পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪১

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪১
মম সাহা

অগ্রহায়ণের নিঝুম রাত। হারিকেনের আলো কিঞ্চিৎ হেলেদুলে যাওয়ার মতন ফুরফুরে বাতাসে কেমন শূণ্যতার আভাস। গ্রামের মানুষ কেউ কেউ মোটা খদ্দরের চাদর দিয়ে শরীর ঢেকেছে একটু উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টায়। আর পাঁচটা দিন পরেই পৌষের আগমন। যে পুরো শীতের রাজত্ব নিয়ে হাজির হবে জাঁকজমক ভাবে। তারই ক্ষানিকটা আভাস দিচ্ছে এই গা হীম করা শীতল পরিবেশ।

গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটেছে কত কথা! কেউবা ছিঃ ছিঃ করে এক দলা থু থু নিক্ষেপ করেছে প্রতাপ সাহার পরিবারের উপর। কেউবা ঠাট্টা করেছে খুব বিশ্রী ভাবে। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত গনিতের মাস্টারমশাই আজ আর বুক ফুলিয়ে গ্রামের সরু পথটা দিয়ে হাঁটতে পারে নি। কিছু কৃত্রিম, মিছে দায়ভারে নত হয়েছে তার মাথা। অসহায়ের মতন নিজের বোনের মতন আগলে রাখা ছোট ভাইয়ের বউটাকে এই নিস্তব্ধ, কালো রাতে এক আকাশ অসম্মান নিয়ে গ্রাম থেকে বিতারিত হতে দেখেছে কেবল ফ্যালফ্যাল করে। কিছু বলতে পারে নি সে। রুখে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের মেয়ের চরিত্রেও কিঞ্চিৎ কালির ছিটা লাগিয়ে ফেলেছে সে। বাবা হয়ে মেয়ের অপমান সইতে পারা যে ভীষণ কষ্টের! তাই সে স্বার্থপর হলো। অনেক স্বার্থপর হলো। চুপ হয়ে কেবল দেখে গেলো সমাজে বিচার করা নামক গ্রাম পঞ্চায়েতে বসে একটা মেয়ের সম্মান উজাড় হওয়ার দৃশ্য। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করা সমাজের জ্ঞানী গুণী মানুষদের।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত দশটা কম কথা নয় গ্রামের মানুষদের জন্য। দূর হতে শেয়ালের হাঁক যেন বলে দিচ্ছে এটা ভয়ঙ্কর মধ্য রজনী। পঁচা ডোঁবা হতে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে ঘ্রাণ ভেসে আসছে। শশ্মান হতে আহাজারি ভেসে আসছে হৃদয় নিংড়ানো সুরে। খুব বিষণ্ণ সুরে কাঁদছে কেউ। পাশের গ্রামের সজল মারা গিয়েছে। বিরাট ডাক্তার ছিলো সে কিন্তু জীবনের শেষ সময়টাতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তারই পরিবারের কান্না হয়তো ভেসে আসছে। এত করুণ! এত হাহাকার! অথচ সবটাই লোক দেখানো। লোকটা তো এত দ্রুত মরতো না, ছেলেমেয়ের দু’হাত উজাড় করা অবহেলায় পড়ে মানুষটা চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ হয়েছে। অথচ এই জীবন নামক রঙ্গমঞ্চে আমাদের কত আপন মানুষ!

প্রতাপ সাহা হাতের হারিকেনটা নিয়ে গ্রামের সরু পথটা ধরে ফুলকণ্ঠ নদীর কিনার ঘেঁষে যাওয়া শ্মশানটার দিকে গেলো। দাউ দাউ করে এখনো আগুন জ্বলছে শ্মশানের মধ্যখানে চন্দন কাঠে শুয়ে থাকা দেহখানায়। কী ভীষণ যন্ত্রণা পুড়ে যাওয়ায় তাই না? অথচ আমরা মানুষেরা রোজই পু*ড়ি, অপ্রাপ্তির দহনে। সেটা কেউ দেখে না, কেউ বুঝে না, কারণ এ পুড়ে যাওয়ায় শরীরের ভিতরে বিশাল ক্ষত হয় কিন্তু দাউদাউ করে আগুন জ্বলে না আবার ধোয়াও উড়ে না।

প্রতাপ সাহা তাকালেন একদম আগুনের শিখা বরাবর। কতক্ষণ সে তাকিয়ে রইলো। অতিক্রম হলো কত কত বেহিসাবি মিনিট। তার দৃষ্টি নড়লো না, পলক পড়লো না। সে কি যেন দেখলো চোখ মেলে। হয়তো জীবনের চরম সত্য মৃত্যুটাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। মৃত্যু কতটা নির্মল সত্য আমাদের জীবনে তাই না? এখন শ্বাস নিচ্ছি,মিনিটের ব্যবধানে হয়তো আর শ্বাস নেওয়া হবে না, তবুও আমরা বছর তিনেক পরের জীবন নিয়ে কি সুন্দর ছক কষে রাখি! মৃত্যুই জীবনের একমাত্র সত্যি, একদম আগুনের মতন জ্বলজ্বল সত্যি, অথচ এই সত্যিটা ছাড়াই আমরা জীবনকে কল্পনা করে কতই না অন্যায় করছি! কতই না সুখে আছি!

জীবনে এই প্রথম প্রতাপ সাহা সিগারেট জ্বালালেন, দু আঙুলের মাঝে রেখে এই প্রথম ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলেন নিকোটিনের ধোঁয়া। সাথে উড়ালেন বিশৃঙ্খল বেদনা। শ্মশানে জ্বলজ্বল করতে থাকা মৃত ভদ্রলোকের আগুন খানা থিতিয়ে এসেছে। অথচ কান্নার শব্দ কমছে না। প্রতাপ সাহা গাঢ়ো দৃষ্টি রাখলেন দাহ্য করা জায়গাটাতে, পুড়ে যাওয়া কাঠের উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার মাঝে চক্ষুগোচর হলো দুটো মলিন ভিজে চোখ। যে চোখ দুটো নির্মিশেষ তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত আগুনে। চোখ দু’খানা কোনো মানুষের না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের না এই অসহায় কান্না। চোখ গুলো আমাদের সমাজে অবহেলিত খুব নিম্নমান কিন্তু বিশ্বস্ত প্রাণী কুকুরের। প্রতাপ সাহা হাসলেন।

সজল সাহেবের মৃত্যুর আগে শেষ বন্ধু ছিলো এই কুকুরটা। সকালের জগিং করার রাস্তা হতে সজল সাহেবের ভাতের পাত ভাগ করে নিয়েছিলেন কুকুরটার সাথে। তাই হয়তো আজ এই নিস্তব্ধ শ্মশানে মৃত, একা সজল সাহেবকে সাথ দিচ্ছে এই প্রাণীটা। সজল সাহেবকে হয়তো অনুভব করাচ্ছে, সজল সাহেবের জীবন বৃথা না। তার বিরহে কেউ তো একটা কাঁদছে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। কেউ তো একটা আছে তার, যে তার শূণ্যতায় দিবানিশি হাহাকার করবে, তার খালি বারান্দায় একটু উঁকিঝুঁকি করবে তাকে দেখতে পাওয়ার লোভে, তার আরাম কেদারার পাশে কেউ তো একটা বিরস চোখে চেয়ে শুয়ে থাকবে, খালি বাড়িটার দিকে কেউ তো অন্তত তাকিয়ে থেকে দু’ফোটা বিরহ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে জানিয়ে যাবে একসময় সজল নামক কোনো মানুষ এ পৃথিবীতে ছিলো। সজল সাহেব হয়তো মরে গিয়েও নিজের অস্তিত্ব আরও কয়েকটা বছর টিকিয়ে রাখতে এ প্রাণীটাকে ভালোবেসে ছিলেন। সে হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, ‘মানুষ হারালে হারিয়ে যায় আজকাল তার অস্তিত্ব। মানুষ মানুষকে আজকাল মনে রাখে না। মানুষের চেয়েও কৃতজ্ঞ বেশি কুকুর।’

প্রতাপ সাহা নিকোটিনের ধোঁয়া নিকষ, কালো আকাশে উড়িয়ে দিতে দিতে পৃথিবীর সবচেয়ে কৃতজ্ঞ প্রাণী কুকুরটার পাশে গিয়ে বসলো। বুক পকেট থেকে ফোন খানা বের করে কাকে যেন ফোন লাগালো। রিং হতে হতেই সে মেয়ের জীবনটা কিছুটা গুছিয়ে দেওয়ার জল্পনাকল্পনা করলো। তার এই মুহূর্তে এসে হঠাৎ করেই অনুভব হলো, আজ সজল সাহেবের জায়গায় সে থাকলে কুকুরটার জায়গায় থাকতো তার হতভাগিনী, কূল-কিনারা হারা প্রিয়দর্শিনী। যে মেয়েটা তার মৃত্যুর পর তার এমন একটা আঁধার রজনী সাথ দিবে, সে মেয়েটার জন্য বেঁচে থাকা কালীন কিছু না করলে বিরাট অপরাধ হয়ে যাবে যে!

অপরপাশ থেকে কলটা না ধরায় অনবরত রিং হচ্ছে প্রতাপ সাহার ফোনে। প্রতাপ সাহা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতেই হঠাৎ গান ধরলো,
‘মাটির দেহ মাটি হবে, পুড়ে হবে ছাঁই,
এ দেহ পঁ*চা দেহ, গৌরব কিসের ভাই!’

বাহিরে রিক্সার টুংটাং শব্দ, মাঝে মাঝে তুমুল হর্ণ তুলে সাঁই সাঁই করে হয়তো বিশাল গাড়ি গুলো ছুটে যাচ্ছে। ঘরের মাঝে আটটা মানুষ আর একটা নিথর দেহ। যার শরীরে র*ক্ত এখন শুকিয়ে গেছে। মায়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মোহনার ডান কাঁধে ভরসার হাত খানা দিয়ে। আজ তার যেন মোহনাকে একা অনুভব করাতে ইচ্ছে করছে না। খারাপ মানুষেরেও তো একটা বিশ্বস্ত হাত প্রয়োজন হতে পারে, মায়া নাহয় কিছুটা সময়ের জন্য সেই হাত হবে।
নিরবতার জাল ছিঁড়লো এবার বিহঙ্গিনী। অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভেজা আঁখি পল্লবে কিঞ্চিৎ মায়ের দিকে চেয়ে বাবার দিকে আঙ্গুল তাঁক করে অসহায় কণ্ঠে বললো,

“তোমার সেই খারাপ সময়টাতে যে মানুষটা তোমার পাশে ছিলো, আজ সেই মানুষটার মৃ*ত্যুর জন্য দায়ী তুমি। কেনো মা? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না।”
মোহনা অপলক তাকিয়ে রইলো নিলয় কুমারের নির্লিপ্ত দেহখানার দিকে। র*ক্ত নেই বোধহয় দেহখানায়। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে মানুষটার শরীর। সত্যিই তো এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। অথচ যা ঘটার কথা না তা-ই ঘটেছে।
“কেনো মা*রলেন বাবাকে?”
প্রশ্নটা করার সময় দর্শিনীর কণ্ঠও কাঁপলো সামান্য। সে হয়তো আন্দাজ করতে পারছে শ্বশুরের অন্যায় খানা কিন্তু মন যে মানতে চাচ্ছে না। পুরো পৃথিবী যে রাত্রিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলো, সে রাত্রিরে সজাগ ছিলো একটা মানুষ অগাধ দুশ্চিন্তায়। পুত্রবধূর একা রাস্তায় যদি ভীষণ ক্ষুধা পায় তাহলে যেন হাতের কাছে খাবার পায় সে ব্যবস্থা করার জন্য। এই মানুষটাকে খারাপ কীভাবে ভাবা যায়!

মোহনা আবার মুখ খুললেন। এবার মুখে চোখে কাঠিণ্যতা নেই, কেবল হাহাকার হচ্ছে হৃদয় মাঝে। তার মাকেও খু*ন করেছে, এ কথাখানা বলার সময়ও তার চোখে মুখে এতটা বিষাদ দেখা যায় নি যা এখন দেখা যাচ্ছে। আঁচল খানা চেপে ধরে রাখলো সে শক্ত করে। অতঃপর বললো,

“আমার অতীত জেনে এ মানুষটাই আগলে রেখে ছিলো আমাকে বটগাছের মতন। কূল-কিনারা হারা আমার, কূল হয়ে এসেছিলো সে। এতিম ছিলো মানুষটা। মা-বাবা ছিলো না তার এ দুনিয়ায়। আমারও কেউ ছিলো না। আমরাই দু’জন দু’জনের গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছিলাম। সংসার গড়ে উঠে ছিলো আমাদের। যেখানে রচনা করেছিলাম সুখের উপন্যাস। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার মহিলা ভীতি সৃষ্টি হয়েছিলো। মেয়েদের প্রতি আমার একটা ভয় কাজ করতো। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে যখন আমাদের সুখের সংসার হলো তখনই হঠাৎ মৈত্র জানালো তার একটা মেয়েকে পছন্দ। আমার সমস্ত সুখ হঠাৎ করেই চুপসে গেলো।

ভয় হতে শুরু করলো নিজের জন্য, বিহুর জন্য। ঘরে বউ আনলে যদি আমার বৌদির মতন হয়? আমার মেয়েটার যদি কপাল পুড়ে! কিন্তু প্রকাশ করতে পারলাম না সেটা। আমার ভয় যুক্তিযুক্ত না, তবুও আমার প্রচন্ড রকমের ভয়ে ঘুম হতো না। মাঝ রাতে জেগে উঠতাম। ভয় হতো, প্রচন্ড রকমের ভয়। বিহুর জন্য খুব কাঁদতাম লুকিয়ে। মেয়েটার তো সবে জীবন শুরু, ওর সাথে এমন হলে কী হবে! অতঃপর ছেলের আবদারে মৃত্তিকাকে দেখতে যাই আমরা। মৃত্তিকা বেশ ছটফটে, চঞ্চল ছিলো। আমার কি যেন হলো জানিনা, ভয়টা দারুণ ভাবে জেঁকে ধরলো। এই চঞ্চল মেয়েটা যদি আমার বৌদির মতন হয়! অতঃপর বাড়ি এসে মৈত্রকে বলি, ‘বাবা, আমার একটা কথা রাখবি?’ মৈত্র সম্মতি জানালো।

সে কথা খানা রাখবে। অতঃপর এই প্রথম আমি মৈত্রের কাছে অন্যায় আবদার করে বলি এই বিয়েটা যেন সে না করে। মৈত্র দ্বিমত করে নি, কেবল ঘাড় কাত করে সে আমার কথাটাকে মেনে নিলো। কোনো প্রশ্ন না, কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই আমার ছেলেটা সবটা মেনে নিলো। সেদিন রাতে আমি কাঁদলাম, খুব কাঁদলাম। যাকে পৃথিবীর সব সুখ দিতে এতকিছু সহ্য করলাম আজ তার সুখ কেড়ে নিয়েছি ভেবে কাঁদলাম। পরের দিন ওদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে একটু ঘুরতে গেলাম শহরের বাহিরে। ওদের বাবা গেলেন না।

যখন বাড়ি ফিরলাম তখন মৃত্তিকার মৃ*ত্যুর খবর ভেসে এলো। এরপরই আরেকবার বদলে গেলো আমার সংসারের চিত্র। আমার ছেলেটা মৃত্তিকার বাড়ি গিয়ে ফিরে এসে কেমন হয়ে গেলো। পাগলামো শুরু করলো। তারপর আমি ওকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেই এবং সবার কাছে জানাই ছেলেটা আমার হারিয়ে গেছে, কই যেন চলে গেছে। বিপ্রতীপ আর বিহুও তখন অনেকটাই ছোট ছিলো। তাই এ ঘটনা নিয়ে আর তত ঘাটাঘাটি হয় নি।”
কথা থামিয়ে মৈত্রের চোখে মুখে অনবরত স্নেহের হাত বুলাতে থাকে মোহনা। বুকের সবটুকু স্নেহ যেন ঢেলে দিবে সে এক নিমিষেই।

এবার কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো মায়া,
“আপনি মৈত্রদাকে কেনো লুকিয়ে পাগলা গারদে পাঠিয়ে ছিলেন?”
“আমার কেনো যেন সন্দেহ হতে থাকলো মৈত্রের আচরণে। আমার মনে হতে লাগলো মৈত্র এমন কিছু জানে যা অন্য কেউ জানলে অসুবিধা। মৈত্রের প্রাণঘাতীও হতে পারে। তাই এত গুলো বছর ওরে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
বিহু তার বাবার দেহ পানে তাকিয়ে বললো,
“তাহলে এতগুলো বছর পর, বাবার মৃ*ত্যুর সাথে এ ঘটনার কী সম্পর্ক মা?”
মৈত্রের চোখে-মুখে বুলাতে থাকা মোহনার হাতটা আপনা-আপনি থেমে গেলো। তার চোখ আবার ভরে উঠলো জলে। মায়ার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“যদি বলি মায়ার কারণেই আজ এত বছর পুরোনো ঘটনা উঠে এসে তোর বাবার মৃ*ত্যু ঘটেছে।”
উপস্থিত সবাই মোহনার কথাতে ভীষণ অবাক হলো বুঝায় গেছে। মোহনা সবার অবাক মুখ পানে তাকিয়ে স্মিথ হাসলো। বিরস কণ্ঠে বললো,

“আজ থেকে প্রায় এক মাস আগের ঘটনা, একদিন বিকালে ছাদে গিয়ে এই মায়ার সাথে হৈমন্তকে কথা বলতে দেখলাম। তারা কিসের প্রতিশোধ নিয়ে যেন কথা বলছে। হঠাৎ করেই আমার পুরোনো ভয়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। মায়া তবে কী আমার বৌদির মতন! আমার ভয় ধীরে ধীরে বাড়লো। এই প্রথম আমি মায়ার পরিবার সম্পর্কে খোঁজ শুরু করি। আমার ছেলে বউদের নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই বরং তাদের এ বাড়ি থেকে তাড়ানো নিয়েই আমার আগ্রহ বেশি ছিলো। আর সেই আগ্রহের স্বীকার দর্শিনী। ওরে যখন কোনো মতে তাড়াতে পারছিলাম না তখনই ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে আমি মত দিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম ছোট বউ আসবে, একটু অত্যাচার করলে পালাবে এ বাড়ি ছেড়ে। পুরোনো ঘটনার রেশ ধরেই আমি বিহুর সাথে দর্শিনীর মেলামেশা পছন্দ করতাম না। সে যায় হোক, আমি হৈমন্তের সব চলাফেরা লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। লোকও ঠিক করলাম ওর পিছনে। পরে জানতে পারলাম হৈমন্ত মায়ার মাসির জা’য়ের ছেলে। মায়া তার মাসির বাড়িতেই থাকে। আর সবচেয়ে বড় সত্যি, মায়া সেই মৃত্তিকার বোন।”

মোহনার শেষ কথায় বিপ্রতীপ, বিহু,মৃত্যুঞ্জয় বেশ অবাক হলো। দর্শিনী একটু আগে মায়ার মুখ থেকে সবটা শুনেছিলো বিধায় আর ততটাও অবাক হয় নি।
মোহনা কারো দিকে চাইলো না। স্বামীর লা*শের দিকে তাকিয়েই বললো,
“মায়া নিজের দিদির মৃ*ত্যুর প্রতিশোধ নিতে এ বাড়িতে এসেছে জানার পর অনেক গুলো বছর আগের ছক গুলো আমি আবার মেলানোর চেষ্টা করলাম। কোনোমতেই সে হিসেব মিলছে না। হঠাৎ তোদের বাবার আলমারির এক কোনার শপিং ব্যাগ থেকে র*ক্তা*ক্ত জামা উদ্ধার করলাম।

আমার হিসেব যেন আরও গরমিল হয়ে গেলো। অতঃপর আমি হাজির হলাম মৈত্রের কাছে। সেদিন আমার ভারসাম্যহীন ছেলের যেন কী হলো, আমি একবার মৃত্তিকার নাম নিতেই সে ফ্যালফ্যাল কেঁদে দিলো। নালিশের স্বরে বললো, ‘মা,বাবা খারাপ। ও, ও আমার মাটিকে মে*রে*ছে জানো। ও মে*রেছে। আমি মৈত্রের কথায় অবাক হলাম। অবাক হয়ে মৈত্রকে জিজ্ঞেস করতেই মৈত্র বললো, আমরা যেদিন শহরের বাহিরে যাই সেদিন মৃত্তিকা এ বাড়িতে এসেছিলো আমাকে মানানোর জন্য। তোদের বাবা তখন ধুম জ্বরের ঘোরে ছিলে। মৃত্তিকাকে দেখে তার হঠাৎ করেই পুরুষত্ব জেগে উঠলো। আমার এত ভালোবাসার মানুষটা সেদিন অতটুকু মেয়ের জন্য নির্দয় হয়ে উঠলো।

অতঃপর মেয়েটার সতীত্ব ছিনিয়ে নিলো। মৃত্তিকা তার ডায়েরির ভাজে চিঠিতে এসব লিখে রেখে ছিলো যা মৈত্রই বের করে জানতে পারে। আমার পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরে উঠেছিলো। এত এত দিনের বিশ্বাস ধূলোয় মিটে গেলো। আরেকবার পুরুষজাতির উপর গা ঘিন ঘিন করা রা*গ উঠলো। নিজের ভালোবাসার উপর তাচ্ছিল্য জন্মালো। জীবনটা যে আমার এমন ভাবে বৃথা যাবে কে জানতো! একদিন আমিও সতীত্ব হারিয়ে ছিলাম। তাই সতীত্ব হারানো যন্ত্রণা বুঝি। তাই ভালোবাসাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি মানুষ হলাম আরেকবার।

মৃ*ত মেয়েটার বিচারের জন্য আরেকবার স্নান করলাম স্বামীর র*ক্তে।”
ড্রয়িং রুম জুড়ে হু হু করে কান্নার শব্দে ভেসে এলো। মায়া কাঁদছে, বিপ্রতীপ, বিহু এমনকি দর্শিনী কাঁদছে। তারা যে মানতে পারছে না এই নিকৃষ্ট সত্যি। সত্য এত তিক্ত কেনো! কেনো সত্যি মানতে হয়! কিছু ভয়ঙ্কর সত্যি পৃথিবী থেকে কেনো হারিয়ে যায় না? ভালোবাসার মানুষ গুলোকে ঘৃণা করা যে অনেক কষ্টের। মৃ*ত্যু যন্ত্রণাও যে এর চেয়ে সোজা।
মোহনা উঠে দাঁড়ালো। দর্শিনীর দিকে হাত বাড়িয়ে আবার কি মনে করে যেন গুটিয়ে নিয়ে ভীষণ ফ্যাকাসে, পানসে হাসি দিয়ে বললো,

“আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই,
তাই দুঃখ হয়ে যায়,,
সে হাত দিয়ে কী বলো বন্ধু, তোমায় ছোঁয়া যায়!”
দর্শিনীর কী হলো সে নিজেও জানেনা। গত তিনবছরে শাশুড়ির করা আচরণ সে এক নিমিষেই ভুলে গেলো। মোহনাকে হুট করেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো হাহাকার করে। তার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কষ্টটা কার জন্য হচ্ছে সে জানেনা। শ্বশুরের জন্য না এই দুঃখিনী শাশুড়ির জন্য না এই পৃথিবীর নির্মম সত্যি মানতে না পারার জন্য!

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪০

[বিঃদ্রঃ ২১০০+ শব্দ লিখেছি একটা পর্বে। এবার গঠনমূলক মন্তব্যও চাই। আর অনেকে এই পর্বের প্রথম অংশকে অহেতুক মনে করতে পারেন। তাদের বলছি, একটু নিজের জন্য প্রথম খণ্ডটা উপলব্ধি করবেন।]

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২