শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৫

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৫
নূরজাহান আক্তার আলো

তখন দুপুর একটা। বিরক্ত মুখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে স্যান্ডি।
বিরক্তিতে চোখ, মুখ, কুঁচকে আছে তার। পাশের জনকে ইশারায় কিছু জিজ্ঞাসা করে গালি ছুঁড়ল নিজের ভাষায়। কোনোভাবেই কিছু হচ্ছে না।
এইদিকে শুদ্ধ জানিয়েছে দু’দিনের মধ্যে কাজ না হলে তার গফকে বলে দিবে সে আরেকটা নতুন গফ জুটিয়েছে। হা’রা’ম’জা’দা শুদ্ধ মুখে মুখেই
হুমকি দিয়েছে তা নয়, বিদেশী গফকে লিপকিস করার ভিডিওটা প্রমান হিসেবে রেখেছে তার সেলফোনে। এটা যদি লিপা দেখে তার খবর করে ছাড়বে। তার বাপ আবার পুলিশ। পুলিশের মেয়েকে ঠকানোর কেসে চৌদ্দ শিকের ভাত কপালে নাচছে। হঠাৎ’ই বিপ বিপ শব্দে রেড এলার্ট
বাজতেই লেপটপের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠেছে সে। লোকেশন শো করছে। জায়গাটা ঢাকার মধ্যে। লাল গোল মার্ক করার জায়গাটা একটা বাজার। অবশেষে তার কষ্ট সফল। সে দ্রুত কল করল শুদ্ধকে। খুশিতে তার মন বাকুম বাকুম করছে। তিনবারের বেলায় শুদ্ধ কল রিসিভ করা মাত্রই স্যান্ডি প্রফল্ল সুরে বলে উঠল,

-‘কালপ্রিটের আসল নাম ইয়াসির সিকদার। থাকে ঢাকাতেই। মাফিয়া। ধামাকাদার খবর আবু সিদ্দিকের খুব কাছের কেউ।’
শুদ্ধর ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে গেল। আবু সিদ্দিক জড়িত সে আগেই জেনেছে। এই সুযোগে প্রমাণসহ সায়নকে দেখিয়েছে বিধায় সায়ন দলও ছেড়েছে।
কিন্তু ইয়াসির? এই ছেলে কে? তার সাথেই বা কিসের শত্রুতা? মাফিয়া? মাফিয়া এলো কোথা থেকে? তার যতদূর মনে পড়ছে কোনো মাফিয়ার সাথে চৌধুরীর বাড়ির কারো কোনো ঝামেলা হয় নি। তবে? নাকি এটার পেছনেও অন্য গল্প রয়েছে। সে আপাতত নিজের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘সে মাফিয়া কিভাবে জানলি?’
-‘যেই কোডটা পাঠিয়েছিলি ওটা দিয়ে এখন তার ডিটেইলস্ শো করছে।’
-‘ছবি আছে?’
-‘আছে। শালারে দেখে আমিই ফিদা ভাই।’
-‘তার কাছে পৌছানোর উপায়?’
-‘জানাচ্ছি।’
-‘ওকে।’
একথা বলে স্যান্ডি কল কেটে পুনরায় কাজে লেগে পড়ল। শুদ্ধর ফোনে পরপর নোটিফিকেশন এলো। চেক করে দেখল একটি ছেলে। দেশী ও
বিদেশী সংমিশ্রনে তার মুখাবয়। তাকে একপলক দেখে শুদ্ধ আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসল। ব্যস্ত হাতে ফোনে টুকটাক কি করতেই তার সামনে দেওয়াল ভেদ করে একটি পর্দা তৈরি হলো। সেই পর্দায় ভাসতে থাকল ইয়াসিরের ছবি এবং তার সম্পর্কে নানান তথ্য। ইয়াসিরের জন্ম ইতালির
রাজধানী রোমে। তবে বড় হয়েছে সুইডেনে। তার বাবা বাঙ্গালী হলেও মা বিদেশী। তাদের দু’জনের সংমিশ্রনে ইয়াসির। ভাই-বোন আছে কি না তা জানা যায় নি। শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কেও কিছু বলা নেই। তার বাবা মা কোথায়? সে কেন মাফিয়া হলো এসব অজানা।

তবে সব কথার এক কথা সে বর্তমানে সুইডেনের নামকরা মাফিয়। বিশাল বড় গ্যাং রয়েছে তার। তবে এ অবধি তাকে কেউ দেখে নি। সে দেখতে কালো নাকি ফর্সা, লম্বা নাকি খাঁটো তাও জানে না কেউ। তবে সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে,
ইয়াসির শিকদার খুব সাধারণ পোশাক, সাধারণ বেশে চলাফেরা করে। অথচ ছেলে হয়েও তার প্রকৃত রুপ চোখ ধাঁধানো। তথ্য অনুযায়ী এইটুকু পড়ে শুদ্ধ তীক্ষ দৃষ্টিতে তার ছবিটা জুম করে দেখল।ছবিতে দেখা যাচ্ছে
ইয়াসিরের ঠিক সামনাসামনি 9×19 মিলিমিটার পারাবেলাম, M1911, CZ -75, সিহর্স এসই, পেলিকান 1200, এমটিএম দ্বৈত ও প্লানো 1404 মডেলের পিস্তল। এত পিস্তল দেখেও তার ঠোঁটে হাসি নেই। ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেগুলোর দিকে। তার একহাতে কারুকাজ করা খচিত র’ক্ত মাখানো ছুরি। শুদ্ধ ছবিটা আর একটু জুম করে দেখল ইয়াসিরের পেছন সাইড। এরপরই সে হো হো করে হেসে উঠল। কারণ তার ধারণা
সঠিক। ইয়াসিরের নাম ইয়াসির হলেও ছবি মানুষটা ইয়াসির নয়। এই ছবিটা কোনো এক এ্যাকশন মুভির তামিল নায়ক। শ্যুটিং সেটে ছবিটি
তোলা। মোদ্দাকথা, কোনো মাফিয়া এভাবে শো অফ করবে না।

তারা যেসব কাজে যুক্ত যত পারে নিজেদের আড়ালে রাখবে নয়তো তাদের ভয়ংকর কাজ সর্বসম্মুখে চলে আসার সম্ভবনা থাকে। ইয়াসির যদি এটা নাহয় তবে সে কে? কেনই বা সে নিজেকে এভাবে পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছে? এমন নানান জটিল প্রশ্নের গোলকধাঁধায় সমাধা পেল না শুদ্ধ। তবে বুঝল এখানে অন্য ঘাপলা আছে। যেটা ধরতে পারছে না সে।
হতে পারে ইয়াসিরের নামটাও ফেইক। এমনও হতে পারে এই ইয়াসির’ই তাদেরই চেনা জানা আপন কেউ। মরার পাখনা গজিয়েছে বলে এভাবে লুকোচুরিতে নেমেছে।

শুদ্ধ দুই পা নাচাতে নাচাতে কিছু একটা ভেবে ফিচেল হাসল। এই হাসির মানে কি? কি চলছে তার মনে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা গেল না। যাবেও না যতক্ষণ না সে নিজে থেকে কাউকে কিছু জানায়। ঘড়ির কাঁটা তখন টিকটিক করে চলছে নিজ নিয়মে। রুমের এককোণে রাখা ট্রলিটা টেনে সে সবকিছু গুছিয়ে নিলো। আর ঘন্টা খানিক পরেই তার ফ্লাইট। যেসব কাজের জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল সেসব কাজ শেষ। ফাইনাল রেজাল্ট জানা যাবে তিনমাস পর। ড্রয়িংরুম থেকে অর্ক, হাসান আর কামরানের কথা শোনা যাচ্ছে। দেশে ফেরার আনন্দে তারা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুশিতে ডগমগ করছে। একটু পর পর পঁচাচ্ছে হাসানকে। হাসান নিজেও বন্ধুদের সাথে তাল মিলাচ্ছে। তার মনটা বেশ ভালো। যতটা মন খারাপ নিয়ে দেশ ছেড়েছিল এখন ডাবল খুশি নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে। শুদ্ধর পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে সে। একটু টাইট দেওয়াতে বউটা মিনমিন করছে। যে মেয়ে ভুল করেও কল/মেসেজ দেয় না সে প্রতি ঘন্টায় খোঁজ নিচ্ছে।

এদিকে শুদ্ধ বড় স্যারের সাথে কথা বলে কিছু ব্যাপারে আলোচনা সেরে নিলো। প্রয়োজনীয় সবকিছু ঠিক আছে কি না চেক করল। এরপর সময় হয়ে এলে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল এয়ারপোর্টের দিকে।যেতে যেতে
কত গল্প, হাসাহাসি, আড্ডা হলো। টুকটাক ফর্মালিটিজ পূরণ করে ঠিক সময়ে প্লেন উড়তে শুরু করল। সবার মনে তখন আপন দেশের মা, মাটি ছোঁয়ার অপেক্ষায়।
শুদ্ধ দেশে ফিরছে কাউকে জানায় নি। সেদিন তার রুমে লাস্ট শীতলের সাথে কথা হয়েছিল। এরপর শীতলের ফোন সায়নের কাছে বিধায় আর কথা বলার সুযোগ মিলে নি। তবে সে অবগত শীতল তার দেশে ফেরার কথা শুনে সেদিনই ফুপির বাসায় চলে গেছে। বোকা মেয়েটা সত্যি সত্যি ভেবেছিল তাকে বিয়ে করার জন্য দেশে ফেরার কথা বলেছিল। তা হয় নাকি? তারা একই বাড়িতে জন্ম, এক সাথে বেড়ে ওঠা, লোক সমাজেও পরিচিত ভাই-বোন হিসেবে। মোদ্দাকথা, দু’জনের কারো মনে কারোরই জন্য অন্য কোনো ফিলিংস নেই। যদি থাকত তাহলে নাহয় ভাবা যেতো।

এইটুকু ভেবে শুদ্ধ নিজেই হতবাক হয়ে গেল, আসলেই কি ভাবা যেতো?
বোধহয় যেতো না। এর বিশেষ কারণ সায়ন ও স্বর্ণ। সে তাদের কথা সব জানে। তারা দু’জন দু’জনকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে তাও জানে। সায়ন চালাক আর স্বর্ণ মুখচোরা বলে বাসার কেউ এতদিন খেয়াল করে নি। করবে না তাও কিন্তু নয়। আজ অথবা কাল তাদের কথা বাড়িশুদ্ধ সবাই জানবে। শাহাদত চৌধুরী কিভাবে নেবে ব্যাপারটা জানা নেই তবে ভিলেন হবে শারাফাত চৌধুরী নিজে৷ উনি কখনো স্বর্নের সাথে সায়নের বিয়ে হতে দেবে না। যদিও দেয় তবে রাজনীতি ছাড়ার শর্তে দেবে। যেটা সায়ন কখনো মানবে না। আর এসব নিয়ে একটা ঝামেলা হবে বলারও অপেক্ষা রাখে না।
যদিও ঝড় ঝাপ্টা সময়ের সাথে সাথে ঠিকঠাক হয়ে তাদের বিয়েও হবে। সংসার হবে। সায়ন স্বর্ণকে মেনেও নেবে। কিন্তু ভুলক্রুমে যদি তার সঙ্গে শীতলের কিছু হয়ও তাদের বাড়ির কেউ মানবে না। কারণ এটা হয় না।
লোক সমাজ বলেও কিছু আছে। যদি তাদের দুই ভাইয়ের সাথে স্বর্ণ ও শীতল জড়িয়ে যায়ও তখন আপনাআপনিই খারাপ বদনাম রটে যাবে।

একই বাড়ি, একই পরিবারে থেকে একই ঘটনা, যেগুলো শুনতেও বিশ্রী লাগবে।
তাছাড়া পুরুষ মানুষ কলঙ্ক দাতা তবুও তাদের গায়ে কলঙ্ক লাগে না। যা লাগে সবটাই মেয়েদের গায়ে। তখন দেখা যাবে সায়ন স্বর্ণ বেঁচে গেলেও একই ঘটনা ঘটায় শীতলের গায়ে তার নামের কলঙ্ক লেপ্টে যাবে। বাজে কথা রটানো হবে। চৌধুরী বাড়ির শিক্ষা নিয়ে কথা উঠবে। এগুলো হবে জানা সত্ত্বেও এসবে জড়ানো ঠিক হবে না। কারণ বাড়ির সদস্যকে নিয়ে ওর একটা পরিবার। আর পরিবারের দিকে কেউ কাঁদা ছুঁড়াছুড়ি করলে সহ্য করতে পারবে না। বলা বাহুল্য, শীতল, শখ, স্বর্ণের মতো ধীর, শান্ত, স্বভাবের নয়। যদি হতোও তাহলে তাকে শাষণ করা লাগত না। আর না মার, ধমকের উপর রাখতে হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শীতল হয়েছে খুবই
দুষ্টু। চঞ্চলতা তার রন্ধে রন্ধে। তাকে ছাড়া কাউকেই ভয় করে না। বারণ শুনে না। তার উপরে তার আর্মি বাবাকে কাছে পায় না দেখে শারাফাত চৌধুরী একটু বেশিই লায় পায়। প্রশ্রয় পায়। এইটুকুতেই মেয়েটা সাপের পাঁচ পা দেখে। এবং আবদার না মেটানো অবধি ওর জেদে অটল থাকে।

এজন্য একটু আধটু শাষণ করে এই যা। তারমানে এই না সে শীতলকে ভালোবেসে হাবুডুবু খাচ্ছে। শাষনের আড়ালে ভালোবাসা চুইয়ে চুঁইয়ে
পড়ছে। এসব করতে বয়েই গেছে তার। শীতল ভালোবাসলে তার দিন যাবে ভালোবাসার সংজ্ঞা বোঝাতে বোঝাতে। বোঝানো পরও তার প্রশ্ন হতে পারে, ‘ভালোবাসলে কি হয় শুদ্ধ ভাই? ধরুন আমি বাসলাম না তো তাতে কি বাংলাদেশ এতিম হয়ে যাবে?’ এসব পাগলের সাথে পাগলামি
করার বয়স তার নেই। এসব ভাবতে ভাবতে শুদ্ধর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল। গতদিন তার ফোনে শখের নাম্বার থেকে বড় একটা লিস্ট এসেছে। সবগুলো মেয়েদের সাজগোজের জিনিস। নামগুলো মন রাখা কঠিন। এক একটা নাম পড়ে মনে হয়েছে এর থেকে জীবাণুর নাম মনে রাখা সহজ। অন্তত কাজে দিবে। মোটকথা, শখ কখনো এসব মেয়েলি
হাজিবাজি আনার কথা তাকে বলবে না। একাজ কার বুঝতে একটুও।কষ্ট হয় নি তার। এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে শুদ্ধ শরীর এলিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। অতঃপর লং জার্নি পার করে যথাসময়ে দেশের মাটিতে পা রাখল। এরপর বন্ধুরা একে অপরের থেকে বিদায়
উবার নিয়ে বাসার পথে রওনা হলো।

গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ধারালো একটা করাত কিনে গুদামঘরে ঢুকল আজম। অন্যহাতে প্যাকেট মোড়া টাকিলা। আজকের আসর সেই জমবে। টাকিলা গলায় ঢালতে ঢালতে করাতের কাজ সারবে। বহুদিন টাকিলার স্বাদ নেওয়া হয় না৷ শাহরিয়ার ভাইকে সাহস করে সে বলতেও পারে না একটা টাকিলা কিনে দিতে। গতকাল রাতে শাহরিয়ার ভাইপার্টি অফিস রুমে তাকে ডেকে হঠাৎ শুধাল,
-‘বিদেশি ব্যান্ড নাকি খাঁটি বাংলা?’
আজম কথার মানে বুঝতে না পেরে মুখ কাঁচুমাচু করছিল। সাহস করে জিজ্ঞাসাও করতে পারতে পারছিল না। পরে চট করে কথাটা ধরে ফেলে
দাঁত বের করে হাসল। ধরে নিলো ভাইয়ের মন ভালো। কারণ মন ভালো থাকলে ভাই সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেয়, মজা করে, নিজের খরচে ব্র্যান্ড চাখার সুযোগ দেয়। আজও হয়তো সেই দিন বোধহয়। মনে মনে এসবই ভাবছিল সে। খুশিতে ছলমল করছিল তার মুখ, চোখ। তখন সায়ন দশ আঙ্গুলের সাহায্য আঙ্গুল ফুটাতে ফুটাতে বলল,
-‘ ভোঁতা জং ধরা করাত আনবি। এরপর ভোঁতা করাত দিয়ে ধীরে সুস্থে এবড়ো-থেবড়ো করে ওদের চার হাত-পা কাটবি। ভুলেও যেন কাটাকাটি স্মুথ নাহয়। আর হ্যাঁ, পাঁচজন ওরা। ৫×৪= ২০ হয়। মোট ২০ টা হাত পা চটের বস্তায় ভরে ঠিক সকাল দশটার মধ্যে আমার সামনে এনে হাজির করবি। যদি দশটা এক’ও বাজে তাহলে তোকেও ওই অবস্থা দান করব।’

-‘ওকে ভাই।’
-‘ আর হ্যাঁ, চেয়ারে বেঁধে কাটবি। জ্যান্ত অবস্থায়।’
-‘ঠিক আছে ভাই।’
-‘সিদ্দিকের দিকে নজর রাখতে বলেছিলাম।’
-‘ রেখেছি। সে এখন পাগলা কুকুরের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ক্ষমতার লোভে বউটাকেও অন্যের বিছানায় পাঠায়। সব খবর আছে ভাই। ইশারা করামাত্রই সব ভাইরাল করে দেবো।’
-‘হুম।’
-‘কনকের বোনকে রেপ করেছে কে?’
-‘ জানি না ভাই। তবে কনক কাল আপনার নামে পুলিশ কেস করেছে। তার মতে, পুরনো শত্রুতার জের ধরে আপনিই একাজ করেছেন।’
-‘আমি বুঝি না, কনক আমার মারা খেতে এত লাইক করে ক্যান। একা একা আর কতজনকে মারা দেবো আমি? আমিও তো মানুষ। এনার্জি বলেও একটা ব্যপার আছে। সিদ্দিক যে এত আদর যত্ন করে ওর পেছন মারা দিলো। অথচ সে ওদিক ওদিক তাকিয়ে সত্যিটা না জেনে সমানে আমার নামই জপে যাচ্ছে। শালায় সত্যি সত্যিই আমারে টুরু লাভ মারে। আমিই খালি এসব বালছাল কিছু বুঝি না তাই।’

আজম মুখ টিপে হাসল। সায়ন তখন এক বান্ডিল টাকা টেবিলের উপর রেখে নিতে ইশারা করল। সে নিলো। এরপর দলবেঁধে টাকিলা নিয়ে চলে এলো ডালের গুদামঘরে। এখানে আজ কাজ আছে মেলা। সব সারতে
হবে। ভাই ওদেরকে খুশি করেছে তাই তারাও ভেবেছে সকাল দশটা নয়, রাত দশটার আগেই কাজ সেরে ফেলবে। এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে তারা গলায় টাকিলা ঢেলে লেগে গেল আদেশকৃত কাজে। তাদের দেখে ছটফট করতে লাগল পাঁচজন যুবক। বাইরে থেকে মনে হবে কেউ
গুদামঘরে রড কাটার কাজ করছে। নতুবা পুনরায় তা মেরামতের কাজ করছে। আসলে সেসব কিছুই না। তারা একপাশে গ্রিল মেশিন অন করে অন্য পাশে জ্যান্ত মানুষের হাত পা কাটছে।

পরেরদিন সকাল দশটা,
দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান মাস। পরশুদিন থেকে রোজা শুরু৷ রোজা উপলক্ষ্যে বাজার সদাইয়ের লিস্ট করতে বসেছে সিঁতারা । উনাকে সাহায্য করছে সিরাত ও সিমিন। তিন জন মিলে বড় লিস্ট করে ধরিয়ে দিলেন সাওয়ান চৌধুরীর হাতে। সাওয়ান চৌধুরী যেতে গেলে চট করে উনার পথ আগলে ধরল সাম্য, সজৃন।জেদ ধরল তারা বাবার সাথে যাবে। বাজার করে বাড়ি আনবে৷ তারা বড় হয়েছে কাজ করতে পারবে। সায়ন, শুদ্ধ ভাইয়ের মতো তারা এবার দায়িত্ব নেবে। সেই দায়িত্ব পালন করবে৷

সাওয়ান চৌধুরী বোঝাতে পারলেন না এ সময় বাজারে খুব ভিড় থাকে। প্রচন্ড গরম। এত গরমে শরীর খারাপ করবে। অন্য আরেকদিন বাজার করতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু না তারা শুনলোই না। অগত্যা জেদের কাছে হার মেনে তাদের নিয়ে যেতেই হলো। শারাফাত চৌধুরী বারবার গাড়িতে করে যেতে বললেন। কিন্তু সাম্য, সৃজন এবারও গো ধরল তারা রিকশায় যাবে। দুই ছেলের কথামতো সাওয়ান চৌধুরী তাদের নিয়ে রিকশায় চড়ে বসলেন। পাড়ার মোড় পার হতেই দেখা গেল সায়ন দাঁড়িয়ে আছে পার্টি অফিসের সামনে। ছেলেপুলে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে বোধহয়। কানে ফোন ধরে কথা বলায় ডাকল না কেউ। বাপ, ছেলেরা মিলে গল্পে গল্পে এগিয়ে গেলেন বাজারের দিকে।
আজ সরকারী ছুটির দিন। শখ, স্বর্ণ, শীতল কেউ দুদিন বাসায় ছিল ন। শতরুপা চৌধুরীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। কিছুক্ষণ হলো বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেছে৷ দুদিন আগে শীতল হঠাৎ’ই গোঁ ধরল সে ফুপির বাসায় যাবে। বলামাত্রই ব্যাগ প্যাক নিয়ে রেডি। মূলত শুদ্ধ আসার কথা শুনে সে দ্রুত পালানোর পায়তারা জুড়েছিল। পরে তাকে একা না ছেড়ে শখ, স্বর্ণ ওর সাথে গিয়েছিল। দুটো দিন থেকে যখন শুনল শুদ্ধ ফিরতে আরো দেরি হবে তখনই বাসায় ফিরে এসেছে। আপদ এখন বাসায় নেই, আসতে দেরি হবে, একথা ভেবে শীতলের প্রাণবন্তরুপটা ফিরে এসেছে।

এখন ক’দিন ইচ্ছে মতো ঘুরবে, ফিরবে। কিয়ারার সাথেও কথা হয়েছে আজ শপিংমলে যাবে দু’জন। দেখে আসবে এবারের ইদে কোন ড্রেসের চাহিদা বেশি। কোন, কোন কালারটা ক্রেতারা পছন্দ করছে। রোজা শুরু হতে না হতেই তার ড্রেস নিয়ে চিন্তিত। এই নিয়ে সিমিনের কানের কাছে কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে বকা খেয়ে তারপর থেমেছে।
হাতের কাজ সেরে সিঁতারা চৌধুরীর মনে পড়ল সকালের ওষুধটা খেতে ভুলে গেছেন। রুমে ড্রেসিংটেবিলের সামনেই রাখা উনার ওষুধের পাতা।
যেতেও ইচ্ছে করছে না। উনার সোফায় বসে দেখলেন শীতলকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসেছে। তাই তাকে বললেন,

-‘শীতল, আমার রুম থেকে ওষুধের পাতাটা এনে দে তো মা।’
-‘কোন ওষুধের পাতা বড় মা?’
-‘সাদা পাতা।’
-‘কোথায় আছে?’
-‘ড্রেসিংটেবিলের উপর।’
-‘আচ্ছা।’
একথা বলে সে চলে গেল গেল বড় মায়ের ঘরে। সামনে রাখা ওষুধের পাতা। সে সেটা নিয়ে বের হতেই চোখ পড়ল একটা এ্যালবামের দিকে।
এটা চিনে সে। দেখেছেও বহুবার। তবুও বড়সড় এ্যালবামটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। এখানে বড় মা, বড় আব্বুর, বিয়ের সব ছবি আছে। আছে তাদের সব ভাইবোনদের ছোটোবেলার স্মৃতি। দাদা-দাদীর ছবিও আছে। সে বড় মাকে ওষুধটা দিয়ে সোফায় হাঁটু মুড়ে ছবি দেখতে বসল। আগেও দেখেছে তবুও বারবার দেখতে ভালোই লাগে। হাসাহাসি হয়। ততক্ষণে সিঁতারা সরে এসে বসেছে তার পাশে। উনিও দৃষ্টি দিয়েছে
এই দিকেই। এক একটা ছবি মনে করিয়ে দিচ্ছে একটা একটা মুহূর্তের কথা। গল্পে গল্পে শীতলকে সেসব গল্প শুনাচ্ছেনও। শীতল মন দিয়ে তা শুনছে। কখনো খিলখিল করে উচ্চযোগে হেসে উঠছে। তার সঙ্গে তাল মিলাচ্ছেন সিঁতারাও।

তখন কলিংবেশ বেজে উঠল। সিমিন এদিকেই আসছিলেন দেখে উনিই দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে কারো সাথে কথা বলছে মানে পরিচিত কেউই হবে ভেবে সিঁতারা কিংবা শীতল কেউ পাত্তা দিলো না। নিজেরা নিজেদের গল্পে মেতে থাকল। তখন শীতল একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ডাকল,
-‘বড় মা?’
-‘হুম।’
-‘কলেজে থাকাকালীন শুদ্ধ ভাই হাবাগোবা টাইপের ছিল, তাই না?’
-‘মোটেও না। আমার ছেলের চোখ, নাক, মুখ, ঠোঁটের আর্ট দেখেছিস?
-‘হুম দেখেছি, পুরাই দেশি হাম্বা টাইপের।’
-‘কিহ্! আমার ছেলের চোখ, মুখ, হাম্বা টাইপের?’
-‘হুম, কেন তুমি জানতে না? এই দেখো, শুদ্ধ ভাইয়ের এই ছবিতে গরু গরু চোখ গুলো ভালো করে দেখো। মোটা, চওড়া, করে কাজল দিয়ে দিলে পুরাই দেশি গরু।’

তখন পাশে কাউকে বসতে দেখে দু’জনই তাকাতেই দেখে ক্লান্ত শরীরে শুদ্ধ এসে বসেছে। শীতল চোখ সরিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে আড়চোখে আরেকবার তাকাল শুদ্ধর দিকে। শুনে নিলো নাকি? মার না খেতে হয়!
তবে হাবাগোবাটা আর হাবাগোবা নেই, সুদর্শন পুরুষে পরিণত হয়েছে।
মুখে যত যায় বলুক বিশুদ্ধ পুরুষের পুরুষালি চোখ গুলো অদ্ভুত সুন্দর। চোখ, মুখের আর্ট সত্যিই মুগ্ধ করার। প্রশ্বস্ত বুক। মাথাভর্তি চুলে নিউ হেয়ার কাট। লম্বায় কত হতে পারে? সঠিকটা জানা নেই তবে অনেকটাই লম্বা। তাকে চোখ তুলে উপরে তাকিয়ে কথা বলতে হয়। যদিও চৌধুরীরা সবাই উচ্চতায় এমন। সে আর তাকাল না আর না আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলল। দেখা যাবে কিছু বলতে গেলে ত্যাঁড়াব্যাঁকা কথা বলে বসে থাকবে।
সিঁতারা ছেলেকে দেখে চট করে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। কুশল বিনিময় করলেন। সিরাত, সিমিন তাকে ক্লান্ত দেখে ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার তাড়া দিলেন। শীতল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তার মা চাচীদের ব্যস্ততা। কিছুক্ষণ আগে তারাও দুদিন পর তো বাড়ি এলো। কই কেউ তো এমন করল না। অথচ বিশুদ্ধ পুরুষের কদর দেখো। সে মুখটা বাঁকিয়ে একটা খোঁচা মেরেই দিলো,

-‘ যান, যান, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন শুদ্ধ ভাই। রাজ্য জয় করে ফিরেছেন কত ধকল গেছে। একটু বিশ্রাম না নিলে হয়? তাছাড়া মেয়ে মানুষের সাথে আকাশে আকাশে উড়াউড়ি করা কি চারটে খানি কথা নাকি?’
একথা শুনে শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বাড়ি আসতে না আসতেই খোঁচা মারা শুরু। এরপর শুরু করবে জ্বালাতন করা। ফলস্বরুপ তার শক্তহাতে মার খেয়ে এরপর যদি থামে। তাকে তাকাতে দেখে শীতল উঠে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে পুনরায় শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৪

-‘মানুষ রাজ্য জয় করে আসে। অনেক অনেক টাকা ইনকাম করে। অথচ কাউকে কিছু দিয়ে আফসোস করে সেটা আবার কেড়েও নেয়। হায়রে দুনিয়া। পৃথিবীতে মানবিকতা বলে কিছু নেই। আল্লাহ এসব জল্লাদদের তৌফিক দান করো। রমজানের উসিলায় এদের মনে মায়া দাও, আমিন!’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ২৬