শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৬
নূরজাহান আক্তার আলো
শুদ্ধ সায়নকে বাড়িতে পাঠিয়ে পুনরায় এসেছে হাসপাতালে। যা লাগবে হাসপাতাল থেকে ব্যবস্থা করা হবে। সারাদিন রোজা থেকে দৌড়াদৌড়ি করে প্রায় সবাই ক্লান্ত। তাছাড়া মেডিসিনের প্রভাবে পেশেন্টরা ঘুমাচ্ছে।
এখানে আপাতত সবাই না থাকলেও চলবে। রুবাবকে বলেছিল বাকিরা যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাকিরাত সে থাকবে হাসপাতালে। রুবাবও ওর কথামতো তাই করেছে। এবং শুদ্ধকে কলে জানিয়েছেওতা। কিন্তু শুদ্ধ এসে দেখে রুবাবের কাঁধে মাথা রেখে শীতল ঘুমাচ্ছে। ওকে দেখে রুবাব ইশারা করল কথা না বলতে। কারণ কেবলই ঘুমিয়েছে মেয়েটা।
শুদ্ধর বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বিরবির করতে করতে চলে গেল নার্সদের সাথে কথা বলতে। আর কোনো সমস্যা হয়েছে কী না জানা দরকার। না তেমন কোনো সমস্যা হয় নি দেখে ফিরে এলো আইসিইউ এর সামনে। তারপর ধীর কন্ঠে রুবাবকে বলল,
-‘তুইও বাড়ি চলে যা।’
-‘কিন্তু শীতল?’
-‘ওটা তো ঘুমালে মরা গরু। এভাবে কেউ ঘুমায়? ঘাড় ব্যথা করবে না? দাঁড়া ওকে কেবিনে শুঁইয়ে দিয়ে আসি। আমার একটা কথা যদি শোনে বেয়াদবটা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে থাপড়ে দাঁত ফেলে দিতে।’
-‘থাক বকিস না।’
-‘না বকব না কোলে তুলে নাচব।’
একথা বলতে বলতে শুদ্ধ রুবাবের কাঁধ থেকে শীতলের মাথা নিজের বুকের কাছে নিলো। এরপর ধীরে সুস্থে শীতলকে কোলে তুলে হাঁটা ধরল কেবিনের দিকে। রুবাব ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসল। ভালোও নাকি বাসে না আবার যত্নেরও কমতি রাখে না। শীতলকে ঠিকঠাকভাবে শুইয়ে দিয়ে এসে রুবাবকেও চলে যেতে বলল। এদিকে সেহরীর সময় হয়ে আসছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুবাব ওদেরকে সাবধানে থাকতে বলে রওনা হলো বাড়ির পথে। শুদ্ধ কেবিনে ফিরে পাশের ফাঁকা বেডে শরীর এলিয়ে দিলো। কি ভেবে যেন ঘাড় কাত করে তাকাল ঘুমন্ত শীতলের দিকে। এই বোকা রাণীটা জানে তার জন্য কত কী ঘটেছে। এমনকি সে এতরাতে কোথায় থেকে ফিরল? কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল? কিছু জানে না। হয়তো জানবেও না কারণ বর্তমানে তার ত্রি-সীমানায় আছে কঠোর নজরদারী। সর্তকতা।
না রেখেও উপায় ছিল না কারণ ঘোর বিপদ যে দোর গোড়ায়। এসব ভেবে সে নিঃশব্দে উঠে বসল। রক্ত নেওয়ার সময় যেখানে সূঁচ ফুটানো হয়েছিল সেখানে লাল হয়ে আছে। মেয়েটার শরীর এত নাজুক আলতো স্পর্শেও লাল হয়ে যায়। সে হাত থেকে নজর সরিয়ে তাকাল ওই আদুরে
মুখটা দিকে। এই আদুরে পুতুলটাকে ভালোবাসার কারণ জানে না। তবে ছোটো থেকে কেন জানি মনে হতো এই জীবন্ত পুতুলটা শুধু তারই রুমে শোভা বাড়াবে। তারই হবে। হতেই হবে। কারণ পুতুলের জন্য তার বুকটা হবে নিরাপদ আবাসস্থল। একথা ভেবে সে উঠে দাঁড়াল। বোতল থেকে পানি খেয়ে পুনরায় শুতেই সায়নের থেকে মেসেজ এলো, ‘she’s okay.’
মেসেজ দেখে স্বস্থির শ্বাস ছাড়লেও বুকের দাবানল যেন তখনও জ্যান্ত।
এবং এটাও অবগত এই দাবানল এত সহজে থামার নয়। মনে মনে এসব ভেবে ঘুম আসবে না জেনেও চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। কারণ তার পাশের বেডে থাকা ঘুমকুমারীর চোখের পাতা পিটপিট করছে। এতক্ষণ সে অভিনয় করছিল বুঝতে বাকি রইল না। দিনকে দিন এত ফন্দিবাজ হচ্ছে মেয়েটা। তবে এই মুহূর্তে পাজিটার বাচলতার হাতে থেকে বাঁচতে তাকেও এখন ঘুমানোর অভিনয় করতে হবে। সত্যি সত্যিই শুদ্ধ চোখের
পাতা বন্ধ করতেই শীতল চোখ খুলে তাকাল। কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ঘুমন্ত শুদ্ধকে। বালিশ ছাড়াই ঘুমাচ্ছে মানুষটা। সে উঠতে গেলে হতচ্ছাড়া বেড শব্দ করতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল।যখন দেখল শুদ্ধর ঘুম ভাঙ্গে নি তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। অতঃপর সে বেড থেকে নেমে কেবিনের বাইরে গেল। তাকে যেতে দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকে মাথা উঁচিয়ে তাকাল। পাক্কা এক মিনিটের মধ্যে কেবিনে না এলে চড়িয়ে ভেতরে আনবে বলে ভেবেও নিলো। মিনিট না চল্লিশ সেকেন্ডের
মাথায় ফিরে এলো শীতল। সাম্য, সৃজন ও সিরাতকে দেখতে গিয়েছিল।
সব ঠিকঠাক দেখে কেবিনে এসে নীরবে পায়চারী করল। নখ কামড়াতে কামড়াতে শুদ্ধর দিকে দু’একবার উঁকিঝুঁকিও মারল। সে ঘুমাচ্ছে ভেবে একবুক সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো। তারপর ধীরে ধীরে শুদ্ধর মাথা ধরে বালিশে রাখল। শুদ্ধর কাঁচা ঘুম না ভাঙ্গিয়ে কাজটা করতে পেরে মিষ্টি করে হাসল। তারপর কিছুক্ষণ শুদ্ধর মুখপানে তাকিয়ে বিরবির করল,
-‘এই যে বিশুদ্ধ পুরুষ আমাকে ভালোবাসতে শেখাবেন? দখিনা হিসেবে আমার আমিটাকে দিয়ে দেবো।’
একথা বলে একটু থামল। তারপর মুখ বাঁকিয়ে শুদ্ধর টিকালো নাকের উপর আলতো করে টোঁকা মেরে পুনরায় বলল,
-‘এই নাকের ডগায় এত রাগ কেন শুনি? এখন এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেই? একটা ভুল করেছি নাহয় তাই বলে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে?
একটা সুযোগ তো দিন। আর কষ্ট দেবো না তো।ওই ভুলটাই নাহয় ফুল করে ভালোবাসা সমতে আপনার কাছে অপর্ন।’
শীতল আপনমনে বিরবির করে কথাগুলো বলে দ্রুত সরে এলো। কখন উঠে যায় বলা যায় না। কি দরকার এত রিস্ক নেওয়ার? তারপর সে উঠে এসে তার বেডে শুয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। অথচ শীতল টেরও পেল না পাজি পুরুষটা সব শুনেছে। সব শুনে মনে মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এবং এই শান্তরুপী পুরুষটা ঘন্টা তিনেক আগে কী কান্ডটাই না ঘটিয়ে এসেছে সে।
_★ঘন্টা তিনেক আগের ঘটনা( গতপর্বের শেষাংশ থেকে এর সূচনা),
কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা এক নারীর মুখ। উফ! উফ! দারুণ দুটি চোখ। চোখেও যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। ইয়াসির তাকে আপাদমস্তক দেখে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটি বাক্যই উচ্চারণ করল, ‘অগ্নিকন্যা।’ তবে এই শব্দ উচ্চারণ করার আগেই মেয়েটি শুট করে বসল তার বুক বরাবর…!
যদিও টার্গেট বুঝে দ্রুততার সাথে বসে পড়েছিল মাটিতে। এরপরপরই উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটা আর পায় নি। এদিক ওদিকে খুঁজতে গিয়ে শুনতে পায় কারো ফিসফিসানি শব্দ। সেই শব্দ অনুসরণ করে একটু এগোতেই হাতের ঘড়িটা রেড এলার্ট দিতে থাকল অনবরত৷ অর্থাৎ এখানে সেইভ নয় সে। সেটা দেখেও হাসল। ছোটো থেকে বড় হয়েছে রিস্ক নিতে নিতে।
জীবন নিয়ে বাজি ধরতে তার ভালোই লাগে। মোদ্দাকথা, মাফিয়া কিং
তো এমনি এমনি হয় নি। সামান্য একটা রেড এ্যার্লাটে যদি পিছনে যায় তাহলে কী ভালো দেখায়? না, মোটেও না! তাছাড়া কাপুরুষরা পালায়।
একথা ভেবে সে ত্রূদ্ধ হেসে পেছনে সরতেই কারো উপস্থিতি টের পেল। চট করে পেছনে ঘুরে পিস্তল তাক করতেই দূর হতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো শোয়াইব শুদ্ধর শক্ত পোক্ত শারীরিক অবয়। তার থেকে পাঁচহাত দূরত্বে দারুণ এক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি।
তীক্ষ্ণ চাহনীতে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ছেলে হয়েও সে বলতে বাধ্য এই সাইন্টিস্টের এটিটিউডের হাই লেভেলই তার পারসোনালিটির পরিচয় দেয়। বডি ফিসনেস দেখতে যেমন তেমনি ধারালো তার ধূর্ততা। নয়তো এত তাড়াতাড়ি তাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা না। শুদ্ধও আজ সরাসরি দেখল মাফিয়া কিং এর সুদর্শন রুপ। ইয়াসিরের নীলাভ চোখ আর ফেস বলে দিচ্ছে দেশী বিদেশী মিলিয়েই তার মুখাবয়। অদ্ভুত রকমের সুন্দর দুটি চোখ। ডান চোখের পাশটায় কাটা দাগ। নিঁখুত শারীরিক গঠন এবং
গায়ের রং ফর্সা। বয়সটা সম্ভবত পয়ঁত্রিশ থেকে আঁটত্রিশের কাছাকাছি। এই হচ্ছে মাফিয়া কিং ইয়াসিন খান!
এতদিন ছবি কিংবা ভিডিওতে দেখার পর শুদ্ধকে সামনাসামনি দেখে
ফিচেল হাসল ইয়াসির। শুদ্ধকে এখানে দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছে। তবে বিষ্ময়ভাবটা চট করে লুকিয়েও ফেলল। শত্রুকে দূর্বলতা দেখাতে নেই। দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। হাইট প্রায় সমানে সমান। মুখে রা শব্দ নেই কারো। তবে চার চোখে ভয়াল শিকারী চাহনী।
সেই চাহনীতে যেন ধ্বংস অর্নিবার্য। তাদের দেখে মনে হচ্ছে একজন ভয়ানক হার্পিয়া তো আরেকজন আকুইলা ক্রিসায়েটোস। দু’জনই শক্তিশালী শিকারী। শুদ্ধ ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসল। বসার ভঙ্গিমাও ছিল চমৎকার। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ এখনো ইয়াসিরের দিকে। তাকে বসতে দেখে ইয়াসিরও বুঝে নিলো কিছু বলতে চায় শুদ্ধ। কী বলে শোনা দরকার। তাই সেও এক পায়ের উপর পা তুলে বসল মরা গাছের গুঁড়ির উপর। তারপর হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে ঘাড়ের কাছটায় চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-‘ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না আমি কাজের কথায় আসা যাক।’
-‘যাক।’
-‘FGSL নামে যেই ফমূর্লা তৈরি করেছিস ওটা আমার চাই।’
ফমূর্লার কথা শুনে শুদ্ধ অদ্ভুত কায়দায় এক ভ্রুঁ বাঁকিয়ে বলল,
-‘তারপর?’
-‘ওটা আমার লাগবে।’
-‘এইটুকুই?’
-‘ এইটুকুই যে নয় সেটা বুঝতে এখনো বাকি আছে নাকি চৌধুরী? যখন আমার মুখেই শুনতে চাচ্ছিস তখন বলছি শোন, তোর বাড়ির সবচেয়ে আদুরে ফুলটা আমার চাই। চাই মানে চাই-ই চাই। ফুল দে পাক্কা প্রমিস
দেশ ছেড়ে চলে যাব আর জ্বালাব না তোদের। খুব যত্নে রাখব ভাই দিয়ে দে।’
-‘ফুলে যেমন সৌরভ আছে তেমনি কাঁটাও আছে সেটা জানিস?’
-‘ সেই কাঁটা কে, তুই বুঝি?’
-‘ধরে নে তাই।’
একথা শুনে ইয়াসির হো হো হেসে উঠল। কিন্তু হাসতে হাসতে কোথায় থেকে একটা গুলি এসে বিঁধল তার বাঁম পায়ে। গুলি ক্যাত করে গেঁথে গেছে মাংসে। গুলি এলো কোথা থেকে? কে করল? ইয়াসির উত্তেজিত হলো না সেভাবেই বসে রইল। শুদ্ধ ফিচেল হাসল। তারপর কন্ঠে অবাধ কঠোরতা ঠেলে জোর গলায় বলল,
-‘ ওটা আমার সঞ্জীবণী ফুল। আমার! ওই অমৃত ফুল যেমন প্রাণ দেয় তেমনি প্রাণ নেয়’ও। এবং সেই ফুল রক্ষা করে বিষধর সাপ। সেসব কাল কেউটে সাপের বিষ হজম করতে পারবি না তুই। বরং মেপেগুনেও শেষ করতে পারবি না ঠিক কতটা সাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুধু ওই একটা ফুলের পেছনে। তোকে আমি বারবার ওয়ার্নিং দেবো না। ধরে নে এটাই ফাস্ট এ্যান্ড লাস্ট চান্স। এরচেয়ে বেটার হয় বিদেশী মাল বিদেশে ফিরে যা।’
-‘দেশটা কি তোর বাপের কেনা?’
-‘না তোর বাপের কেনা তবুও থাকতে পারবি না।’
শুদ্ধর কথা শুনে ইয়াসির বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়াল। তারপর আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে বলল,
-‘কোথায় যেন শুনেছিলাম অন্যের জিনিস কেড়ে নেওয়ার মজা অমৃত সমান। অভিজ্ঞতা আছে নাকি?’
-‘ না, ওসব ছোটোলোকী কারবার। ছোটো লোকদের মাঝে এসব দেখা যায়। আর আমরা হলাম চৌধুরী। আমাদের সঙ্গে সেসব যায় না। তবে তোর সঙ্গে কিন্তু খু্ব যায়। ‘
-‘(….)’
একের পর এক অপমানজনিত কথা শুনে ইয়াসিরের মুখ থমথমে হলো।
ইচ্ছে করল এখনই একটা বুলেট শুদ্ধর বুকে গেঁথে নিতো। কিন্তু তাতে খেলা শেষ যাবে। এত সহজে জিতে গেলে খেলার মজা আসে না। তাই সে গা ঝাড়া দিয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বলল,
-‘বাংলার আকাশে বাতাসে প্রেম প্রেম গন্ধে ছড়াছড়ি। প্রেমের নেশালু সুগন্ধে আমার লোভী মনটাও যে এবার শীতল হতে চাইছে। শীতলের শীতলতা সর্বাঙ্গে মাখতে ইচ্ছে করছে।’
-‘ লোভে পাপ আর পাপে কাফন ছাড়াই সাড়ে তিনহাত মাটির কবর।’
-‘ চ্যালেঞ্জ করছিস?’
-‘ চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতেও তো যোগ্যতা লাগে। এই যোগ্যতা আছে নাকি তোর?’
-‘শোয়াইব মুখ সামলে বস। হাত ফঁসকে গেলে শেষ নিঃশ্বাস এখানেই ছাড়তেই হবে।’
-‘সরি, বিন্দুমাত্র ভয় পেলাম না এবার অন্যকিছু ট্রাই কর দেখি।’
শুদ্ধর কন্ঠে ব্যাঙ্গাতুর সুর স্পষ্ট। শীতলের কিডন্যাপিংয়ের পর থেকেই শুদ্ধর কাজ ছিল পাতাল ফুঁড়ে হলেও ইয়াসিরকে খুঁজে বের করা। সে তাইই করেছে। মাঝের দিনগুলোতে স্থির হতে পারে নি। শান্তিতে একদন্ড ঘুমাতে পারে নি। বারবার মনে হয়েছে চৌধুরী বাড়ির মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে কেউ। এত বড় কলিজা! এত দুঃসাহস! সেই ব্যাক্তিকে তার মুখোমুখি চায়। পাওয়ার পর কী করবে ওটা পরের হিসাব, তবে চায়। সে কথায় নয় বরং কাজে বিশ্বাসী। গোপনে সারা ওর মুদ্রাদোষও বটে। ঠিক এই স্বভাবের কারণে গোপনে ইয়াসিরকে খুঁজে বের করে ফেলেছে সে।
স্কাইড্রাইভিং ছিল ছুঁতো মাত্র। সেখানে মূলত গিয়েছিল ইয়াসিরের খোঁজ পেতে। পারসোনাল জেট ভাড়া করেছিল ইয়াসিরের জোট ফল করতে।
আর এসব করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাশিয়ান সাইন্টিস্টি মিখাইল ইগর এর নাম। ইগনের সাথে শুদ্ধর সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত। কারণ ইগর
প্রচন্ড অহংকারী ও সুবিধাবাদী। তাছাড়া সে মুসলিমদের দেখতে পারে না। এবং ষাটোর্ধ্ব বয়সী ইগর নিজেকে সর্বদা সর্বোত্তম ভাবে। অন্যের শ্রম, মেধা তার কাছে হেয়। এবং বলা বাহুল্য, ইগর হায়ার করেছে এই মাফিয়া কিং ইয়াসিরকে খানকে। কেন করেছে? কারণ শুদ্ধ মাস ছয়েক আগে ইগরের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে। কোটি টাকার অফার দেওয়ার পরও তার তৈরি করা একটা ফমূর্লা ইগরকে দেয় নি। এটাও মূলত তার রাগ। ধূর্ত লোকটি নিজেকে আড়ালে রেখে বাংলাদেশেও এসেছিল। হাত মিলিয়েছিল সায়নের চরম শত্রু আবু সিদ্দিকের কাছে। আর সিদ্দিকের মাধ্যেমেই ইয়াসিরকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সিদ্দিক আর ইগর হয়তো জানে না ইয়াসিরও আরেক চিজ। তাদের থেকে লক্ষকোটি
টাকা হাতাতে দু’জনকে নিয়ে আরেকটা কড়া দান সাজিয়েছে। যে দানে
ইয়াসির হয়তো ভেবেছে একাই বাজিমাত করবে। কিন্তু ও হয়তো ভুলে গেছে বাপেরও বাপ থাকে..!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইয়াসির উঠে দাঁড়াল। পা থেকে এখনো রক্ত ঝরছে দেখে রুমাল বের করল। তারপর পা বাঁধতে বাঁধতে হাসতে হাসতে বলল,।
-‘ইয়াসিরের নজর পড়েছে অথচ সে জিনিস পাই নি এমনটা কখনো হয় নি। তবে তোর ফুল কবে তুলব জানি না তবে ওয়াদা করছি তুলবোই।’
একথা বলতে না বলতেই ক্ষীপ্ত গতিতে একটা ঘুষি এসে পড়ল তার নাক বরাবর। শুদ্ধ থামল না। পরপর দুটো দানবীয়রঘুষি মারতেই ইয়াসিরও পাল্টা আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। সেই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হলো সায়ন। ছোটো ভাইকে মারতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল,
-‘এ্যাই হারামজাদা ছাড় আমার ভাইকে, ছাড়। আমার ভাইয়ের গায়ে একটা টোঁকা পড়লে তোর নতুন করে করে খাৎনা করাব শালা।’
ইয়াসির শুনল তবে থামল না। সেও একটা ঘুষি মেরে দিয়ে বলল,
-‘সরি ব্রো, দুম করে মেরে দিয়েছি আর একটু আগে বলবেন না? আর
আপনার ভাইটা যা দুষ্টু একথা কথাও শোনে না। তাছাড়া আমাদের ফুল ভাগাভাগি হচ্ছে আপনি এর মধ্যে আসবেন না।’
-‘হ্যারে শুদ্ধ মাসির ছেলে মামাতো ভাই কয় কী এসব? এ্যাই চ্যাংরা এই চিনোস আমারে? এক্কেবারে খাইয়ালামু।’
-‘আমি ছেলে হয়ে ছেলে খেতে পারি না, রুচিতে বাঁধে।’
একথা শুনে শুদ্ধ ও সায়ন দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকাল। সায়ন এগিয়ে গিয়ে ইয়াসিরের শার্টের কলার ঠিকঠাক করে বলল,
-‘ওভার স্মার্ট সেজো না ব্রো। খাওয়া-খাওয়ির ব্যাপারে আমি কিন্তু কম যাই না? যাও এবার রাস্তা মাপো নয়তো এমন দোচন দেবো মুখ কুঁচকে আউচ করারও সময় পাবে না।’
একথা বলতে না বলতে সেখানে কালো পোশাধারী অনেকগুলো ছেলে এসে হাজির হলো। এসে দাঁড়াল ইয়াসিরের দিকে। বুঝতে বাকি রইল না তারা ইয়াসিরের লোক। তবে তাদের দেখে শুদ্ধ ও সায়ন ভয় পাওয়া তো দূর কপালও কুঁচকাল না। ছেলেগুলো শুদ্ধ ও সায়নের দিকে এগোতেই
পরপর একইসাথে পাঁচটা অদৃশ্য গুলি এসে বিঁধল ফাঁকা মাটিতে। ভয়ে পিছিয়ে গেল তারা। বুঝল কেউ আড়ালে আছে। তবে ইয়াসির ইশারায় ছেলেদের পিছিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়ে বলল,
-‘শশুড়বাড়ির লোকদের অসন্মান করতে নেই। বউ গোস্তা করে। পিস্তল নামা।’
শীতলকে বউ বলায় রাগে শুদ্ধর মাথা চিরচির করে উঠল। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘সময় ভিক্ষা দিলাম কলিজার হেফায়ত কর। নয়তো তোর কলিজাখানা ইঞ্চি ইঞ্চি করে কাটার দায়িত্ব নেবো এবার। আই শোয়্যার, জাস্ট ইঞ্চি ইঞ্চি!’
এরপরই সেখানে গোলাগুলি শুরু হয়। কে মরল আর কে বাঁচল দেখার সময় নেই তাদের। ইয়াসিরকে আহত করে ফিরে আসে দুই ভাই। এরপর
বারোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে বসে কিছু ব্যাপারে আলোচনা করে। কথার মাঝখানে সায়ন হঠাৎ থেমে যায়। তারপর থেমে থেমে বলে,
-‘আমার মনে হয় শীতলের হাতে পিস্তুল তুলে দেওয়ার সময় এসে গেছে।’
সায়নের কথা শুনে ছাদের রেলিংয়ের উপর দুই পা ঝুলিয়ে বসল শুদ্ধ।
এখান থেকে পড়লেই কেল্লাফতে। অমাবস্যার রাত হলেও বাতাস বইছে।
বাতাসে উঠছে মাথায় চুল। ভাইয়ের দেখাদেখি বসল সায়নও। দু’জনের হাতে বিয়ারের বোতল। মুখ থমথমে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে শুদ্ধ জবাব দিলো,
-‘তোমার বোন বড্ড নাজুক। পিস্তুলের ভার সওয়া দূর পিস্তল দেখলেই জ্ঞান হারাবে।’
-‘ইয়াসির শালা যেভাবে পেছনে লেগেছে ওর এবার পাকাপোক্ত সেফটি প্রয়োজন। আমরা যতই ওর নজর রাখি নিজের সেফটি নিজের কাছে। দেখছিস না, এত কড়াকড়ি নজরদারীর পরেও পুনরায় আক্রমণ করে বসল বাস্টার্ডটা। ভাবতে পারছিস এসিডের ছিঁটেফোঁটা শীতলের মুখে পড়লে কি হতো?’
-‘কি আর হতো? ওই ব্লাডি বিচটার শরীরে ৩১৩ রকমের জীবাণু পুশ করে বসে বসে মজা দেখতাম।’
ভাইয়ের কথা শুনে সায়ন নীরবে মাথা দুলিয়ে মুচকি হাসল। আজকে হাসপাতালে রুবাব না থাকলে সাম্য, সৃজন, সিরাতের সাথে শীতলকেও হাসপাতালে এডমিট করতে হতো। কারণ হাসপাতালেও ছদ্মবেশে কেউ একজন এসে শীতলের মুখে এসিড ছুঁড়তে চেয়েছিল। যে ব্যক্তি ছুঁড়তে চেয়েছিল সে ধরাও খেয়েছে। আজম এতক্ষণ বোধহয় যত্নআত্নি করছে।
তার হিসাব আগামীকাল করা হবে। সায়ন আপাতত হাসি সামলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘কেউ নাকি আমার বোনকে ভালোবাসে না, বাসবেও না, তবে এত দরদ আসে কোথা থেকে?’
-‘ বাসি না তো। আর বাসলেই বা কি? তোমার বোন ভালোবাসা বুঝে? ভালোবাসা পিষে গুলে খাওয়ালেও বুঝবে না কিছু।’
-‘ পাগলিটা তোকে চোখে হারায় কিন্তু নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে না। কথা বল ওর সাথে। আর ভাব কি করবি?’
-‘কিসের কথা বলছো? সেফটির ব্যাপারে?’
-‘হুম।’
-‘পৃথিবী এত সুন্দর কেন জানো? কারণ পৃথিবীতে অতি চালাকের সাথে সাথে বোকাদেরও বসবাস। বোকারা আছে বলেই ভালোবাসার অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে। খেয়াল করে দেখবে চালাকরা কিছু ভালোবাসার মাঝেও ফায়দা খোঁজে। আর বোকারা কষ্ট পাবে জেনেও নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে।’
-‘কিন্তু পরিস্থিতি?’
-‘স্বর্ণ ইন্টিলিজেন্ট। আবেগী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না সেটা আমিও জানি আর তুমিও জানো। মূলত এ কারণে ওর হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। কিন্তু শীতল বোকা, আবেগী, মাথামোটা।
ধীরে-সুস্থে হাজারবার ভেবে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া ওর বদঅভ্যাস। মাঝে মাঝে ওর দুষ্টুবুদ্ধিতে ওই ধরা খায় দেখো না? তাকে যদি পিস্তুল দিয়ে সেটা লুকিয়ে রাখতে বলো দেখবে কোথায় রাখবে সেটা ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই ওকে নিয়ে এসব চিন্তা করা যাবে না। ও যেমন আছে তেমনই থাকুক। বরং এসব জানলে ভয় পাবে। সেই ভয়ই কেড়ে নেবে তার ডানা ঝাপটে মুক্তমনে উড়ে-উড়ে, ঘুরে-ঘুরে বেড়ানোর সুখ।
এরচেয়ে সে তার মতোই থাকুক। আমি আছি তো। ভরসা রাখো আমার উপর। কথা দিচ্ছি আমি জীবিত থাকতে তোমার বোনের উপর ফুলের টোঁকাও পড়তে দেবো না।’
শুদ্ধর কথাগুলো সায়নও গভীরভাবে ভাবল। শুদ্ধ কথাগুলো ভুল বলে নি। অতঃপর দুইভাই আরো কিছু ব্যাপারে আলোচনা করল। আধাঘন্টা পর সেখানে আর কয়েকজন হাজির হলো। তাদের নিয়ে একটা মিটিং হলো। টানা দেড় ঘন্টা সেই মিটিং শেষ করে সায়ন গেল বাড়ির দিকে আর শুদ্ধ হাসপাতালে।
সময় যেন বহমান স্রোত। সে আপনমনে বইতে থাকে নিজস্ব গতিতে।
আমাদের জীবনে সুখ কিংবা দুঃখ কোনোটাই স্থির নয়। সুখের পরেই যেমন দুঃখের আগমন। তেমনি দুঃখের পরপরই সুখ এসে ভুলিয়ে দেয় কিছু কষ্ট। কিছু ব্যথা।
এদিকে দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় দু’দুটো সপ্তাহ। সাম্য, সৃজন সিরাত আজ সকালে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে। চিকিৎসা এখনে চলমান তাদের। আরো সপ্তাহ খানিক ওদের হাসপাতালে থাকার কথা থাকলেও বাচ্চা দুটো বাড়ি আসার জন্য কেঁদে কেঁটে হয়রান। ঘুরে ফিরে একই কথা হাসপাতালে ভালো লাগে না। শুদ্ধ, সায়ন, রুবাব, শখ, স্বর্ণ, শীতল যে যেমন ভাবে পারে তাদের সময় দেয়। হাসাতে চায়। কিন্তু ওরা একসাথে কান্না জুড়ে আবদার ধরে বাড়ি চলো, বাড়ি চলো, এই জায়গা ভালো না। পরে দু’জন নার্সকে তাদের দেখভালের জন্যও আনা হয়েছে। রির্পোটে এসেছে সিরাতের মেরুদন্ডের হাঁড় না ভাঙ্গলেও ফাটল ধরেছে। বড্ড ভুগতে হবে উনাকে। এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। প্রচন্ড ব্যথা করে। ডাক্তারও জানিয়েছেন শারীরিক ক্ষত সারলেও এই সমস্যা দীর্ঘদিন থাকবে। সব মিলিয়ে এ ক’টা দিন চৌধুরী নিবাস যেন নেতিয়ে পড়েছিল। সুখ হারিয়ে গিয়েছিল যেন বাড়িটা থেকে। আজ গোটা চৌদ্দ দিনের মাথায় বাড়িটি আবার গমগম করছে। কথার হাঁট বসেছে। হাসি খুঁনশুঁটিতে বাড়ি মেতে উঠেছে। বিলাশবহুল ড্রয়িংরুমে বসেছে সকলের আনন্দমেলা। সব সদস্যা উপস্থিত। কোনো একটা কারণে হাসছে সবাই।
শারাফাত চৌধুরী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সবাই হাসি মুখ। এতগুলো দিন যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হতো উনার। হবে নাই বা কেন? এই বাড়ির বাচ্চাগুলোই তো বাড়ির প্রাণ। তারা কেউ অসুস্থ থাকলে ভালো থাকা যায় নাকি?
আজকে পনেরো রমজান। অথচ এতগুলো দিনে সবাই মিলে একসাথে ইফতার করতে পারে নি। তাই আজ বাড়িতে চলছে ইফতার পার্টি। সব কাজ হাতে হাতে করছে সবাই। সিরাত হুইল চেয়ারে বসে আছে। রোজ প্রতিবেলায় অনেকগুলো মেডিসিন নিতে হয়। যার ফলে রোজা রাখতে পারেন না। এই নিয়ে আফসোসের শেষ নেই উনার। সিঁতারা, সিমিন দুই জা কত কিছু বলে বোঝায়। মানসিক সার্পোট দেন। জায়েদের সার্পোট পেয়ে উনার বাপের বাড়িতেও যান নি উনি। কারণ উনি খুব ভালো করে জানেন এখানে উনার বিন্দুপরিমাণ অযত্ন হবে না। বরং এই বাড়ি ছেড়ে গেলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। বিয়ের আগে ভাবতেন বাপের বাড়ির মতো শান্তি আর কোথাও নেই। কিন্তু এখন ভাবেন নিজের সংসার ছাড়া শান্তি বুঝি আর কোথাও মিলবে না। এখানেই শান্তি, এখানেই সব স্বস্তি।
শুদ্ধ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল। এসে দেখে তার রুমের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে কে গেছে বুঝতে বাকি নেই তার। পুরনো সেই পার্স আবার দেওয়াতে শীতলের অত্যাচার আবার বেড়ে গেছে। কদিন পার্সে কাজ না করায় কাঁদো কাঁদো মুখে দরজা থেকে ঘুরে যেতো। এখন পার্সে কাজ করছে দেখে এখন সোজা রুমে ঢুকে পড়ে। দু’দিন ইগনোর করেছিল দেখে এতিমের মতো মুখ করে তাকাতো। এটা ওটার ছুঁতোয় কথা বলতে আসতো। চারদিন আগে রাতে বাসায় ফিরতেই দেখে তারই রুমের দরজার কাছে বসে আছে। সরতে বলতেই কান ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ‘সরি!’ সে জবাব না দিলে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলেছিল, ‘সরি বলছি তো নাকি? আর কতবার বলব? কেউ আমার উপর রেগে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয়।’ এভাবে সরি বললে কী আর রাগ করে থাকা যায়? নাকি রাগের অভিনয় চালিয়ে যাওয়া যায়? অগত্যা থমথমে মুখে বলেছিল সে মাফ করে দিয়েছে তবে এইশেষবার। অথচ মাফ পাওয়ার খুশিতে সে পূর্বের আবারও বাদরামি শুরু করেছে।
যখন তখন রুমে আসা। রুমের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করা। কিছু বললে মুখ ভেঙ্গানো। খেতে বসে তার ভাগের খাবারে ভাগ বসানো। কফি এনে দিতে বললে আড়ালে গিয়ে এঁটো করে দেওয়া। এভাবেই দিন কাটছে।
এখন নিশ্চিয়ই কোনো আবদার নিয়ে এসেছে। কারণ কিছুক্ষণ আগেও দেখেছে শখের ফোন নিয়ে অনলাইনে ইদের ড্রেস দেখছে। হয়তো গত বারের মতো কোনো ড্রেস দেখিয়ে দাঁত বের করে বলবে, ‘শুদ্ধ ভাই এই ড্রেসটা কিনে দেন না? এটা কিনে দিলে ঠিক পুতুলের মতো একটা বউ পাবেন।’
-‘দাম কত?’
-‘নয় হাজার তিনশ বিশ টাকা।’
-‘একটা ড্রেসের দাম নয় হাজার টাকা? টাকা কি গাছের শুকনো পাতা যে চাইলেই পাওয়া যায়?’
-‘দেন না শুদ্ধ ভাই?’
-‘ বলছি তো, টাকা নাই।’
-‘ওই যে ওই লকারের সেকেন্ড ড্রয়ারে অনেকগুলো নতুন টাকার বান্ডিল আছে। ওখান থেকে নিন?’
-‘তুই আবার আমার লকার খুলেছিস?’
-‘আমি লকার খুলি নি রুমে এসে দেখি খোলা। উঁকি মেরে দেখি অনেক টাকা। নতুন কড়কড়া টাকা দেখে টাকা না হাতালে নাকি পাপ হয়। তাই পাঁচটা হাজারের নোট মেরে দিয়েছি।’
-‘পাঁচ হাজার নিয়ে আবার ড্রেস কেনার আবদার করছিস? তুলে আছাড় মারার আগে চোখের সামনে থেকে যা, যা বলছি।’
একথা শুনে ওই মুহূর্তে মন খারাপ করে চলে গেলেও পরে ড্রেসটা নিয়েই ছেড়েছে। আর রুমে যতই টাকা পড়ে থাক সে কখনো হাত দেয় না বরং সেটা তুলে ঠিক জায়গায় রাখে। এবং সেও বুঝে তাকে রাগাতে পাজিটা এসব বলে। পুরনো কথার ছেদ ঘটিয়ে শুদ্ধ রুমে ঢুকে দেখে শীতল চার হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। একটা বালিশ ওর বুকের উপর। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। তাকে দেখামাত্রই লাফ মেরে উঠে হড়বড় করে বলল,
-‘ শুদ্ধ ভাই দারুণ একটা খবর আছে।’
শুদ্ধ ওর কথায় কোনো জবাব না দিয়ে ওয়াচ খুলে ওয়ালেটটা বের করে রাখল। সে জানে কিছু না বললেও দারুণ খবরটা শীতল তাকে বলবেই।
তখনো শীতলের চোখে মুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। কিছু একটা নিয়ে খুব খুশি বোধহয়। তখন সত্যি সত্যিই শীতল বলল,
-‘কিছুদিন আগে আমলকি গাছের ডালে একটা পাখি বাসা বেঁধেছিল। আজ দেখে এলাম বাসায় দুটো ছানা ফুটেছে।’
-‘আবার গাছে উঠেছিলি?’
-‘ক ক কই নাতো।’
-‘তাহলে কিভাবে বুঝলি বাসায় দুটো ছানা ফুটেছে?’
-‘মাটিতে দাঁড়িয়েই দেখলাম।’
-‘তোর বাপ কোন কোম্পানির ভিটামিন খাওয়াচ্ছে তোকে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে উঁচু গাছের মগডালের সবকিছু দেখতে পাচ্ছিস?’
একথা শুনে শীতল মুখ ভোঁতা করে চলে গেল। তাকে যেতে দেখে শুদ্ধ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে শীতল পুনরায় হাজির। ওড়নায় আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,
-‘কিয়ারা ফোন করেছিল ওর বাবা নাকি কোথায় থেকে সাদা পেঁচার ছানা এনেছে। কি নাম রাখবে তাই জিজ্ঞাসা করছিল।’
-‘পেঁচা টা ছেলে নাকি মেয়ে?’
-‘ছেলে।’
-‘তাহলে তোর বাপের নামটা বলে দিতি?’
-‘ বলেছি।’
-‘তোর বাপের নাম বলেছিস?’
-‘না। পেঁচাটা দেখামাত্রই কেন জানি আপনার কথা মনে পড়েছিল। তাই কিয়ারাকে বলেছি নাম রাখতে __শোয়াইব শুদ্ধ।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৩৫
একথা বলে শীতল নিজেই খিলখিল করে হেসে একছুটে দৌড়ে পালাল। চোখের পলকেই শুদ্ধর নাগালের বাইরে সে। নয়তো চ্যালাকাঠের দর্শন পেতে হতো খুব ভালো করেই জানে সে। ওর কথা এবং দৌড়ে পালানো দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকাল। তারপর বিরবির করে বকতে বকতে ওয়াশরুমে চলে গেল।