পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২
মম সাহা

নিরব আলিঙ্গনে মিনিট দুই পেরুতেই মোহনা বাঁধন মুক্ত হয়। দর্শিনীর সামনে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বলে,
“নারী ভীতি আমার মানসিক রোগ ছাড়া কিছুই না। আমার এই একটা রোগের জন্য তোমার স্বাধের সংসার লুটোপুটি খেয়েছে ধূলোয়। তোমার সন্তান আজ বাবার আশ্রয়স্থল হারিয়েছে। সবটা দোষ আমি মাথা পেতে স্বীকার করছি। আমাকে তুমি চিরজীবন অভিশাপে রেখো, অন্তত আমি নিজের কাছে নিজে একটু কম লজ্জিত হবো।

কিইবা করতাম বলো তখন? ছেলেরা ভাবে, নারী জীবন বোধহয় ভীষণ সোজা। কিছু বছর বাবার ঘরে তারপর বাকি বছর স্বামীর ঘরে বসে কাটিয়ে দেওয়াটাই নারী জীবনের সারাংশ। কিন্তু যদি একটু তলিয়ে দেখতো মানুষ, তাহলে বুঝতে পারতো পৃথিবীতে নারী জীবনের চেয়ে কঠিন জীবন আর কিছু হয় না। পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ পাবে না যারা নিজের পুরুষ জীবনকে ঘৃণা করে অথচ এই পৃথিবীতে এমন কতশত নারী আছে যারা নারী হয়েছে বলে নিজেদেরকে ঘৃণা করে। কেনো করে বলো তো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভীষণ সুখে কী ঘৃণা আসে? ঘরে-বাহিরে সব জায়গায় নারীদের নিরাপদ থাকতে হয়। নিজের সম্মান টিকিয়ে রাখতে দিবানিশি ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকতে হয়। কই পুরুষরা তো যুগের পর যুগ নির্দ্বিধায় জীবন কাটাচ্ছে, তাদের তো সম্মান রক্ষার ভয় নেই। পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় বলে পুরুষরা নারীদের কত হেলা’ই না করে। পুরুষদের মতন আর কোনো জীব যেন পৃথিবীতে নেই। অথচ পরিবার, সমাজ,দায়িত্ব পালন করতে করতে শেষ হয় নারী জীবন। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় ভয়ে থাকতে হয় কোনো পুরুষ না আবার নারী স্বত্তা খানা ছুঁয়ে দেয়।

শুধু রাস্তাঘাট না, পরিবারের মানুষ এমনকি আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকেও ভয়ে থাকতে হয়। আত্মীয়র মাঝে কোনো পুরুষ তার লোভের হাতখানা শরীরে ছুঁয়ে দিলেও কিছু বলা যায় না, ভিতরে ভিতরে অপমান-ঘৃণায় গুমরে ম*রতে হয়। কেনো! কেবল মাত্র নারী বলেই। পৃথিবীতে নব্বই শতাংশ নারী এই ছোঁয়ার স্বীকার। পরিবারের মানুষ অব্দি ছাড় দেয় না নারীদেহ ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ। আমরা এই নারী জনম নিয়ে বেঁচে আছি। একেক জন যেন মানসিক রোগী হয়ে আছি। অথচ সমাজ কত অবলীলায় বলে দেয়, নারী জীবনে কি আর এমন কষ্ট! এই অপ্রাসঙ্গিক ঘটনায় আমিও আজ ভুক্তভোগী দর্শিনী। ক্ষমা করো। তোমার সংসার আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো না জানি, কেবল আমার সবটুকু প্রার্থনায় তোমার অঢেল সুখের কামনা করছি। ভালো থাকবে কেমন?”

দর্শিনী মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে। এই মহিলাটা শেষ মুহূর্তে এসে এতটা ভালো না হলেই তো পারতো। কেনো এতো ভালো হলো সে!
মৃত্যুঞ্জয় দর্শিনীর মাথায় হাত বুলালো। হাত বুলাতে বুলাতে মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আন্টি, আপনি জীবনে প্রচুর লড়াই করেছেন। কিন্তু আপনার লড়াইয়ের পথও যে অন্যায় পথ ছিলো।”

“তার জন্যই বুঝি পুলিশকে খবর দিলে? দেখেছি, দেখেছি, আমি সবই দেখেছি। বাড়ির ঠিকানাখানা পাঠিয়েছো এতক্ষণ তাই না? আমার অন্যায়ের শাস্তি দিবে বলে? বেশ করেছো। আমি অন্যায় করার জন্য কত কিছুই না করলাম! স্ট্রোক করার পর শরীরের সব অঙ্গ ঠিক থাকতেও খবর ছড়ালাম বা’হাত অবশ হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম এবারও ধামাচাপা দিতে পারবো পাপ। কিন্তু আমি যে ভুলে গেছিলাম, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এই যে দেখো, স্বামীকে নিজের হাতে খু*ন করার পরও কি সুন্দর সিঁদুর লেপেছি কপালে। এটাও ধর্ম অনুযায়ী পাপ কিন্তু আমার কাছে চির শান্তি। ঐ যে ওখানে যে মানুষটা শুয়ে আছে, এ সিঁদুর টা আমি তার নামে পড়ি নি। বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ আগে কূল-কিনারা হারা আমার মাথার উপর বটবৃক্ষ হয়ে যে এসেছিল, এই সিঁদুর টা আমি তার নামে পড়েছি। সেই স্মৃতি মিটবার নয়, সে মানুষও আমার কাছে কখনো মরবে না। আমি ভালোবাসতাম, বাসি আর চিরকালে বেসে যাবো ঐ মানুষটাকে। এই ধর্ষক নিলয় কুমার আমার কেহ না, কিচ্ছু না। কিন্তু ঐ বটবৃক্ষ নিলয় কুমার আমার পুরো পৃথিবী।”

এই পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় মানুষটার মাঝে ভালোবাসা কতটা প্রবাহমান! অথচ ভালোবাসার মানুষটা কত বিশ্রী! এই মানুষটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভালোবাসার মানুষ খারাপ মানেই ভালোবাসার উপর কলঙ্কের কালি লেপে দিলেই তুমি প্রেমিক না। প্রেমিক হতে হলে তোমার অন্তরে কেবল আর কেবল মাত্র প্রেম থাকতে হবে। তোমার ভালোবাসার মানুষ অযোগ্য হতেই পারে কিন্তু ভালোবাসা সর্বদা পূজনীয়। ভালোবাসাকে ঠুনকো অবহেলায় ছুড়ে ফেলার অধিকার তোমার নেই। ভালোবাসা পূর্ণিমার চাঁদের মতন উজ্জ্বল, ভুল প্রেমিক তার অদৃশ্য কিছু কলঙ্ক মাত্র।
মোহনা হুট করে ভয়ঙ্কর হাসি দিয়ে উঠলো। তার খিলখিল হাসিতে ভরে উঠলো পরিবেশ। কেঁপে উঠলো লোমকূপ। হাসতে হাসতেই মোহনা বললো,

“বিহু, সাবধানে থাকিস। এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর, একা বেঁচে থাকা ভীষণ কষ্টের তবুও টিকে থাকিস। তুই যেন আবার নতুন করে কোনো মোহনা না হোস সেই প্রার্থনা করি। মোহনারা জীবনে সব পেলেও ভালোবাসা পায় না। আর ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন রে বড্ড কঠিন।”
মোহনার কথার ধরণ, হাসির অঙ্গভঙ্গি কিছুটা সন্দেহ জাগালো উপস্থিত মানুষ জনের মনে। মায়া তার শ্বাশুড়ির পানে এগিয়ে আসতে নিলেই হুট করে তাদের পুরো ঘর আঁধার হয়ে উঠে। কোনো আলোর ছিটেফোঁটা নেই। আহম্মক বনে সবাই যার যার স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। বিদ্যুৎ চলে গেলো! আঁধারে আঁধারে জায়গাটা যেন মৃত্যুপুরী ধারণ করলো। মিনিট পাঁচের ব্যবধানে পুরো মহল্লা আলোকিত করে জ্বলে উঠলো কৃত্রিম আলো গুলো। বিদ্যুৎ আসতেই সবার নজর গেলো তাদের মেইন দরজা খানার দিকে যেটা হা করে খোলা। সবাই বিষ্মিত হলো, অবাক হলো মোহনা এখানে নেই! কোথাও নেই! মিনিট পাঁচের ব্যবধানে মহিলাটা উধাও! কোথায় গেলো সে?

মৃত্যুঞ্জয় আশপাশে খোঁজা শুরু করলো। তন্মধ্যেই পুলিশ তার স্ব শব্দে জিপ খানা নিয়ে হাজির হলো। উপস্থি সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বদলে গেলো সব!
থানার বড় অফিসার নিলয় কুমারের লা*শটা উঠিয়ে নেওয়ার হুকুম জাড়ি করলেন। কে মে*রেছে, কী হয়েছে জানতে চাইলে ঘটনা ঘুরিয়ে দেয় বিপ্রতীপ। সবটা দোষ অকপটে নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। এমনকি সে এটাও বলে ছু*ড়িতে তার হাতের ছাপ, দড়িতেও তার হাতের ছাপ। কারণ লা*শটা সে-ই খুলেছিলো ফ্যান থেকে। সবটা, সবটাই যেন সবার অবিশ্বাস্যকর ভ্রম মনে হলো।

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কিছু না করেও খু*নের আসামী হয় বিপ্রতীপ। সবাই সবটা কেবল চেয়ে দেখলো৷ কারো কিছু বলার নেই, বলতে চেয়েও যেন কেউ কিছু বলতে পারলো না। বিপ্রতীপ সবার সাথে আলাদা কথা বলবে একটু সাইডে নিয়ে গেলো সবাইকে। বিহঙ্গিনী মুখ খুললো এবার, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“তোরা সবাই স্বার্থপর, দাভাই। আমায় এই পুরো পৃথিবীতে একা করে দিয়ে পালাচ্ছিস?”
বিপ্রতীপ হাসলো। বিহঙ্গিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“তুই কোথায় একা? এই গোটা পৃথিবীটাকে তুই নিজের ধরে নে। এই প্রথম আমি কোনো সঠিক কাজ করছি। তাছাড়া হয়তো আমি বাবার খু*ন করি নি কিন্তু খু*ন তো আমি করেছি। একটা সম্পর্কের খু*ন করেছি। একটা মেয়ের বিশ্বাসের খু*ন করেছিলাম। সেটার শাস্তি তো আমার প্রাপ্য। সেটাই নাহয় হলো এবার। আমার মা পৃথিবীর বুকে একদম পবিত্র নারী হয়েই নাহয় বেঁচে রইলো। কেউ জানবে না একটা নারীর নির্মম জীবনের নিষ্ঠুরতা। যে মানুষটা সারাজীবন এতকিছু সহ্য করলো, সে নাহয় শেষ অব্দি সুন্দর থাকুক। যে মানুষটার বেঁচে থাকার বড্ড ইচ্ছে, নরক সহ্য করেও বেঁচে ছিলো, সে মানুষটাকে কীভাবে ম*রতে দেই বল?”

“তাই বলে তুই দোষ না করেও দোষী হবি, দা’ভাই!”
বিহঙ্গিনীর কণ্ঠে চরম অসহায়ত্ব স্পষ্ট। বিপ্রতীপ বাম চোখের কোণাটা কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্য মুছে নিলেন। ফর্সা মুখ খানা লাল হয়ে গেছে। হয়তো ভেতর ভেতর সে প্রচুর কাঁদছে। কিন্তু উপরে হাসি মুখ বজায় রেখেই বললো,
“হ্যাঁ দোষী হবো। মা যেহেতু বেঁচে থাকার জন্য গিয়েছে তাহলে তাকে বাঁচতে দে। মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো এমন কিছু হবে তাই তো সব প্ল্যান করেছে। আর তাছাড়াও, আমি না হতে পেরেছি ভালো প্রেমিক, না হয়েছি ভালো স্বামী, আর না হতে পারবো ভালো বাবা। অন্তত একটা ভালো সন্তানই হলাম। মায়ের গর্ভের কলঙ্ক নাহয়ে কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল নক্ষত্র হলাম। ভালো থাকিস বিহু।”

বিপ্রতীপের কণ্ঠস্বর কাঁপলো, অশ্রু গড়ালো। জীবনে সে অনেক বাজিমাত করেছে, আজ জীবন একটা বাজিমাত করে দিলো। কথায় আছে না? সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।
দর্শিনী কেবল ফ্যালফ্যাল করে বিপ্রতীপের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। অন্তরের গহীন হতে বেরিয়ে এলো খুব পাংশুটে দীর্ঘশ্বাস। জীবনটা এমন না হলে কী খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতো! জীবনের পথ চলতে গিয়ে কত কিছুই না দেখতে হয়, কত হিসেব গড়মিল হয়, তবুও তো জীবন সুন্দর।

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪১

খালি রাস্তায় সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়ের গাড়িটা। খুব মনযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। তার বা’পাশেই দর্শিনী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। মধ্যরাতেই তারা পাড়ি জমিয়েছে বাড়ির পথে। এই শহর দর্শিনীকে কেবল কষ্টই দিয়েছে, আর যে সহ্য করার শক্তি নেই তার।
বিহঙ্গিনীকে নিজের সাথে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টাই করেছে দর্শিনী কিন্তু মেয়েটা আসে নি। কেমন ভেঙে পড়েছে। একদম নেতিয়ে গেছে সে। মায়া অবশ্য বলেছে সাথ দিবে বিহুর কিন্তু তা কতদিনের জন্য!

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪৩