মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৪

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৪
ইফা আমহৃদ

“আজকে রাতের জন্য একটা পাখি নিয়ে এসেছি, পছন্দ হয়েছে? পাখি নিজেই দরজার সামনে শিকারির অপেক্ষা করছিল। তাই ধরে এনেছি জবাই করতে।”
বলেই উচ্চশব্দে হেসে উঠল। ধ্যান ভাঙল আমার। ঘাড় ঘুরিয়ে দ্রুত দৃষ্টিপাত করলাম সেদিকে। স্যার এই পাঁচতারা হোটেলের এড্রেস দিয়েছিলেন তো, না-কি আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি।‌ কয়েক সেকেন্ডেই ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হওয়াই আমার একমাত্র লক্ষ্য। কাঁধে রক্ষিত ব্যাগটা চেপে ধরলাম। চাতক পাখির ন্যায় এদিক ওদিক অবলোকন করলাম। পিছিয়ে যেতে লাগলাম ক্রমাগত। দরজার কাছে আসতেই সেই দাড়োয়ান পথ আঁটকে দাঁড়াল। কার্ড দেখতে চাইলেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো কার্ড নেই। কীভাবে বের হব, এই চিন্তায় মশগুল।

এর মাঝেই কেউ একজন এগিয়ে এলো আমার দিকে। নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, “তুমি এখানে কেন বেবী। ঐদিকটায় চলো। ওখানে বেশ নিরিবিলি, কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করতে পারবে না।”
মেজাজ চটে গেল আমার। ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হলাম। তুমুল শব্দে চড় বসিয়ে দিলাম তার গালে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আছে বিধায় ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আঘাত করল। চোখের মণিগুলো জ্বলে উঠল। বাঁকা গাঁ জ্বালানো চাওনি। চিৎকার করে উঠল। কেঁপে উঠলাম আমি। চারপাশে হৈ চৈ শব্দ থেমে গেল। মিউজিক বন্ধ হয়ে গেল। সবাই এদিকে তাকিয়ে আছে।
“তোরা দেখছিস কী? ধর ওকে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভীত হলাম আমি। ক্রমাগত এগিয়ে আসছে আমার নিকট। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শক্তি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতগুলো ছেলের সাথে পারব না, উপায়ান্তর না পেয়ে ছুটলাম। ফাঁকা ঘর পেয়ে ঢুকে পড়লাম। ছিটকিনি লাগিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। এতেও কোনো কাজ হলনা, ক্রমাগত দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। ব্যাগ থেকে দ্রুত ফোন বের করলাম। কাকে ফোন করব বুঝতে পারলাম না। বাড়িতে ফোন করলে মামা, মামনি, বাবুই চিন্তা করবে। তাছাড়া তাদের আসতে আসতে যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়। সাত পাঁচ না ভেবে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে ফোন করলাম, কারণ তার কন্টাক্ট নাম্বারটাই উপরে ছিল। তিনি ফোন রিসিভ করলেন না। বেশ কয়েকবার ফোন করার পরেও ধরছেন না। বুঝতে বাকি রইলো না, অনুষ্ঠানের কারণে তার ফোনের রিংটোন শুনতে পারছেন না। হাল ছেড়ে দিলাম আমি। এই মুহুর্তে কী করা উচিত, মস্তিষ্ক প্রায় অচল। এভাবে অতিবাহিত হলো বহুসময়। কেউ ফোন তুলছে না। অবশেষে প্রিন্সিপাল স্যার ফোন তুললেন। তাকে বলতে না দিয়ে আমি ক্রমাগত বলতে শুরু করলাম,

“স্যা-র আ-মি চ-ড়ু-ই ব-ল-ছি। প্লী-জ হে-ল্প মি!”
পরক্ষণেই ধ্রুব স্যারের গলা শুনতে পেলাম। তিনি বিচলিত হয়ে বলতে লাগলেন, “চড়ুই কুলডাউন। আমি ধ্রুব। স্যারের ফোন আমার কাছে। তুমি শান্ত হও। এমন করছ কেন? কোথায় আছো? এখনও আসো নি কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে? আমাকে বলো!”
প্রতুক্তি দেওয়ার বিপরীতে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বুলি নেই। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এই প্রথম অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে। সাহস হারিয়ে ফেললাম। বলার ক্ষমতা হ্রাস পেল। গলায় আঁটকে আগে হাজারো না বলা কথা। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে টেনে টেনে বললাম,
“প্লীজ আমাকে বাঁচান। ওরা আমার বাঁচার উপায় রাখবে না। আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না আমার।”

“চুপ। একদম চুপ। কোথায় তুমি? কী হয়েছে বলো আমায়?”
“স্যারের দেওয়া ঠিকানায় আছি আমি। ঠিকানাটা মনে নেই আমার। মেসেজ চ্যাক করলেই বুঝতে পারবেন। স্যার মেসেজ করে জানিয়ে ছিল।
সেখানে এসে দেখি, পরিচিত কেউ নেই। একটা ছেলে আমাকে..
পুনরায় কেঁদে উঠলাম। শরীরটাও তাল মিলিয়ে কেঁপে চলেছে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “কী করেছে ছেলেটা?”
“আমাকে মিথ্যা বলে দোতলায় নিয়ে এসেছে। আমি ওদের হাত থেকে বাঁচতে একটা ফাঁকা ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছি। দরজা যখন তখন ভেঙে ফেলবে। প্লীজ বাঁচান।”
“তুমি দ্রুত লোকেশন অন করো আর কোনো অবস্থাতেই ফোন কল কা’টবে না। আমি বলার আগ পর্যন্ত দরজা খুলবে না।”

আমি দ্রুত লোকেশন অন করলাম। ভাঙাচোরা খাটের নিচে ঘাপটি দিয়ে বসে রইলাম।
দরজা ধাক্কার শব্দ নেই। দূর থেকে অস্ফুট চ্যাঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পারছি। দরজা খুলার সাহস পাচ্ছিনা। খাটের তলা থেকে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আড়ি পেতেছি দরজায়। হাতে এখনও ফোন। ধ্রুব স্যার বললেন,
“ভয় না‌ পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসো। আমি দরজার বাইরে।”
নিমিষেই ভয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিতেই ধ্রুব স্যারকে দেখলাম সর্বপ্রথম। আতঙ্কে জাপটে ধরলাম তাকে। তিনিও বিনাদ্বিধায় হাত রাখলেন পিঠে। অস্বস্তি হল না। এতক্ষণ এই স্পর্শটার জন্য যেন কাতর হয়ে অপেক্ষা করেছিলাম। অপরিচিত সেই সুভাস তার শরীর থেকে আসছে। অস্ফুট স্বরে শুধালাম, ” আপনি এসেছেন স্যার। আমি প্রচুর ভয় পেয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ, এসেছি তো! এখনও কি ভয় করছে তোমার?” কৌতূহলী স্বরে বললেন।
“না!”
“তাহলে কেন কাঁপছ? শান্ত হও। কোনো ভয় নেই।”

আমাকে শান্তনা দিতে দিতে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি। কতগুলো ছেলে নিচে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এরাই দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। আমাকে বের করে আনার আগে একচোট হয়ে গেছে তাহলে। ধ্রুব হরতাল ফাইটিং জানে? ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলে আমাকে কে এখানে এনেছে? আমি পর্যবেক্ষণ করেন সে ছেলেটিকে দেখিয়ে দিয়ে বলি, ঐ।
ধ্রুব স্যার এদিক ওদিক কিছু খুঁজতে লাগলেন। ডিঙ্কের বোতল এনে বিকট শব্দে ভাঙল ছেলেটির মাথায়। লহমায় রক্ত প্রবাহিত হল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
“অসহায় একটা মেয়েকে পেয়ে এমন জঘ’ন্য কাজ করতে লজ্জা করেনি তোদের। আজকের পর থেকে এমন অবস্থায় রাখব না। তোদের সবাইকে আমি পুলিশে দিব আর এই পাঁচতারা হোটেল বন্ধ করে দিবো।”

শ্রবণ পথে পৌঁছাল না পরবর্তী শব্দগুলো। অস্পষ্ট হয়ে আসছে সবকিছু। আমার যে ব্লাড ফোবিয়া রয়েছে। হাত পা থরথরিয়ে কাঁপছে। দৃষ্টি সেকেন্ডে দশ বারের অধিক উঠানামা করছে। থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম নিচে। ঝাঁপসা হয়ে এলো সবকিছু। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

যখন জ্ঞান ফিরল আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। চোখ ভারী পাতা নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে অবলোকন করতেই ধরা দিল মাথার উপর ঝুলন্ত সিলিং ফ্যান। স্থির সিলিং ফ্যানটা। তবুও হাড় কাঁপানো শীতে করছে। যেন বরফে আচ্ছন্ন দেহখানা। হাতে‌ স্যালাইনের ক্যানেল লাগান। স্যালাইন প্রায় শেষের দিকে। সবকিছু মনে পড়তেই উঠে বসলাম আমি। জানালা থেকে নিভু নিভু আলো প্রবেশ করছে। রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। সূর্য মাথার উপরে অবস্থান করছে। ধ্রুব স্যার কোথায়? আমাকে হসপিটালে কে এনেছে? মামা মামনি ব্যাপারটা জানে? চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। ব্যাগটা নেই আশেপাশে। ওয়ার্ড বয় পরিস্কার করছিল সবকিছু। আমাকে উঠতে দেখেই ওয়ার্ড বয় বেরিয়ে গেল নার্সকে খবর দিবে বলে। নার্স নিয়ে ফিরলেন। আমাকে চ্যাকআপ করে ইঞ্জেকশন পুশ করলেন। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে রইলাম। হাঁসি দিয়ে বলল,

“তুমি অনেক লাকি মেয়ে। তোমার স্বামী এখনও বাড়িতে যায়নি।”
“আমার স্বামী? কে সে?”
“কে আবার ধ্রুব।”
হার্ট বিট বেড়ে গেল। অশ্রু গড়াল। ধ্রুব আমায় দেখতে এসেছে, সত্যি। মিনমিনে স্বরে বললাম, ” আপনি সত্যি বলছেন তো! ধ্রুব এসেছে?”
“হ্যাঁ ম্যাম, ধ্রুব স্যার এসেছেন। আপনি বসুন আমি ডেকে নিয়ে আসছি।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩

মেয়েটি প্রস্থান করল। ভেতরে ভেতরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি। এতগুলো বছর পর ধ্রুব আমাকে চিনতে পেরেছি। আমি তাকে চিনতে পারব তো! আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে গেলাম। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালাম। শক্তি নেই তবুও চেষ্টা চালালাম। ওয়ার্ড বয় ধরতে এলো আমায়। আমি তার দেওয়া বাঁধা তোয়াক্কা করলাম না। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে যাওয়ার প্রয়াস করলাম। উপায়ান্তর না পেয়ে ওয়ার্ড বয় পেছন থেকে জাপটে ধরল আমায়। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করলেন ধ্রুব স্যার। আমি আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। ইনি তো ধ্রুব স্যার, আমার ধ্রুব নয়। আমারই ভুল হয়েছে তাকে আশা করা। আমার মুখ দেখবেন না বলেই তো বিয়ের পরেরদিন জার্মানে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন। তাহলে আজ কেন আসবে। তাছাড়া যেখানে ডিভোর্স পেপার পাঠানো হয়েছে, সেখানে এইসব ভাবনাই অহেতুক, অবাস্তব। আমারই ভুল হয়েছে, ভুল সময়ে ভুল আব্দার করে ফেলেছি।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৫