ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৬

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৬
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

তানিশা চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।তানিশা বুঝতে পারলো না কিছু।তাকে আবার কে নিয়ে এলো হাসপাতালে ?সে তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো রাস্তায়।তারপর কি হয়েছিলো তার সাথে সে কিছুই মনে করতে পারলো না।

তানিশা তার কপালের ব্যান্ডেজ টা বোলাতে বোলাতে উঠতে ধরলো।কিন্তু তন্নি এগিয়ে এসে বললো,
উঠছিস কেনো?শুয়েই থাক।তা এখন কেমন লাগছে তোর?
তানিশা তখন শান্ত কন্ঠে বললো,ভালো লাগছে।কিন্তু আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো কে?আর তোর নোমান ভাইয়ার কি অবস্থা?উনি কি ঠিক আছেন?
তন্নি তখন বললো,আমান ভাইয়া নিয়ে এসেছে তোকে।আর নোমান ভাইয়া গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে।সেও এই হাসপাতালেই আছে।এখন মোটামুটি সুস্থই আছেন।
তন্নি তখন বললো হয়েছিলো টা কি তানিশা?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তানিশা তখন বললো আমি বাসস্ট্যান্ডে যাবো বলে রিক্সায় উঠেছিলাম।হঠাৎ কিছু ছেলে এসে আমাকে এট্যাক করে।তারা আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলো।আমাকে নাকি জোর করেই বিয়ে করবে।হঠাৎ সেই পথে তোর নোমান ভাইয়া যাচ্ছিলেন।তোর নোমান ভাইয়াকে দেখামাত্র আমার ভয় কিছুটা দূর হলো।আমি তখন চিৎকার করে তাকে ডাকতে লাগলাম।তোর নোমান ভাইয়া আমার চিৎকার শুনে সাথে সাথে এগিয়ে আসে।এবং আমাকে ছেলেগুলোর হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন।কিন্তু একটা ছেলে পিছন দিক থেকে তোর নোমান ভাইয়ার মাথায় আঘাত করলে তিনি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে যান।আমি ওনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি।কিন্তু কেউই এগিয়ে আসে না।তারপর একটা ছেলে আমার মুখ চেপে ধরলে আমি সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যাই।তারপর আর কিছু বলতে পারি না।
নোমান ভীষণ ভাবে আহত হওয়ার কথা শুনে তানিশার খুব খারাপ লাগলো।তাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ তার এ অবস্থা হলো।
হঠাৎ আমান এলো তানিশার বেডে।আর জিজ্ঞেস করলো তানিশা কেমন আছো এখন?

–জ্বি ভালো ভাইয়া।
আমান তখন বললো,আর কখনোই একা একা যাবে না কোথাও।আমি না থাকলে কি হতো তোমার একবার ভেবে দেখেছো?
–জ্বি ভাইয়া।
আমান এবার তার দুর্দান্ত সাহসের গল্প তানিশাকে শোনাতে লাগলো।
আমান বললো,ভাগ্যিস আমিও বাহিরে বের হয়েছিলাম তা না হলে ছেলেগুলো তো তোমাকে উঠিয়েই নিয়ে যেতো।তারপর কি হতো তা উপরওয়ালাই ভালো জানে।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো,ভাইয়া আপনি ছেলেগুলোকে কিভাবে তাড়ালেন?যেখানে নোমান ভাইয়া গুরুতর আহত হয়েছে সেখানে তো আপনার কিছুই হলো না।

আমান তখন হাসতে হাসতে বললো,তুই খুবই বোকা তন্নি।আমি হলাম ভবিষ্যৎ এর একজন পুলিশ অফিসার।এরকম ছোটো খাটো সন্ত্রাসীদের তাড়ানোর ক্ষমতা আমার আছে।আমি যে ফাইট জানি নোমান কি সেই ফাইট জানে নাকি?যার সন্ত্রাসীদের তাড়ানোর ক্ষমতা নেই,সে গিয়েছে তানিশাকে উদ্ধার করতে।আমাকে ফোন করে ডাকলেই তো নোমানের আজ এ ক্ষতি হতো না।
তানিশা আমানের মুখে পুলিশ অফিসার হওয়ার কথা শুনে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো।কারণ তাকে হুমকি দেওয়া ছেলেটাও তো পুলিশ অফিসার পরিচয় দিয়েছে।তানিশা তখন বললো,ভাইয়া আপনি পুলিশ অফিসার হবেন?

–হবো মানে?ধরে নাও হয়ে গেছি।এবার পরীক্ষা অনেক ভালো হইছে।শুধু রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি।রেজাল্ট বের হলেই এই আমান হয়ে যাবে পুলিশ অফিসার আমান চৌধুরী।
তন্নি তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো,ভাইয়া আপনার এসব বড় বড় গল্প করা এবার বাদ দিবেন।যেদিন হবেন সেইদিন বলিয়েন।এ যাবতে তো অনেক পরীক্ষা দিলেন।
আমান সেই কথা শুনে বললো আগে নিজের চরকায় তেল দে।আমি এবার পুলিশ অফিসার না হলেও সমস্যা নাই,নেক্সট আবার ট্রাই করবো।কিন্তু তোর তো এবারই লাস্ট সুযোগ।মেডিকেলে চান্স না পেলে কিন্তু খবর আছে।বাসার সবাই উঠেপড়ে লাগবে।

আমান আর তন্নি এইভাবে একের পর এক ঝগড়া করতেই আছে।
কিন্তু আমানের পুলিশ হওয়ার কথা শুনে তানিশার মাথা টা যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো।সে কিছুতেই এই হিসাব টা মেলাতে পারছে না।আর সত্যি যদি হুমকি দেওয়া ছেলেটাই আমান হয় তাহলে তিনি কেনো এভাবে তাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইবে?
নাহঃ কি ভাবছি সে।তার ধারণা হয়তো ভুল।এমনও তো পারে সবকিছু কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে।
হঠাৎ তানিশার বাবা মিঃ তহিদুল সাহেব দৌঁড়ে চলে এলেন তানিশার বেডে।তারপর তানিশার মুখ চোখ বুলিয়ে বললেন,মা ভালো আছিস তুই?কি হয়েছিলো তোর?

তানিশা তার বাবাকে দেখে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,ভালো আছি বাবা।কিছুই হয় নি।একটু আঘাত পেয়েছি শুধু।
তহিদুল সাহেব তখন তন্নিকে বললো,মা এসব কি করে হলো?
তন্নি তখন বিস্তারিত ভাবে তহিদুল সাহেব কে সবকিছু খুলে বললো। তহিদুল সাহেব সব কাহিনী শোনার সাথে সাথে বললো,লাগবে না ডাক্তার হওয়া।এই শহরে তোকে আমি একলা একলা কিছুতেই রাখবো না।যদি সন্ত্রাসী রা খারাপ কিছু করতো তাহলে কি হয়ে যেতো?আমরা কোথায় পেতাম তোকে।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, তাই বলে কি ঘরের মধ্যে বসে থাকবো বাবা?
–হ্যাঁ ঘরের মধ্যেই বসে থাকবি।গ্রামের কেউ যদি শোনে তোকে সন্ত্রাসীরা ধরেছিলো তাহলে তো একদম নাক কাটা যাবে আমার।

আমান সেই কথা শুনে বললো, আংকেল কি বলছেন এসব?তানিশা অনেক মেধাবী স্টুডেন্ট আর একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তারও।এভাবে ওর ক্যারিয়ার টা নষ্ট করবেন না।আমরা সবাই আছি তো?আমাদের কে বিশ্বাস করেন না?
তহিদুল সাহেব তখন বললো তোমরা আর কতদিন পাহারা দেবে তাকে।ঢাকা শহরে চেনা পরিচিত কেউ নেই তানিশার।আমার এতোদিন তেমন ভয় লাগে নি।কিন্তু এই ঘটনার পর কিছুতেই মন আমার সায় দিচ্ছে না।
আমান তখন বললো,তাহলে আংকেল আপনারা ঢাকাতে থাকছেন না কেনো?আন্টি আর আপনি থেকে যান এখানে।
তহিদুল সাহেব সেই কথা শুনে বললো,তা কি করে হয় বাবা।একলা মানুষ আমি।শহরে থাকলে গ্রামের জমিজমা গুলো কে দেখবে আমার?তাছাড়া তানিশার বড় বোনের এখন একের পর এক বিয়ের স্বমন্ধ আসতেছে।এই মুহুর্তে শহরে থাকা সম্ভব না আমাদের।

হঠাৎ তায়েব চৌধুরী প্রবেশ করলেন তানিশার রুমে আর বললেন,কেনো সম্ভব নয়?ইচ্ছা থাকলে সবকিছু করা সম্ভব।আপনি যদি কিছু না মনে করেন তাহলে তানিশা আমার বাসা থেকেই কলেজ করতে পারবে।আমার ছোটো ছেলেও তো তানিশার কলেজেই পড়ে।ওরা একসাথে যাবে প্রতিদিন।আর তা না হলে আমার সাথে যাবে।আমিও তো রোজ রোজ আটটায় অফিসে যাই।

তহিদুল সাহেব তায়েব চৌধুরীর কথা শুনে বললো,আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় অনেক বড় মন আপনার।আপনাদের ফ্যামিলির প্রতিটা সদস্যই অনেক ভালো।আমার তানিশাকে যে আপনারা এতো বেশি ভালোবাসেন এই ঘটনা না ঘটলে সত্যি আমি বুঝতে পারতাম না।কিন্তু ক্ষমা করবেন আমাকে তানিশাকে আমি কিছুতেই আপনাদের বাসায় রাখতে পারবো না।নানান লোকে নানা কথা বলবে।তাছাড়া আমারও তো একটা মানসম্মানের ব্যাপার আছে।

তায়েব চৌধুরী তখন তহিদুল সাহেবের হাত ধরে বললো, তানিশাকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখে আসছি।তন্নি আর তানিশাকে কখনোই আমি আলাদা চোখে দেখি নি।আপনি নিশ্চিন্তে আমাদের বাসায় ওকে রাখতে পারেন।আমাদের বাসায় থাকলে ও বরং ভালোই থাকবে।হোস্টেলের সকল মেয়েই কিন্তু ভালো না।এমনও তো হতে পারে এসব ষড়যন্ত্র ওর চেনাজানাই কেউ করছে।সেজন্য আমি চাচ্ছি তানিশা আমাদের বাসা থেকেই ওর পড়াশোনা কম্পিলিট করুক।
তায়েব চৌধুরীর কথা শুনে তাহমিনা চৌধুরীর মাথায় যেনো আকাশ ভেংগে পড়লো।তার ভাই এসব কি বলে।বাসায় দুই দুই টা জোয়ান পোলা।তার মধ্যে এই মেয়েটাকে রাখা কি ঠিক হবে?তাদের তো একটা মানসম্মান আছে।তাছাড়া তানিশা বাসায় থাকলে তন্নি মোটেও পড়তে বসতে চাইবে না।সারাক্ষন শুধু গুজুরগুজুর করবে ওর সাথে।মেয়েটা আমার ভীষণ সহজ সরল।তানিশা ঠিকই তার লক্ষ্য পূরণ করবে মাঝখান থেকে তার মেয়েটা ছিটকে পড়বে।

সেজন্য তাহমিনা চৌধুরী বললো,তোমরা সবাই যেভাবে ভয় পাচ্ছো মনে হয় তানিশা একাই থাকে ঢাকা শহরে।আরে ওর মতো অহঃরহঃ মেয়ে থাকে এই শহরে।পরবর্তী তে একটু সাবধানে চলাফেরা করলেই আর এ বিপদ হবে না।আর তানিশা তুমি হুদাই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়বা না,আমাদের বাসাতেও আসার দরকার নাই।হোস্টেল থেকে সকল মেয়ে এক সাথে বের হবে,আবার কলেজ শেষ করে আবার একসাথে ফিরবে।তাহলেই তো কোনো বিপদ হবে না।

তায়েব চৌধুরী তাহমিনা চৌধুরীর কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন।তিনি তখন তাহমিনা কে বললেন, তুই মাঝখান থেকে নাক গলাস কেনো?তানিশা আমাদের বাসায় থাকলে তোর প্রবলেম টা কোথায়।তন্নি যেটুকু ভালো স্টুডেন্ট হয়েছে তা তানিশার সাথে চলাফেরা করেই হয়েছে।তানিশার সাথে চলাফেরা করে দেখেই পড়াশোনায় সে আজ এতো সিরিয়াস হয়েছে।জানিসই তো সৎ সংগে স্বর্গবাস,অসৎ সংগে স্বর্বনাশ।
তাহমিনা চৌধুরী তায়েব চৌধুরীর কথা শুনে একদম কেঁদেই ফেললো।তার ভাই তানিশাকে এতো বেশি পছন্দ করে।তানিশার জন্য সবার সামনে তাকে এতোগুলো গালমন্দ করলো।

অন্যদিকে তন্নি মনে মনে তো সেই খুশি।তানিশা তাদের সাথে থাকলে সে সবচেয়ে খুশি হতো।কিন্তু তার মা যেভাবে বাঁধা দিচ্ছে তাতে যে কি হয়? তন্নি চুপচাপই থাকলো।কারণ এখানে সে যদি একটা কথা বলে তার মা একদম গলা টিপে মেরে ফেলবে তাকে।

তহিদুল সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।তিনি কি করবেন এখন কিছুই বুঝতে পারছেন না।আবার তানিশাকে একা একা রাখার সাহস ও পাচ্ছেন না তিনি।যদি এক্সিডেন্ট কিছু হয় তখন তিনি মেয়ে পাবেন কোথায়?অন্যদিকে তায়েব চৌধুরী আর তার পরিবার কে তিনি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন।কারন তিনিও অনেকবার গিয়েছেন তায়েব চৌধুরীর বাসায়।তানিশা যখন তন্নির সাথে একসাথে কোচিং করেছে তখন প্রথম কয়েকদিন তিনি তায়েব চৌধুরীর বাসাতেই ছিলেন।তাছাড়া ঢাকাতে তানিশাকে দেখতে এলেও তিনি মাঝেমধ্যেই ওদের বাসায় গিয়ে থাকতেন।সেজন্য তায়েব চৌধুরীর সাথে তার সম্পর্ক টা মোটামুটি ভালোই।

তায়েব চৌধুরী তহিদুল সাহেব কে চুপচাপ থাকা দেখে বললেন,এতো কিসের চিন্তা করছেন আপনি?যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে নিয়েন।যে কয়দিন তানিশা সুস্থ হয় নি অন্তত সে কয়দিন তো আমাদের বাসায় থাকতে পারে।আর আপনিও এ কয় দিন থাকবেন তানিশার সাথে।তানিশা সুস্থ হলে তবেই গ্রামে ফিরে যাবেন।
তহিদুল সাহেব হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না।কারণ তিনি ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন।না করলে তায়েব চৌধুরী ভীষণ মন খারাপ করবেন,আবার হ্যাঁ করলে তার মানসম্মান নিয়ে লোকে কথা বলবে।
নোমান আর তানিশা দুইজনই মোটামুটি সুস্থ হয়েছে।সেজন্য দুজনকেই বাসায় নিয়ে গেলো তায়েব চৌধুরী। নোমান সেই আগের মতোই চুপচাপ আর নিচ মুখ হয়ে থাকলো।এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরও সে এ বিষয়ে তানিশার সাথে একটি কথাও বললো না।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৫

কিন্তু তানিশা নোমানের প্রতি অনেকটাই দূর্বল হয়ে গেছে।নোমান নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কি করে তাকে বাঁচাতে এলো।সে তো ইচ্ছে করলে মানুষ জন জড়ো করে তবেই তাকে বাঁচাতে আসতে পারতো।কিন্তু নোমান সেরকম কিছু না করে তার বিপদ আছে জেনেও তানিশাকে বাঁচাতে এসেছিলো।ছেলে গুলোর সাথে কিভাবে মোকাবিলা করছিলো!
নোমান যখন প্রতিটা ছেলেকে ঘুষি দিচ্ছিলো তানিশার মনে হয়েছে সেই ছেলেগুলোর মনে হয় সেই জায়গার হাড় একদম ভেংগে গেছে।তানিশার শুধু বার বার সেই দৃশ্যই চোখের সামনে ভাসছে।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৭