পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৯

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৯
মম সাহা

নিস্তব্ধ, ভয়ঙ্কর,রোমাঞ্চকর একটি সন্ধ্যা হুড়মুড় করে যেন অতিবাহিত হলো। সিলিং ফ্যানের ঝু*লে থাকা লাশ, সেই লাশের পা বেয়ে গলগল করে পড়তে থাকা র*ক্তের স্রোত, আর এ সবগুলো জিনিসের চেয়ে বেশি অবাক করা কান্ড হলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে পরিপাটি করতে থাকা মোহানার হাসি হাসি মুখের দৃশ্য। মায়ার চিৎকারে বিপ্রতীপ আর বিহঙ্গিনীও এসে বাবার এমন করুণ দশা আর মায়ের এমন শীতল রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। দর্শিনী কেবল চেয়ে রইলো প্রাণহীন শ্বশুরের দেহখানার দিকে। চোখের সামনে টুকরো টুকরো কিছু সুন্দর স্মৃতি ভেসে উঠেছে। শ্বশুর বাড়িতে তার যত গুলো ভালো স্মৃতি রয়েছে তার দুই তৃতীয়াংশ স্মৃতির কারণ এ মানুষটা। কখনো বাবার অভাব অনুভব করতে দেয় নি মানুষটা। যেদিন এ বাড়ি ছেড়ে সে চলে যাচ্ছিলো, সেদিনও মানুষটা নিঃস্বার্থ ভাবে দর্শিনীর পাশে ছিলো। রাস্তায় খিদে লাগবে ভেবে দর্শিনীর জন্য খাবার দিয়েছিলো। অথচ এ মানুষটার আজ বিভৎস মৃত্যু!

“ও মা, বাবার কী হলো? মা গো, তুমি বাবার সাথে কী করেছো? বাবা, ও বাবা, কী হলো তোমার? বাবা গো? চোখ খুলো না গো বাবা।”
বিহঙ্গিনীর আর্তনাদে কেঁপে উঠলো মায়া। এ মানুষটার এমন নিষ্ঠুরতা কেউ ই যেন মেনে নিতে পারছে না। মোহনা নিজের মতন শাড়ির আঁচল ঠিক করে বড় করে সিঁদুর দিলো সিঁথির মাঝে। বড় লাল এক ফোঁটা দিলো ললাটে। শরীরে জড়ানো টকটকে লাল জামদানী শাড়ি। সাদা কালো মিশ্রণের মোটা চুল গুলো পুরো পিঠে ছড়ানো। কোমড়ের নিচ অব্দি গড়াগড়ি খাচ্ছি সেই চুলের ঝিলিক। মনে হচ্ছে স্বর্গীয় কোনো দেবী স্বয়ং এখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের মাঝে মোটা করে কাজল লেপে দেওয়া। দর্শিনী কখনো নিজের শাশুড়ির এমন রূপ দেখে নি। মনে হচ্ছে অপ্সরাও যেন হার মানবে সেই রূপের কাছে। কেমন গা ছমছমে রূপ। শরীরের লোমকূপ শিরশির করে উঠার মতন রূপ। চোখ ধাধানো অথচ রোমাঞ্চকর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিপ্রতীপ দ্রুত গিয়ে বাবার ঝুলে থাকা লাশ খানা সযত্নে নামায়। ছুটে নিয়ে যায় ড্রয়িংরুম অব্দি। হয়তো বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য ছুটছে। কিন্তু মোহনার বজ্রকণ্ঠের কাছে বাবাকে বাঁচানোর অগাধ ইচ্ছে খানা খানিক চুপসে এলো। উপস্থিত বাকি তিন নারীরও শরীর কেঁপে উঠলো নিবিড়ে। মোহনা বড় বড় পা ফেলে মিনিট দুইয়ের মাঝেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো তার পিছে পিছে মায়া,বিহু,দর্শিনীও উপস্থিত হলো সেখানে। বিপ্রতীপ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। অবাক কণ্ঠে বললো,
“মা,বাবার অবস্থা দেখেছো! তুমি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছো দেখো। তাও কীভাবে তুমি এখন আবার আমাকে আটকাচ্ছো?”

মোহনা হা হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই হাতের ছুরি খানা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“মৃত মানুষকে বাঁচানোর সাধ্যি এ পৃথিবীর কারো নেই। তোর বাবার প্রান গিয়েছে কমপক্ষে আধাঘন্টা হয়ে গেছে। কাকে বাঁচাতে যাচ্ছিস, বাবু? উনারে এখানেই শোয়া। রেখে দে বলছি। নাহয় আমাকে তো চিনিসই, ভয়ঙ্কর কিছু করতে আমার দু’বার ভাবতে হবে না। চাচ্ছিস এমন কিছু?”
বিপ্রতীপ বরাবরই ভীতু,কাপুরুষ। মায়ের এমন ভয়ঙ্কর হুমকির পরও বাবাকে বাঁচানোর ইচ্ছে তার মাঝে অবশিষ্ট ছিলো না। সে দ্রুত তার বাবার নিথর দেহটা মাটিতে রেখে দিলো। দর্শিনী এগিয়ে এলো শ্বশুরের দিকে। তার মাথায় ঘুরছে অনেক রকমের রহস্য। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে দিয়েছে তার বিষণ্ণতা। সে যেন মানতেই পারছে না মানুষটা নেই।
ড্রয়িংরুমে যখন পিনপতন নিরবতা, তখন কলিংবেল বেজে উঠলো বিকট শব্দ করে। মোহনা উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে নরম সোফায় গিয়ে বসতে বসতে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“যাও আমার দুষ্টুবুদ্ধি সম্পন্ন বৌমা। দরজাটা খুলে দিয়ে আসো। তোমার কাঙ্খিত মানুষ বোধহয় এসে গেছে।”
মায়া অনেকটাই চমকালো। চমকে গিয়ে ভীতু স্বরে বললো,

“মানে!”
“ওমা, মিনিট খানেক আগেই তো কাউকে আসতে বলে ক্ষুদ্র বার্তা পাঠালে ঐ যন্ত্র খানা দিয়ে। ভেবেছো আমার চোখে ফাঁকি দিবে! ভয় পাওয়ার কারণ নেই। গিয়ে দরজাটা খুলে দেও।”
মায়ার ভয়ে হাত-পা কাঁপা শুরু করলো। মোহনাকে যতটা ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিলো, মোহনা তার চেয়েও বেশি কিছু। সবদিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিরাজমান।
মায়াকে কাঁপতে দেখে দর্শিনীই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করলো হৈমন্ত। হৈমন্ত ঘরে প্রবেশ করতেই বাড়ির গেইটের সামনে আরেকটা গাড়ি এসে থামলো। সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো দু’জন পুরুষ। দর্শিনী তাদের ঘরে প্রবেশ করার জায়গা দিয়ে সড়ে দাঁড়ালো। তারা প্রবেশ করতেই মোহনার আদেশে দরজাটা আবার আটকে দিলো সে।
হৈমন্তকে দেখে মোহনার মুখে যেই কুটিল হাসিটুকু ছিলো তা পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেলো হৈমন্তের পিছে দাঁড়ানো মানসিক ভারসাম্য হীন পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের ছেলেটাকে দেখে। যাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়। মোহনা অবাক, বিষ্ময়ে হা হয়ে রইলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“মৈত্র, বাবা! তুই এখানে!”
চুল এলোমেলো কিঞ্চিৎ ফরমাল পোশাকে আবৃত মানসিক ভারসাম্য হীন ছেলেটা খুশি খুশি চোখে মোহনার দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিতে দিতে বললো,
“ছোটমা, ছোটমা। আমার ছোটমা, ভালোমা। আসো আসো, আমারে বুকে নেও, মা।”
মৈত্রের ব্যবহারে তাজ্জব বনে গেছে উপস্থিত সবাই। বিহঙ্গিনী ‘দাভাই’ বলে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটার বুকে। ছেলেটা দু’কদম পিছিয়ে গেলো। মায়া তাকিয়ে রইলো মৈত্রের দিকে। এইতো, অনেক বছর আগের আবছা স্মৃতির মানুষটা। ছোট্ট মায়ার আদুরে মানুষটা, যাকে দেখলে সে ঝাঁপিয়ে পড়তো আহ্লাদে। সে মানুষটার এরকম দশা! এতটা ভয়াবহ! অথচ এ মানুষটার উপর প্রতিহিংসার নেশায় সে ছুটে এসেছিলো এ বাড়ি অব্দি। কী হচ্ছে, কী হবে, সবটাই যেন কারোই বোধগম্য হচ্ছে না। কেনো হিসেব গুলো এত গড়মিল!
মৈত্র বিহঙ্গিনীকে ঠেলে তার বুক থেকে উঠিয়ে দিলো। কি যেন ক্ষানিকটা বিড়বিড় করলো। হঠাৎ তার নজর গেলো মাটিতে লেপ্টে থাকা নির্জীব মানুষটার দিকে। সে ক্ষেপে উঠলো আচমকা। মৃত মানুষটার বুক বরাবর কয়েকটা লাথি মারলো। অনবরত লাথি মারতে মারতে কেঁদে দিলো। দুহাতে চোখের পানি মুছলো সাথে অনবরত লাথি চালিয়ে যেতে যেতে বললো,

“মেসো খারাপ ছোটমা। অনেক খারাপ। তুমি জানো ছোটমা ও অনেক খারাপ। মে*রে দেও ওকে, ছোটমা। তুমি না বলেছো মারবে ওকে। মা*রছো না কেনো? মারো।”
মৈত্রের এমন কাণ্ডে আরেক ধাপ অবাক হলো উপস্থিত সবাই। বিহঙ্গিনী অবাক কণ্ঠে বললো,
“মা, দাভাই বাবাকে মেসো কেন বলছে? আর এমনই বা কেন করছে ও? ও না বাবার ভক্ত ছিলো। তাহলে!”
মোহনা উত্তর দিলো না বিহুকে। কেবল মৈত্রকে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“চিন্তা করিস না, বাবা। তোকে দেওয়া কথা আমি রেখেছি। দেখ, ও মরে গেছে। মে*রে দিয়েছি আমি, তুই খুশি তো!”

গ্রাম জুড়ে হৈচৈ ভাব। কলঙ্কের দাগ ছিটিয়ে দিচ্ছে সবাই। রাত আটটা বাজেও মানুষ এখান ওখান থেকে ছুটে আসছে গ্রামের নতুন কাহিনী দেখার জন্য। কেউবা ছিঃ ছিঃ করছে। দর্শিনীদের পুরো পরিবার বিচার সভায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে পুরো গ্রামবাসীও আছে। মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবারও এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
বিচারের মধ্যমনি হলো হিমাদ্রি আর দর্শিনীর ছোট কাকী কুহু। যার স্বামী মারা গিয়েছে অনেক বছর আগে। প্রতাপ সাহা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে যেই তথ্য নিয়ে এত রমরমা আর যাই হোক এই তথ্য যে সত্যি না সেটা তার ঢের জানা আছে। কিন্তু কীভাবে থামাবে গ্রামবাসীকে!
বিচারকের আসনে হরমোহন কুটিল হাসছে। প্রতাপ সাহার এমন বিশ্রী ভাবে নাক কাটা অবস্থান দেখতে তার যেন বেজায় খুশি লাগছে। প্রতাপ সাহার ছোট ভাইয়ের বিধবা বধূ পরকীয়া করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা! কি দারুণ খবর!

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৮

কুহু কেবল ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায় তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এত বছর যে সম্মান নিয়ে সে বেঁচে ছিলো আজ সে সম্মান ভরা বাজারে ধূলিসাৎ হচ্ছে! একটা নারীর জন্য এরচেয়ে অপমানজনক আর কী হতে পারে!
প্রতাপ সাহা অসহায় হয়ে বার বার খুঁজে যাচ্ছে তার মেয়েকে। দর্শিনী থাকলে হয়তো আজ ভরা বাজারে পবিত্র মেয়েটাকে বেঁচে থাকার পরও মৃত্যুর স্বাধ পেতে হতো না।

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪০