পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪০

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪০
মম সাহা

মৃত লা*শ খানা পড়ে আছে নির্জীব। মাথার উপর নিরলস খটখট শব্দ তুলে ঘুরছে তিন পাখার যন্ত্রটা। নরম তুলার কেদারায় দর্শিনীর বাহু আঁকড়ে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয়। তার সামনের সোফাটাকেই উন্মাদ মৈত্রকে জাপ্টে ধরে মূর্তির ন্যায় বসে আছে মোহনা। তাদের সামনেই বিপ্রতীপ একদিকে দাঁড়িয়ে আছে আর অপরদিকে হৈমন্ত আর মায়া। বাবার লাশ থেকে দু’হাত দূরে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছে বিহঙ্গিনী। মিনিট খানেক গড়ালো নিরবে। কোনো শব্দ নেই। মোহনা মৈত্রের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলো অনবরত। কি বিশ্রী মানুষটার কি মমতাময়ী রূপ! একটু আগে যে মানুষটা দা*ন*বীয় রূপ ধারণ করে একটা পুরুষের যৌ*নাঙ্গ কে*টে ফেলেছে, বিশ্রী ভাবে আঘাত করেছে মানুষটার সেনসিটিভ জায়গাটাতে, সে মানুষটাই এখন স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আরেকটা পুরুষের মাথায়!

ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে পড়লো ঝরঝর করে। নিরবতারা ডানা ঝাপটিয়ে সজাগ করে তুললো সবার কণ্ঠধ্বনিকে। এবার সবটা বলার সময়, এবার সবটা জানার সময় এলো যে! দর্শিনীই প্রথম নিরবতাকে ভাঙলো, বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“মা, মা*র*লেন কেনো বাবাকে! আর মৈত্রদা ই বা বাবাকে কেন মেসো বলছে? হিসেব অনুযায়ী তার বাবা হবে তাই না?”
নিরবতা ভাঙলো তবে বিষ্ময়কর অবস্থা না। সবাই উত্তরের আশায় মোহনার পানে তাকিয়ে রইলো। মোহনা উত্তর দিলো না, নড়চড় করলো না কোনো কিছুর। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করলো মায়া,
“শাশুড়ি, পয়ত্রিশ বছর আগের তিন তিনটে খু*নের কারণও জানতে চাই আমি। আর প্রথম খু*নটা কাকে করেছিলেন সেটাও জানতে চাই আমরা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এবার আরেক ধাপ অবাক হলো বিপ্রতীপ, বিহঙ্গিনী আর মৃত্যুঞ্জয়। তাদের মা আরও তিনটা খু*ন এর আগে করেছে! তাও আবার পয়ত্রিশ বছর আগে! অথচ এতগুলো বছর সবটা তাদের অজানা ছিলো! মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো দর্শিনীর পানে। সেও তো অজ্ঞাত এ ব্যাপারে। দর্শিনী মায়ার বলা সব ঘটনা খুলে বললো উপস্থিত সবার সামনে। সবাই হা হয়ে কেবল শুনলো প্রত্যেকটা ঘটনা। মোহনা এতটা ভয়ঙ্কর এটা যেন কারো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
এই প্রথম, জীবনের এই প্রথম বিপ্রতীপের এই উঁচু মাথাটা নত হলো। ভেঙে পড়লো তার এতদিনের দম্ভ,অহং। মায়ের পায়ের কাছে কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে সে বসে পড়লো। পানসে, ফ্যাকাসে কণ্ঠে এই প্রথম বিপ্রতীপ উচ্চারণ করলো,
“মা, তুমি সত্যিই বুঝি এত পাষাণ!”

বিপ্রতীপের কথায় মোহনা নড়েচড়ে বসলো। তারপর তার ছড়ানো ছিটানো দৃষ্টি খানা পুরো ঘরময় বুলালো। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো দর্শিনী ফুলে উঠা পেটটার দিকে। আচমকা কি যেন হলো তার, সে উঠে দাঁড়ালো। দর্শিনী নরম উঁচু পেট টার কাছে নিজের হাতটা এগিয়ে নিতে গেলে সে হাত ধরে থামিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। একবার দর্শিনী অতঃপর মোহনার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
“পাপ লেগে যাবে যে, ছোঁবেন না।”
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় মোহনা রাগলেন না, চিৎকার করলেন না বরং হাসলেন। হাত গুটিয়ে ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়। বর্তমানের এই মুহূর্তটাই এসে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় নারী লাগছে মোহনাকে। মনে হচ্ছে সে রোমাঞ্চকর, অদ্ভুত তবে ভয়ঙ্কর না।

মোহনা আবার মৈত্রের পাশে বসলো। মৈত্র ঝিমিয়ে আসছে বার-বার। ঘুমে চোখ ঢুলছে রীতিমতো। মোহনা ধীর গতিতে মৈত্রের মাথাটা তার কোলে নিলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সবাইকে খুব ধীর গতিতে বললো,
“তোমরা একটু স্ব-স্থানে বসো। আজ আমার অনেক কথা বলার আছে। এই পৃথিবীর বুক থেকে এত দিন যত সত্যি লুকানো ছিলো বা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম, আজ সব বলবো। কিছু সত্যি তোমরা সহ্য করতে পারবে না। তাই আগেই নিজের মাটির উপর ভিত্তিটা শক্ত করে ধরো।”
মোহনার কথার ভঙ্গিমা ভীষণ গা ছমছমে। তবে তার কথা রাখলো সবাই। যে যেখানে পেরেছে বসে পড়লো। মোহনা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,

“আমার জীবনে আমি প্রথম খু*ন করেছি আমার মাকে। মায়া তোমার উত্তর পেলে?”
বজ্রপাতের শব্দও যেন এমন ভাবে হৃদয় কাঁপায় না যেমন ভাবে মোহনার কথা হৃদয় কাঁপাতে সক্ষম হয়েছে। একটা মানুষ কতটা অমানুষের খাতায় নাম লেখালে নিজের জন্মদাত্রী মাকে খু*ন করতে পারে? অমানুষও বোধহয় কিঞ্চিৎ লজ্জা পাবে এই মোহনার সাথে তার তুলনা করছে দেখে।
“আপনি নিজের জন্মদাত্রী মাকে খু*ন করেছেন অথচ আপনার মুখে আফসোসের কোনো রেশ নেই! কোনো হাহাকার নেই বক্ষ মাঝে। আপনি আদৌও মানুষ!”

মৃত্যুঞ্জয় সবসময় শীতল কথার মানুষ। তার কথার ধা*রালো ভাবও অনেক। তবে এবারে মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় মোহনা হাসলো না আবার রাগলোও না কিন্তু কাঠিন্য একটা ভাব তার সারা মুখে ছড়িয়ে গেলো। শক্ত কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“না, আমি মানুষ না। আমি মেয়ে মানুষ। পৃথিবীর সব থেকে অসহায় জাত। যাদের তোমরা ইচ্ছেমতন খুবলে খাবে অথচ ভাববে তারা প্রতিবাদ করতে জানে না। আমি সেই মেয়ে মানুষ যে প্রতিনিয়ত নিজেকে ঘৃণা করেছি মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি বলে। আমি সেই মেয়ে মানুষ যে নিজের শরীরের বিনিময়ে ঋণ মিটিয়েছি। আহ্, আজ তোমরা আমার ঘৃণা দেখাচ্ছো? সেদিন সভ্য মানুষ তোমরা কোথায় ছিলে যেদিন সতীত্ব হারানোর যন্ত্রণায় আমি হাহাকার করেছি, একটু বাঁচতে চাওয়ার আশায় নরক সহ্য করেছি। কোথায় ছিলো মানুষ তোমরা? সমাজের উঁচু শ্রেণীর পুরুষ, কোথায় ছিলে গো?”
মোহনার শেষ কথায় কেমন আর্তনাদ শোনা গেলো। কত বিভৎস হাহাকার সেথায়! এ মানুষটা কি সেই কঠিন মোহনা, যে প্রতিনিয়ত মানুষকে কথার আঘাতে মেরেছে! না তো, সে মোহনার সাথে এই মোহনার কোনো মিল নেই। এই নারী ভীষণ অসহায়। একজন কূল-কিনারা হারা নারী এই মোহনা।

ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সবার অনেক কিছু জানার আছে অথচ কেউ কথা বললো না। এখন, এই মুহূর্তে কেবল একজনকে কথা বলতে দেওয়া হবে কারণ অনেক গুলো বছর পর এই মানুষটা কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। হ্যাঁ, শক্ত খোলশের মোহনা এতদিন কথা বলেছে কিন্তু এই অসহায় নারী দীর্ঘ কতগুলো যুগ নিরব ছিলো। আজ তার বলার সময় এলো যে!
মোহনা মাথা নত করলো। মৈত্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এক নাগাড়ে বিরতিহীন ভাবে বলতে শুরু করলো,
“এই যে মৈত্রকে দেখছো, সে আমার ছেলে না। আমার বড় বোনের ছেলে। যাকে সংসারের অভাবের তাড়নায় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মাত্র তেরো বছর বয়সে।

আমাদের বড় ভাই, অবশ্য ওরে ভাই বলতেও ঘৃণা লাগে। আমার মা, আমি আমার মেঝো বোন আর বাবাকে নিয়ে ছিলো সংসার। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন সংসারে অভাব দেখি নি। দুই বোনের গলায় গলায় ভাব ছিলো। গ্রাম চষে বেড়িয়ে দিন কাটিয়েছি আমরা। দিদির যখন বছর বারো, বাবা মারা গেলেন আকষ্মিক। হঠাৎ এক রাতে সবাই হাসি মজা করে ঘুমালাম পরেরদিন সকালে উঠে দেখি বাবা নেই। ছোট ছিলাম। সদ্য দশ বছরের কিশোরী মনে বাবা হারানোর আঘাত বুঝো? কখনো আর বাবা বলে ডাকতে পারবো না, আর কখনো বাবা বাজার থেকে এলো তার কাছে বায়না ধরা হবে না, রথের মেলাটা বাবা ছাড়া কাটাতে হবে, উঁচুনিচু রাস্তায় যখন মুখ থুবড়ে পড়ে যাবো তখন আর কেউ দু-হাত এগিয়ে দিয়ে তুলবে না আমাকে – বুঝো সেই দশ বছরের মেয়েটার যন্ত্রণা?

গতকাল রাতেও যে মানুষটা আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়েছিলো সকাল হতেই শুনি সে মানুষটা আর নেই, বুঝো এ ব্যাথা? বাবা মারা গেলো, সংসারের হাল ধরলো সংসারের বড় ছেলে মানে আমার ভাই নিতাই। দাদার বয়স তখন বাইশ। ওর সাথে আমাদের তত গলায় গলায় ভাব ছিলো না। ও ওর মতন থাকতো আর আমরা দুই বোন আমাদের মতন। ভাই অবশ্য তখন থেকেই শহরে থাকতো। বাবা মারা যাওয়ার বছর পেরুতেই দিদিকে বিয়ে দিয়ে দিলো দাদা। মা কোনো কিছুতেই কথা বলতেন না, মতামত দিতেন না। কেমন যেন চুপসে গেলেন সে। বাবা মারা যাওয়ার পর শুধু বাবাকে হারায় নি আমরা হারিয়ে ছিলাম মাকেও। দাদা শহর থেকে মাঝে মাঝে আসতো নিজের মতন থাকতো আবার চলে যেতো। দিদির বিয়ের দু’বছরের মাথায় একদিন হুট করে বিয়ে করলো দাদা। আমাদের ভালোভাবে বাঁচার দিন ফুরোলো তখন থেকেই।”
বিরাট বক্তব্যের পর থামলো মোহনা। একটু শ্বাস নিলো। আবার একটু শক্তি কুড়ালো ঘৃণিত অতীত খানা বর্ণনা করার জন্য। আবার সে নতুন উদ্যমে বলা শুরু করলো,

“দাদার বিয়ে হওয়ার পর আমরা গ্রাম ছাড়লাম সারাজীবনের মতন। শহরে দাদার বাসায় গিয়ে উঠলাম। বাসা না এটা, বস্তির এক খুপরি বলা চলে। যার ভিতরে কবুতরের বাসার মতন দুটো রুম ছিলো। আমার চব্বিশ বছরের দাদার বউয়ের বয়স কত ছিলো জানো? ত্রিশ। গুনে গুনে তার থেকে ছয়বছরের মহিলাকে সে বিয়ে করেছে। মা তো কিছুতেই মতামত প্রকাশ করে নি কিন্তু বারো বছরের আমি টুকটাক প্রতিবাদ করে উঠি তার বিনিময়ে মা’র খাই অনেক। আমার চুপচাপ দাদাটাকেও কেমন বদলে যেতে দেখি। কথায় কথায় মারতো, ম*দ খেতো আরও নানান নে*শা। বৌদি তখন আমার কাছে যমদূত। বাড়ির প্রতিটা কাজ আমি করতাম। একটু ভুল হলে বেধড়ক মা*র। এমনও হয়েছে কখনো কখনো গরম লোহার চামচ আমার বুকে লাগিয়ে দিতে। জ্বলে যেতো নরম চামড়াটা। কাউকে দেখাতে পারতাম না, বুঝাতে পারতাম না। মাকে বললে মা কেবল বলতো চুপ থাক। আমিও চুপ থাকতাম। বিকেল হলেই দেখতাম বৌদি পাড়ার পুরুষ মানুষদের সাথে কেমন বিশ্রী কথা বলতো, মিশতো।

এর মাঝেই আমার পনেরো বছরের সদ্য বিধবা বোন তার এক মাসের ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে। দুধের বাচ্চার খরচ সহ আরও একটা মানুষের খরচ বাড়লো। এতদিন কোনোমতে সংসার চালালেও দাদা এবার হিমশিম খেয়ে গেলো। এখানে ওখানে বাড়তে থাকলো ঋণ। এর মাঝে বৌদির আচরণ আরও খারাপ থেকে খারাপের দিকে নামলো। আমাকে মারা অব্দি সীমাবদ্ধ থাকে নি সেটা দিদিকেও মারতো। মা কোনো প্রতিবাদ করতো না, কিছু বলতো না কেবল দেখতো। ছোট ছিলাম, যখন বিপদে মাকে পাশে পাওয়ার কথা তখন মায়ের এমন নির্জীবতা মানতে পারি নি। মাকে বলতাম গ্রামে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু মা হেলদোল দেখাতেন না।

এরপর ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারে আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হলো। ডুবে গেলাম ঋণের নিচে। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখলাম দিদি বাড়িতে নেই। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজলাম। পুরো পাড়া খুঁজলাম। কত অচেনা রাস্তা হেঁটে বেড়ালাম দিদিকে খুঁজতে খুঁজতে কিন্তু দিদি নেই। কোথাও নেই দিদি। অবাক করা ব্যাপার হলো, আমাকে বাদে আর কেউ দিদিকে খুঁজে নি। এমনকি তার জন্মদাত্রী মাও না। দিদি নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন দেখি বৌদি কানে স্বর্ণের দুল। দাদার ঘরে ম*দের আড্ডা। এ যেন আনন্দ উৎসব। আমার খটকা লাগলো। দিদি কোথাও যায় নি, ওরাই দিদিকে কিছু করেছে। খুব বাজে কিছু করেছে।”

থেমে গেলো মোহনা। কণ্ঠ তার কাঁপছে। এত কঠিন মানুষটারও কণ্ঠ কাঁপছে অতীত বলার সময়, কতটা জঘন্য ছিলো তাহলে সেই অতীত!
মায়া মেয়েটার ভয় করলো না আজ মোহনার কাছে যেতে। সে মোহনার কাছে গেলো। মোহনার বাহুতে হাত রেখে এই প্রথম সে কোমল কণ্ঠে বললো,
“মা, তারপর কী হলো?”
মোহনার যেন এই ভরসাটুকুর খুব প্রয়োজন ছিলো এই সময়টাতে। মোহনার চোখ রক্তজবার মতন লাল। কান্না আটকানোর অদম্য চেষ্টা তার মুখে। সে থামলো, জিরিয়ে নিলো কিছুক্ষণ। মৈত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে এক ধ্যানে সেই মুখখানায় দৃষ্টি রেখে বললো,

“চৌদ্দ বছরের মেয়েটা তখন চব্বিশ বছরের নারীর মতন বুঝদার হয়ে উঠলো। প্রতিবাদ কণ্ঠ ছড়িয়ে দিলো সে। বৌদি মারলো খুব। গোপন অঙ্গ গুলোতেই বৌদি সবসময় বেশি আঘাত করতো। মা দাঁড়িয়ে দেখলো। থামালো না বৌদিকে। চেষ্টাও করলো না কেবল ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইলো। দাদা টলতে টলতে এসে দু চারটা লাথি মেরে দিলো। আমি কাঁদলাম না অন্যসময়ের মতন, বরং করে বসলাম উদ্ভট কাজ, বড় কাঠের টুকরোটা নিয়ে সজোরে আঘাত করলাম বৌদির কপালে। গলগল করে ফিনকি দিয়ে উঠলো র*ক্তের ধারা। আমি এই প্রথম র*ক্ত দেখে তৃপ্তি পেলাম। শান্তি পেলাম। বৌদি আর্তনাদ করে উঠলো। মাতাল দাদা আমার তখন অতিরিক্ত ম*দ খেয়ে বেহুশ হয়ে আছে। পাড়ার মোড়ের বৌদির পুরুষ বন্ধুরা বৌদিকে ধরে বেঁধে হসপিটালে নিয়ে গেলো।

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা তখন সশব্দে কয়েকটা চ*ড় বসিয়ে দিলো আমার গালে আর অনবরত বলতে লাগলো ‘কী করলি মুখপুরী তুই? ওরা মেরে ফেলবে তোকে। কী করলি এটা?’ মায়ের আচরণে মায়ের প্রতি ঘৃণাটা বাড়লো। মায়ের প্রতি আমার তখন কেবল ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই কাজ করছিলো না। আমি ছু*রি নিয়ে মায়ের গলার সামনে ধরলাম। হিংস্র হয়ে গেলাম হঠাৎ করেই। আমার কেন যেন মনে হলো দিদির খবর মা জানে। তাই মাকে ভয় দেখানোর জন্য বললাম, ‘তুমি যদি না বলো দিদি কোথায় তাহলে তোমার পরিণতি খুব খারাপ হবে।’ আমার হিংস্রতা দেখে মা ভয় পেলো। তারপর মা এমন কিছু শুনালো যে আমার পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠলো।

দিদিকে ওরা টাকার লোভে বিক্রি করে দিয়েছে। কতটা পাষাণ ওরা, আমার ফুলের মতন দিদিটাকে ছাড় দিলো না। টাকার কাছে বিক্রি হলো সেই মেয়েটা। আর আমার বাবার মৃত্যুটাও স্বাভাবিক ছিলো না। টাকার লোভে আমার দাদাই বাবার সাথে সেইদিন রাতে ঝামেলা করে ছিলো। এক কথা, দু’কথা হতে হতে একপর্যায়ে বাবার গলা চেপে ধরে দাদা অতঃপর মৃ*ত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানুষটা। আর আমার বৌদি একজন পতিতালয়ের মহিলা। তার লোভে পড়েই দাদার এত অবনতি। মায়ের মুখে এতকিছু শোনার পর আমার আর শরীরে কুলালো না। ছোট ছিলাম আমি, পুতুল খেলার বয়সে জীবনের এই নির্মম খেলা মানতে পারি নি তাই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি সেখানেই।

যখন জ্ঞান ফিরে সাথে সাথে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হয়। কেউ যেন আমার চুলের মুঠি টেনে ধরেছে। আমি পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার বৌদি। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ আর মুখে তুমুল রাগ। আমি বৌদির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু পারি না। এই মোটা লাঠি নিয়ে ইচ্ছেমতন মনের স্বাধ মিটিয়ে আমাকে মা*রে আমার বৌদি। চিৎকার করেছি, মাকে ডেকেছি বাঁচানোর জন্য অথচ মা বাঁচায় নি। অবশ্য মা যে বাঁচাবে না সেটা আমার বুঝতে বাকি রইলো না। বাবার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর মা আসলেই আর সুস্থ মানুষ ছিলো না।

মায়ের আচরণেই সেটা বুঝতে পারতাম। বৌদির ইচ্ছেমতন মা*র খাওয়ার পর যখন নিভু নিভু চোখে পড়ে রইলাম বিছানায় তখন ঘরে ঢুকলো অপরিচিত পুরুষ। ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম পাড়ার মোড়ের মুদি দোকানের কাকাবাবু। বৌদি আমার চুলের মুঠি টেনে বললো কাকাবাবুর দোকানে আমাদের অনেক ঋণ। আমার সাথে একসপ্তাহ থাকার পর সে ঋণ শোধ হয়ে যাবে। ক্লান্ত, র*ক্তা*ক্ত শরীরটা নিয়ে প্রাণপণে উঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। বৌদির কাছে সতীত্ব রক্ষার ভিক্ষা চাইলাম। অবশ্য এমন প*তি*তা কী আর সতীত্ব বুঝবে! বৌদি বললো মৈত্রের দুধও এই দোকান থেকে আনা হয়, বাচ্চাটা না খেয়ে বাঁচবে তো! দিদির শেষ সম্বলটাকে বাঁচানোর জন্য নিলামে উঠলাম আমি। ঋণ শোধের পথ্য হলাম শেষমেশ।

সে ঘটনার দু’দিন পর একরাতে মা হঠাৎ কয়েকটা টেবলেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি ততদিনে মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। বৌদি আর ভাইয়ের উপর যতটা ঘৃণা ছিলো তার দ্বিগুণ ঘৃণা হলো মায়ের উপর। টেবলট দেখে যখন জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কিসের টেবলেট, আমার মানসিক ভারসাম্য হীন মা জবাব দিলে ইঁদুর মা*রার বি*ষ। খেয়ে নিলে এ জীবন থেকে মুক্তি। আমি হাসলাম। এত লড়াই করেছি বাঁচার জন্য অথচ আজ বাঁচার মতন না বেঁচে মরে যাবো! কখনোই না। মায়ের হাত থেকে টেবলেট গুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম

মা আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লো। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে যখন কাঁদা আমি বালিশ চা*পা দিয়ে জীবনের প্রথম খু*নটা করলাম। মেরে ফেললাম মাকে। এ মানুষটা তো এতদিন ম*রেই ছিলো আজ একবারে মুক্তি দিলাম। মায়ের হয়তো কোনো দোষ ছিলো না, আবার হয়তো অনেক দোষ ছিলো। বাবার মৃ*ত্যুর সঠিক বিচার করলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের। মায়ের মৃত্যু টা যথেষ্ট স্বাভাবিক ভাবে নিলো সবাই। আর ভাই বৌদির এতে কিছু যায় আসেও না তাই তত ঘাটায় নি ব্যাপারটা। এরপর জাগলো আমার মৃ*ত্যু ক্ষুধা আর মৈত্রকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই। পড়ার মুদি দোকানের ঋণ আর ভাইয়ের ম*দ কেনার টাকা আমার সতীত্ব বিক্রি করে পরিশোধ করা হতো। কেবল মৈত্র, দিদির শেষ চিহ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে সহ্য করতে লাগলাম সব কিছু।

একবার দাদা হুট করে উধাও হয়ে গেলো। বুঝলাম কোনো ম*দের আড্ডা কিংবা নিষিদ্ধ পল্লিতে তার সুখ খুঁজে নিচ্ছে। সুযোগ বুঝে দাদার অনুপস্থিতিতে মে*রে ফেললাম বৌদিকে। দুপুরে বিভোর ঘুমের মাঝে মে*রে ফেললাম তাকে কু*পিয়ে। অতঃপর অনেক দিনের মনের স্বাধ মিটিয়ে ছোট ছোট পিস পিস করে টুকরো করলাম তার। ভাসিয়ে দিলাম বস্তির পিছনের পুকুরটাতে। জীবনের সবচেয়ে বড় পূণ্য কাজ আমি সেদিন করে ছিলাম। সবচেয়ে বেশি শান্তির কাজ।”
বিভৎস, ভয়ঙ্কর কাহিনীর পর থামলো মোহনা। মায়া মোহনার বাহু খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর তার কাঁপছে ভয়ঙ্কর ভাবে। দর্শিনীরও গা গুলিয়ে উঠলো। মৃত্যুঞ্জয় দ্রুত উঠে এক গ্লাস জল দিলো মেয়েটাকে। পকেট থেকে শুভ্র রুমালটা বের করে মুছিয়ে দিলো মেয়েটার ঘাম। সবার ভিতরে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। মোহনার প্রতি রাগ নয় বরং করুণা অনুভব হচ্ছে সবার।
মোহনা নিজের বাহুতে থাকা মায়ার হাতটার দিকে একবার নজর বুলালো। কিঞ্চিৎ হাসলো। অতঃপর ঘুমন্ত মৈত্রের দিকে তাকিয়ে শুরু করলো নিজের কালো অতীতের বাকি বর্ণনা,

“দাদা যখন ফিরে, বৌদিকে না পেয়ে সে পাগ*ল প্রায়। আমি বৌদির সব স্বর্ণ গয়না লুকিয়ে রেখে দাদাকে বললাম বৌদি পালিয়েছে অন্য কারো সাথে। দাদা বিশ্বাস করলো। বৌদি যে মহিলা পালানোটা স্বাভাবিক। কিন্তু দাদা ভেঙে পড়লো। দাদার জন্য আমার মায়া হতো না কেবল দিনের পর দিন ঘৃণা বাড়তে লাগলো। তখন অবশ্য আমার সতীত্ব ছিঁড়ে খেতে আর কেউ আসতো না। সব পথ আমি বন্ধ করে ছিলাম। কিন্তু একদিন মাঝ রাতে ম*দ খেয়ে নেশায় বুদ হয়ে আমার আপন দাদা, আমার মায়ের পেটের ভাই ভুলে গেলো নিজের পরিচয়, হামলে পড়লো আমার উপর।

নারীদেহের লোভ কী আর পুরুষদের ছাঁড়ে? বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা লাগালাম। নিশুতি রাত, পাশে ছোট্ট মৈত্র আমাদের ধস্তাধস্তির শব্দে ভয়ে কাঁদছে। আর যাই হোক নিজের ভাইয়ের কাছে নত স্বীকার করি নি আমি। টেবিলের উপর থেকে সেফটিপিন নিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম ওর বুকে, নেশায় বু*দ হয়ে থাকার জন্য সামন্য ছিটকে পড়লো সে অতঃপর জ্ঞান হারালো। সেদিন, সেই নিশুতি রাতে আমার কাছে ও ছিলো দুনিয়ায় সবচেয়ে নোংরা মানুষ, আমার বাবার খু*নি। ওর প্রতি ঘৃণায় ওর অন্ডকোষে লাথি মারলাম। ক্ষাণিক গুঙ্গিয়ে উঠলো ও। তারপর গলগল করে রক্তের স্রোত বেয়ে পড়লো। নিজের মনের সব ক্ষোভ মিটিয়ে নিলাম। অতঃপর ঝুলিয়ে দিলাম সিলিং ফ্যানের সাথে। ছোট মৈত্রকে বুকে জড়িয়ে সেই মধ্য রাতে বাড়ি ছাড়লাম আমি। আর সেই সুদূর অঞ্চল পাড়ি জমিয়ে পা রাখলাম এই শহরে। জীবনের নতুন অধ্যায়। নতুন সূচনা। বৌদির স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে ছোট ফ্লাট ভাড়া করলাম। চাকরি শুরু করলাম গার্মেন্টসে। অতঃপর পরিচয় ঐ যে নিলয় কুমারের সাথে যে আমার এই একা শহরের জীবনটাতে সর্বপ্রথম আর সর্বশেষ সঙ্গী ছিলো।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৯

মোহনার কথা থামলো। দৃষ্টি তার নিলয় কুমারের উপর। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। ব্যাথার অশ্রু। প্রিয় মানুষ হারানোর অশ্রু। হৃদয় ছাড়খার করা হাহাকারের অশ্রু। সে যে তার দুর্দিনে পাশে থাকা এই মানুষটাকর হারাতে চায় নি কভু। তবে আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা তারই হাতে খু*ন হয়েছে। কতটা অকৃতঞ্জ সে!
উপস্থিত সবাই তাজ্জব বনে কেবল সে অশ্রু দেখলো। জীবন এতটাও কঠিন হতে পারে!

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪১