মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা শেষ পর্ব 

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা শেষ পর্ব 
ইফা আমহৃদ

আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদ। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। রঙ বেরঙের আলো জ্বলছে। পরিবেশ আজ শান্ত। লাল বেনারসী শাড়ি পড়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। দরজার সামনে ভিড় জমেছে। ‘বর এসেছ, বর এসেছে’ বলে নাচছে সকলে। উপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। রাহাত স্যারের পাশে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিয়া, আঁখি, নিরব, তারিফ গেট ধরেছে।
আঁখি গানের ছলে বলে,

“টাকা ছাড়ো, বিয়ে করো। টাকা নাই বিয়ে নাই, বেশি বেশি কাবিন করুন, সুন্দর সুন্দর মেয়ে বিয়ে করুন।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ভাবল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে, “টাকাও নাই, বিয়েও না। বেশি বেশি টাকাও দিবো না, তোমাদের মতো জ’ল্লাদ বোন বিয়েও করব না।”
ফট করে ধ্রুবের দিকে তাকালেন রাহাত স্যার। রুমালটা আলগা করে ধ্রুবকে ফিসফিসিয়ে বলেন, “চুপ কর, কী বলছিস। তোর জন্য আমার বিয়েটা ভেস্তে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুব পকেট থেকে চিরুনি বের করলেন। মাথায় আঁচড় কে’টে বললেন, আমি তোর বন্ধু দোস্ত। ওরা তোর টাকাগুলো শেষ করার ধান্দা করছে, আমি থাকতে হবে দিবো না এটা। চড়ুই তো বড় ধান্দাবাজ। বিয়ের পর তোকে জ্বলিয়ে খাবে। আমি তোর ভালো করছি।”
ধ্রুবকে ছেড়ে রাহাত স্যার নিজেই বললেন, “কত‌ টাকা লাগবে তোমাদের?”
ফিক করে হেসে দিলাম। দুই বন্ধুই বড্ড উন্মাদ। একজন তার বউকে অন্যের থেকে বাঁচাতে ভাংচি দিচ্ছে আরেকজনের তার বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য পাঁয়তারা করছে। আমার বাবুইটা ভালো থাকলেই খুশি। মামা-মামুনি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলেও বাবুইকে ছাড়ছে না। এই বাড়িতেই থাকবে। পড়াশোনা করে স্বপ্ন পূরণ করার পরেই বাবুইকে দিবেন। ভাবনার ছেদ ঘটল আঁখির কথায়, “পঞ্চাশ লাগবে।”

ধ্রুব নির্দ্বিধ হয়ে পঞ্চাশ টাকার কচকচে নোট এগিয়ে দিল। আঁখি নোটের দু’দিক ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ফোড়ন
দিয়ে বলে, “আমি আপনার কাছে পঞ্চাশ হাজার চেয়েছি, শুধু পঞ্চাশ টাকা নয়। বিয়ে করতে এসেছেন ভাইয়া স্যাররা, মাছ কিনতে না। দাম কষাকষি করছেন।”
আমি আরেকটু মনযোগ সহকারে শোনার প্রয়াস চালালাম। তৎক্ষণাৎ বয়স্ক মহিলারা হুরমুড়িয়ে ঢুকল ভেতরে। তাঁদের ডাক শুনে ঘরে গেলাম। লাল ওড়নাটা ক্লিপ দিয়ে সিকিউর করে দিল। মামুনি নজর ফোঁটা দিলেন। জড়িয়ে নিয়ে বললেন, “ভালো থাকিস মা। নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছি, কখনো অভাব বুঝতে দেইনি। আমার বিশ্বাস ধ্রুব তোর সব কষ্ট লাঘব করবে।”

আমি হাসি উপহার দিলাম। রমিলা আন্টি মামুনির কথা শুনে বললেন, “কাঁদিস না, আমার ছেলে ওর কোনো অযত্ন হয়ে দিবে না।”
রাত আরেকটু গভীর হল। মামা কাজি, উকিল চলে এলো। আমি নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে রইলাম। কাজি, উকিল লিখেই নিয়ে এসেছে। উকিল কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে সাইন করতে বললেন। হঠাৎ প্রচুর কাঁদতে ইচ্ছে হলো। আমি ঘোমটার আড়ালে নিজেকে সংযত করলাম। কাগজ পড়তে হাতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটল। অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরো ঘর। ধ্রুব মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। রাহাত স্যারকেও নিয়ে এলেন। তিনি যেন জানতেন এখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটবে। সন্দেহজনক লাগল ব্যাপারটা। মুখ ফুটে কিছু বললাম না। মোমবাতিটা কিছুটা দূরে রাখলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম না লেখাগুলো। এমনিতেই চোখে সমস্যা, তার উপরে অন্ধকারে ভয়ঙ্কর ঝাপসা।

ধ্রুব এবার ঝাঁজালো গলায় বললেন, “পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ, এত দেখার কী আছে। তাড়াতাড়ি সাইন করো, বউ।”
দ্রুত ধ্রুবের দিকে অবলোকন করলাম। বউ শব্দটায় বেশ চমকালাম। মিনমিনে গলায় বললাম, “বউ?”
“হ্যাঁ বউ। আমরা যখন জার্মানে ছিলাম, আমার সব জামাকাপড় রাহাত পড়ত। কিছু বললেই বলত, তুই আর আমি কি আলাদা? আমার জিনিস তোর, তোর জিনিস আমার। আমি বরাবরই প্রতিবাদ করেছি। আমার জিনিস আমারই। সেই কথা অনুযায়ী ওর বউ আমার আর আমার বউও আমার।”

বিরক্তকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিলাম। একে-একে সবাই সাইন করে রাখল। ধ্রুব সাক্ষী হিসেবে সাইন করলেন। অতঃপর কাজি বিয়ে পাড়ানো শুরু করলেন। ধ্রুব তার আগে কাজির সাহেবের কানে কানে কিছু বলেন। তাই আস্তে আস্তে সবকিছু পড়ে শুনিয়ে কবুল বলতে বলেন। সময় নিয়ে কবুল উচ্চারণ করলাম। কবুল বলার পরে পাত্রকে কবুল বলতে বললেই ধ্রুব চট করে তিন কবুল বললেন। হতভম্ব হল সকলে। ধ্রুবের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধ্রুব তোয়াক্কা করলেন না। হাই তুলে বিছানায় উঠে কোলে শুয়ে পড়লেন। লহমায় বিদ্যুতিক সমস্যার সমাধান হল। টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা মিষ্টি থেকে একটা মিষ্টি মুখে পুড়ে নিলেন। পানি খেয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ। শুভ পরিণয় সম্পূর্ণ হল। এবার যে যার বাড়িতে যাও। আমি যাচ্ছিনা। দুই মাস ধরে অনেক খাটনি করেছি, এবার বিশ্রাম নিবো।”

অতঃপর কাজি সাহেবকে একটা খাম ধরিয়ে দিলে বললেন, “যা কন্ট্রাক হয়েছিল তারচেয়ে বেশি আছে, ভাগাভাগি করে নিবেন দু’জনে।”
সবকিছু মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেল। প্রিয়া আঁখি নিরব তৌফিক এলো এতক্ষণে। ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লান সাকসেসফুল, সো আগামী টুরের সব খরচ আমার। আর দাদিমা তুমি,
হুম্মা, তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।”
বোধগম্য হলনা এদের কথার মানে। শোরগোল শুরু হল। না বোঝার স্বরে বললাম, “সরুন, সোজা হয়ে বসুন। গায়ে পড়ছেন কেন? কীসের প্লান সাকসেসফুল হয়েছে শুনি?”

দাঁত কেলিয়ে ধ্রুব বলে, “কীসের আবার তোমার আর আমার বিয়ের।”
“বিয়ে কখন?” সন্দেহজনক দৃষ্টি।
“এইতো একটু আগে, আজকে, শুক্রবার। ভুলে গেলে, সাইন করোনি? পেপারগুলো পড়ে দেখোনি তো তাই বুঝতে পারোনি।”
ধ্রুব কাগজগুলো এগিয়ে দিল। আঁখি বাঁধা দিল। যদি আমি ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু ধ্রুব শুনল না। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে, কাবিন ছিঁড়ে লাভ কী?
আমি বন্ধুদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম, সামান্য টুরের জন্য বন্ধুর সাথে এমন করল। এজন্যই বিদ্যুৎ চলে গেছিল। না! না! বিদ্যুৎ মিটারে কিছু করেছে নিশ্চয়। আমি চুপটি করে বসে রইলাম। তবে মনে মনে একটু তৃপ্তিকর হাসি দিলাম। তবে রমিলা আন্টি আমাদের বিয়ের জন্য অন্য ব্যবস্থা করেছিলেন।

সজ্জিত ঘরে একহাত ঘোমটা টেনে বসে আছি। পূর্ণিমার চাঁদটা এখন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। পশ্চিমা হাওয়া বইছে। দূরে অস্পষ্ট নদী দেখা যাচ্ছে। নৌকায় জ্বলে থাকা আলোগুলোতে ফানুসের মতো লাগছে। নদীর বুকে ফানুস। কল্পনায় দেখা যায় কেবল। শান্তি লাগছে। পরম শান্তি অনুভব করছি। মৃদু শব্দ হল বাইরে থেকে। বুঝতে পারলাম , কেউ ভেতরে ঢুকছে। এ সময় ধ্রুব ছাড়া কেউ আসবে না। দরজা খুলে গেল। ধ্রুব ভেতরে প্রবেশ করলেন। পরক্ষণেই বালিশ ছুঁড়ে ফেললাম। ঘাবড়ে গেলেন তিনি। অন্য একটা বালিশ নিলাম। তিনি নিচের বালিশটা তুলে আড়াল করে বললেন, “এগুলো ছোড়াছুড়ি করছ কেন?”
ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, “এখন বালিশ ছুঁড়েছি, তারপরে যা-যা আছে সেগুলো ছুঁড়ব। তারপরে আপনাকে ছুড়ব। কাছে আসুন।”

“এই না!”
কাছে তো এলেই না। সম্পূর্ণ উল্টো ঘটল। মধুময় রাতকে বিদায় দিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত। আচ্ছা রকম কপাল চাপড়াতে লাগলাম, ছুঁড়ব বলেছি কি সত্যি ছুঁড়ব নাকি? আশ্চর্য! কী করব এখন?
[পরিশিষ্ট]
বাসের জানালা খোলা। অশান্ত হাওয়া বইছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত আজকের মিশন। উথালপাথাল চারদিকে। কুয়াশায় দেখা যাচ্ছেনা কিছু। মনে আছে সেদিনের কথা, যেদিন আমার খাতা থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন ধ্রুব। হ্যাঁ, সেদিন তিনি কথা দিয়েছেন টুবে নিয়ে যাবেন। আজ সেই পথে রওনা হয়েছি। শুধু আমরা পরিবারের কয়জন যাচ্ছি। ভার্সিটির সবাই বান্দরবান যাচ্ছে।
পেটের ভেতরে ডিপ ডিপ শব্দ। চাদরটা সরে গেছে। আমি পুনরায় চাদর দিয়ে পেট ঢেকে নিলাম। আমি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

ধ্রুব পাশেই বসে আছেন। পরোটা খাচ্ছেন। আমাকেও খাইয়ে দিচ্ছেন।
হঠাৎ বমি পেল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে মুখ করে বমি করে দিলাম। ধ্রুব খাওয়া রেখে আমাকে ধরলেন। মুখ মুছে হেলান দিয়ে বুকে মাথা রাখলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন, “তোমার কষ্ট হবে, তাই আসতে বারণ করেছিলাম। বেবী হলে একসাথে আসতাম তুমিও রাজি হলেনা।”
অভিমানী সুরে বললাম, “তো? নাচবো আমি? তখন বলে দিতেন, আমাকে নিয়ে আসলে আপনার ঝামেলা পোহাতে হবে।”
ধ্রুব মিশুক কণ্ঠে বললেন, “আমাকে তো বাড়িতে থাকতেও ঝামেলা পোহাতে হয়, এখান আসার ফলে তোমাকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।”

শীতল প্রত্যুত্তর মন কেড়ে নিতে পারেনি আমার। তেজ দেখিয়ে উঠে গেলাম। পেটে হাত দিয়ে রাহাত ভাই আর বাবুইয়ের কাছে গেলাম। দুইজনের প্রকৃতি দেখছিলেন। আমি গিয়ে কর্কট কণ্ঠে বললাম, “ভা,ই আপনার বন্ধুর কাছে যান। অসহ্য বিরক্তকর একটা মানুষ। আমাকে সহ্য করতে পারেনা।”
রাহাত স্যার বিনা বাক্যে উঠে গেলেন। আমি বাবুইয়ের কাঁধে মাথা রেখে বসলাম। বাবুই মিষ্টি কণ্ঠে বলে, “মোরগ ঝুঁটি কী রেসপন্স করছে?”
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “ওর নাম মোরগ ঝুঁটি না। তুই ডাকিস মোরগ ঝুঁটি, তোর ভাই ডাকে বুলবুলি। সুন্দর কোনো নাম নেই না-কি? আশ্চর্য!”

হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। ঝুঁকে গেলাম পেছনে। পুনরায় সামনে ঝুঁকে গেলাম। সামনের সিটের সাথে মাথায় আঘাত পেলাম। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে নিচে পড়ে গেলাম। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম সেখানে।
যখন চোখ মেলে পৃথিবী দেখলাম তখন সবকিছুই অজানা অচেনা লাগছিল। ঝাপসা চোখে সবকিছু আরও ঝাপসা লাগছিল। আমি সর্বপ্রথম ধ্রুবকে খুঁজতে লাগলাম। তিনি নেই, কোথাও নেই। ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন অ্যাক্সিডেন্টে করেছে বাস। আমাকে কে হসপিটালে এনেছে? তাও জানে না। শুধু বলেছেন অনেকেই হসপিটালে ভর্তি আছে। দু’দিন হয়েছে অ্যাক্সিডেন্টের। কেঁপে উঠলাম অকস্মাৎ। তারা কোথায়?
হাতে স্যালাইনের ক্যানেল লাগানো। হাত পায়ে ব্যান্ডেজ, তবে মাথায় চোট বেশি। আমি পাশ ফিরে পেটে হাত রাখলাম। বেবীর কথা মনে পড়ল। ডাক্তার জানিয়েছেন, বেবী ঠিক আছে। ধ্রুবের সাথে অভিমানটা পোড়ালো আমায়। কেন শেষবার তার বুকে মাথা রাখছে পারলাম না।

ডাক্তারের থেকে একটা ফোন চাইলাম। বাড়ির কাউকে ফোনে পাওয়া গেল না। ভেতরটা পুড়ে উঠল। কোথায় সবাই। বেবী ঠিক আছ। আমার মাথায় একটু আঘাত লেগেছে, তাই জ্ঞানহীন অবস্থান ছিলাম। কাঁদতেও পারছিনা। এভাবে দোটানায় অতিবাহিত হল আরও দু’দিন। শরীর তখনও সুস্থ নয়। তবুও বাড়ি ফিরতে হবে। টাকা পয়সা কিছু নেই। নিজেকে শান্ত করলাম। হসপিটাল থেকে সাহায্য চেয়ে পাঁচশ টাকার ব্যবস্থা হল। নিজেই শহরে ফিরলাম বাসে। পড়নে সেদিনের পুরোনো জামাটা। ছেঁড়া অংশগুলো চাদর দিয়ে ঢাকা। ধ্রুবদের বাড়িতে গেলাম। স্টার্ফরা সবাই আমাকে দেখে হতবাক হল। একজন তো কেঁদেই ফেলল। ধ্রুবের কথা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস হলনা। তারাই কেঁদে বলে,

“ধ্রুব স্যার আপনার মামা বাড়িতে। কেমন পা’গল পা’গল হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলেনা, খাওয়া দাওয়া করে না। কাঁদেও না। চুপ করে থাকে।”
পলক পড়ল। টেনে টেনে বললাম, “ধ্রু-ব?”
“হ্যাঁ, ম্যাম।”
“আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।”
“ম্যাম জামা কাপড় পাল্টাবেন না? ময়লা।”
“আমার ধ্রুব কেমন আছে, না জানা অবধি আমার শান্তি নেই।”
“ম্যাম বাবু ঠিক আছে, বাবুর দিকে তাকিয়ে যদি কিছু খেয়ে যেতেন।”
“বাবু ঠিক আছে, প্লীজ..

আমি অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলাম ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে। পরিবেশ শান্ত। বাড়িতে পৌঁছাতে আধ ঘণ্টা লাগল। কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি চুপিসারে নিজের ঘরে গেলাম। ধ্রুব বিছানায় শুয়ে আছেন। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছেন। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। ধ্রুবের পাশে বসলাম। কাঁপা কাঁপা হাত ধ্রুবের হাতের উপর রাখলাম। ধ্রুব ফট করে তাকালেন। রক্তিম চোখজোড়া ভীত হয়ে আছে। আমাকে দেখে মোটেও চমকালেন না। এটা যেন হওয়ারই ছিল। আমি তার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম। তিনি বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন, “মজা দেখতে এসেছ? কত কষ্টে আছি তা দেখতে এসেছ? বারবার আমার সামনে এসে কেন দূর্বল করে দাও আমায়, যাও। প্লীজ যাও..

“ধ্রুব কীসব বলছেন, আমি কেন আপনার কষ্ট দেখতে আসব।”
তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন, “যাবে না, তাই তো?”
“যাবো কেন? কী হয়েছে আপনার?”
“না গিয়ে থাকো কীভাবে আমিও দেখতে চাই।”
ধ্রুব উঠে বসলেন। বিছানার পাশে রাখা লাইটার নিলেন। আগুন জ্বেলে ছুঁড়ে ফেললেন আমার দিকে। সেকেন্ডের ব্যবধানে আগুন ধরল। ভরকে গেলাম আমি। আগুন আগুন বলে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম। ধ্রুব বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। টেনে টেনে বললেন, “কী হল, যাচ্ছনা কেন? আগে যখন এসেছিল, হাত পায়ে মাথা ব‌্যান্ডেজ তো ছিলনা। হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে।”

আমার চিৎকার শুনে ছুটে এলো সকলে। আগুন দেখে হকচকিয়ে গেল। তারচেয়ে আমাকে দেখে বেশি চমকালেন। দ্রুত পানি এনে ঢেলে দিল গায়ে। কাশি উঠল আমার। এই সময়ে কেউ এখানে আশা করেনি আমায়।‌ কাশতে কাশতে বললাম, “পানি, পানি খাবো।”
পানি এনে নিজ হাতে খাইয়ে দিল মামুনি। চোখের পানি চিকচিক করছে তার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “তুই বেঁচে আছিস মা।”
ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাশ করতে করতে বললাম, “বেঁচে তো আছি, কিন্তু এক্ষুনি আমাকে মে’রে ফেলছিল।”
ধ্রুব আমার পাশ ঘেঁষে বসলেন। চোখজোড়া টলটল করছে। তার হাত রাখলেন গালে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলাম। অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, “এতদিন কোথায় ছিলে চড়ুই কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। আমি কল্পনা ভেবে তোমাকে..

কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম, “ছিলাম এক হসপিটালে। দু’দিন আগে জ্ঞান ফিরেছে। কতবার ফোন করেছি, সবার ফোন বন্ধ।”
“অ্যাক্সিডেন্টে ফোন ভেঙে গেছে চড়ুইপাখি‌।”
চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, “চোখেমুখের এই অবস্থা হয়েছে কেন? খাওয়া-দাওয়া করেননা, শুকিয়ে গেছেন বড্ড।”
ফট করে জড়িয়ে ধরল আমায়। মিশে গেল সবাঙ্গ। বাহুডোরে আবদ্ধ রেখে বললেন, “আমার চড়ুইপাখি আর বুলবুলি চলে এসেছে, এবার সেই আমার যত্ন করতে পারবে।”
কপালে সময় নিয়ে অধর ছুঁয়ে দিলেন। নিচে বসে পেটের উপর কান পেতে বললেন, “আমার বুলবুলি কেমন আছে?”
“আপনার বুলবুলির কোনো অযত্ন হতে দিতে পারি আমি, হম?”

“প্লীজ খাবো না।” চোখমুখ কালো করে।
“খেতে তো তোমাকে হবেই। এতদিন ঠিক করে খাওনি, এবার থেকে খেতে হবে। হাঁ করো।”
ধ্রুবের কথাই হাঁ করে লোকমা মুখে নিলাম। চিবুতে চিবুতে বললাম, “প্লীজ আর খাবো না, প্লীজ।”
“এখন খাও, কালকে চেকআপ করে সিউর হতে হবে।
চড়ুই ভাবতেই ভয় করে, পরক না করেই তোমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলাম।” আরেক লোকমা মুখে তুলে দিয়ে। প্রসঙ্গ বদলে বললাম, “ধ্রুব, আমি ঘোড়ায় উঠব।”

“এখন ঘোড়া কোথায় পাবো চড়ুই?”
“আপনার পিঠই তো ঘোড়া, হি! হি! হি!”
“ব্যথা পাবে চড়ুই।”
“না, পাবো না।”
ধ্রুব হাত ধুয়ে উবুত হয়ে ঘোড়ার ভঙ্গিতে থাকলেন। আমি পিঠে বসলাম। চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে বললাম, “চল ঘোড়া চল, হাম্বা, হাম্বা।”
ধ্রুব হেসে কুটিকুটি হলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ডাকছ গরুর মতো, কিন্তু চড়েছ ঘোড়ায়। ব্যাপার কী?”
“কারণ ঘোড়া কীভাবে ডাকে আমি জানি না, আপনি জানেন কি?”
‘মেঘ জড়ানো চাঁদপরী,
দেয় অভিযোগের হাতছানি
কাছে এসে পাশে বসবে, জানি বড্ড বেশিই অভিমানী।’
– ইফা ?

এখানে মেঘ দ্বারা অভিমান, চাঁদপরী চড়ুই অর্থাৎ প্রথম লাইন দ্বারা অভিমানী চড়ুইকে বোঝানো হয়েছে।
আমরা সবাই এক একটা চাঁদ। পূর্ণিমা হয়ে আকাশে থাকি। কখনো নিজেকে মুক্ত করে দেই। কখনো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আড়াল করে রাখি। আড়াল করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে চাঁদের ছোট ছোট ফালি। চুপিসারে হঠাৎ করেই নিজের আড়াল করে নেওয়াই মেঘ। মেঘ তো থাকবেই জীবনে, মেঘ আর পূর্ণিমা নিয়েই তো জীবন। জীবন হয়ে উঠুক মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা ?
ভালো থাকবেন, ভালোবাসা?
আসসালামু আলাইকুম ?

[সমাপ্ত

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৬