তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ২৪

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ২৪
রাজিয়া রহমান

গত এক সপ্তাহ ধরে মেঘ নিয়মিত নবনীদের বাসায় আসা যাওয়া করে।ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।প্রথম দিন সকালে বাসার কলিং বেল বাজতেই নবনী গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মেঘকে দেখতেই নবনীর হার্টবিট এতোটা বেড়ে গেলো যে নবনীর মনে হলো বুকের পিঞ্জিরা থেকে হার্ট বুঝি এখনই টুপ করে বের হয়ে যাবে।
গায়ে একটা নরমাল টি-শার্ট,একটা গ্রে কালার প্যান্ট পরা মেঘকে দেখে কিছুতেই বুঝার উপায় নেই এই ছেলে কোনো অফিসের বস।

নবনী ভাবলো চোখে ভুল দেখছে সে।তাই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে যেতেই মেঘ এক পা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। নবনী দরজা বন্ধ করতে যেতেই মেঘ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। নবনী ভীষণ চমকে গেলো।
মেঘ মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বললো, “আমি ফাল্গুনী আর চৈতালীর টিউটর।”
নবনী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। হাশেম আলী রুম থেকে বের হয়ে মেঘকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এই স্যারে আইজ থাইকা ফাল্গুনী আর চৈতালীরে পড়াইবো রে মা।”
নবনী চোখ মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো, “কে ঠিক করেছে বাবা?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হাশেম আলী হেসে বললো, “আর কইস না মা,তোরে তো কাইল কইতে পারি নাই।কাইল আমি ওগো ইস্কুলে গেছি না,তখন ওগো স্কুলের স্যারেরা ওনারে ঠিক কইরা দিছে।”
নবনী জিজ্ঞেস করলো, “কেনো ঠিক করে দিছে ওনাকে?”

হাশেম আলী বললো,”ও এক সময় ওই ইস্কুলে পড়ছে।পোলাডার অবস্থা আমাগো মতোই আছিলো।ফ্রি-তে ইস্কুলের স্যারেরা পড়াইছে।এখন নিজে চাকরি করে। বাপ মা নাই।নিজেই ইস্কুলে আইসা স্যারগো কইছে সে ও কাউরে সাহায্য করবার চায়।স্যারেরা আমাগো ফাল্গুনী চৈতালীর লাইগা ঠিক করছে ওরে।গতকাল আমারে যাইতে কইছে ইস্কুলে। আমি গেছি আর স্যারেরা কইলো এই স্যারে আমার দুই মাইয়ারে ফ্রি পড়াইবো।দেখলাম এরকম আরো কয়েক জন আছে স্কুলে,পোলা মাইয়াগো ফ্রিতে পড়ানোর লাইগা।মানুষের মন কতো বিশাল তা কাইল ইস্কুলে না গেলে বুঝতাম না রে মা।কতো পোলারে দেখলাম কাইল ফ্রিতে পড়ানোর লাইগা আইসা বইসা রইছে। ভালো মানুষ এখনো আছে এই দুনিয়ায়। ”
নবনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘের দিকে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো,কেউ বুঝলো না।

নবনী নিজের রুমে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা তার এলোমেলো লাগছে।নীড়ের জন্মদিনের পর থেকে নবনী মেঘের দিকে ভুল করে ও তাকায় না।সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছে। লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে বসে থাকে।মেঘের দিকে তাকালেই নবনীর ভীষণ কষ্ট হয়,বুকের ভেতর কেঁপে উঠে,দ্বিধায় পড়ে যায়।আজকাল নবনী নিজের মনকে বুঝতে পারে না। নীড়ের জন্মদিন ছিলো ৪ মাস আগে,এই ৪ মাস ধরে নবনী নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন আর তামিমকে দেখলে মোটেও জ্বালাপোড়া অনুভব হয় না।বরং নিতুর সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। এখন জীবনে একটাই সমস্যা, মেঘ।

মেঘের কাছ থেকে নবনী তাই লুকিয়ে বেড়াতে চায়।বারবার মনে হয়, সরাসরি তাকালেই বুঝি মেঘ বুঝে যাবে নবনীর বুকের ভেতর জমে থাকা একটা কষ্টের পাহাড় মেঘের কাছাকাছি থাকলে গলে যেতে চায়।বুকের ভেতর বসন্তের বাতাস বইতে চায়।প্রাণপণ চেষ্টা করে নবনী সেই বাতাস কে থামিয়ে দেয়।ধরা দিতে চায় না কিছুতেই নবনী।
হাশেম আলী নবনীর রুমের সামনে এসে দরজা নক করলেন।নবনী উঠে বসে বাবাকে ভেতরে আসতে বললো।
হাশেম আলী মেয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “ছেলেটার জন্য একটু নাশতার ব্যবস্থা করতি যদি।”
নবনী বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি দরকার ছিলো বাবা টিউটর রাখার?আমি অথবা সাব্বির কি ওদের পড়াতে পারতাম না?না-কি আমরা পড়াই না?”

হাশেম আলী বললেন,”কি বলস মা,ইস্কুলের এতো বড় বড় মানুষের সামনে আমি কি কমু যে না আমি রাজি না।সব বাপ মায়েরা দেখলাম হাসিমুখে রাজি হই গেছে। আমি সেখানে কেমনে না করি?আমি মুর্খ মানুষ কি এতো বড় মানুষের লগে কথা কইতে পারি?”

নবনী আর কথা না বাড়িয়ে কিচেন রুমে চলে গেলো। হাশেম আলী বুঝতে পারলেন মেয়ে কোনো কারণে রেগে আছে। মেয়ের পিছনে পিছনে গিয়ে হাশেম আলী বললেন,”রাগ করছস মা?রাগ করিস না।শুন মা,আমার আসলে খুব খারাপ লাগছে যখন শুনছি পোলাডার বাপ মা নাই,বাপ মা মরা পোলাডার লাইগা আমার এতো মায়া লাগছে।মেসে থাকে,আত্মীয় স্বজন নাই।যাওনের জায়গা নাই।শুইনা আমার কলিজা কাঁইপা উঠছে।
এতিম পোলাডার মুখের দিকে তাকাইয়া আমার যে কেমন লাগছে। আমি ও তো এতিম ছিলাম রে মা।মা মরছে আমারে ছোট রাইখা।”

নবনী বাবার সাথে তর্ক করলো না। বাবার মন খারাপ হয়ে যাবে নবনী কথা বাড়ালে।
নবনী মেঘের জন্য এক মগ কফি আর এক প্লেট পাস্তা নিয়ে ফাল্গুনীদের রুমে গেলো।
হাশেম আলী সেখানেই বিছানার এক পাশে বসে ছিলো। মেঘ নবনীর হাতের রান্না বুঝতে পেরে গোগ্রাসে খেয়ে নিলো। হাশেম আলী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেঘের দিকে। নবনীর পিছুপিছু এসে বললেন,”দেখলি মা,পোলাডা মনে হয় গতরাতে ও কিছু খায় নাই।ভীষণ ক্ষিধা ছিলো পেটে মনে হয়। শুন মা,এখন থাইকা প্রত্যেক দিন পোলাডারে নাশতা দিস,মাঝেমাঝে ভালো কিছু রান্না হইলে তোর মায়েরে কমু পোলাডারে ভাত খাওয়াইতে।”

নবনী বিরক্ত হয়ে বললো,”তোমার যেমনে ভালো লাগে করো বাবা।”
হাশেম আলী মেয়ের রাগ বুঝতে পেরে বললেন,”রাগ কইরা আছস এখনো? আমাগো নবীজি ও তো এতিম ছিলো। নবীজি কইছে এতিমরে মায়া করতে।”
নবনীর ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলে দিতে সব কিছু,কিন্তু বলতে পারলো না বাবার ইমোশন দেখে।
নবনী নিজের রুমে গিয়ে বসে রইলো। রাবেয়া বেগম রান্নার জন্য তরকারি কাটছেন।হাশেম আলী রাবেয়ার পাশে বসে বললো,”মেয়েটা এরকম রাগ কইরা আছে ক্যান কও তো?”

রাবেয়া বেগম কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছেন মেয়ের মন খারাপ। কিছু নিয়ে মেয়ে চিন্তায় আছে তিনি বুঝতে পারছেন, আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না নিজে।মেয়ে বড় হয়েছে এখন,ভালো মন্দ বুঝে।নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে মেয়েকে বিব্রত করতে তার লজ্জা লাগছে।আবার মেয়ে কোনো সমস্যায় আছে কি-না তাও বুঝতে পারছেন না।
হাশেম আলী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, “কি হইলো তোমার? ”
রাবেয়া বেগম বললেন,”মেয়েটার মনে হয় মন খারাপ কোনো কারণে। আপনে আর ওর লগে কথা বাড়াইয়েন না।মেয়েটার মন ভালো হইলে দেখবেন সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
হাশেম আলী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,”কি কও তুমি, আগে কও নাই ক্যান?আমি এখন কি করমু?
মেয়ের মনে কষ্ট দিলাম বুঝি আমি?”

রাবেয়া বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,”আরে না,আপনি কষ্ট দিলেন কখন। ওর মন আগে থেকেই খারাপ। আপনি ওরে কিছু জিজ্ঞেস কইরেন না।নিজের মন ভালো হইলে নিজেই কইবো কোনো অসুবিধা হইলে।”
এক সপ্তাহ পরে শুক্রবার। মেঘ আজ জুমার নামাজ পড়ে পড়াতে এসেছে।বাসায় আসতেই রাবেয়া বেগম বললেন, ” বাবা আজকে আমাগো লগে কয়েকটা ডাইল ভাত যদি খাইতেন খুশি হইতাম।”
মেঘ বিগলিত হয়ে বললো,”কি বলেন চাচী,আমার জন্য এতো কষ্ট করবেন না।আমি মেসেই খেয়ে নিবো।”
রাবেয়া বেগম বিনীত হয়ে বললেন, “আপনার চাচা আপনার লাইগা নিজ হাতে বাজার কইরা আনছে।আমারে কইছে আইজ বাবাজিরে লইয়া একসাথে খানা খামু,তুমি সব রান্দো ভালো কইরা।”

মেঘ হেসে বললো, “চাচা যেহেতু বলেছে তাহলে তো নিশ্চয় খাবো চাচী।তাছাড়া আজকে মেসে দেখলাম ব্রয়লার মুরগী রান্না হয়েছে।মেসের খাবারের কথা আর কি বলবো চাচী,এক বাটি ঝোলের মধ্যে দুই পিস আলু আর এক পিস মাংস হাবুডুবু খায়।বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয় শুধু। বাবা মা না থাকলে কপালে এরকম কষ্টই হয়।”
রাবেয়া বেগমের চোখে পানি চলে এলো মেঘের কথা শুনে। আঁচলে চোখ মুছে নবনীর রুমে এসে বললেন,”আহারে ছেলেটার কতো কষ্ট রে মা।দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষের এতো কষ্ট দিলো ক্যান!
বাপ ও নাই মা ও নাই,কে রাখে তার খাওনের খবর!
কি খায় না খায়,কে জানে!”

নবনীর ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলতে,”তুমি জানো না মা ওনাদের খাবার জন্য কতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে,ওনাদের খাবার আসে ৫ তারা হোটেল থেকে।আমাদের এসব খাবার ওনাদের সইবে না।”
বললো না কিছু,সিদ্ধান্ত নিলো আজকে একটা বিহিত করবে সে।আজকে সরাসরি মেঘকে জিজ্ঞেস করবে এসব নাটক কেনো করছে সে!নিজের সাথে নিজে এভাবে আর যুদ্ধ করতে পারছে না।যেকোন একটা সিদ্ধান্ত এবার নেওয়া উচিত।
রাবেয়া বেগম রান্না করতে গেলে নবনী বললো, “মা তরকারিতে ঝাল কম দিও।”
রাবেয়া বেগম অবাক হলেন মেয়ের কথা শুনে।তাদের বাসায় সবাই ঝাল খেয়ে অভ্যস্ত। বরং ঝাল কম দিলেই কেউ খেতে চায় না।

মেয়েকে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই নবনী বললো,”আজ ঝাল কম দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে মা।পেটে গন্ডগোল।”
খেতে বসে মেঘ চমৎকৃত হলো।ছোট মাছের চচ্চড়ি,ধনেপাতা দিয়ে পাতলা ডাল,চমৎকার একটা ঘ্রাণ আসছে ডাল থেকে।চিকন চিকন করে তেলের উপর করা আলুভাজা,ইলিশ মাছ ভাজা,বেগুন ভাজা।
ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে মেঘ খাবার খেলো।যদিও প্রথমে ভয় পেয়েছিলো খাবারে ঝাল নিয়ে।মেঘ ঝাল খেতে পারে না।
কিন্তু খেতে বসে দেখলো সব খাবারে তার মন মতো ঝাল হয়েছে। নবনী ছাড়া বাকি সবাই একইসাথে বসে খাবার খেলো।নবনী পেটে সমস্যা বলে খেতে এলো না।

খেয়ে মেঘ বিদায় হবার আগে নবনী বের হলো ঔষধ আনতে যাবে বলে। মেঘ বাহিরে এসে দাঁড়াতেই নবনী এগিয়ে গেলো মেঘের দিকে। মেঘের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার এসব নাটকের মানে কি?”
মেঘ নিজের দিকে তাকিয়ে বললো,”নাটক কোথায় দেখলে?আমি তো নাটক করি না।”
নবনী বিরক্ত হলো প্রচন্ড। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, “আপনি এরকম বেহায়াপনা কেনো করছেন?নিজের স্ট্যাটাস,নিজের অফিস সব ফেলে রেখে এরকম এতিম সেজে আমার বাসায় আসার মানে কী?”
মেঘ বললো,”আমার একটাই অপরাধ নবনী, আমি তোমাকে ভালোবাসি,ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতোটা ভালোবাসলে আমার মতো একটা ছেলে নিজের সব ছেড়ে তোমাকে একটু সময় বেশি দেখার আশায় তোমার বাসা পর্যন্ত চলে আসতে পারে।”

নবনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ মুচকি হেসে আবার বললো,”আমি মাঝেমাঝে আফসোস করি,কেনো আমি বখাটে হতে পারলাম না।তাহলে অন্তত সাহস করে তোমার হাতটা আমার বুকে চেপে ধরে বলতাম,দেখো তোমার নামে বারবার আন্দোলিত হয় আমার এই হৃৎপিন্ড।আমার ব্যাড লাক নবনীতা, আমি এসব পারি না।আমি তাই তোমাকে দেখার জন্য মিথ্যা বাহানা দিতে পারি।

তুমি আমার ভয়ে সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছ,তুমি লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকো,অফিস টাইমে রোবটের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে থাকো।সিসি ক্যামেরায় আমি দেখি,আমার নবনীতা আমার থেকে ১০-১২ ফিট দূরে বসে আছে মাথা নুইয়ে,শুধু আমি যাতে তাকে না দেখি এর জন্য।ক্যামেরায় দেখে আমার মন ভরে না নবনীতা,আমার আজন্ম পিপাসা তোমাকে দেখার।তাই তো শুধু কিছু সময় বেশি দেখার জন্য এতো প্ল্যানিং আমার। আমাকে তুমি মিথ্যাবাদী বলতে পারো,অপরাধী বলতে পারো,আমি হাসিমুখে মেনে নিবো।ইস্পাত কঠিন মানবীকে ভালোবাসার মতো অপরাধ যখন করে ফেলেছি তার শাস্তি পাবো না তা কি হয় না-কি। ”

নবনী অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল গোপন করে বললো,”আমার সাথে আসুন,আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
মেঘ মিষ্টি হেসে বললো, “তা আগে বললেই পারতে যে আমার সাথে আলাদা করে কথা বলবে।এভাবে রাগ করে বলার কি আছে নবনীতা। আগে জানলে তো আমি একটু সেজেগুজে আসতাম।”
নবনী চোখ গোল করে তাকাতেই মেঘ হেসে বললো, “আসো আমার সাথে। ”

একটা রিকশা ডেকে নিয়ে মেঘ নবনীকে রিকশায় উঠতে বললো। তারপর নবনী বসার পর নিজে উঠে বসলো। নবনী অস্বস্তিতে নুইয়ে গেলো। মেঘের ভীষণ ভালো লাগছে। এই প্রথম দুজন এতো কাছাকাছি বসেছে।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামলো। নবনী বললো, “আমি রেস্টুরেন্টে বসবো না।আমি একটা খোলামেলা জায়গায় বসতে চাই।”

মেঘ যথা আজ্ঞা বলে রিকশায় উঠে বনানী লেকে যেতে বললো।
১০ মিনিট পর লেকের পাশে এসে রিকশা থেকে নামলো দুজনে।মেঘ কিছুটা সামনে এসে বললো, “সাঁতার জানো?”
নবনী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।মেঘ বললো,”নৌকায় উঠবে?”
নবনী মাথা নাড়িয়ে না বললো।কিছুটা হেটে দুজন বসলো রাস্তার পাশে।তারপর মেঘ নরম স্বরে বললো, “কি বলবে? ”
নবনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “একটা গল্প বলবো। নবনীর গল্প।”

মেঘ মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা আজকে না হয় আমি গল্প বলি,তুমি শোনো,ভুল হলে আমাকে সংশোধন করে দিও।”
নবনী উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। মেঘ কি গল্প বলবে কে জানে!
মেঘ গম্ভীরমুখে বললো, “এক গ্রামে ছিলো এক দম্পতি। তাদের চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোট সুখের সংসার।তাদের সংসার শুধু সংসার নয়,সুখের রাজ্য যেনো।বড় রাজকন্যার নাম নবনী জাহান।ছোট ফুটফুটে সেই রাজকন্যা বাবা মায়ের সংসারে বাকি তিন ভাই বোন নিয়ে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছিলো।অনার্সে ওঠার পর তার বিয়ে হয়ে যায় এক অচেনা রাজ্যের রাজকুমারের সাথে।হুট করেই বিয়ে হয়ে যায়। কেননা নবনীকে তার শ্বশুর কলেজ থেকে ফিরার সময় পথে দেখে এতো বেশি পছন্দ করে ফেলেন যে তিনি আর দেরি করতে রাজি হন নি।আসলে ভদ্রলোকের জহরির চোখ,খাঁটি হিরে চিনতে তিনি ভুল করেন নি।ফুলবাগানে ফুটে থাকা উৎকৃষ্ট গোলাপটিকে তাই অতি যত্নে,ভালোবাসায় নিজের রাজ্যের শোভাবর্ধন করতে রাজকন্যার বাবার কাছে এক প্রকার ভিক্ষা করে নিয়ে যায়।

কিন্তু ভদ্রলোক জানতেন না তার বাসায় তিনি আর তার ছোট পুত্র ছাড়া বাকি সবাই যে রাক্ষসরূপী মানুষ। রাজকন্যা নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ও শ্বশুর ছাড়া আর কারো আপন হতে পারে নি।
এদিকে রাজকন্যার স্বামী,সে নিজের বাগানের গোলাপের দিকে না তাকিয়ে অন্য বাগানের গোলাপ থেকে মধু আহরণ করতে উঠে পড়ে লেগে গেলো। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো যে তার স্বভাব তা সে ছাড়া আর কেউ জানতো না।এজন্যই নিজে বাগানের ফুলটি তার কাছে বিবর্ণ লাগতে লাগলো।

তারপর একটা সময় আসে যখন রাজকন্যা জেনে যায় সে আসলে নিজের সব দিয়েও রাজকুমারকে আপন করতে পারে নি। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাজকন্যা তখনই সিদ্ধান্ত নিলো সব অবহেলা সহ্য করে নিলেও এই অবহেলা সে সইবে না।তারপর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
রাজকন্যা তারপর থেকে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য এক অদম্য মনোবল নিয়ে শহরে আসে পুরো পরিবার নিয়ে।সেই শহরে আসে যেখানে সে তার একটা সুখের স্বপ্ন দাফন করে শূন্য হাতে ফিরে গিয়েছিলো,যেখানে সে শূন্য হয়েছে সেখানেই সে আবার পূর্ণ হতে আসে।

রাজকন্যা পূর্ণতা পেতে লাগলো,আত্মবিশ্বাসী রাজকন্যার ভালোবাসায় পড়ে শূন্য হতে লাগলো সেই শহরের এক কাঙাল প্রেমিক। ভালোবাসা ছাড়া যার চাওয়ার কিছু নেই।কাঙালের মতো নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করে রাজকন্যার পদে পদে ঘুরতে লাগলো। কে জানে,হয়তো একদিন রাজকন্যার মনে দয়া হবে।পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, এরকম করে এটা ঘটে যায় যদি এই আশায় বাঁচে সে কাঙাল। ”

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ২৩

নবনী হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কে বলেছে এসব?কিভাবে জানলেন?আমি তো এসব শিমলা আপাকে ও বলি নি কখনো। ”
মেঘ মুচকি হাসলো।

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ২৫