একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৭

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৭
সাদিয়া জাহান উম্মি

ইদানিং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না প্রাহির।অনেক দূর্বল লাগে শরীর।হাত পা ম্যাচ ম্যাচ করে কেমন যেন।অস্থির লাগে।অল্প একটু কাজ করলেই হাপিয়ে যায়।কিছু খেলেই বমি হয়ে যায়। আর শুধু ঘুম পায় ওর।এইযে সোফায় বসে আছে প্রাহি।টিভি দেখার জন্যে।কিন্তু কিভাবে দেখবে ঘুমে চোখ ভেঙ্গে আসছে ওর।প্রাহি টিভি বন্ধ করলো।বড় একটা হাই তুলে রুমের দিকে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হলো।কিন্তু অর্ধেক সিড়ি উঠেই হাপাতে লাগলো।

যেন কতো ভারি কিছু নিয়ে সে সিড়ি বেয়ে উঠছে।প্রাহি চোখ বুজে বার কয়েকবার জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো।তারপর আস্তে আস্তে হেটে রুমে চলে গেলো। কিছু ভালো লাগছে না ওর।মাথাটাও ভীষন ঘুরছে।একটু ঘুমাতে পারলে বোধহয় ভালো লাগবে।যেই ভাবা সেই কাজ প্রাহি বিছানায় সুয়ে চোখ বুজতে দেরি ওর ঘুম আসতে দেরি হয়নি।মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো প্রাহির।কিন্তু ইশির তীব্র কন্ঠের আওয়াজে ধরফরিয়ে উঠে বসলো।বুকটা ধরাস ধরাস করছে।চোখে পানি এসে পরেছে ওর।প্রাহি ইশির দিকে তাকিয়ে দেখে ইশির চোখে জল।প্রাহি ভয় পেয়ে গেলো।জলদি ইশির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ কি হয়েছে ইশি।তুই কাঁদছিস কেন?’
ইশি কিভাবে কথাটা বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ভীতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।প্রাহির দিকে তাকিয়ে ওর ভীতর থেকে ঠ্যালে কান্নারা যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে।নিজেকে এতো শক্ত রাখতে চাইছে প্রাহির সামনে কিন্তু পারছে না।প্রাহি অস্থির হয়ে গিয়েছে।বার বার জিজ্ঞেস করছে,
‘ কি হয়েছে ইশি? কি হয়েছে আমাকে বল প্লিজ।আমার ভয় করছে।এই ইশি বল নাহ?’
ইশি চোখ মুছে বললো,

‘ তুই আয় আমার সাথে। আমার সাথে চল।তাহলেই বুঝতে পারবি।আমি এখন কিছু বলতে পারবো না।চল তুই।’
ইশি প্রাহির হাত ধরে প্রাহিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো তারপর ড্রাইভারকে বললো গাড়ি স্টার্ট দিতে।কিছুক্ষনের মাঝেই ওরা কাঙ্খিত স্থানে পৌছে গেলো।প্রাহি তাকিয়ে দেখে ওরা হাসপাতালে এসেছে।এটাতো সেই হাসপাতাল যেখানে ওর মা’কে রাখা হয়েছে।প্রাহির বুকের ভীতর কেমন যেন করতে লাগলো।হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে অজানা ভয়ে।ইশি প্রাহিকে নিয়ে ওর হাসপাতালে প্রবেশ করলো।ওর মায়ের কেভিনের সামনে আসতেই দেখলো। হিয়া, রায়হানা আর হেনা বেগম কাঁদছেন। উনাদের সামলাচ্ছেন আরাফ,হিয়াজ শিকদার আর হিয়ান্ত শিকদার।ইশিও আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। শব্দ করে কেঁদে দিলো।হেমন্ত এসে ইশির মাথায় হাত রাখলো। হেমন্ত’র চোখ থেকেও টপটপ করে পানি পরছে।হেমন্ত ধরা গলায় বলে,

‘ কাঁদেনা।আমাদের এভাবে কাঁদলে হবে?প্রাহিকে সামলাতে হবে তো?’
প্রাহি ধীর পায়ে হেটে হেমন্ত আর ইশির সামনে আসলো।অবাক কন্ঠে বলে,
‘ কি হয়েছে তোরা কাঁদছিস কেন?আর সবাই কাঁদছে কেন?আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আর আম্মু ঠিক আছে তো?তোরা সবাই আম্মুর রুমের সামনে এইভাবে কাঁদছিস।আম্মুর সমস্যা হবে।আর এই সময়ে তো আম্মুকে ডাক্তার চেক-আপ করে।তাই এই সময়ে আম্মুর রুমের সামনে এমন করা ঠিক না।’
প্রাহি কিছুই বুঝতে পারছে না কি হয়েছে এখানে?ওর মনটা বড্ড খচখচ করছে।সবার কান্না দেখে ওরও চোখে পানি এসে পরেছে।প্রাহি কাঁদো কন্ঠে বলে,

‘ তোমরা সবাই কান্না থামাও।নাহলে আমিও কেঁদে দিবো।’
হেমন্ত প্রাহির কাছে আসলো।বড় ভাইয়ের মতো আদুরেভাবে প্রাহিকে নিজের বাহুডোরে নিলো।প্রাহি হেমন্ত’র দিকে চোখ তুলে তাকালো।হেমন্ত ভেজা কন্ঠে বলে,
‘ আমি এখন যা বলবো।তা মেনে নিবি।কোনভাবে উত্তেজিত হবি না,ঠিক আছে?আমরা সবাই আছি তো তোর জন্যে?’
‘ কিন্তু কি হয়েছে?’
‘ আন্টি আর নেই প্রাহি।আন্টি আর নেই।তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রাহি।আর আন্টি ফিরে আসবেন না এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।’

বলেই হেমন্ত কেঁদে দিলো।প্রাহি অবিশ্বাস্য চাহনী নিয়ে তাকালো হেমন্ত’র দিকে।এ কোন বিষাক্ত বানি শোনালো হেমন্ত ওকে?কি বলে ফেললো হেমন্ত?প্রাহি দুহাতে নিজের গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে হেমন্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।ধাক্কাটা এতো জোড়ে ছিলো যে প্রাহি নিজেকেই ভালোভাবে সামলাতে পারলো না।হেমন্ত এগিয়ে গিয়ে ধরতে নিলেই প্রাহি চিৎকার করে উঠে,
‘ না একদম নাহ।আমার কাছে আসবি না।তু..তুই আর আমার সামনেও আসবি না।তুই মা..মাত্র কি বললি এসব হ্যা?এমন কথা তু…তুই কিভাবে বলতে পারলি?তোর একটু বুক কা…কাপলো নাহ?এই নিষ্ঠুর বাক্যটুকু বলতে তোর একবারও বুক কা…কাপলো না রে?’

প্রাহি চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে।প্রাহি দুহাতে বারবার চোখের জল মুছছে।তারপর পাগলের মতো করে বলে,
‘ কই আমার আম্মু?আমি আম্মুর কাছে যাবো! তোদের এখনি প্রমান দেবো আমার আম্মু বেঁচে আছে।সে এখনো ঘুমাচ্ছে।তোরা সবাই মিথ্যাবাদি।সব মিথ্যাবাদি।এই মিথ্যা অভিনয়ের কান্না থামা তোরা।আমার এসব সহ্য হচ্ছে না।থামা বলছি।’
হেমন্ত বলে উঠে,
‘ প্লিজ প্রাহি আমার কথাটা শোন।’
‘ নাহ শুনবো না।আমি কারো কথা শুনবো না।আমি আম্মুর কাছে যাবো।’
কথাগুলো বলে প্রাহি একদৌড়ে ওর মায়ের কেভিনের দরজা খুলে ভীতরে প্রবেশ করলো।দেখলো বেডের উপর সাদা চাঁদর দিয়ে কাউকে ঢেকে রাখা হয়েছে।প্রাহি দ্রুত গেলো সেখানে।গিয়েই সাদা চাঁদরটি সরিয়ে দিলো।বিরবির করে বলছে,

‘ এই সাদা কাপড় দিয়ে আম্মুকে ঢেকে রেখেছে কেন ওরা?আমার আম্মুর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় ওরা বুঝে না?আর আমার আম্মুর অক্সিজেন মাক্স কই?’
প্রাহি ওর মাকে ছেড়ে রুমের চারদিকে চোখ বুলালো।কিন্তু কোথাও অক্সিজেন মাক্স পেলো না।তাই চিৎকার করে বলতে লাগলো,
‘ এই ডাক্তার?ডাক্তার?আমার আম্মুর অক্সিজেন মাক্স কই?তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাক্স দেন আম্মুকে।আমার আম্মুর কষ্ট হচ্ছে।’

ইশি,হেমন্ত,আরাফ আর হিয়া দৌড়ে আসলো।কিন্তু কেউ প্রাহিকে সামলাতে পারছে না।ইশি অর্থকে মেসেজ দিয়ে দিয়েছে যে প্রাহিকে সামলানো যাচ্ছে।অর্থ মেসেজ পেয়েই ছুটে এসেছে।ও গিয়েছিলো ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে।সকল ফর্মালিটিস পূরন করার জন্যে।ইশির মেসেজ পেয়ে একমুহূর্তও অপেক্ষা করে না দৌড়ে এসেছে ও।দরজার কাছে আসতেই ডাক দিলো,

‘ প্রাহি?’
প্রাহি অর্থ’র কন্ঠস্বর শুনে দৌড়ে অর্থ’র কাছে গেলো।ঝাপিয়ে পরলো অর্থ’র বুকে।অর্থ ভীষন যত্নে প্রাহিকে বুকে আগলে নিলো।প্রাহি অস্থির হয়ে গিয়েছে।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বললো,
‘ দেখুন না অর্থ।ওরা কি বলছে?আমার আম্মু নাকি আর নেই।কিন্তু দেখেন ওই তো আম্মু ঠিক আগের মতোই ঘুমিয়ে আছে।ওদের বলুন না, আমাকে এসব বলে যেন ভয় না দেখায়।আমার কিন্তু ভালোলাগছে না।’
অর্থ’র চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।চেয়েও কাঁদতে পারছে না অর্থ।ওর কাঁদলে চলবে নাহ।এই মেয়েটাকে এখন সামলাতে হবে।ওকে সবটা মেনে নেওয়ার জন্যে বোঝাতে হবে।অর্থ শীতল কন্ঠে বলে,

‘ ওরা যা বলছে ঠিক বলছে প্রাহি।মা আর বেঁচে নেই।তিনি আর ফিরবেন না আমাদের কাছে।’
প্রাহির শরীর ঝাকি দিয়ে কেঁপে উঠলো।অর্থকে জড়িয়ে ধরে রাখা হাতদুটো হালকা হয়ে আসলো।প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে অর্থকে ছেড়ে দিলো।ওর কানে বারবার অর্থ’র বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আর সবার কথা যেমন তেমন। কিন্তু প্রাহি জানে ওর অর্থ কখনও ওর সাথে মিথ্যে কথা বলতে পারে নাহ।প্রাহি একপা দুপা করে ওর মায়ের কাছে এগিয়ে যায়।কিছু না বলে ওর মায়ের পাশে গিয়ে সুয়ে ওর মায়ের বুকে মাথা রাখে।আহা,কি শান্তি মায়ের বুকটায়।প্রাহির সকল অস্থিরতা একনিমিষে চলে গেলো।প্রাহি আবারও মাথা তুলে ওর মায়ের দিকে তাকালো।কি নিস্পাপ মুখশ্রী ওর মায়ের।কি সুন্দর নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।প্রাহি ওর মায়ের সারামুখে হাত বুলালো আদুরেভাবে।তারপর ওর মায়ের কপালে চুমু খেয়ে আবারও ওর মায়ের বুকে মাথা রাখলো।চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে প্রাহির।প্রাহি বিরবির করে বলছে,

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৬

‘ তুমি ঘুমাও আম্মু।আমি একটু ডিস্টার্ব করবো না তোমায়।শুধু তোমার সাথে আমিও তোমার বুকে ঘুমিয়ে থাকবো।তুমি ঘুমাও আম্মু।ঘুমাও।’
প্রাহি বিরবির করছে।ওর চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।সবকিছু যেন অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে।একসময় প্রাহি নিজেই সেই অন্ধকারের মাঝে তলিয়ে গেলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৮