শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১০

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১০
নূরজাহান আক্তার আলো

হঠাৎ চৌধুরী বাড়ির মূল ফটকে পুলিশের গাড়ি দেখে স্বর্ণ, শখ, সাম্য, সৃজন দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের চোখে-মুখে বিষ্ময়। শুধু শখের চোখ বাঁধা থাকায় সে হাত বাড়িয়ে খুঁজে যাচ্ছে দুষ্টু ভাই-বোনদের৷ পুলিশ দেখামাত্র শীতল চট জলদি শখের চোখের বাঁধন খুলে বিষ্ময়ঝরা কন্ঠে বলল, ‘এই আপু ওই দেখ পুলিশ!’
শীতলের কথা শুনে শখ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যিই চৌধুরী নিবাসের মূল ফটক পেরিয়ে পুলিশের গাড়ি থেমেছে। কয়েকজন পুলিশ ধপাধপ পা ফেলে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাদের পরখ করে নেইমপ্লেটে লেখা ইনসান নামের পুলিশটি অত্যান্ত রুক্ষকন্ঠে বলল,

-‘ইউ আর আন্ডার এরেস্ট সুবর্ণ চৌধুরী স্বর্ণ।’
উনার কথা শুনে ভাই-বোনের বিষ্ময়ের মাত্রা চূড়ান্ত লেভেল পার করল।
তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কি বলবে খৈই হারিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ সায়ন রাজনীতি করলেও পুলিশ কখনো চৌধুরী নিবাসে প্রবেশ করে নি। আর না পুলিশের জেরায় পড়তে হয়েছে তাদের। অথচ স্বর্ণ কি এমন করেছে যে পুলিশ এসেছে চৌধুরী বাড়িতে?
পুলিশের কথার শুনেও স্বর্ণের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা দিলো না। সে আপনমনে পেয়ারা চিবাতে ব্যস্ত। ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে সে জানত এমন কিছুই হবে। তাকে ভাবলেসহীন দেখে ইনসান নামের পুলিশটি ত্যাছড়া হেসে বলল,

-‘চলুন, তাহলে যাওয়া যাক?’
-‘কোথায় যাব?’
-‘আপনাকে শাশুড়বাড়ি নিয়ে যেতে আমরা আসব না নিশ্চয়ই?’
-‘আশাও করি নি।’
-‘কথা বাড়াবেন না, চলুন।’
-‘আগে প্রমাণ করুণ আমি অপরাধী তারপর যাব।’
একথা বলে স্বর্ণ ঘাসের উপর বসল। হাতের আধখাওয়া পেয়ারার দিকে তাকিয়ে বিরক্তমুখে শীতলকে বলল,
-‘কি পেরেছিস এটা? এত কস্টা কেন?’
শীতল জবাব দিলো না। হতবাক হয়ে একবার তাকাচ্ছে পুলিশের দিকে একবার স্বর্ণের দিকে। পুলিশ ওকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে অথচ এ মেয়ে পুলিশকে দাঁড় করিয়ে রেখে পেয়ারার ভালো-মন্দ বিচার করছে। স্বর্ণের মতিগতি দেখে ইনসানের বিরক্তের মাত্রা বাড়ল। একেতো
সারাদিন বিশ্রামের সুযোগ পায় নি। মেজাজও চটে আছে। এখন আবার এই মেয়ে নখরা শুরু করেছে। মন তো চাচ্ছে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে। কিন্তু আদেশ আছে এই মেয়ে চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। তাকে যেন
বিন্দুমাত্র অসন্মান করা না হয়। তার উপরে সে নাকি মেজরের মেয়ে।
ইনসান বিরক্তের মাত্রা চেপে পুনরায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ দে দে.খুন..
-‘ইচ্ছে করছে না।’
-‘কি? কি ইচ্ছে করছে না?’
-‘যা দেখাতে চাচ্ছেন সেটা দেখতে।’
স্বর্ণের কথা আর পুলিশের মুখে দেখে শখ মুখ টিপে হাসল। এই পুলিশটা যে রাগ চেপে ভদ্রতা দেখাচ্ছে সেটা তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। এদিকে বাড়ির পেছন দিকে পুঁইশাকের লতা বেড়ে ওঠার তিন জা মাচা করে পুনরায় বাগানের দিকে এসে পুলিশের গাড়ি দেখে অবাক হলেন। তিনজনই দ্রুতপায়ে এগিয়েও গেলেন। স্বর্ণের মুখের সামনে হ্যানকাপ ঝুলিয়ে তাকে এরেস্ট করার কথা বলায় সিঁতারা চৌধুরীর বললেন,
-‘ওর অপরাধ? ‘

হঠাৎ মহিলা কন্ঠ শুনে তারা পেছনে তাকিয়ে তিনজন মহিলাকে দেখে বুঝল উনারা চৌধুরীদের সহধর্মিণী। পরনের পোশাকেও আভিজাত্যের ছাপ। ইনসান উনাদেরকে যথেষ্ট সন্মান দেখিয়ে জবাব দিলো,
-‘উনি গতকাল দুপুরে সন্মানিত এক ব্যাক্তিকে থাপ্পড় মেরেছে। যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে। সেই ভদ্রলোক আজ মানহানির কেস ফাইল করেছে। ‘
কাকে থাপ্পড় মেরেছে স্বর্ণ? কে সেই লোক? কেনই বা মেরেছে? সিঁতারা
এসব জিজ্ঞাসা করার আগেই ফোনের টোন বেজে উঠল। শুদ্ধর নাম্বার দেখে উনি কল রিসিভ করতেই শুদ্ধ বলল,
-‘ পুলিশকে ফোনটা দাও কথা বলি।’
সিঁতারা চৌধুরী ছেলের কথা শুনে ফোন ইনসানের দিকে বাড়িয়ে দিলে ইনসান ফোনটা নিয়ে কানে ঠেঁকাল। শুদ্ধর বলা কোনো কথা শোনা না গেলেও পুলিশের মুখভঙ্গি থমথমে হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে শুদ্ধর কথা শুনে গেল। তারপর ফোন ফিরিয়ে দিয়ে সেভাবে এসেছিল তারা সেভাবেই চলে গেল। না বাড়তি কথা বলল আর না কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো। পুলিশকে চলে যেতে দেখে সবাই স্বর্ণকে ঘিরে ধরল ঠিকই কিন্তু কিছু বলার আগেই দ্রুত গতিতে সায়নের গাড়ি ঢুকল।

সায়ন গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটবলে বাগানে এসে দাঁড়াল। ভাই-বোন এবং মা-চাচীদের দেখে গম্ভীরতাকে মুছে ফেলে ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
-‘এই তোরা পেয়ারা কোথায় পেলি? আমাকেও দে দেখি একটা চিবায়।’
শীতল সায়নের কাছে থেকে আগেই সরে বসল। তারপর তার আধখানা পেয়ারার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে দাঁত বের করে হেসে বলল,
-‘আমার পেয়ারা খুব টক শখ আপুরটা নাও।
অতঃপর পেয়ারা কাড়াকাড়ি করতে লেগে গেল সায়ন। সিঁতারা চৌধুরী বার বার মূলত ঘটনা জানতে চাইলেও একথা ওকথা বলে এড়িয়ে গেল। ছেলের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে উনারা ধরে নিলেন গুরুতর কিছু নয়। গুরুতর কিছু হলে সায়ন নিশ্চয়ই দাঁত বের করে হাসত না। স্বর্ণ সায়নের চালাকি বুঝেও কিছু বলল না। ভাই-বোনদের দুষ্টু মিষ্টি খুনশুটিতে মেইন টপিকটা আপাতত চাপা পড়ে গেল।

রাত তখন কয়টা হবে, এই একটার কাছাকাছি বোধহয়। নির্জন রাস্তায় এক টগবগে যুবককে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে রেখেছে কয়েকজন ছেলে।
শোয়ানো ছেলেটার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। চোখে ভয়। গোঁ গোঁ শব্দে বাঁচার আকুতি ছেলেটার চোখে-মুখে। কিছুক্ষণ আগেও দাপট দেখিয়ে মা-মাসি তুলে বি’শ্রী বি’শ্রী গালি ছুঁড়েছে। একজনকে ঘুষি মেরে রক্তাক্ত করেছে। এখন নিজেই বাঁচার ভয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে। এজন্যই বোধহয় প্রবাদে প্রচলিত, পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইকে করে সায়ন উপস্থিত হলো। পরনে থ্রি কোয়াটার কালো প্যান্ট ও সাদা টি-শার্ট। সে শিষ বাজাতে বাজাতে বাইক স্ট্যান্ড করে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে তাদের কাছে এসে থামল। চারদিকে অন্ধকার।
এদিকে রাতের বেলায় গাড়ি ঘোড়া আসে না বিধায় জায়গাটা সুনশান।
সায়ন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে ছেলেদের তাড়া দিয়ে ধারালো ছুরি তুলে নিলো। ছুরিটা উল্টো পাল্টে দেখে ধার পরখ করে নিলো। সব ঠিকঠাক দেখে সন্তুষ্টির সুরে বলল,

-‘ভালোই ধার আছে। আমার এনার্জি কম লস হবে।’
সায়নের ইশারা পেয়ে ছেলেগুলো ওই ছেলেটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরতেই সায়ন ছেলেটার গাল ধরে শান্ত কন্ঠে বলল,
-‘আমার বাড়ির মেয়ের রেট জানতে চেয়েছিলি শুনলাম। কাজটা ভালো করিস নি। এসব পাগলামি কেউ করে রে পাগলা?’
-‘উম, উম।’
-‘এই ওর মুখটা খুলে দে মরার আগে কি বলে শুনি।’
নান্নু নামের একটা ছেলে ওই ছেলেটার মুখ খুলে দিতেই ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ভাই, ভাই আর করব না ভাই, মাফ করে দেন ভাই।’
-‘ভাই না,বাপ ডাকলেও ছাড় পাবি না তুই। তোর মরার টিকেট অলরেডি কনফার্ম হয়ে গেছে।’
-‘আমি আপনার বোনের পা ধরে মাফ চাইব ভাই। আমার অপরাধ আমি স্বীকার করব। শু..শুধু এবারের মতো জান ভিক্ষা দেন ভাই।’

-‘মাফ করতাম যদি তোর নোং’রা কথা শুনে আমার বোনটা না কাঁদত।
মাফ করতাম যদি আমার মাকে নিয়ে গালি না দিতি, মাফ করতাম যদি আমার বোনকে তুলে আনার জন্য ভুয়া পুলিশ না পাঠাতি। কি ভেবেছিস পুলিশের পোশাকে গেলে আমরা আমাদের বোনকে তোদের হাতে তুলে দিতাম? আর তোরা আমার আদরের বোনকে খুবলে খুবলে খাবি। এত সোজা? নারে, শুয়োরের বাচ্চা, না। চৌধুরী নিবাসের মেয়েদের গায়ে কলঙ্ক লেপ্টানো এত সোজা না! গু খেয়ে রাজনীতির মাঠে নামি নি রে।’
একথা বলে সায়ন ছুরি দিয়ে ছেলেটার গলায় আকিঁবুকিঁ করতে করতে
ফিসফিস করে বলতে শুরু করল,

-‘তোকে একটা সিক্রেট বলি শোন। আমরা দু’ভাই, আমি সায়ন, আমার ভাই শুদ্ধ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের কোনো মিল নেই। না দেখতে আর না স্বভাবে। যা আছে সবই অমিল। আমরা দু’জন দুই মেরুর মানুষ। আমাদের রক্ত যেহেতু এক, এক বাবা-মায়ের সন্তান, যদি কিছু মিল না থাকে রক্তের বদনাম হয়ে যাবে। তাই কষ্টে সৃষ্টে একটা মিল খুঁজে বের করেছি আমরা। সেটা কি জানিস? আমরা দু’জনেই হাইড এ্যান্ড সিক খেলতে এবং খেলাতে ভালো পারি। দক্ষ প্লেয়ার বলতে পারিস।’
এইটুকু বলতে সায়ন থামল। একা একা ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর নক্ষত্র ভরা আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে এদিক-ওদিকে করে ঘাড় ফুটাল। তারপর পুনরায় বলল,
-‘আমি ভালোর মুখোশ পরে সবার কাছে ভালো হয়ে চলার চেষ্টা করি। তবে রেগে গেলে অন্য অন্যকথা। আর শুদ্ধর ভেতরেও যা বাইরেও তা।

ও এমন এক ছেলে নিজের বাপ/ ভাইয়ের পেছনে বাঁশ দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘ব্যথা পেলে নাকি?’ তাহলে একবার ভাব সে কতটা ক্রেজি। আমি তোকে ছেড়ে দিলেও শুদ্ধর হাতে পড়তে হবে। ওর হাতে পড়লে সহজে মারবে না। তবে তোর বলিষ্ঠ দেহখানা রিসার্চের কাজে লাগাবে। আমার ভাই অপছন্দের কাউকে ধীরে ধীরে মারতে পছন্দ করে। আর ধীরে ধীরে মরলে কষ্ট হবে বেশি। এরচেয়ে আমার হাতে মরে যা, কথা দিচ্ছি, আমি কম কষ্টে মারব তোকে।’
একথা বলে সায়ন ছেলেটাকে কিছু বলার আগেই গলায় ছুড়ি চালিয়ে দিলো। পাক্কা হাত, একটুও কাঁপল না। ধারালো ছুরিতে এবড়োখেবড়োও হলো না। ঠিক যেভাবে কুরবানির পশুকে জবাই করা হয় ঠিক সেভাবেই জবাব করল সায়ন। তার পরনের জামা কাপড় লাল রক্তে রঞ্জিত। চোখ মুখে উচ্ছ্বাস। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। ছেলেটার গলা দেহের সঙ্গে খানিকটা
লাগিয়ে রেখে সায়ন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ছেলেটা পিচ ঢালা রাস্তায় ধরফড় করছে। গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে। গলার ফাঁক গলিয়ে গলগল করে রক্তের স্রোত বইছে। কয়েক মিনিট ছেলেটা কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে একটা সময় থেমে গেল। চোখ খোলা রাখা অবস্থায় তার প্রাণপাখি দেহ ত্যাগ করল। সায়ন পরনের টি-শার্টের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। রক্ত মাখা হাতে টি-শার্টটা ঝেড়ে ঝুড়ে মুখে বলল,

-‘ধুর বাল, জা’নো’য়া’রে’র র’ক্তে শীতলের দেওয়া সাধের টি-শার্টটাই নষ্ট করে ফেললাম।’
একথা বলে মুখে বিরক্তিকর শব্দ করে নান্নুর হাতে ছুরিটা দিয়ে বাইকে চেপে বসল। উপস্থিত ছেলেপুলেরাই লা’শ গায়েব করতে ওস্তাদ।আলাদা করে কিছু বলতে হবে না তাদের। তবে রাজনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের
একমাত্র ছেলে অংকনকে মনমতো শাস্তি দিতে পেরে মেজাজ ফুরফুরে। খুব শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা এত রঙিন কেন? সুন্দর কেন?
সে নির্জন রাস্তায় বাইকের গতি স্বাভাবিক রেখে শিষ বাজাতে বাজাতে প্রফুল্ল সুরে গান ধরল,
কাছে আইসো, আইসো রে, বন্ধু, প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো, বাইসো রে, বন্ধু, আমায় যতন! ‘

পরেরদিন সকালে, বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে কেবলই এসে বসেছে শুদ্ধ।
ডায়নিং টেবিলের চেয়ারে বসে তিনবোন গুজরগুজর করছে। আজকে সরকারী ছুটি বিধায় সবাই বাসাতেই আছে। শুদ্ধ সোফায় বসে সামনের সেন্টার টেবিলে থাকা এসির রিমোট নিয়ে এসি অন করল। গরমে জান যায় যায়। সে এখনো তাকে খেয়াল করি নি হয়তো। কাউকে ডেকে পানি চাইলেও শুনতে পাবে না। কারণ সাম্য সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে গান ছেড়েছে। যেন এটা বিয়ে বাড়ি। হঠাৎ মায়ের বকুনিতে সে গান বন্ধ করে ফুটবল খেলতে চলে গেল বাগানে। সৃজনও সেখানেই আছে। গান থামায় সকলের কান মাথা যেন বাঁচল। এইদিকে শীতল, শখ, স্বর্ণকে লাল শাক বাছতে দিয়ে গেছেন সিরাত। তিনজন বাছতে বাছতে গল্প করছে। হঠাৎ কি ভেবে শীতল রান্নাঘরে থাকা সিঁতারা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

-‘ওহ বড় মা শুদ্ধ ভাইয়ের বিয়ে দিবে না?’
-‘দিবো। ভালো মেয়ের সন্ধান পেলে খোঁজ দিস।’
-‘ খোঁজ আছে। কিন্তু তোমার ছেলের বউ টিকবে না বিয়ে দিয়ে আর কি করবা? বরং ভাইয়ার বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে, অহেতুক টাকা-পয়সা খরচ না করে ওই টাকাগুলো আমাকে দাও ট্যূর থেকে ঘুরে আসি।’
শীতলের কথা শুনে সিমিন এবার খ্যাক করে উঠে ধমকে বললেন,
-‘এ আবার কেমন কথা? বড় ভাইকে নিয়ে এভাবে কথা বলে? দিন দিন বে’য়া’দ’বের ধাড়ি হচ্ছে একদম।’
-‘আম্মু, পুরো কথা না শুনে শুধু শুধু বকবে না। শুদ্ধ ভাইয়ের বউ টিকবে না কারণ শুদ্ধ ভাইয়ের সমস্যা আছে।’
এবার সিঁতারা, সিরাত, সিমিন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এ মেয়ে সমস্যা বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে? উনারা যা ভাবছেন তাই?

তারমানে সমস্যার কারণে শুদ্ধ, সায়ন বিয়ে করতে রাজি হয় না?সমস্যা থাকতেও পারে তাই বলে দু’জনেরই? এ আবার কেমন কথা? কই আগে কখনো শুনেন নি তো। শীতল চঞ্চল, কিন্তু সে না জেনেশুনে আন্দাজে কথার বলারও মেয়ে না। তাও আবার শুদ্ধকে নিয়ে। কারণ শুদ্ধকে নিয়ে ভুল বকলেই তার কপালে মাইর নিশ্চিত। তাই তার কথায় গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন উনারা। অতঃপর তিন জা নিজেরা গুজগুজ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শীতলের কাছে এসে বললেন,

-‘হ্যারে মা তুই জানলি কিভাবে শুদ্ধর সমস্যা আছে?’
-‘সকাল থেকে ডান হাত লুকাচ্ছে টাকা আসবে বোধহয়।’
-‘আচ্ছা টাকা দেবো, এখন বল।’
-‘ভাইয়ার বন্ধুরাই বলাবলি করছিল। ভাইয়াও ছিল। উনি নিজেও স্বীকার
করেছেন। আমি সায়ন ভাইয়ার রুমে যাওয়ার সময় উনাদের বলা কথা শুনতে পেয়েছিলাম।’
শীতলের কথা শুনে সিঁতারার চিন্তা দ্বিগুন বেড়ে গেল। এই তাহলে বিয়ে না করার মূল কারণ? এর সমাধানই পাবেন কিভাবে? না, না, জেনেশুনে
এসব নিয়ে বসে থাকা যাবে না আজকেই শারাফাত চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে ওই দুই গাধাকে মারতে মারতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এগুলো চেপে থাকার জিনিস?চেপে রাখলে কী সমাধা হবে? বাবা মায়ের কাছে এত কিসের লজ্জা? না, না, এতদিন জানতেন বিধায় ছেলেদের নানান অজুহাত মেনে নিয়েছেন।আজ যেহেতু জেনেই নিলেন আর বসে থাকবেন না।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৯

এদিকে সোফায় বসা শুদ্ধর ফোন স্কল করা আঙুলটা থেমে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের চিন্তিত মুখের দিকে। ওদের বলা কথাবার্তা ও চিন্তাধারা দেখে শুদ্ধ একবার নিজের শরীরের দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে বলল,
-‘কি আশ্চর্য! সমস্যা আমার আমিই কিছু জানি না অথচ বাড়িসুদ্ধ সবাই জেনে বসে আছে।’
বিরবির করে একথা বলে সে পুনরায় ফোন স্কল করতে করতে হাঁক ছাড়ল,
-‘শীতল! বাগান থেকে একটা চ্যালাকাঠ এনে দে তো। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে কাউকে ইচ্ছে মতো পিটায়।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১১