ‌। ভোর বেলায় উঠেই জিম করার অভ্যাস আছে তার স্বভাবসুলভ জিম শেষে ব্যালকনির ধারে দাঁড়িয়ে সে পাশের টেবিল থেকে প্রোটিন শেকের পটটি নিয়ে তাতে হালকা চুমুক দিচ্ছে,
প্রতিটি ঢোকের সঙ্গে তার গলার অ্যাডামস অ্যাপেল উঠছে আর নামছে,যেন একটা ছন্দ বাজছে। আর সেই ছন্দের তালে তালে ছন্দ হারাচ্ছে ফারিনের হৃদস্পন্দন। সে শুকনো একটা ঢোক গিলে অনিমেষ চেয়ে রইল তার পানে।
অতিবাহিত হলো মুহূর্ত খানেক, হঠাৎই ফারিন খেয়াল করল নির্ঝর সেখানে নেই, কি হলো নির্ঝর কোথায় গেল? অদ্ভুত রকম একটা অনুভূতি হল তার! হঠাৎই সে শুনতে পেলো ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ,সে বুঝতে পারল নির্ঝর নিশ্চিত শাওয়ার নিচ্ছে! কিন্তু ব্যাপারটা কি হলো! নির্ঝর চলে গেল কিন্তু ফারিন টের পেল না কেন?তবে কি সে… নির্ঝরের উপর…! আর কিছুই ভাবতে পারল না ফারিন নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে মনে মনে বলল,,
“ধুর মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গিছে আমার! ওই রক্তচোষা বাদুরের উপর ক্রাশ!তাও আমি! ইস: কালকে রাতে তেরে বিন টা দেখাই আমার উচিত হয়নি মাথার ভেতর উল্টোপাল্টা চিন্তাটা বাসা বাঁধছে!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—”দোস্ত তোকে তো বলা হয়নি রিদিত ভাই সিঙ্গাপুর চলে যাবে!”
ক্লাস শেষে বন্ধুরা সবাই মিলে হেঁটে যাচ্ছিল অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে, হঠাৎই শিশিরের এমন কথায় থমকে যায় সবাই, আনায়া বিস্ময় ভাবাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় শিশিরের দিকে, তবে তার প্রশ্ন করার আগেই লিজা বলে,,
—”কেন হঠাৎ সিঙ্গাপুর কেন?”
শিশির কিছুটা গা ছাড়া ভাবে বলে,,
—”তাছাড়া আর কি ভাইয়া তো সিঙ্গাপুরেই থাকতো! এইতো মাত্র ৫ বছর হলো দেশে আসছে, উনিতো সিঙ্গাপুরেই বড় হয়েছে বলতে গেলে, আবার চলে যাচ্ছে!”
সাইফ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল,,

—”চলে যাচ্ছে মানে আর আসবে না?”
শিশির:”মনে হয় তো দশ বছরের ভিতর আর আসবেনা!”
সজল:”তাহলে ওনার বিজনেস?”
শিশির:”ওনার বিজনেস তো সিঙ্গাপুরেই, জাস্ট এইখানে কয়েকটা ব্রাঞ্চ খুলছিল! দেশে নিজের পরিচিতির জন্য ভেবেছিলে হয়তো দেশেই থাকবে বাট উনি আগের দিন আন্টির কাছে ফোন দিয়ে বলছিল যে উনি চলে যাবে! আর একবার যদি চলে যায় তাহলে মনে হয় না যে দশ বছরের নিচে আসবে!”
আশা:”কি বলিস?”
শিশির:”হুম!”

আশা:”তাহলে আনায়ার সাথে ওনার বিয়ে?”
শিশির একবার আনায়ার দিকে তাকালো, তার চোখের কোনে চিক চিক করছে একরাশ সমুদ্রের নোনা জল,যেন প্রবাল বর্ষণের পূর্ব মুহূর্ত, কিন্তু সেদিকে শিশির পরোয়া না করে ফের বলল,,
—”একটা মানুষের কত অপেক্ষা করবে বল তোরা? আর সবচেয়ে বড় কথা ওনার বিয়ে ওনার ফ্যামিলি তার এক কাজিনের সাথে অলরেডি ঠিক করেছিল আর যেহেতু তারা সিঙ্গাপুরের সিটিজেন এজন্য ভাইয়া ভেবেছিল উনি আর সিঙ্গাপুর থাকবে না দেশেই আসবে আর এখানেই সেটেল্ট হবে,বাট জীবন তো আর আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী হয় না মাঝে মাঝে তার ইচ্ছায় আমাদের চলতে হয় ফর দিস রিজন ভাইয়া সিঙ্গাপুর ফিরে যাবে আর মেইবি উনার কাজিন আয়মানকেই বিয়ে করবে!”

প্রত্যেকের চোখে এক আকাশ সম বিস্ময়, তবে সবচেয়ে গভীরতম অব্যক্ত যাতনা আনায়ার চোখে মুখে, তার হৃদয়ের গোপন র’ক্তক্ষরণ কেউ টের না পেলেও, শিশির ঠিকই তা অনুভব করতে পারছিল, তবে তৎক্ষণাৎ সে কিছু বলল না, আনায়া আর সেখানে দাঁড়ালো না, ধীর তবে জোরালো গতিতে দ্রুত প্রস্থানগুলো সেখান থেকে। পিছন থেকে তাকে লিজা ‌ডাকতে গেলেও তাকে থামিয়ে দিল শিশির।
মুহূর্ত ক্ষণিকের মাঝে ক্যাম্পাস ছেড়ে বের হয়ে গেল আনায়া। সে বেরিয়ে যেতেই লিজা শিশিরের দিকে ফিরে বলল,,

—”তুই ওকে থামালি না কেন? জানিস না আমাদের একটু পরে একটা ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে!”
শিশির:”আজকে আপাতত ওর জন্য আর কোনো ইম্পর্টেন্ট ক্লাস নেই! ওকে যেতে দে ওকে বুঝতে দে সব কিছু!”
লিজা সাইফ সজল আশা সকলে বেশ অবাক হলেও শিশিরের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না! সে এক অনবদ্য রহস্যময় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসের বাইরে আনায়ার চলে যাওয়ার পথে চাইল, অতঃপর তাদের সবার দিকে ফিরে এক রহস্যময় হাসি টেনে শিশির বলল,,
—”কি হলো তোরা ক্লাসে যাবি না? আরে চল চল টেনশন নট! আই থিঙ্ক তোরা কিছুদিনের ভিতর একটা স্পেশাল নিউজ পাবি!”
শিশিরার দাঁড়ালো না দ্রুত চলে গেল তাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে, অন্যদিকে লিজারা বোকাদৃষ্টিতে একবার শিশিরের দিকে তাকালো তারপর নিজেদের ভিতরে! শিশিরের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝল না তারা!

হুররাম বেগম:”কিরে সতীন তুই নাকি শুনলাম আমার নাতিডারে স্যার বলিস?”
আজকে কলেজে যায়নি ফারিন, একমাস পরেই ইয়ার চেঞ্জ এক্সাম এজন্য এই এক মাস আর কলেজে যাবে না সে! দুপুরবেলায় নিজের রুমে একা একা ভালো লাগছিল না তার। নিঝুম স্কুলে গেছে, আর হাসনা খান রান্না ঘরে ব্যস্ত, এজন্যই সে এসেছে হুররাম বেগমের কক্ষে তার সাথে গল্প দেওয়ার জন্য, পুরো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল সে, হঠাৎই হুররাম বেগমের এহেন কোথায় তার দিকে ঘুরে ফারিন বলল,,

—”তা তোমার নাতি তো আমার স্যারই তাকে স্যার ব্যাতিত আর কি বলতাম?”
হুররাম বেগম মুখ কিছুটা গোমড়া করে বললেন,,
—” স্যার আবার কি?ও এখন তোর সোয়ামী!আর নিজের সোয়ামীকে কেউ স্যার বলে?”
ফারিন নাক সিঁটকে বলে,,
—”সোয়ামী না কি বললে?”
হুররাম বেগম:”সোয়ামী মানে বোঝো না?জামাই,জামাই!”
ফারিন:”সে তো জানি!”
হুররাম বেগম:”তাহলে?”
ফারিন:”তাহলে আর কি এখন থেকে কি তোমার নাতিকে আমি সোয়ামিজী বলে ডাকবো?”
হুররাম বেগম:”তা আমি কখন বললাম?”

ফারিন:”তাছাড়া আর কি?”
হুররাম বেগম:”হায় কপাল মাইয়া! তুই না এই যুগের মাইয়া?”
ফারিন:”হু!”
হুররাম বেগম:”তাও তোকে শেখায় দিতে হবে যে স্বামীকে কি বলে ডাকবি?”
ফারিন”….”
হুররাম বেগম:”জান ডার্লিং ময়না সোনা পাখি, কত কিছু আছে আর তুই খুঁজে পাচ্ছিস না?”
ফারিন অবাক কণ্ঠে বললো,,

—”দাদিজান!”
হুররাম বেগম মুচকি হেসে বললেন,,
—”অবাক হচ্ছিস?”
ফারিন তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
—”ভীষণ!”
হুররাম বেগম কিছু বলার আগেই একটা কাচের গ্লাসে ডালিমের জুস নিয়ে রুমে ঢুকলো হাসনা খান। ফারিনকে এমন অবাক হতে দেখে তিনি মুচকি হেসে বললেন,,
—”কি ব্যাপার পুতুল? দাদীর মুখে এটুকু শুনেই অবাক হচ্ছিস? তোর দাদাজান তোর দাদিজানকে কি বলে ডাকতো জানিস?”

ফারিন:”কি বলতো আম্মু?”
হাসনা খান জুসের গ্লাসটা বেডসাইট টেবিলের পাশে রাখতে রাখতে বললেন,,
—”আম্মা আমি বলব নাকি আপনি বলবেন?”
হুররাম বেগম হেসে বললেন,,
—”জানপাখি!”
ফারিন চোখ বড় বড় করে বলল,,
—”কিইইইইই!”
হাসনা খান হেসে বললেন,,
—”জ্বী!”
হুররাম বেগম আর হাসনা খান ফারিন এর অবস্থা দেখে হেসেই যাচ্ছে! এদিকে ফারিন বিস্ফোরিত নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,,
—”যার দাদা এত রোমান্টিক ছিল! সেই ব্যাডা এত আনরোমান্টিক আর খাইস্টা কেমনে হয়!”

মাথার উপর চেপে বসেছে প্রখর সূর্য,তেজস্ক্রিয় রশ্মি যেন মাথার তালু গলে ঢুকে যায় হৃদয় পর্যন্ত।আকাশ ফ্যাকাসে নীল, কিন্তু বাতাসের মধ্যে তীব্র উত্তাপ,পুড়ে যাওয়া পাতা যেমন নিঃশব্দে ছাই হয়ে যায়,তেমনি শহরটাও আজ যেন নিঃশব্দ পুড়ে যাচ্ছে।
সড়ক জুড়ে রিক্সা, বাস, মোটরগাড়ির এক মেলা।
হর্নের শব্দ গলগল করে ছুটে বেড়াচ্ছে বাতাসে,
তবু যেন কেউ শুনছে না।এই যান্ত্রিক কোলাহলের মাঝেও আনায়া হাঁটছে,অন্যমনস্ক, নির্বাক, হৃদ গহীনের ঝড় সামলে নিজের ভিতরেই ডুবে থাকা এক পথচারী।

তার কপালের ঘামে, চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া একফোঁটা জলেই বোঝা যায়,ভেতরে জমে আছে অস্ফুট কিছু প্রশ্ন।সকালের শিশিরের বলা কথাগুলো তার কানে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে।
পায়ে যেন ভার নেমে আসে তার।সে হাঁটছে, অথচ ঠিক হাঁটছে নাতার চারপাশে গাড়ি, মানুষ, আলো, শব্দ—সব আছে,তবু সে তাদের ছুঁতে পারছে না।ঠিক সেই মুহূর্তেই তার সামনেই এক গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ায়,বারবার হর্ন বাজাচ্ছিল গাড়িটা,কিন্তু আনায়া যেন সেই শব্দ শুনতেই পায়নি।

গাড়িটা যখন প্রায় ছুঁয়ে যেতে বসেছে তার শরীর,ঠিক তখনই কে যেন টান দিয়ে তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়।এক ঝাঁকুনি, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় তার ভারসাম্য কিছুক্ষণের জন্য যেন চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসে।
অতিবাহিত হয় কিয়ৎকাল, অবশেষে জ্ঞান ফিরলো তার বুঝতে পারলো একটু আগেই তার সাথে কি ঘটতে যাচ্ছিলো, তাকে বাঁচানোর জন্য সে আগন্তুক থেকে ধন্যবাদ দিতে যাবে তার আগেই দেখতে পেল লোকটি প্রায় তার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেছে!
কিন্তু হঠাৎই আনায়ার মনে হল তার চারপাশের বাতাসে এক অদ্ভুত পরিচিত সুগন্ধ বিরাজমান! যেন বহুদিনের পরিচিত ঘ্রাণটি!যেন হারিয়ে যাওয়া কোন বিকেলের অলিখিত অঙ্গার এটি…

দুপুরটা কেটে গেছে হাসিঠাট্টা মজায় ঘেরা এক অন্যরকম পরিবেশে,হাসনা খান আর হুররাম বেগম মিলে পুরো চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস তুলে ধরেছে ফারিনের সামনে, তবে ফারিনের সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে হাসনা খান আর ইমরান চৌধুরীর কিছু সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলোকে, লাভ ম্যারেজ তাদের আর তাদের প্রণয় সংঘটনে সবচেয়ে বেশি যিনি সহায়তা করেছিলেন সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে ফারিনের বাবা, বন্ধুত্বের বিভিন্ন মুহূর্ত ভালবাসার মুহূর্ত সবকিছুর গল্প শুনে ফারিনের মনে হচ্ছিল সে যেন পিছিয়ে গেছে আরও কয়েক যুগ!
অবশেষে আসরের ওয়াক্তে রুমে আসলো সে, রুমে এসে বিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিতেই চক্ষু চরক গাছ তার, লিসার নাম্বার থেকে দশটা মিসডকল, সাথে আর আর মোবাইল থেকেও পঞ্চম বার মিসড কল, ফারিন দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে লিসার নাম্বারে কল লাগালো। সঙ্গে সঙ্গে ওই পাশ থেকে ভেসে আসলো একটা তেজী কন্ঠ,,

—”কই থাকিস তুই কল দিয়ে পাওয়া যায় না কেন?”
ফারিন কিছুটা ভরকে গিয়ে বলল,,
—”কি কি হয়েছে লিসু? এত উত্তেজিত কেন তুই?”
লিসা:”উত্তেজিত মাই ফুট!তুই আজকে কলেজে আসিস না কেন?”
ফারিন এবার শান্ত কণ্ঠে বললো,,
—”এই শোনার জন্য এত রাগ? আমি তো এই এক মাস আর কলেজ আসবো না!”
লিসা:”আসা লাগবে না তোমার কলেজে নিজের বর যখন অন্য কারো হয়ে যাবে তখন বুঝো!”
ফারিন এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,,
—”মানে?”

লিসা:”মানে আশেপাশে অনেক শাকচুন্নি ঘুরছেন যারা তোমার হাজবেন্ডের কাঁধে বসার জন্য ছলচাতুরি করছে!”
ফারিন:”ভনিতা না করে সঠিক করে বল লিসু! কি হইছে?”
লিসা:”মেহেনাজ ঢঙ্গী আছে না? উনি আপনার হাসবেন্ডের উপর ক্রাশ খেয়েছেন! আসলে এখানেই শেষ না ওতো আজকে শুনতে ছিল নির্ঝর স্যার ফেভরিট কালার, স্যারের বাসা কোথায় হেন তেন বিভিন্ন কিছু! আর সবচেয়ে বড় কথা ও একবারও নির্ঝর স্যারকে স্যার বলেনি নির্ঝর বলে সম্বোধন করতে ছিল!”

ফারিনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, এতক্ষণ ধরে সবকিছু মেনে নিতে পারলেও লাস্টের কথাটা সে যেন একদমই মানতে পারছিল না যেখানে বিবাহিত স্ত্রী হওয়া সত্বেও ফারিন কখনো নির্ঝরকে স্যার ব্যতীত অন্য কিছু বলতে পারেনি সেখানে মেহেনাজ কিনা তাকে নির্ঝর বলে সম্বোধন করেছে! ফারিন রাগে গজগজ করতে করতে বলল,,
—”ফোন রাখ তুই আমি কালকেই কলেজে আসবো! আর ওই শাকচুন্নিটাকে তো আমি…!”
ফারিন ফোন কেটে দিল, রাগে শরীর রি রি করে কাঁপছে তার, মনে হচ্ছে এখনই গিয়ে মেহনাজের চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে। রাগে হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করলে সে!

আকাশের গায়ে টাঙানো দীপ্তিমান এক ফালি অর্ধচন্দ্র, সেও মাঝে মাঝে মেঘের দস্যিপনায় লুকিয়ে পড়ে।দেয়াল ঘড়ির একটানা টিক-টিক শব্দ যেন কক্ষের নীরবতায় একমাত্র জীবন্ত আওয়াজ।এক উষ্ণ নির্জনতা ছড়িয়ে আছে কক্ষটিতে,ঘরের দরজাটা ধীরে খুলে যায়।ভেতরে ঢোকে নির্ঝর, নিঃশব্দে।
তার চোখ সোজা গিয়ে স্থির হয় বিছানার উপর।সেখানে ঘুমিয়ে আছে ফারিন,বুকের উপর রাখা একটি রসায়নের বই,তার পাতাগুলো খানিক খোলা, খানিক কুঁচকে থাকা যেন পড়তে পড়তেই মাঝপথে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে,নিঃশব্দ জয় হয়েছে ঘুমের, পাঠ আর প্রয়াস হেরে গেছে।চুলের কিছু অংশ পড়ে আছে কপালের কোণে, কক্ষের উজ্জ্বল আলোক রশ্মি তার মুখশ্রীকে করে তুলছে আরো লাবণ্যময়, অধিকতর মোহনীয়!

হঠাৎই ফারিন এর হাত যায় বেড সাইড টেবিলে রাখা কাচের গ্লাসটির দিকে, এক অদ্ভুত রকম পুরাতন অভ্যাস ফারিনের কখনোই শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারে না সে ঘুমানোর মাঝে পুরো বিছানা জুড়ে ফুটবল তাকে খেলতেই হবে! আরো সে ঘুমিয়েছে বিছানার কোণে, ফলে সহসা তার হাত চলে গিয়েছে গ্লাসটির দিকে!
কিন্তু এখন যদি গ্লাসটা নিচে পড়ে তাহলে বিশ্রী একটা শব্দের সৃষ্টি হবে,মুহূর্তভঙ্গের এক তীব্র শব্দ ছুটে যাবে নিস্তব্ধ রুমের শরীর ছুঁয়ে। তাই নির্ঝরের দ্রুত এগিয়ে যায় ফারিনের দিকে, আলতো হাতে তার হাতটা সরিয়ে দেয় সেখান থেকে, তবে ফারিন এর হাত সরাতে গিয়েই ঘটে এটা অদ্ভুত সুন্দরতম ঘটনা, ফারিন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই নির্ঝরের হাত টেনে সে হাতের উপর মাথা রাখে।

আর এদিকে ফারিনের এহেন কাণ্ডে নির্ঝরের মুখশ্রী ধীরে ধীরে ঝুঁকে আসে ফারিনের খুব কাছাকাছি তাদের নিঃশ্বাসের উত্তাপ মিলেমিশে এক অব্যক্ত সুর তুলছে বাতাসে।ঘরটা নিঃসাড়, কিন্তু তাদের মাঝখানে জমে উঠেছে শব্দহীনতা। বেজে ওঠে এক নিঃশব্দ কবিতার ‌প্রেমময় চরণ খানা!

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪২

ঠিক সেই মুহূর্তেই, ফারিনের ঘুম ভেঙে যায়।সে চোখ মেলে তাকায় হঠাৎই শ্বাস আটকে আসে তার!নির্ঝর তার সম্মুখে, তাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের চোখাচোখি হয় দু’জনের, মিলিত হয় নেত্রজোড়া!দুটি নয়ন জ্বলে উঠে।তাদের মুখ এতটাই কাছাকাছি যেন সময়ের নিজস্ব সীমারেখা মুছে গেছে,শুধু নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে মুখের রেখা,আর সেই স্পর্শেই জন্ম নিচ্ছে এক মৃদু প্রেম,যার না আছে ভাষা, না আছে নাম।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৪