মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৪

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৪
ইফা আমহৃদ

লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছি। দু’দিন আগে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘ফুড কমপ্লেক্সে’ যোগদান করেছি। গতকালে অভিজ্ঞতা। দু’সিপ্টে স্টার্ফদের পরিচালনা করা হয়। আমার এগারোটা থেকে বিকেল তিনটা। সেলারি ধরা হয়নি, কাজ অনুযায়ী ধরা হবে। কিছুদিন দাঁড়িয়ে বুঝাবেন।

প্রিয়া ও আঁখি আমাকে ঘিরে রেখেছে। বারবার কাজ ছেড়ে দেওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল আমি। ধ্রুব নেই ভার্সিটিতে। পরীক্ষার পর তাকে আর দেখা যায়নি। খবরও নেই। আমিও আগবাড়িয়ে খবর নিতে যাইনি। তবে রাহাত স্যারের সাথে কথা হয়েছে‌। প্রিয়া উচ্চ কণ্ঠে বলে, “তোর এত জেদ কেন? মামা তোকে টাকা দিচ্ছে, তবুও কেন কাজ করবি?”
আমি প্রত্যুত্তর না করেই নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। উভয়েই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল। আঁখি টেবিলে আঘাত করে বলল, “আমাদেরকে তোর মানুষ মনে হয়না? মাছি মনে হয়, ভনভন করছি কনের কাছে। কতক্ষণ ধরে কথা বলছি, উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কী মনে করিস নিজেকে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ক্ষান্ত কণ্ঠে বললাম, “আমি কিছু বলিনি। তোরাই বলছিস। আমিও যেমন মানুষ, তোরাও তেমন মানুষ।”
হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। এখান থেকে ফুড কমপ্লেক্সে যেতে বিশ মিনিট লাগবে। আমি উঠে গেলাম। বাই বলে ওদের অগ্রাহ্য করলাম। অগ্ৰসর হলাম বাইরের দিকে। দরজা দিয়ে অতিক্রম করে বের হওয়ার পূর্বেই শক্তপোক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলাম। নিজেকে সামলানোর পূর্বেই ভারসাম্যহীন হয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়লাম। হাতের কণুইতে আঘাত পেলাম একটু। বিরক্তিকর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে মাহি আর চারটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করলাম। পথ আঁটকে দাঁড়াল। নিম্ন স্বরে বললাম, “কী সমস্যা? পথ ছাড়ো।”

মাহি ব্যঙ্গ করে বলল, “ধ্রুব স্যার তো নেই ভার্সিটিতে, ছুটিতে আছেন দু’দিনের। যেতে দে।”
বিদ্রুপ করে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো। ধ্রুব স্যার নেই তাই তুমিও থাকতে চাইছ না। বলছি তলে তলে চলছে না-কি?”
তিক্ত কথাগুলো দেহে দহনে পরিনত করল। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ফুটে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “মুখ সামলে কথা বল।”
“তুমি নিজের চরিত্র আগে সামলাও। মুখ পরেও সামলানো যাবে, কিন্তু চরিত্র। ওটা তো আগেই নষ্ট করে ফেলেছ, এবার বাকিটুকু সামলাও। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার?”

চোখজোড়া টলটল করল। বাঁধ ভাঙল। অস্থিরতায় দমিয়ে গেল হৃৎপিণ্ড। বিষাদময় শ্বাস নিলাম। প্রিয়া এগিয়ে এসে কড়া উত্তর দিল, “তোমরাও তো মেয়ে, একটা মেয়েকে এই ভাষায় কথা বলতে লজ্জা করছে না?”
মাহি তিক্ত গলায় বলল,”না, করছে না। কারণ আমরা এর মত যেখানে সেখানে নিজেকে বিলিয়ে দেই না।”
নিজেকে এবার সামলাতে ব্যর্থ হলাম। সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলাম মাহির গালে। ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলি, “অনেক বলেছিস, কিছুদিন আগে ধ্রুব তোকে চড় মে’রেছিল ভুলে গেছিস। তখন দিব্যি বলেছিলিস, এমন ভুল আর করবি না। তুই নিজের কথা চিন্তা কর..

তাচ্ছিল্যের হাসল মাহি। আমার চতুর্দিকে ঘুরে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে, “ধ্রুব স্যার থেকে শুধু ধ্রুব। বাহ্! ভালো সার্ভিস দিয়েছিস বুঝতে পারছি। ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরীতে চশমা পড়া ভদ্র শয়’তান সেজে থাকিস‌ আর স্যারকে দেখামাত্রই শুরু হয়ে যায়।”
আরেকজন ওকে থামিয়ে বলতে শুরু করে করে, “শুরু হয়ে যায়-কি? প্রথমদিন থেকেই শুরু করে দিছে। দেখিস-না রাত বিরেতে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচাচ্ছে। বাড়িতে থাকছে। লাইব্রেরীতে সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু ধ্রুব স্যার তো এমন না।”
মাহি গম্ভীর গলায় বলে, “লোভ দেখিয়েছে। জোর করে রাজি করিয়েছে। পুরুষরা নারীদের প্রতি একটু দুর্বল থাকে, সেটা কাজে লাগিয়েছে। পরীক্ষা এবং ভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট হওয়ার জন্য। পেটে পেটে কুবুদ্ধি।”

মাথা নত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে স্মিত হেসে বললাম, “ধ্রুব স্যার আসার আগেও আমি যেমন টপ ছিলাম, এখনও আছি।
আর পুরুষেরা নারীদের উপর দুর্বলতা। ওটা বরং তুমি কাজে লাগিয়ে দেখতে পারো। আমার প্রয়োজন নেই।”
বলেই পা বাড়ালাম। মাহি হাত ধরে ফেলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “তোর এত অহংকার আসে কোথা থেকে? নিজের কর্মকাণ্ডগুলো আমাকে বলিস কোন সাহসে।”
হাত ছাড়ালাম না, উল্টো মুচড়ে ধরলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, “সাহস চলে আসে। ফানি গার্ল, ফানি গার্ল।”

হাঁটুর উল্টোদিকে পা দিয়ে আঘাত করলাম। তৎক্ষণাৎ উল্টে পড়ল নিচে‌। হাত ঝাড়া দিয়ে ফিচেল হেসে দিলাম।
ফুড কমপ্লেক্সে এসে কাজে লেগে গেলাম। রঙিন চশমা চোখে। মাক্স দিয়ে মুখ ঢাকা। চোখ রক্তিম হয়ে এসেছে। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি আমি। বিনা কারণে এতগুলো কথা শুনিয়ে গেল আমায়। ধ্রুব কোথাও? তিনি থাকলে এর একটা বিহিত করত। আমার স্বামী আর তাকে নিয়েই আমাকে কটুক্তি করছে। ধ্যান ভাঙল মেইলি কণ্ঠে,
“আপু, আমার বাবুটাকে একটু ধরবেন। ঘুমিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে জিনিসপত্র নিতে সমস্যা হচ্ছে‌।”
“জি ম্যাম, সিউর।”

বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মহিলার পেছনে পেছনে গেলাম। তিনি চাহিদার মত দ্রব্য নিচ্ছেন। জিনিসপত্র কিনে রিসেপশনে যেতেই ফোন বেজে উঠল। পাশের ড্রয়ারে লক করে রেখেছিলাম। আমি দ্রুত ফোন বের করলাম। সবাই তখন বিরক্তিকর চোখে তিন চার বার তাকাচ্ছে। ফোনের রিংটোনে তাঁরা বিরক্ত বুঝাই যাচ্ছে। ধ্রুব ফোন করেছে। দু’দিন পর ফোন করেছে। কান্না পেল গভীরতর। আমি ফোন ভাইব্রেশন করে রাখলাম। রিসিভ করব না। এতক্ষণে তার কানে ঘটনাটা নিশ্চয়ই চলে গেছে। আমাকে শান্ত করতে ফোন করেছেন। আমি হাতের মুঠোয় ফোন রেখে হেল্প করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মিনিট খানেকের মত এক নাগাড়ে ফোন করে গেল। আমি বুঝলাম তিনিই করেছেন।‌ পরবর্তী মিনিট পাঁচেক কোনো ফোন এলো না। একটু অভিমানের মেঘ জড়ো হল। কললিস্ট চ্যাক করে দেখলাম ‘৯টা মিসড কল’, এতেই হাপিয়ে গেছেন? মাঝখানে লম্বা একটা বিরতি নিয়ে ফোন এলো।‌ আমি আগ্ৰহ নিয়ে স্ক্রিনে অবলোকন করলাম। অচেনা নাম্বার। আগ্ৰহহীন হয়ে রেখে দিলাম। পুনরায় ফোন বাজল। বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম,

“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?”
কার কাছে ফোন করেছে নিজেই জানেনা। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
“আপনি যার কাছে কল করেছেন সে। কেন বলুন তো?”
“একটু আগে আমার কাছে কল এসেছিল, এই ধরুন দুই মিনিট আগে।”
“গত বিশ মিনিট ধরে ফোনটা আমার হাতের মুঠোয় আছে আর আপনি বলছেন কল গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার তো!”
“আশ্চর্য ব্যাপার হোক বা অ-আশ্চর্য! ফোন আপনি দিয়েছিলেন, কেন দিয়েছিলেন?”

রাগ নিয়ন্ত্রণ করে টেনে টেনে বললাম, “আসলে একটু ফ্রি ছিলাম, সময় যাচ্ছিল না। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু সময় কাটাই।”
কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, “মজাটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?”
অচেনা নাম্বার থেকে দু’দিন পরপর ফোন করে আবোলতাবোল কথা বলে।
“আরে কীসব বলছেন? মজা করব কেন? আপনাকে আমার ভালোমত চেনা আছে। দু’দিন পরপর ফোন দিয়ে বলেন, তোমার গলাটা খুব মিষ্টি, নাম কী তোমার? দেখা করা যায়-কি?
আরেকবার ফোন করলে পুলিশে কমপ্লেন করব।”

“তাই না-কি? আসলে অনেকদিন থানায় যাওয়া হয়না যদি ব্যবস্থা করে দাও মন্দ হয়না। তবে অন্য ছেলেদের মত আমি তোমাকে নাম জিজ্ঞেস করব না, দেখা করতে বলব না। [দম নিয়ে]
পার্কে দেখা করবে?”
বিস্মিত কণ্ঠে, “কী?”
সত্বর কণ্ঠে বললেন, ”তাহলে হোটেলে”
“হোটেল? না বোঝার স্বরে।”
“হ্যাঁ” আপনাআপনি মৃদু ফাঁক হয়ে বেরিয়ে এলো।
“আচ্ছা, তাহলে হোটেল কনফার্ম। বাই..
তাজ্জব বনে গেলাম। আগ পিছ না ভেবে তড়িঘড়ি করে বললাম, “এই, না! না!”
এবার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হল। সরে গেল মোটা চাপা স্বর। সন্দিহান গলায় বললেন, “ছিঃ! চড়ুই। তুমি হোটেলে যেতে রাজি হয়ে গেলে। তারমানে খুবই শীঘ্রই আমি বাবা হবো।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৩

ধ্রুব গলা শুনতেই পলক স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি অন্য সিম থেকে আমায় কল করেছে। এজন্যই গলাটা পরিচিত ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল গলায় দম রেখে কথা বলছে। আমি ফোন রেখে দিলাম। চেয়ারে বসলাম। টেবিলে মাথা রাখলাম। দুপুর হয়ে এসেছে। স্টার্ফরা খেতে ব্যস্ত। আপাতত আমার খাওয়ার স্পৃহা নেই। ধ্রুব কি ঘটনাটা জেনে আমাকে ফোন করেছে, না-কি আমার খবর নিতে ফোন করেছে। তার কণ্ঠস্বর শুনে একবারের জন্যও মনে হয়নি, তিনি সবটা জানত।
শরীর হালকা হয়ে গাঢ় হল ঘুম। গরমের দিনে এসির হাওয়া কেড়ে নিল ক্লান্তি। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৫