শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৭
নূরজাহান আক্তার আলো
-‘চটি খুলে, পদধূলি ঝেড়ে, হাগা-মুতা সেরে পাশের রুমে বসুন। একটু পরে মেডাম এলে, গলা ঝেড়ে, খানিকটা কেশে, নিজের সমস্যার কথাটা জানাবেন। আলোচনা চলাকালীন কৌষ্ঠকাঠিন্য রোগীর মতো কুঁতকুঁত
করবেন না। চুলকাচুলকি, মুচড়ামুচড়ি মেডাম একদমই পছন্দ করে না,
তাই এসব থেকে নিজেকে সংযত করবেন, ধন্যবাদ।’
অপরিচিত কারো কথা শুনে দরজামুখো দাঁড়ানো লোকটি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথম পরিচয়ে কেউ কাউকে এভাবে বলতে পারে? তাও আবার এমন ধরনের কথা? উনার বিষ্ময়মাখা মুখ দেখে নাদিমের মধ্যে দেলদোল দেখা দিলো না। সে সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করে। অপ্রিয় কথা মুখের উপর চটাস করে বলার কারণে তার বাবা মা’ও তাকে গা’লি দেয়। কিন্তু অভ্যাস ছাড়তে পারে না। সে শতরুপা চৌধুরীর এসিস্ট্যান্ট
হিসেবে নিয়োজিত পাঁচ বছর। পাঁচ বছরে কেসের সুবিধার্থে সে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছে।ভালো মানুষের যেমন দেখা পেয়েছে তেমনি গুঁটি কয়েক ছ্যাঁচড়াও কপালে জুটে/জুটেছে। প্রায়ই অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে চেম্বারে এসে অন্যের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। যেন মাছের বাজার।
কার বাপের কত বিঘা সম্পত্তি ছিল, বর্তমানে কত আছে, কার ভাতিজা ডাক্তার, কোন মহিলা ননদের স্বামীর সঙ্গে ভেগে গেছে এসব গল্প জুড়ে বসে। এরপর মেডাম একে একে ডেকে কেসের ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে তখন কথার মাঝখানে বলে বসে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘মেডাম, বলছিলাম যে ওয়াশরুমটা কোনদিকে?’
সিরিয়াস কথার মধ্যে এই কথা শুনে বিরক্তির মাত্রা তরতর করে বেড়ে যায়। এমনিতেই শতরুপা চৌধুরী সময় সচেতন মানুষ। বাড়তি কথা বলা পছন্দ করেন না উনি। উনার মতে, বাড়তি কথা কাজকর্মে ঢিলেমি করে বেশি। ওয়াশরুমের চক্করে দশ মিনিটের কথাতে যদি পঁচিশ মিনিট খরচ হয়ে তাহলে কিভাবে হবে? এজন্যই কেউ এলে মুখের উপরে এসব বলে
সচেতন করে দেয়। যাতে হাঁট না বসিয়ে পারসোনাল কাজটা সেরে নেয়।
এতে সময়ও বাঁচে আলাপও দ্রুত হয়। অকপটে বলা কথা শুনে লোকটা আমতা আমতা করছে। নাহিদ দরজা থেকে সরে শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল,
-‘ওই যে ওইদিকে ওয়াশরুম।’
মধ্যবয়সী লোকটা সেদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে মিনমিন করে বললেন,
-‘শতরুপা মেডাম কখন আসবে?’
-‘সময় মতো চলে আসবে। আপনি কাজ সেরে বসুন।’
-‘ঠিক আছে।’
অতঃপর তিনি ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসলেন। নাদিমও তার টেবিলে কাজ করতে বসল। সামনে অনেক ফাইল রাখা এই কেসগুলোর
সারমর্ম শতরুপাকে চৌধুরী জানাতে হবে। তথ্য কালেক্ট করতে হবে। এর
আবার আলাদা ফাইল তৈরি করতে হবে। গতকাল রাত থেকে যে ফাইল ধরেছে সব ক’টাই পরকিয়া কেস। পরকিয়ার প্যাঁচে পড়ে ডিভোর্সও যেন দুধভাত।
নাহিদ টাইপ করতে করতে মধ্যবয়সী লোকটার দিকে একবার তাকাল।
দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র গোছের ভদ্র মানুষ। বাকিদের মতো ফিসফাঁস না করে চুপটি করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর ভাবনায় বিভোর।
নাহিদ কি মনে করে হাতের কাজ থামিয়ে উনাকে ডাকল। ডাকটা শুনে উনি ভদ্রতা বজায় রেখে নাহিদের সামনের চেয়ারে বসল। নাহিদ হাঁক ছেড়ে কদর নামে একটা ছেলেকে ডেকে দু’কাপ চা দিতে বলে উনাকে বলল,
-‘কোথা থেকে এসেছেন?’
-‘মাদানীপুর থেকে।’
-‘অনেক দূর।’
-‘হুম। গতকাল রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে এখন পৌঁছালাম। আসলে বাবা, ধৈর্য্যে আর কুলায় না বলেই আসতে বাধ্য হয়েছি।’
-‘কেন, কি সমস্যা?’
-‘মেয়ে জামাই খুব অত্যাচার করে। কথায় কথায় আমার গায়ে গা তুলে।
আমার জায়গা জমি তার নামে লিখে দিতে বলে। মেয়ে প্রতিবাদ করায় পরশুদিন সে আমার গিন্নির হাতে পুঁড়িয়ে দিয়েছে।’
-‘আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন কাকা? ওই গোলামের পুতের নামে কেস করছিলেন?’
-‘একটাই মেয়ে আমার। সঙ্গ দোষে পালিয়ে বিয়ে করছিল। গিয়ে দেখে
ছেলের ঘরবাড়ি কিছু নাই, ছেলে বস্তির টোকাই। বস্তিতে এক আত্নীয়ের বাসায় থাকে। পরে সবকিছু জানাজানির পর আমার বাড়িতে উঠেছিল।
আমারও একটাই আদরের মাইয়া। কষ্ট দেখতে না পেরে আমিও সুযোগ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ছেলের মতো তাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াব। কাজ যোগাড় করে দেবো। সরল মনে এসব ভেবে ঘরে তুলছিলাম এখন মেয়ে জামাই আমাকেই বাড়ি ছাড়তে বলে। দুঃব্যবহার করে।
-‘আপনি কি করেন কাকা? নাম কি আপনার?’
-‘আমার নাম খালেক বেপারি। আমি বেসরকারি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। গতবছর অবসর নিয়েছি।’
-‘ওহ, তা এখন কি করতে চাচ্ছেন?’
-‘আমাকে সায়ন বাবা পাঠিয়েছে। মেডামের সঙ্গে নাকি কথাও হয়েছে। এখন মেডাম আমাকে যা বলবে, যেভাবে বলবে, আমি সেভাবেই ব্যবস্থা নিবো।’
-‘কোন সায়ন? মেডামে বড় ভাইয়ের ছেলে শাহরিয়রায় চৌধুরী সায়ন?’
-‘জি।’
উনাদের এই কথোপকথের মাঝেই গাড়ির হর্ণ শোনা গেল। শতরুপা চলে এসেছে দেখে নাহিদ বের হলো। সে বিনয়ীভাবে সালাম দেওয়ার আগেই বাইরে অনেক মানুষের কথা শুনতে পেল। দু’একটা বাংলা গালিও কানে
এসে বিঁধলো। শতরুপা নিজের চেম্বারে চলে গেলে নাহিদ কৌতুহলবশত মূল ফটকের দিকে তাকাল। ইশারায় দারোয়ানের থেকে জানতে চাইল, ঘটনা কি। দারোয়ান জানাল, এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে মাছের নাড়িভুঁড়ি, গোবর, পঁচা ডিম ছুঁড়ে মারে। এসবের কারণ ওই বাড়ির দুই বুড়ি দু’জন দু’জনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এরপর হয়েছে জা।
কোনো কিছু নিয়ে ঠুকাঠুকি হলেই তারা একে অপরের বাড়িতে ন্যাস্টি জিনিসপত্র ছুঁড়াছুঁড়ি করে। আবার কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেও পারে না। তাদের ঝগড়া দেখে ঝগড়া থামাতে গেলেও রেগে যায় তারা। একথা শুনে নাহিদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মনে মনে দোয়া করল এমন ঠ্যাঙ্গামারা বন্ধুত্বগুলো আজীবন বেঁচে থাক।
দুপুরের পর শীতল ঘুম থেকে উঠেছে। ক্ষুধার চোটে এখন চোখে ঝাপসা দেখছে। কোনোমতে গোসল সেরে দৌড়ে নিচে নেমেছে সে। কোনো কথা
না বলে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে ঝটপট খেতে বসল। প্রথম লোকমা
মুখে পুরে চিবাতেই বাইরে থেকে শুদ্ধ এলো। লাটসাহেব বসলও সিঙ্গেল
সোফায়। বড় মা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে ঢকঢক করে গিলে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। যেন যুদ্ধ জয় করে কেবল ফিরেছে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা ব্যাগ খুলতে খুলতে সিঁতারা চৌধুরী শুধালেন,
-‘ সব এনেছিস বাপ, বাদ পড়ে নি তো কিছু?
-‘দেখো আগে। কিছু বাদ পড়লে জানাও এনে দেওয়া যাবে।’
-‘ওরা কখন আসবে জানিয়ে কিছু?’
-‘সন্ধ্যার পরপরই চলে আসবে।’
-‘আচ্ছা।’
এভাবে তিন গিন্নি আর শুদ্ধর মধ্যে টুকটাক কথাবর্তা চলছিল।শারাফাত ও সাফওয়ান চৌধুরী অফিসে। সাম্য, সৃজনকে দুপুরে খাইয়ে জোর করে ঘুম পাড়িয়েছে সিরাত। তখন সিমিন আর শখকে নামতে দেখা গেল। কি নিয়ে কথা বলতে বলতে নামছে তারা।সিমিন শখকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে পা
রাখতেই শুদ্ধ শখকে বসতে ইশারা করল। শখ মা-চাচীদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে সুস্থে বসল। তবে মুখ চুপসে আছে তার। বুঝতে
বাকি রইল শুদ্ধ সিরিয়াস কিছু বলবে তাকে। জরুরি কিছু বলার থাকলে সে এভাবে ডেকে পাঠাল। আবারও বিয়ের ঝামেলায় পড়তে হবে কি না ভেবে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে তার। তখন শুদ্ধ বলল,
-‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
-‘ভালো।’
-‘আমি বারবার এক কথা জিজ্ঞাসা করব না। তবে এখন যা জানতে চাই আশা করি সরাসরি জবাব দিবি।’
-‘হুম।’
-‘কাউকে পছন্দ করিস?’
-‘ আমি পড়াশোনা করতে চাই ভাইয়া। বিয়ে করব ন…!’
-‘ এটা কি আমার প্রশ্নের আনসার হলো?’
-‘না।’
-‘কি না?’
-‘পছন্দ নেই।’
-‘ভেবে বললি? পরে অন্য গান গাইতে যেন না শুনি। এখনো সময় আছে ভেবে জানা।’
-‘ তেমন কেউ নেই।’
-‘সন্ধ্যার পর গেস্ট আসবে রেডি থাকিস। এনজেগমেন্ট করা থাক। দেড় বছর পর আহনাফ ফিরলে বিয়ে সম্পূর্ন করা হবে।’
আহনাফের কথা শুনে শখ দৃষ্টি তুলে এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকাল।
কিন্তু এখন বিয়ে করতে চায় না সে। বিয়ের পর বেশির ভাগ মেয়ের স্বপ্ন জলাঞ্জলী দিতে হয়। ছোটো থেকে তার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া, এতদিন সে সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছে। এমনকি এক ছেলে পেছনে থাকায় সে মিথ্যা কথা বলেছিল যে, তার বফ আছে। শীতলের সামনে কথাটা বলায়
বাড়ির সবার কাছে সেকথা পৌঁছে গেছে। সবাই ভাবে তার পছন্দ আছে। কিন্ত তেমন কিছু না। এ অবধি অনেক ছেলে তাকে প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু কেন জানি কারো প্রতি অনুভূতি জাগে নি। মনে হয় নি মানুষটা একান্তই নিজের মানুষ। আরাধনার মানুষ। শখ আর একটা কথাও বলল না চুপ করে বসে রইল। তখন সিরাত তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-‘ ছেলেটা খুব ভালো। আমাদের সবার বেশ পছন্দ। তোরা খুব ভালো থাকবি। মোটকথা, তোরা পড়াশোনা নিয়েও আহনাফ কিংবা তার পরিবারের কারো কোনো সমস্যা নেই। বরং তুই চাইলে তোকে বাইরের দেশ থেকে ডাক্তারী পড়া কমপ্লিট করাবে।’
-‘বড় ভাইয়া বাসায় আসে নি?’
-‘না, তবে আহনাফ নাকি সায়নের কাছে আগে প্রস্তাব দিয়েছিল। সায়ন
তোর বাবাকে জানিয়েছে। তোর বাবা ছেলে ও তার পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছে। শুদ্ধও চিনে। সেও বলেছে ছেলেটা অমায়িক। তারপর আহানাফের বাবা একদিন তোর বাবার অফিসে গিয়ে আবার’ও প্রস্তাব রাখে। আহনাফ নাকি আবার চলে যাবে। যাওয়ার আগে কিছু করে যেতে চায়। তারপর ভেবেচিন্তে দুই পরিবার এনগেগেজমেন্ট করিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।’
এভাবে টুকটাক কথা হচ্ছিল শখকে নিয়ে। রোজই হয় তাই সেদিকে না তাকিয়ে শীতল খাওয়াতে মন দিয়েছে। পছন্দের ডিশ পেয়ে অন্যদিকে তাকানোর সময় নেই। কিন্তু আহনাফ নামটা কর্নকুহুরে পৌঁছাতেই মাথা তুলে তাকাল। এনগেজমেন্টের কথা শুনে খাবারের প্লেট নিয়ে গেল সবার কাছে। শুদ্ধর পাশের সোফায় ধপ করে বসে গদগদ হয়ে বলল,
-‘আপু, তোমাদের দু’জনকে যা লাগবে না। পুরাই রাজযোটক।’
শখ লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে বাহানা দেখিয়ে উঠে গেল। ব্যাগ হাতে সিঁতারা, সিরাত গেলেন রান্নাঘরের দিকে। শুদ্ধ ফোন স্কল করছে দেখে শীতল বলল,
-‘ভাইয়া? বাজারে গিয়েছিলেন?’
-‘হুম।’
-‘আমার জন্য রসমলাই এনেছেন?’
-‘না।’
-‘কেন? জানেন না আমি রসমালাই কত পছন্দ করি।’
-‘ তা জেনে আমি কি করব? তোকে দেখতে আসছে যে ঘটা করে তোর জন্য হাজিবাজি আনতে হবে?’
-‘ এক বোনের জন্য আরেক বোনকে অবহেলা করতে পারেন না। এটা অন্যায়। আমাকে রসমালাই এনে দিন।’
-‘আমি তোর বাপের চাকর? তোকে রোজ রসমালাই গেলানোর জন্য আমাকে টাকা দেয় তোর বড় আব্বু? নাকি তুই আমার মালকিন যে যা বলবি আমাকে তাই শুনতে হবে?’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৬
-‘কোনোটাই না।’
-‘তাহলে ভাগ এখান থেকে।’
একথা শুনে শীতল মুখ ভোঁতা করে সেখান থেকে উঠে রান্নাঘরে গেল। গেস্টদের জন্য কয়েক ধরনের মিষ্টি আনা হয়েছে। সিঁতারা সেসব তুলে রাখছে। ক’দিন যাবৎ কাজিন রিলেটেড একটা বই চুপিচুপি পড়ছে সে।
সেখানে নায়ক নায়িকাকে বকে, মারে, আবার যখন যা চায় এনে দেয়।
অথচ বিশুদ্ধ পুরুষ মারে, বকে কিন্তু যখন যাচায় এনে দেয় না। আনার জন্য জেদ দেখালে দু’থাপ্পড় মেরে দেয়। ইশ! বাস্তব জীবনের গল্প কেন যে উপন্যাসের মতো সাজানো হয় না।