শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪১
নূরজাহান আক্তার আলো
আজ ইদ। মুসলিমদের ঘরে ঘরে বয়ে যাচ্ছে ইদআনন্দ। চৌধুরী গিন্নিরা ফজরের পরপরই উঠে রান্নাঘরে চলে এসেছেন। ব্যস্তহাতে সামলাচ্ছেন রান্নাবান্না। ইদের নামাজ শুরু হবে সকাল সাড়ে সাতটাই। সবাই গোসল সেরে রেডি হতে হতে খাবার রেডি করে ফেলতে হবে। এই ইদে শাহাদত চৌধুরী আসতে পারবে না ভেবে সিমিনের মনটা খুব খারাপ ছিল। মেয়ে দুটোও ভিডিও কলে কথার বলার সময় মলিন মুখে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। তবে তাদের চোখ দুটো যেন চিৎকার করে বলছিল, ‘এসো বাবা। এসো। আজকের দিনটা নাহয় আমাদের দাও।’ শাহাদত চৌধুরীও মলিন হেসেছিলেন। কিন্তু গতকাণরাত তিনটাই তিনি কাউকে না বলে উপস্থিত হয়েছেন। আজকে সকালে সবার সামনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে চমকে দেবেন ভেবে বাইরে বের হোন নি। সিমিনকেও বলে দিয়েছে আপাতত কাউকে না জানাতে। সিমিনও হেসে সম্মতি জানিয়েছে।
সায়ন সকাল বেলা বাইরে থেকে বাড়ি এসে আগে রান্নাঘরে ঢুকল। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার সময় নেই যেন। সে মাকে দেখামাত্র হড়বড় করে বলল, ‘ আম্মু দাও খেতে কিছু ভীষণ ক্ষুধা লেগে আমার।’ ছেলের কথা শুনে সিঁতারা পাশ ফিরে তাকিয়ে তাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন,
-‘তুই কেবল বাড়ি ফিরলি? তোর কি আক্কেল জ্ঞান হবে না রে সায়ন?’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘সারারাত বাইরে কি এত কাজ তোর?’
সায়ন আর জবাব দিলো না পারল না কারন তার আগেই সিরাত তার মুখে মাংস পুরে দিয়ে বলল,
-‘লবণ ঠিকঠাক আছে নাকি দেখ তো বাপ?’
সায়ন মাংসটুকু চিবিয়ে খেয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
-‘একটা খেয়ে বোঝা যায় নাকি? একবাটি দাও।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার কথা শুনে সিরাত সিমিন একযোগে হেসে ফেলল। সায়ন একবার একাই দুই কেজি মাংস খেয়ে ফেলেছিল লবণ চেক করতে দিয়ে। তবুও বলতে পারে নি লবণ ঠিকঠাক হয়েছে নাকি। তবে ছেলের ক্ষুধা লেগেছে শুনে সিরাত ঝটফট একবাটি মাংস তুলল বাটিতে। সিমিন ফ্রোজেন পরোটা ভেজে আগে খেতে দিলো ছেলেটাকে। সায়ন খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে টেবিলে বসতেই স্বর্ণ নেমে এলো। পাশ কাটিয়ে যেতে গেলে সায়ন তাকে ডাকল। স্বর্ণ তার কাছে গেলে পরোটা আর মাংস ছিঁড়ে স্বর্ণের মুখের সামনে ধরে বলল, ‘ইদ মোবারক। দেখ তো লবল হয়েছে নাকি আমি আবার ওসব বালছাল বুঝি না।’
স্বর্ণ খাবার মুখে নিয়ে মাথা নাড়াল অর্থাৎ ঠিক আছে। তখন শখও এসে দাঁড়াতেই তার মুখে খাবার তুলে দিলো সায়ন। তবে শখ গিলতে পারল না। থম মেরে মুখে খাবার নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। একটুপর সায়ন খেয়াল করল শখ নীরবে কাঁদছে। সে হাতের খাবার ফেলে তড়িৎ উঠে দাঁড়িয়ে পানি এগিয়ে দিয়ে বিচলিত হয়ে বলল, ‘ঝাল লেগেছে? কাঁদছিস কেন? নে পানি খা’ সে এত জোরে কথাটা বলেছে রান্নাঘরের তিন জাও ছুটে এসেছে। এবার শখ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকাতে গিয়েও পারল না। দুহাতে মুখ চেপে ধরে বেশ শব্দ
করে কেঁদে ফেলল। এই ইদটাই সো বাবার বাড়ি করতে পারবে। এরপর থেকে অন্যের ঘরের ঘরণী। তখন বাবার বাড়ি আসতে গেলে পারমিশন নিতে হবে। শশুড়বাড়ির লোকদের ভালো-মন্দ দেখতে হবে। আহনাফের সাথে দেশে বাইরে গেলে তখন প্রবাদ জীবন। মেয়েদের জীবনটা কে যে এমন? তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সবার চোখে পানি চলে এলো। অশ্রু টলমল করে তাকিয়ে রইল শখের দিকে। সায়ন এগিয়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে নিতেই শখের কান্নার যেন বাঁধ ভাঙ্খল। সে ভাইয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কেঁদে বলল,
-‘আমাকে পর করে দিও না ভাইয়া। আমি তোমাদেরকে ছাড়া থাকতে পারব না। ‘
সায়ন বোনের মাথায় হাত রেখে রাখল। বাইরের মানুষজন জানে সে পাষাণ। তার মনে মায়া দয়া একটু কম সে নিজেও মানে। কিন্তু বোনদের
চোখের পানি সহ্য করতে পারে না সে। কলিজা ফেটে চৌচির হয়ে যায় যেন। সে শখকে বলল,
-‘কাঁদে না। ইদের দিন কেউ কাঁদে? সেলামী নিবি না যা নতুর জামা পড়ে আয়।’
কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল। সিঁতারা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। শারাফাত চৌধুরী ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে তাকিয়ে আছে এ দিকে। চোখের কোণে ভেজা। সাফওয়ান চৌধুরীও ভাই-বোনের দৃশ্য দেখে চোখ মুছতে মুছতে বাগানের দিকে চলে গেলেন। সিঁতারা সিমিন
শখকে সায়নের বুক থেকে সরিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে থামালেন। ক্ষুধার্ত সায়নের ক্ষুধা যেন নিমিষেই হারিয়ে গেল। সে চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। স্বর্ণের রুম পার করে শীতলের রুমের কাছাকাছি আসতেই আবার থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শীতল হাউমাউ করে কাঁদছে। নিচে একজন কাঁদছে বিয়ে হয়ে যাবে তাই কিন্তু এর আবার কি হলো? এবার কি ইদ বোনের চোখের পানিতে ভেসে যাবে নাকি? সে এক পা দুই পা করে এগিয়ে রুমের দরজায় নক করল। তারপর ডাকল,
-‘শীতল? রুমে আছিস?’
সায়নের কথা শোনামাত্রই শীতল হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো। এতক্ষণে সাহায্যের মানুষটার নাগাল পেয়ে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাইয়া?’
-‘বলিস কি? কার এত বড় সাহস আমার বোনের সর্বনাশ করে? তার নামটা বল শুধু আমিও তার সর্বনাশের মাথায় বারি না দিয়েছি তো আমার নামও সায়ন না।’
-‘আমার একুলও গেল ওকুলও গেল। আমার ইদের ড্রেসটা বোধহয় পরা হবে না আর।’
-‘কেন কি হয়েছে ড্রেসের?’
সায়ন একথা বলতে বলতে খেয়াল করল শীতলের গালে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। সে বিচলিত হয়ে কিছু বলতে যাবে তাকে অবাকের
চূড়ান্ত সীমানায় ধাক্কা দিয়ে শীতল ব্যান্ডেজ টেনে তুলে ফেলল। ওমনি তার গালে ফুটে উঠল মেহেদীর রং। সেখানে আবার লেখা ‘আমার বউ।’
সায়ন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে শীতলের করুন চোখজোড়া যেন বলছে, ‘বাঁচাও আমাকে।’ সে এবার বিষ্মিত সুরে বলল,
-‘ কি রে বনু তোর গালে এটা কি?’
-‘কিভাবে কি হলো বুঝলাম না। আমি ঘুমিয়েছিলাম ঘুম থেকে উঠে দেখি গালে এটা।’
-‘জ্বিন টিনের কাজ নয় তো?’
-‘জ্বিন আসবে কোথা থেকে? আমি তো শুদ্ধ ভাইয়ের রুমে ছিলাম..!’
-‘ওয়েট! ওয়েট শুদ্ধর রুমের কেন?’
এবার শীতল ধরা পড়ে গেল। খাবি খাওয়া মাছের মতো আমতা আমতা করতে লাগল। সায়ন, শীতলের কথার মাঝে সেখানে রুবাবও উপস্থিত হলো। সে কিছু বলতে গেলে শীতলের দিকে তাকিয়ে কথা হারিয়ে শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। শীতল হাত দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে লাল করে ফেলেছে। তবুও গালের রং একটুও উঠে নি বরং ফর্সা গালে গাঢ় রং ফুটে উঠেছে। এখন এই লেখা নিয়ে নিচে যাবে কিভাবে? কেউ কিছু বললে জবাবে কি বলবে? সাধের ড্রেস পরা হবে না বোধহয়। কত প্ল্যান করেছে অথচ একটাও হবে না একটাও না। সবচেয়ে বড় কথা শুদ্ধ ভাই যদি জানে তার হাতে সে ওসব লিখেছে তাহলে চ্যালাকাঠির বারি এদিক ওদিক হবে না। এসব ভেবে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বোনকে কাঁদতে দেখে সায়ন বোনকে নিয়ে বীরপুরুষের মতো শুদ্ধর রুমে ঢুকল।
আর এর হেস্তনেস্ত আজ করেই ছাড়বে। পেয়েছে টা কি সে? শুদ্ধ ফ্রেশ হয়ে এসে গেছে সায়ান, রুবাব থমথমে মুখে তার বিছানায় বসে আছে।
ওকে দেখে সায়ন গম্ভীর মুখে বসতে বলল। সে বসে তাকাল শীতলের দিকে। পাশে বসে হেঁচকি তুলে কাঁদছে শীতল। বোনকে কাঁদতে দেখে সায়নের মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে উঠল। সে মেকি রাগ দেখিয়ে শুদ্ধকে বলল,
-‘আমার বোনকে ভালোবাসিস না অথচ তার গালে ‘আমার বউ’ লিখে স্ট্যাম্প ছেপেছিস কেন? খুব সাহস বেড়েছে তাই না? বলব বাবাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতে?’
-‘কি ছেপেছি?’
-‘ ওমা এখন বিড়াল দেখি কয় মাছই চিনে না।’
-‘ হেয়ালি না করে সোজা কথা বলো নয়তো উঠলাম।’
-‘কিসের উঠাউঠি? আগে বল ওর গালে এসব কে লিখেছে?’
-‘কিসের লেখা? কার গাল? কিছুই তো বুঝলাম না।’
একথা বলে শুদ্ধ তাকাল শীতলের গালের দিকে। তারপর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
-‘গালে এসব কি লিখে ঘুরছিস? বউ হওয়ার খুব শখ না থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো, বেয়াদব।’
আচমকা শুদ্ধর ধমকে শীতল চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য তো
তাকে কেন ধমকাচ্ছে শুদ্ধ ভাই? সে নিজেও তো জানে না কিভাবে কী হলো?এক আকাম করে ঘুমিয়েছিল উঠে দেখে আরেক আকাম ঘটে ঘ হয়ে বসে আছে। কথা সেটা না কথা হচ্ছে এখন এর সমাধান কি? এই বিপদ থেকে বাঁচবে কিভাবে? কিভাবে মেহেদীর রং রিমুভ করা যায়?
সিমিন যদি দেখে আজ আর তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। এদিকে শুদ্ধও স্বীকার করার মানুষ না। সায়ন আর রুবাবও কথা না নিয়ে নড়বে না। ভাইদের কথা শুনে শুদ্ধ এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো। সামনে থেকে উঠতে গেলে রুবাব তাকে আঁটকে দিয়ে বলল,
-‘এ্যাই খবরদার উঠবি না। এক্ষুণি আমাদের প্রশ্নের জবাব দে।’
প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ এদের ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত শুদ্ধ। না এরা বাইরে যাচ্ছে আর না তাকে কোথাও যেতে দিচ্ছে। তখন থেকে এক ভাষণ দিয়েই যাচ্ছে। কতক্ষণ সহ্য করা যায়? তাই সেও এবার শীতলের দিকে তাকিয়ে দাঁত দাঁতে চেপে উত্তর দিলো,
-‘তোদের বোনকে জিজ্ঞাসা কর গতরাতে আমি ঘুমানোর পর আমার রুমে এসেছিল কেন? শুধু আসে নি এসে চুপিচুপি আমার হাতে মেহেদী দিয়ে লিখেছে, ‘আমার বউ নাই। আমি এতিম।’ এসব লিখে সে নিজেই কখন আমার হাতের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে। ফলস্বরুপ তার বাম গালে মেহেদীর রং জ্বলজ্বল করছে ‘আমার বউ’ লেখা। এখানে আমার কি দোষ? সে দোষ যখন করেছে এখন শাস্তিস্বরুপ আমার বউয়ের ট্যাগ নিয়ে ঘুরুক।’
শীতল হতবাক হয়ে কান্না করা ভুলে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল শুদ্ধর মুখপানে। শুদ্ধর কথা শুনে রুবাব শুদ্ধর হাত টেনে দেখল শুদ্ধর হাতের মেহেদীর রং ও বেশ গাঢ়। এবং লেপ্টানোর চিহ্নমাত্র নেই। অথচ শীতল যদি তারই মেহেদীর উপর ঘুমাতো তাহলে লেপ্টে যাওয়ার কথা ছিল। অতঃপর যা বোঝার বুঝে গেল তারা দু’জনও। এদিকে শুদ্ধর করা চালাকি ধরতে পেরে তারা শুধু পারল না মাটিতে গড়াগড়ি করে হাসতে। এদিকে বোকা শীতল সমাধান না পেয়ে ফিসফিস করে কেঁদেই চলেছে। তাকে কাঁদতে দেখে সায়ন হাসি গিলে শুদ্ধকে বলল,
-‘ মেহেদী রিমুভ করার অপশন জানা নেই? থাকলে তাড়াতাড়ি রিমুভ কর দে নয়তো দু’জনের কপালে শনি নাচছে।’
একথা বলে সে রুবাবকে নিয়ে চলে গেল। আর শুদ্ধ শীতলের মুখপানে তাকিয়ে বলল,
-‘ কে যেন বলেছিল আমার নামে কলঙ্ক মাখতে চায়। সামান্য মেহেদীর ল্যাগ লাগায় কেঁদে কেঁটে একাকার অবস্থা। অথচ মেহেদীর থেকে কলঙ্কের দাগ তো কয়েক লক্ষ গুন ভারী।’
একথা বলে শুদ্ধ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শীতলও মন খারাপ করে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। যেতে যেতে মনে করল ঘন্টা খানিক আগে ঘটনা,
তখন ভোরবেলা। ভোরের আলো কেবলই ফুটতে শুরু করেছে। খোলা জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই শীতলের ঘুম ভাঙ্গে।
পিটপিট করে একবার চোখ খোলো তো আবার বুজে। বেশ কয়েকবার একই কাজকরে নিজেকে বিছানায় ধাতস্থ করে লাফিয়ে উঠে বসে। সে তো মেঝেতে বসেছিল বিছানায় কখন এলো? এলো তো এলো ঘুমিয়ে পড়ল কখন? সে না শুদ্ধ ভাইয়ের হাতে মেহেদী দিতে এসেছিল তারপর দিয়েওছিলো। এরপর কি হলো? একথা মস্তিষ্কে ধাক্কা দিতেই তড়িৎ পাশ ফিরে তাকাল। শুদ্ধ তার থেকে দূরত্বে ওপাশ ফিরে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। শীতল আস্তে ধীরে বিছানা থেকে উঠে গেল শুদ্ধর কাছে। শুদ্ধ হাত টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখে লেখায় ভালোই রং হয়েছে। বাহ্ টকটক করছে।সে মুখ টিপে হেসে ভাবল বাড়ির সবার সামনে শুদ্ধকে খুব লজ্জা দিবে। এতদিন বিয়ের শোক ভেতরে চেপে মনে মনে ঠিক বিয়ের জন্য লাফাত। এখন সেই শোক মন টপকে হাতে এসে পৌঁছেছে ফলে হাতে লিখে রাখে, ‘আমার বউ নাই। আমি এতিম।’ আহারে, আহারে, বিশুদ্ধ পুরুষের কতই না কষ্ট!
এসব ভাবতে ভাবতে তার হাসি চওড়া হলো। আজ ইদের দিন। অনেক কাজ বাকি তাই সে আর দাঁড়াল না। শুদ্ধর হাতটাকে আস্তে করে রেখে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। পেছনে ফিরে ঘুমন্ত শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এলো। তারপর আরেকটু.. তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ইদ মোবারক বিশুদ্ধ পুরুষ। একটুপরেি সেলামী নিতে আসব কিন্তু, হুম।’
একথা বলে সরে গিয়ে দ্রুতপায়ে শুদ্ধর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।নিজের রুমে গিয়ে হাতের মেহেদী দেখে খুশিতে মন ভালো হয়ে গেল। মেহেদীর রং টা কি যে দারুণ এসেছে। সে এবার নাচতে নাচতে ফ্রেশ হতে গেল।
ওয়াশরুমের দরজা আঁটকে মিররের দিকে তাকিয়ে ফ্লায়িং কিস ছোঁড়া তার বদ অভ্যাস। আজও একই কাজ করতে গিয়ে মিররে তাকাতেই ধপ করে হাসি নিভে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে ঘষে মেহেদী উঠানোর বৃর্থা চেষ্টা করল। লেখার উপরে মেহেদীটুকু উঠে গেলে গালে জ্বলজ্বল করে উঠল ‘আমার বউ।’
সে এবার হতবাক হয়ে বিরবির করল, ‘আমার বউ মানে? ও খোদা, কার বউ হলাম আমি? রাতের মধ্যে কার বউয়ের ট্যাগ পেয়ে গেলাম?’ এসব মনে করে মন খারাপ করে শীতল ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। শুদ্ধকে ওর রুমে দেখে কিছু বলার আগে শুদ্ধ তাকে মুখ মুছতে ইশারা করলে তাই করল। তারপর তাকে কিছু বলতে না দিতে তুলোতে কিছু একটা নিয়ে তার গালে আলতো করে ঘষতে লাগল। আশ্চর্ষের ব্যাপার মেহেদীর রং পুরোপুরি না উঠলেও হালকা হয়ে এলো। দু’একবার এভাবে ঘষায় দাগ
অনেকটাই হালকা হলো। পুরোপুরি উঠবে না জেনে সেও আর ঘষলো না। একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ গালে লাগিয়ে বলল,
-‘কেউ কিছু জিঞ্জাসা করলে বলবি ব্যথা পেয়েছিস। ‘
এবার শীতলের ঠোঁটে হাসি ফুটল তার কান্না থেমে গেছে। তাকে হাসতে দেখে শুদ্ধ মুখের দিকে কয়েকপল তাকিয়ে চলে গেল। শীতলও সমাধা পেয়ে উড়ন্ত প্রজাপতির মতো ছুটতে ছুটতে নিচে গেল সে। আর গিয়েই বাবাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। ইদের দিনে বেস্ট সেলামী যেন পেয়ে গেছে সে। ড্রয়িংরুমে তখন যেন চাঁদের হাঁট বসেছে। বাকিরা শীতলের গালের দিকে খেয়াল করে কি হয়েছে জানতে চাইলে শুদ্ধর বলা কথাটা বলেছে সবাইকে। একটু পরে বাড়ির পুরুষরা একসাথে নামাজে যাবে। ইদের দিন এটাই যেন অন্যতম দৃশ্য।
গিন্নিদের রান্না শেষ। বাড়ির পুরুষরা শাওয়ার নিয়ে রেডি হতে লেগে পড়েছে। কিন্তু রেডি হতে গিয়ে বেঁধেছে আরেক সমস্যা। নিজেদের কেনা আনা পাঞ্জাবী পছন্দ হচ্ছে না সাম্য, সৃজনের। অথচ তারা নিজেরা চুজ করে কিনেছিল। এমন ভাব করেছিল এটা কিনে না দিলে ওখানেই শুয়ে গড়াগড়ি খাবে। এখন এই নিয়ে বেঁধেছে চিৎকার চেঁচামেঁচি। শারাফাত চৌধুরীরা তিন ভাই পরেছে একই রকম পাঞ্জাবী। সায়নরা সব ভাইয়েরা পড়েছে এক রকম পাঞ্জাবী। বাড়ির মেয়েরা একই রকমের ড্রেস। বাড়ির গিন্নিরা একই রকমের শাড়ি। এসব রুবাব দিয়েছে সবাইকে। সাম্য সৃজন তো নিজের বাপের টাকায় কেনা পাজ্ঞাবী ফেলে ভাইয়ের সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবী পরে এখন বেজায় খুশি। বাড়ির সবাই এখন হালকা মিষ্টি মুখ করে নামাজে যাবে। সবাই উপস্থিত থাকলেও শুদ্ধ নামে নি দেখে সিঁতারা সেমাইয়ের বাটি নিয়ে ছুটলের ছেলের রুমে। শুদ্ধ কানে ফোন ঠেঁকিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে কথা বলছে কারো সাথে। মাকে দেখে স্বল্প কথায় কথা সেরে মুচকি হাসল।
সিঁতারা ছেলেকে দেখে মনে মনে বলেই ফেললেন, ‘মাশাআল্লাহ্! মাআল্লাহ্!’ উনি নিজের হাতে সেমাই ছেলের মুখে তুলে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলেন। শুদ্ধ মায়ের হাতে দুইবার সেমাই মুখে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ইদ মোবারক।’ সিঁতারাও হেসে ছেলেকে ইদ মোবারক জানিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে বলে চলে গেলেন। উনি যেতেই শীতল শুদ্ধর রুমে উঁকি দিলো। দেখল বিশুদ্ধ পুরুষকে। না মানতেই হয় বিশুদ্ধ পুরুষ দেখতে আসলেই সুদর্শন। এমন একটা মানুষ ব্যক্তিগত পুরুষ হলে মন্দ হয় না। বরং ভালোই হয় যখন তখন জাপটে ধরে যায়। কিন্তু এই ষাঁড়টাকে পটাতেই তো পারে না সে। কম চেষ্টা তো করলো না। এসব ভেবে সে মুখ ভেংচি দিতেই শুদ্ধ বলল,
-‘মেজরের মেয়ে হয়েও ভদ্রতা জ্ঞানের এত অভাব কেন তোর?’
-‘গরু চোখে আবার দেখে ফেলেছেন? যাই হোক আসব, শুদ্ধ ভাই?’
-‘কি বললি?’
-‘কই কিছু না তো। ইয়ে রুবাব ভাইয়া আতর দিতে বলল।’
শুদ্ধ আতর দিলে শীতল শুদ্ধর আপাদমস্তক দেখে যেতে গিয়ে ফট করে বলে বসল,
-‘সোলামীতে কি টাকা ই দিতে হয় শুদ্ধ ভাই আর কিছু দেওয়া য়ায় না?”
-‘ঝেড়ে কাশ।’
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪০
-‘ না মানে সবার তো আর হ্যান্ডসাম শুদ্ধ ভাই নাই। আমার আছে তাই তাকেই যদি আমার নামে কেউ লিখে দিতো তাই বলছিলাম আর কি।’
-‘ধর কেউ সত্যি সত্যিই লিখে দিলো তাহলে কি করবি?’
একথা শুনে শীতল থেমে গেল। চটজলদি পেছনে ফিরে শুদ্ধর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আচমকা শুদ্ধর বুকের বাঁ পাঁশে চুমু এঁকে মিষ্টি হেসে বলে বসল,
-‘তার বুকজমিনে এভাবে চুমু এঁকে আগে আমার নামটা আগে খোদাই করতাম। তাহলে কেউ নজর দিতেও পারত না কেড়ে নেওয়ার কথাও ভাবত না।’