শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২০

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২০
নূরজাহান আক্তার আলো

সন্ধ্যা সাড়ে ছয় টা।
চলন্ত গাড়ির পেছনের সিটে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে শীতল। মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। গাড়িটা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। আর না এই রাস্তা তার পরিচিত। সারাদিন পর অফিস ছুটির কারণ পথেঘাটে জ্যাম বেঁধেছে। একটু পথ গিয়ে জ্যামের কারনে বসতে হচ্ছে মিনিটের পর মিনিট। জ্যাম দেখে চিৎকার করার পায়তারা জুড়তে পারে ভেবে ছেলেগুলো শীতলের চোখ, হাত-মুখ বেঁধে দিয়েছে। কর্কশ স্বরে শাসিয়েছেও যেন শব্দ না করে। গাড়িতে গান চলছে যাতে শীতলের গোংড়ানোর শব্দ ভুলেও বাইরে না যায়। পেছনের সিটও অন্ধকার করে রাখা। গাড়ি গ্লাস তুলে দেওয়ায় বোঝারো উপায় নেই জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে তারা কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে।

কি’ড’ন্যা’প হচ্ছে জেনে শীতল প্রথম প্রথম ভয় পেলেও এখন আর ভয় পাচ্ছে না। বরং রাগ হচ্ছে। মন চাচ্ছে নিজেকে থাপড়াতে৷ মোটকথা সে
এমন বোকামি করলো কিভাবে? নিজের পায়ে হেঁটে এসে গাড়িতে বসে যেসব চিন্তা করল সেসব আগে কেন করল না? কেন ভাবল না বাইরের পৃথিবীটা জনজালে ভরা। বেশিরভাগই নারীখেঁকো হায়েনা। এদিকে তার
ফোনটাও কেড়ে নিয়েছে ছেলেগুলো। কিন্ত কারা এরা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? এসবের পেছনে কে আছে? কে তাদের গোপন শত্রু? কি উদ্দেশ্য তার? তাকে মেরে ফেলবে নাকি তার গায়ে কলঙ্কের বিশ্রী কালি লেপ্টানো তার উদ্দেশ্য?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাছাড়া আজকাল নাকি দলে দলে কিডনী চোর বের হয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে কিডনী কেড়ে নিচ্ছে। তারও কি তাই করবে নাকি? যদি করে টাকার ভাগ তাকে দিবে নাকি পুরোটা নিয়ে নেবে? যদি দেয় তো ভালো নয়তো সেও ব’দ’মা’শগুলোর নামে মা’ম’লা ঠুকে দেবে।
আর্মির মেয়ের কিডনী কাড়ার সাধ জন্মের মতো ঘু’চি’য়ে দেবে। আর্মি শব্দটা স্মরণ হতেই বাবার কথা মনে গেল তার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। কাঁদতে কাঁদতে কান্নার গতি বেড়ে গেল। হঠাৎ তাকে কাঁদতে দেখে ছেলেগুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের কাছে খবর আছে এই মেয়ে দেখতে ভোলাভালা হলেও বহুত চালাক। শয়তানি
বুদ্ধি তার রন্ধে রন্ধে তাই ভুলেও এর অভিনয়ে গলা যাবে না। না আবেগ দেখে মায়া করা যাবে। কেঁদে মরে গেলেও সান্ত্বণা দেওয়া যাবে না কারণ কথার চক্করে ফেলে গোপন তথ্য নিয়ে নিতেও পারে। একথা ভেবে তারা কেউ কথা বাড়াল না বরং নিজেরা নিজেরা গল্প করতে লাগল। তারপর জ্যাম ছুটলে গাড়ি ছুটাল নির্জন রাস্তার পথ ধরে। এই রাস্তায় কেউ নেই দেখে শীতলের মুখ,চোখ খুলে দেওয়া হলো। ছাড়া পেয়ে সে উঠে বসল।
আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল গাড়ি কোনদিকে যাচ্ছে। কিন্তু অন্ধকার জনমানবশূন্য রাস্তা দেখে ভয়ে চুপসে গেল। তাকে ভয় পেতে দেখে একটা ছেলে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল,

-‘ কিছু খাবেন আপু?’
-‘আপনাদের বসের নাম কি?’
-‘জানি না।’
-‘যার হয়ে কাজ করছেন তার নাম জানেন না?’
-‘না, টাকার বিনিময়ে কাজ করি। টাকা পেলে আর কোনোকিছু জানার আগ্রহ আসে না।’
-‘আপনারদের স্যারকে ফোন দিয়ে বলুন, আমি কথা বলব।’
-‘জায়গা মতো পৌঁছায় শুধু কথা না অনেককিছু করতেও পারবেন?’
একথা বলে ছেলেটা শব্দ করে হাসতে লাগল। তার দেখে হাসতে লাগল সঙ্গের ছেলেগুলোও। শীতল চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কয়েকদফা গালি বর্ষণ করে চুপ করে বসে রইল। কাঁদতে লাগল নীরবে, নিঃশব্দে। কাঁদতে কাঁদতে কেন জানি তার বরইয়ের আচারের কথা মনে পড়ল। ভাবল,এদের হাতে মা’রা গেলে আর আচার খাওয়া হবে না তার।

বড় আম্মুর বানানো আচার সায়ন ভাইই খেয়ে নেবে। সায়ন ভাই আবার
আচার পাগল। মেয়ে মানুষের মতো বাটি বাটি আচার খায় সে। আচ্ছা, সায়ন ভাইয়ের যখন বিয়ে হবে তার বউয়ের বাচ্চা হবে তখন সায়ন ভাই কি তার বউযের আচারে ভাগ বসাবে? কেঁড়ে কুঁড়ে নিজেই খেয়ে নিবে?নাকি মুখভর্তি আচার নিয়ে বলবে, ‘বুঝলি শীতল, বাপ হচ্ছি, মুখে রুচি টুচি নেই তাই আচার খাচ্ছি।’
একথা ভেবে খিলখিল করে হেসে উঠল শীতল।ছেলেগুলো কথা থামিয়ে
ঘুরে তাকাল তার দিকে। অদ্ভুত তো, মেয়েটার গায়ে জ্বিন আছে নাকি? এই হাসে, এই কাঁদে। শীতল সিটে হেলান দিয়ে বসে কিছু একটা ভাবল।
জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে একে একে সব ছেলেগুলোকে গুনে দেখল। মোট পাঁচজন আছে গাড়িতে। একজন একটুপর পর কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। একবার তার ছবি তুলে কাকে যেন পাঠাল সে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পুনরায় কল এলে ছেলেটি রিসিভ করল। বিনয়ী ভাব কন্ঠে ঢেলে বলল,
-‘ফেনীর দিকে যাচ্ছি স্যার। তাহলে গাড়ি ঘুরাব? গোডাউন কুমিল্লায়? জি, জি! তাহলে কুমিল্লার দিকে এগোচ্ছি আমরা।’

শীতল তাদের কথা শুনল। মস্তিষ্কে ধাক্কা দিলো নানান চিন্তা। এদেরকে বিশ্বাস করে ভুল করে ফেলেছে। যেভাবেই হোক গাড়ি থামানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে শুদ্ধ, সায়ন, নয়তো বাবাকে একটা ক্লু পাঠাতে হবে। তার আগে কথা বলে এদের মাথা খেতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। বরং ভয় পেলে এরা লাই পাব, মজা লুটবে। একথা ভেবে সে মন খারাপ দূর করে ঠোঁটে হাসি ফুটাল। এরপর কন্ঠে মধু ঢেলে মিষ্টি করে ডাকল,
-‘ভাইজান?’

পাশে বসা ছেলেটা তাকাল। সে আবার কানে কম শোনে। মেয়ে মানুষের মিনমিনে সুরের কথা বোঝেও কম। না বুঝলে পুনরায় জিগাতে ইগোতে বাঁধে। যতই হোক পুরুষ মানুষ বলে কথা আত্মসন্মানবোধ থাকা জরুরি।
শীতল তাকে কিছু বলছে বুঝতে পেরে সে পাশের জনকে গুঁতো মারল। ইশারা করল পাশে তাকাতে। পাশেরজন তখন সবে মুখে পানি নিয়েছিল পান করার জন্য। হঠাৎ’ই পেটে গুঁতো লাগায় মুখের পানি বেরিয়ে গেল। সে বিরক্ত হয়ে তাকাল কম শোনা ছেলেটার দিকে। তাকে তাকাতে দেখে ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে শীতলকে দেখাল। ছেলেটার দৃষ্টি যেন বলে দিলো, শীতলের উপর খুবই বিরক্ত দু’থাপ্পড় দিতে পারলে শান্তি পেতো।
মেয়েটার চোখ, মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক আগে অথচ মেয়েটা না কাঁদছে আর না চিৎকার করছে। চিৎকার করার অজুহাতে মারধর করত নাহয়। কিন্তু সে তা করছে না বরং দেখে মনে হচ্ছে পিকনিকে যাচ্ছে সে।
ভীষণ খুশি। তাকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে শীতল পুনরায় ডাকল। এবার ছেলেটি কর্কশকন্ঠে জবাব দিলো,

-‘কিতা হইছে?’
শীতল ভ্রুঁ কুচকালো। ইচ্ছে করল মুখ বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলতে,
-‘আমাকে কি’ড’ন্যা’প করে আমাকেই বলছিস, কিতা হইছে! হা’রা’মির দল একবার ছাড়া পাই তোদের পেছনে লাল কাপড় বেঁধে শুদ্ধ ষাঁড়ের গুঁতো না খাওয়ালে আমার নামও শীতল না। তখন ভালো করে বুঝবি আমার আসলে কিতা হইছে!’
মনের কথা মুখ ফুটে বলা হলো না শীতলের। কোনোমতে কথা গিলে মুখ এইটুকু করে বসে রইল। তখন ড্রাইভারের পাশে বসা ছেলেটা হাসিমুখে শুধালো,
-‘কোনো সমস্যা আপু?’
শীতল সাহস পেল। বেঁধে রাখা হাতটা মুচড়ামুচড়ি করে বলল,
-‘এই ভাই বরইয়ের আচার আছে আপনার কাছে?’
-‘ না নেই।’

-‘ নেই মানে? কেন নেই? এখন দেবো একটা গাট্টা? কি’ড’ন্যা’প করার সময় মনে ছিল না গাড়িতে উঠলে আমার বমি পায়। মাথায় ঘুরায়। এখন দেই আপনার গায়ে হকহক করে বমি করে?’
-‘ম’স্ত বড় ভুল হয়ে গেছে মেডাম। পরেরবার কিডন্যাপ করতে এলে আপনার জন্য বরইয়ের আচার নিয়ে আসব।’
-‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন টা কোথায়?এক কাজ করুন কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, নয়তো সাজেকের দিকে চলুন। জীবনে কখনো মন খুলে বেড়াতে পারলাম না এই সুযোগে ঘুরে আসাও হবে।’
-‘মেডাম আমরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছি হানিমুনে নিয়ে যাচ্ছি না।’
-‘আপনাদের মতো পেট মোটা, বয়রা, টাকলা পোলাপানের সাথে আমি হানিমুনে যেতামও না। যা বলছি শুনুন নয়তো আপনাদের মালিককের কাছে বিচার দেবো কিন্তু?’

-‘স্যার বলেছে, আপনাকে কুমিল্লায় নিয়ে যেতে।’
-‘ কেন, রসমালাই খাওয়াতে?’
-‘না, আপনাকে খেতে।’
-‘আমাকে কেন খাবে? তার বাড়িতে মা, বোন নেই? গিয়ে তাদের খাক। অন্যের বোনের দিকে নজর কেন?’
একথা শুনে ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। গাড়ি উঠে অবধি বকবক করতেই আছে মেয়েটা। প্রশ্নের বহর থামছে না। কান, মাথা, সব ঝালাপালা করে দিলো। শুধু বসের জন্য কিছু বলতে পারছে না নয়তো এতক্ষণে জানের দফারফা করে ফেলত। ছেলেটা চুপ হয়ে গেল দেখে শীতল কথা বাড়াল না। কিছুক্ষণ পর নড়েচড়ে বসল। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে বসে থাকা যায়? একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত শুদ্ধ জেনেছে কিডন্যাপ হয়েছে৷ নিশ্চয়ই কোনো না কোন পথ খুঁজে বের করবেই সে। তবে ফোন অন থাকার কথা বলেছিল শুদ্ধ। কিন্তু ছেলেগুলো তার ফোনটা কেড়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
রাত বাড়ছে। ঘড়িতে ক’টা বাজে কে জানে? আম্মুরা বাসায় ফিরেছে?

উনারা বাসায় ফিরে তাকে না পেয়ে চিন্তা করছে নিশ্চয়ই! কান্নাকাটিও শুরু করে দিয়েছে বোধহয়! এখন কি করবে সে? কিভাবে ছাড়া পাবে? রোজ পত্রিকা খুললে দেখা যায় ধর্ষনের সংবাদ। তার সাথেও কি এমন কিছু ঘটবে? চৌধুরী বাড়ির সদস্যের মাথা হেট হবে শুধু তার বোকামির কারণে? বড় আব্বু, মেজো আব্বু, আব্বু, সায়ন ভাই, শুদ্ধ ভাই তারা কি লজ্জায় পড়ে যাবে? তাদের সুখপূর্ণ জীবনে অসন্মানের তকমা লাগবে তার কারণে? বড় আম্মু, মেজো আম্মু, আম্মুরা কি তার জন্য কাঁদবে?
শখ আপু, স্বর্ণ আপু এরা কি মন খারাপ করবে নাকি খুশি হবে জ্বালাতন করা মানুষটা হারিয়ে গেলে? এসব ভেবে তার গলা শুকিয়ে এলো। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো বুকচাপা কান্নায়। ভয়ে কাঁপতে লাগল সে। নির্জন রাস্তা তার উপরে এতগুলো ছেলে।

সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল শীতল। না, একটু খাওয়া দরকার। সে ছেলেগুলোকে বলল পানি খাবে তাকে পানি খাওয়ানো হলো। কিছুক্ষণ পর বলল ক্ষুধা পেয়েছে তাকে খাবারও দেওয়া হলো।
অথচ খাবার গলা দিয়ে নামছে না। মানুষ ভয় পেলে কিংবা টেনশনে করলে বুঝি এমনই হয়। ফোনটা এখনো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। শীতলের জানামতে ফোন বন্ধ থাকলে লোকেশন ট্র্যাক করা যায় না। লোকেশন ট্র্যাক না করলে তার খোঁজ করতে পারবে না শুদ্ধ। তাই মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল এভাবে সময় কাটছে না ফোনটা দিলে রিলস দেখলে সময় কাটত। একথা শুনে অতিষ্ঠ হয়ে একজন স্বজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার দুই গালে। দাঁতের সাথে ঠোঁট লেগে রক্ত বের হলো। পুরুষালি শক্ত হাতের থাপ্পড়ে গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেল। শীতল হতবাক হয়ে তাকাল রইল ছেলেটার দিকে। অকারণে মারার জন্য খুব রাগ হলো তার। সেও এক পা তুলে আচমকা লাথি বসাল ছেলেটার প্যান্ট বরাবর।

তার এহেন কান্ডে পাশের ছেলেটা এবার রেগে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে হিজাব টেনে খুলে ফেলল। একহাতে নাক চেপে ধরে আরেক হাতে শক্ত করে চেপে ধরল শীতলের গলা। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে শীতল কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগল। হাত-পা ছুঁড়েও ছেলেটাকে ছাড়তে পারল না। এবার প্রাণটা বুঝি যায় যায়। এতক্ষণ ভয় দূর করতে বকবক করছিল শীতল। বোঝাতে চেয়েছিল সে ভয় পাচ্ছে না স্বাভাবিক আছে। আসলেই তাই? এতগুলো ছেলের মাঝে স্বাভাবিক থাকা যায়? থাকা কি সম্ভব? এদিকে তার বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে অন্য ছেলেগুলো থামানো দূর, এগিয়েও এলো না। বরং দেখল। হাসল। পরে শীতলের চোখজোড়া উল্টে আসলে তারা ছেলেটাকে কোনোমতে সরাল। তবে ছেলেটা সরার আগে শীতলের বুকে স্বজোরে একটা লাথি বসাল। লাথিটা লেগেছে হার্ট বরাবর। এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে এলো। জন্মের পর গায়ে ফুলের টোঁকা না পড়া মেয়েটা অসহ্য যন্ত্রনায় গুমড়ে উঠল। তার হাত-পাও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো। চোখে নামল গাঢ় অন্ধকার। কানে বাজল প্রাণপ্রিয় বাবার আদুরে ডাক, ‘মা, শীতল। কই তুমি মা?’

শীতল ছোটো থেকে অতিরিক্ত চঞ্চল। বাঁচাল। দুষ্টু বুদ্ধির অধিকারিণী।
তবে সে যতই চঞ্চল হোক, দুষ্টুমি করুক, কেউ তাকে এভাবে মা’রে নি। শারাফাত চৌধুরীর কারণে মা’রা’র সাহস করে নি। শুধু মাঝে মাঝে মার খেতো শুদ্ধর হাতে তাও তার অপকর্মের কারণে। এজন্য শুদ্ধকে পাষাণ উপাধিও দিয়েছে। তবে আজ বুঝল শুদ্ধ ভাই মারলেও রয়ে সয়ে সহ্য ক্ষমতা বুঝেই মারত। আর এরা! তবে বলতেই হয় শুদ্ধ ভাই আর এদের মারের মধ্যে অনেক তফাৎ। আকাশ-পাতাল তফাৎ!

শীতল জ্ঞান হারাল। অচেতন শীতলের মাথাটা ধাক্কা খেলো গাড়ির কাঁচে সাথে। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় আবার গিয়ে ধাক্কা খেলো সামনের সিটে।তবুও ছেলেগুলো দেখেও দেখল না। বিরক্ত মুখে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অন্যের বাড়ির মেয়ে, ম’রু’ক, বাঁচুক, যা ইচ্ছে করুক, তাতে তাদের কি?
অগত্যা তিন চৌধুরীর এক কলিজা অনাদরে পড়ে রইল সিটের উপরে।
তিন মায়ের আদুরে রাজকন্যাটা আঘাত পেয়ে কপাল ফুলে কারশিটে পড়ে গেছে। চার ভাইয়ের সবচেয়ে চঞ্চল, বাঁচাল বোনটিকে কথা বলার দায়ে শক্ত হাতে আঘাত করা হয়েছে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। গলা চেপে ধরার গলায় দাগ বসে গেছে। কেউ জানলও না, কেউ দেখলও না, চৌধুরী বাড়ির আদুরে কন্যার বর্তমান হাল।

কিছুদিনের জন্য দেশে ছেড়েছে শুদ্ধ। পাঁচ বন্ধু এসেছে তাদের স্যারের জরুরি ডাকে। দিন-রাত এক করে তারা কাজ করছে ল্যাবে। খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া সময় কাটছে সেখানেই। আজও একমনে কাজ করছিল সে। হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করায় কাজে বিঘ্ন ঘটে সবার। স্যার খুব বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না কারণ শুদ্ধ শুনতো না। দলের মধ্যে এই ছেলেটা যেমন মেধাবী, তেমনি ত্যাড়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় না দিলে সে কাজে হাত দেয় না। তাছাড়া ছেলেটা পরিবার নিয়ে খুব বেশিই পজেসিভ। তাই কথা না বাড়িয়ে সবাইকে মনযোগী হতে ইশারা করলেন উনি। আর শুদ্ধ ফোনটা নিয়ে চলে গেল ল্যাবের এককোণে। ডিসপ্লেতে ভাসছে ‘ব্যাঙাচি’ নাম। কল রিসিভ করে শীতলের কথা শুনে চিন্তা বেড়ে গেছে তার।

সে স্যারকে বলে বেরিয়ে এসেছে ল্যাব থেকে। কথা বলতে বলতে কল কেটে গেলে দৌড়ে এসেছে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। ল্যাবের অ্যাপ্রন পরা অবস্থায় বসে পড়েছে লেপটপ নিয়ে। লেপটপে শো করছে তার ফোনের সকল তথ্য। চেষ্টা করছে ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করার। যদিও ফোন বন্ধ। তারপরেও বেশিরভাগ ওয়্যারলেস চিপগুলি ডিভাইস বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে থাকে। কিছু কিছু কম্পোনেন্ট লো পাওয়ার মোডে চলতে থাকে আইফোন বন্ধ হওযার ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত। তথ্য অনুযায়ী এই উপাদানগুলোর শক্তি থাকে এবং ট্র্যাকিংয়েও সক্রিয় থাকে। মোটকথা, সিস্টেম-ওয়াইড অ্যাক্সেসসহ সেটিং ব্যবহার করে ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে বন্ধ থাকা অবস্থাতেও। তাছাড়া সেও যেন জানত, ফোনটা হারাবে
নয়তো কোনো অঘটন ঘটাবে এই মেয়ে। বরং অঘটন না ঘটালে অবাক হতো। সেই চিন্তা মাথায় রেখে আগে থেকে শকতপোক্ত ব্যবস্থাও করে রেখেছে।

কিছুক্ষণ চেষ্টা চালানোর পর সে সফল হলো। ফোনের লাস্ট লোকেশন শো করছে ঢাকাতে এবং সেটা যাচ্ছে ফেনীর দিকে। শুদ্ধ লেপটপে দৃষ্টি রেখে কল করল শাহাদত চৌধুরীকে। জানাল ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা। শাহাদাত চৌধুরী ঠান্ডা মাথা পুরো ঘটনা শুনলেন। ভাবলেন। তারপর
জানালেন সেনাবাহিনী ক্যাম্পের ঊর্ধ্বস্ত কর্মকর্তাকে। আধাঘন্টার মধ্যে ফেনির রাস্তা ব্লক করার ব্যবস্থা করা হলো। পুলিশ’ও নেমে গেল রাস্তায়।
সেই রাস্তার প্রতিটা পয়েন্টে থাকা ট্রাফিক পুলিশদের সিগন্যাল পাঠানো হলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে যতটুকু করার সম্ভব করল। কিন্তু তাতে কিছু হবে তো! বাঁচতে পারবে তো তাদের বাড়ির প্রানবন্ত ফুলটাকে?

এদিকে সায়নের কাছে এ খবর পৌঁছে গেছে অনেক আগে। তারই লোক দেখেছে শীতলকে একটা কালো গাড়িতে উঠতে। তাৎক্ষণিক জানিয়েছে একথা। সায়ন খেয়ে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ ফোনের গোঁ গোঁ শব্দে খুব বিরক্ত
হয়। দু’পায়ে মাঝে জড়িয়ে ধরে থাকা কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরে গালি দেয় কলদাতাকে। দু’একবার রিং হয়ে থামছে না যখন তখন উঠে কল রিসিভ করল সে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
-‘ওই মা’দার’চো’দ কল করার সময় পাস নি? আমি ঘুমালেই তোর ফোন দিবার মন চায়? আমার ঠা’প না খাইলে শান্তি পাও না তুমি, না? আসো শালা আগে তোমার মনের মখ মিটায়?’
-‘ভুল হইছে ভাই। একখান কথা জানার লিগা ফোন দিসি ভাই।’
-‘পরে জানা যাইতো না তোর ফা’কিং কথা?’

-‘ঢাকা মেট্রো-গ, ৫২_৫২১* এটা আপনাদের গাড়ির নাম্বার। গাড়ির রং কালো।’
একথা শুনে সায়নের ঘুম ছুটে গেল। তার মা চাচীরা বাইরে গেছে তাদের কিছু হলো না তো? আজম হঠাৎ করে গাড়ির কথা জানতে চাচ্ছে কেন? একথা মস্তিষ্কে টোকা মারতেই তার ভ্রুঁ কুচকে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মনে করল তাদের বাড়ির সব গাড়িগুলোও নাম্বার। এই নাম্বারের গাড়ি তাদের নেই। তাই সে বলল,
-‘কাহিনী কি আজম? গাড়ির নাম্বার জিগালি ক্যান?’
-‘ শীতল আপু কিছুক্ষণ আগে কালো একটা গাড়িতে উঠেছে। সঙ্গে ছিল
পাঁচটা ছেলে। তবে তাদের দেখে মনে হলো, আমাদের এরিয়ার ছেলে না তারা।’
-‘গাড়ি ফলো করতে থাক, আসছি আমি। ভুলেও গাড়িটা যেন চোখের আড়াল না হয়।’
-‘ঠিক আছে ভাই।’

তারপর থেকে আজম নামের ছেলেসহ ক’জন গাড়িটাতে ফলো করছে।
শীতলের গাড়ির পেছনে রয়েছে তাদের গাড়িটা। কিন্তু দুঃভাগ্যবশত সেই মুহূর্তে আজমদের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে যায়। চোখের পলকে তারা হারিয়ে ফেলে শীতলদের গাড়ি। নিঁখোজ হয় শীতল। তাকে খুঁজতে উঠে পড়ে রেগেছে তার বাপ ও বড় ভাইরা। একথা শুনে ইয়াসির হো হো করে হাসল। তারপর অর্ধনগ্ন শরীরে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল। হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে কল করল কিডন্যাপারদের একজনকে। বলল,

-‘মেয়েটা কই?’
-‘ গাড়িতেই আছে।’
-‘কিছু করিস নি তো তাকে?’
-‘না স্যার।’
-‘আমার খাবার সে। ভুলেও টাচ্ করবি না ওকে।’
-‘জি স্যার।’
-‘ ওর ফোন আর ওকে গাড়িতে রেখে পালা দেখি এবার।’
-‘কেন স্যার? কুমিল্লা যাব না?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ১৯

-‘ ওর বাপ ভাইরা আসছে তোদের পেছনে বাটাম দিতে। বাটাম নিতে পারলে গাড়িতেই বসে থাক। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু চিনি না তোদের, বাই।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২১