শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৬

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৬
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘শু..শুদ্ধ! আব্বা আমার!’
দো’তলার ওটি রুমের সামনে দাঁড়ানো শুদ্ধ কারো বিষ্ময়ভরা কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকাল। তার থেকে দুহাত দূরে সিরাত সাম্য-সৃজনের হাত ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে হতবাক চাহনি। শুদ্ধ এখানে কেন? কখন এসেছে? একা কেন? এসেছেই যখন তাদেরকে জানাল না কেন? একথা চিন্তা করে উনি দ্রুত শুদ্ধর দিকে এগিয়ে গেলেন। পুনরায় জিজ্ঞাসা করার আগেই হাসান এসে কিছু বলতেই শুদ্ধ উনাকে দাঁড়াতে বলে দ্রুতপায়ে কোথায় যেন চলে গেল। উনি এবার আশেপাশে তাকালে
একজন নার্স বলল,

-‘উনার পেশেন্ট তো..! ‘
বাকি কথা বলার আগে উনারও ডাক পড়তেই উনিও ছুঁটে চলে গেলেন। সিরাত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। উনারা খবর পেয়ে সকালবেলা হসপিটালে ছুঁটে এসে ঐশ্বর্যের ঘটনা জেনেছে। সায়ন রাত থেকে ঐশ্বর্য
নামের মেয়েটার জন্য ছুটাছুটি করছিল তাও জানা গেছে। আর মেয়েটা কে, রুবাব যে মেয়েটার প্রতি কত দূর্বলতা সেই ঘটনাও স্পষ্ট। কাউকেই বাড়তি করে বলার প্রয়োজন পড়ে নি। ছেলের বিপদের খবর শুনে রাগ ভুলে কিছুক্ষণ আগে শতরুপা চৌধুরীও ছুঁটে এসেছেন। এসেই ছেলেকে
বুকে জাপটে ধরে বলেছেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘সবকিছুর মালিক আল্লাহ। ধৈর্য্য ধরো বাবা,,,ধৈর্য্যের ফল সুমিষ্ট হয়।’
রুবাব মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে কোনো কথায় বলতে পারো নি অঝরে কেঁদেছে শুধু। তারপর সবাই মিলে ছেলেটাকে কত বোঝালেন। উনারা এতক্ষণ তিনতলার ওয়েটিং রুমে বসে ছিলেন। মেয়েটার একটা ভালো সংবাদ পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন। কিন্তু ঐশ্বর্যকে নিয়ে ডাক্তার কোনোরকম আশার সংবাদ দিতে পারে নি। বাঁচবে নাকি মরবে তাও বলে নি। শুধু এইটুকুই জানিয়েছে তার শরীরের চামড়া এমনভাবে ঝলসেছে সেটা পূর্বের মতো কখনোই হবে না। একথা শুনে রুবাব মলিন হেসে জবাব দিয়েছে,

-‘চেহারা নিয়ে চিন্তা নেই সে বাঁচবে তো? পারলে তাকে বাঁচান।’
একথা শুনে ডাক্তার কিছুক্ষণ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে স্থান ত্যাগ করেছেন। উনারা এসেছিলের খুব সকালের দিকে এখন
বাজে বেলা বারোটা। এত বেলা হয়েছে অথচ কারো গলা দিয়ে পানিটুকু অবধি নামে নি। সবাই শুকনো মুখে ভালো একটা সংবাদের আশায়।
এদিকে সবার কান্নাকাটি মন খারাপ দেখে সাম্য সৃজনও কাউকে কিছু বলার সাহস করতে পারে নি। সায়নও নেই, তারা হসপিটালে এসে তাকে দেখতে পায় নি। এতক্ষণ না খেয়ে থেকে সৃজন সাম্যকে খোঁচা মেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাম্য তাকালে মিনমিন করে মায়া মায়া স্বরে বলল,

-‘ভাইয়া আমার না পেট ব্যথা করছে। বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে। কিছু মিছু খেলে বোধহয় ভালো লাগত।’
ভাইয়ের কথা শুনে সাম্য চমকে পাশ ফিরে তাকাল। সচারাচর সৃজন তাকে ভাইয়া সম্বোধনে ডাকে না। কারণ তারা জমজ। তবে সৃজন যখন বিপদে পড়ে কিংবা কোনো ব্যাপারে সমাধান খুঁজে পায় না তখন ডাকে পরিবর্তন আনে। সাম্যকে বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়ে দিয়ে মনের কথা শেয়ার করে সমাধান চায়। তবে ভাইয়ের ক্ষুধা লাগার কথা শুনে সাম্য সবার দিকে তাকাল। এবার কি হবে? ভাই খেতে চাচ্ছে খাবার কোথায় পাবে? একটুদূরেই ফিল্টারে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা দেখে একগ্লাস পানি এনে ভাইকে দিলো। কিন্তু পানি খেয়ে ক্ষুধা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
গা গুলাতে লাগল। একথা সাম্যকে জানালে সাম্য করুণ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সে তো টাকা নিয়ে আসে নি।

কিছু টাকা থাকলে দৌড়ে গিয়ে কিছু মিছু এনে ভাইটাকে দেওয়া যেতো।
স্বর্ণ, শখ আপুকেও আশেপাশে দেখছে না। রুবাব ভাইয়ার মন খারাপ। কার কাছে টাকা চাইবে? একথা ভাবতে ভাবতে বড়দের দিকে তাকাতেই দেখে তার তিন মা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দূর থেকে বুঝে গেছে ঘটনা। সন্তান যতই বড় হোক, মুখে কিছু না বলুক কিন্তু মুখ দেখে মনের কথা বোঝার ক্ষমতা শুধু মায়েদেরই আছে। উনাদেরকে তাকাতে দেখে ওরা দু’জন একটু লজ্জা পেল। নাকের ডগা থেকে চশমা ঠেলে ঠিকঠাক
করে নড়েচড়ে বসল। তখন সিঁতারা উনার পার্স থেকে টাকা বের করে সিরাতের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
-‘তোরও কী আক্কেল জ্ঞান হবে না মেজো? বাচ্চা দুটো না খেয়ে আছে

সেটাও খেয়াল করিস নি তুই? একজন খেতে বসে সেই যে উঠে গেল আর খোঁজ নেই। বাড়ির লোক চিন্তা করছে একটা ফোন করে জানাবে তাও করছে না। আরেকজনকে হসপিটালে এসেও দেখতে পেলাম না। রুবারটাকে কি বলব বুঝতে পারছি না। সব কটা একসাথে আমার জান ভাজা ভাজা করতে উঠে পড়ে লেগেছে।’
কান্নাভেজা কন্ঠে একথা বলতে বলতেই উনার গাল গড়িয়ে অশ্রু নামল।
জায়ের কথা শুনে সিরাত মুখ কাঁচুমাচু করলেন। মনে ঠিকই আছে কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পার্সও আনেন নি। এ অবস্থায় টাকা চাইতে নিজের বিবেকে বাঁধছিল। তবে টাকা পেয়ে বসে না থেকে সাম্য-সৃজনকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেলেন। বাচ্চা দুটোকে পেট পুরে খাওয়ালেন। শুকনো কিছু খাবার কিনে দিলেন।

দুটো স্যালাইন কিনে ইন্টেক পানি বোতলের ক্যাপ খুলে গুলিয়ে নিয়ে ফিরে এলেন। এটুকু সময়ের মধ্যেই লিফ্টের কি সমস্যা হয়েছে কে জানে। তাই ভিড় এড়িয়ে দোতলার সিঁড়ি পেরিয়ে তিন তলার সিঁড়িতে পা দিতেই পা
থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। পরিচয় কাউকে দেখলেন ভেবে এগিয়ে দেখেন পেছনে ঘুরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অবাকও হলেন তাকে দেখে। তারপর বিষ্ময় ঠেলে ডেকেই ফেললেন শুদ্ধকে। পেছনে ঘুরতেই সিরাত এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই তো চলে গেল ছেলেটা। একটু পর শুদ্ধ ফিরে এলে উনি শুদ্ধর মুখে বুকে হাত বুলিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

-‘আব্বা,,আব্বা রে কি হয়েছে তোর? কিভাবে এত ব্যথা পেলি? র..রক্ত কেন তোর গায়ে? শীতল..আমার শীতলটা কোথায়? কোথায় রেখেছিস
মেয়েটাকে?’
শুদ্ধ ব্যাকুল স্বরে মেজো মাকে কথা বলতে দেখে হাত ধরে থামাল। এই টুকু কথা বলতে বলতেই হাঁপিয়ে গেছেন। রীতিমতো শ্বাসকষ্টও শুরু হয়ে গেছে। শুদ্ধ উনাকে ধরে পেতে রাখা চেয়ারে বসাল। উনার হাতে থাকা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে উনাকেই খাওয়াল। তারপর স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ জানতে চাইল উনি এখানে কেন? সিরাত যতটুকু জানে সেটাই শুদ্ধকে জানাল। বাড়ির লোক জানে না শুদ্ধর গোপন ল্যাব সম্পর্কে তাই
লুটপাট হওয়ার ঘটনাও অজানা। রুবাবের পছন্দের মানুষ এইটুকু জানে উনারা। কিন্তু শুদ্ধ ঠিকই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলো। সে কয়েকবার ঢোক গিলে বন্ধ ওটির দিকেই নিবার্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অসহনীয় যন্ত্রণায় জর্জরিত হওয়া বুকটায় যেন নতুন করে কয়েক টন পাথর এসে জমা হলো। চোখের তারায় ভাসল রুবাব আর ঐশ্বর্যের মুখ। এরিইমধ্যে সাম্য সৃজন কখন তিন তলায় ছুটে গেছে খেয়াল করে নি তারা।

দুজনই দৌড়ে গিয়ে বাড়ির সবাইকে ডেকে এনেছে। শুদ্ধ হসপিটালে শুনে সবাই এসে তাকে ঘিরে ধরল। সিঁতারা কাঁদতে কাঁদতে শাড়ির আঁচল দিয়ে যত্ন করে ছেলের মুখ মুছিয়ে দিলেন। কপালে চুমু খেলেন। শুদ্ধর গায়ে রক্ত আর ছোটো ছোটো আঘাতের চিহ্ন দেখে সকলের নেত্রজোড়া ভিজে উঠল। ছেলেটা কত ব্যথা নিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিমিন একটু দূরে চোখে আঁচল চেপে ধরে নীরবে কেঁদে যাচ্ছেন। শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেও কিছু বলল না। তখন ওটির দরজা খুলে ডাক্তার হন্নদন্ত হয়ে ও বেরিয়ে এলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে শুদ্ধকে বললেন,

-‘ মি. শোয়াইব সরি টু সে পেশেন্টের কিটিক্যাল কন্ডিশন। কোনোভাবেই হার্টবিট স্বাভাবিক হচ্ছে না। গুলি, কারেন্টের শক একসাথে হওয়ায় তার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বুলেট বের করা হয়েছে। তবে গুলির কারণে শরীর দুর্বল ও রক্তক্ষরণে জন্য অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে কারেন্টের শকে ওর অবস্থা আরো শোচনীয় হচ্ছে। ‘
এইটুকু বলে ডাক্তার থামলেন। তারপর না চাইলেও অপ্রিয় কথা বলেই ফেললেন,

-‘ আস..আসলে যা অবস্থা যখন তখন তার হৃদযন্ত্র থামকে যেতে পারে, প্রস্তুত থেকো ইয়াং ম্যান।’
একথা বলে ডাক্তার নার্সের দিকে তাকালে নার্স কাগজ কলম এগিয়ে দিলেন। শুদ্ধ সেটা হাতে নিয়ে দেখে বন্ড সই দিতে হবে। শুদ্ধ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। মানে কি!কিসব আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে এই ডাক্তার? ওদিকে ডাক্তারের কথা শুনে সকলে কাঁদতে শুরু করেছে। সিমিন দৌড়ে এসে কিছু একটা বলতে চাইলেন কিন্তু উনি একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে গেলেন।
শুদ্ধ কম্পিত হাতে কাগজটার দিকেই তাকিয়ে রইল। তার দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারল না, কাবিননামায় তার নামের পাশে ওর নাম জুড়াতে পারল না অথচ তার জন্য নাকি বন্ডে সাইন করতে হবে। এই দিনটাও দেখতে হলো? ব্যাঙাচি তাকে এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করাল! এতবার করে বলল ছেড়ে যাওয়ার আয়োজন না করতে সে সেটাই করছে। কোনো মানে হয় এসবের? কোথায় সায়ন? আসছে না কেন? আদরের বোনকে সে কিছু বলছে না কেন? তাকে কি আবার চ্যালাকাঠ হাতে নিতে হবে? অন্যদিন নাহয় তার প্রতিটা কথায় ধাপে ধাপে অবাধ্য হয়, তাই বলে আজও হবে? হতেই হবে? নিজের কথা শেষ করে ডাক্তার দাঁড়ালেন না নার্সকে সাইন নিতে বলে ওটিতে ঢুকে গেলেন। শুদ্ধ অনড় হয়ে এখনো তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে। ছাত্র জীবন কিংবা পেশাগত দিক থেকে এ অবধি সে অসংখ্যবার কাগজে সিগনেচার করেছে। নামি-দামি কাগজ সাইন করায় আঁটকে যাওয়া কাজ সম্পূর্ন হয়েছে। তবে কখনো এমন লাগে নি। বুকের ভেতর এভাবে দুমড়ে মুচড়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় ওঠে নি। অথচ আজ হাতই চলছে না। কাগজটা মনে হচ্ছে কয়েক টন ভারী। ধরে রাখাতে মনে হচ্ছে শরীরের সবটুকু শক্তি চুষে নিচ্ছে।

কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো শারাফাত চৌধুরী ছেলের মনের অবস্থা বুঝে
এগিয়ে এলেন। কাঁধে হাত রাখলে শুদ্ধ বাবার দিকে তাকাল। বাবাকে দেখে শুদ্ধর খুব ইচ্ছে করল ছোটোবেলার মতো করে অভিযোগ করতে। কিন্তু এখন তো সেসব সাজে? সে যদি বলে ভঙ্গুর মানুষটা আরো ভেঙে পড়বে। তবে সে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে বাবার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। জ্বলবেই তো শীতল তো উনার কলিজা। দাদীর মতো টকটকে গায়ে রং আর কিছুটা মুখের আদল পাওয়াতে ভালোবাসাটা যেন আরেকদফা বেশি। ভালোবাসার জের ধরে অভিযোগ করলেও যে খাটবে না তা খুব ভালো করেই জানে সে। এদিকে ছেলের মুখ দেখে শারাফাত চৌধুরীর
কিছু বলার ভাষা পেলেন না। অগত্যা উনি কাগজটা নিজের হাতে নিয়ে দিক বেদিক না তাকিয়েই সিগনেচার করে দিলেন। নার্স সেটা নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

এদিকে এই ঝামেলার মধ্যে তিনতলা থেকে খবর এলো ঐশ্বর্যের আরো খারাপ অবস্থা। অসহ্য জ্বালাপোড়ায় কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করছে বেচারি। কখনো মাকে ডাকছে,, কখনো বাবাকে,,কখনো বা আল্লাহকে।
আগুনে পোড়া কিংবা এসিডে ঝলসে যাওয়া মানুষের যে কত কষ্ট সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। এদিকে ঐশ্বর্য কাঁদছে আরেক দিকে তার কান্না দেখে রুবাব কাঁদছে। ওদের কান্না দেখে শতরুপা বিপদ কাটার দোয়া পড়েই যাচ্ছেন। দোয়া পড়তে পড়তে উনার চোখে দিয়েও ঝরছে অশ্রুধারা। এতদিন মেয়েটার বাবার জন্য মেয়েটা বিয়েতে রাজি হতো না। অন্যদিকে রুবাবও জেদ ধরে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না বলে রাজি হতো না দেখে খুব বকাঝকা করতেন। কথা বলাও অফ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কখনো ছেলে মেয়ে দুটোকে বদদোয়া দেন নি। অমঙ্গল কামনা করে নি। তবুও তারা এত কষ্ট পাচ্ছে,,এত কষ্ট চোখে দেখা যায়? এতিম মেয়েটার সাথে এমন কিছু কি হওয়ায় লাগত?

ঐশ্বর্যের কথা শুনে শুদ্ধ আর দাঁড়াল না। শারাফাত চৌধুরীকে এখানেই থাকতে বলে দ্রুতপায়ে গেল তিনতলায়। নিজেই ডাক্তারের সাথে কথা বলল। সরাসরি জানতে চাইল বেস্ট চিৎকার এখানে সম্ভব কী না। যদি হয় তাহলে রাখবে নয়তো ইমার্জেন্সি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। বসে থাকার সময় কারো হাতে নাই। অতঃপর ডাক্তারের সাথে ফাইনাল কথা বলে শুদ্ধ বাইরে এলো। রুবাব দুইহাতে মুখ ঢেকে চুপ করে বসে আছে।
তার হাতে কবজি গড়িয়ে অশ্রুফোঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে। রুবাব ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছিল ওর বাবা মারা যাওয়ায়। তারপর তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি কেউ। শুদ্ধ, সায়ন কখনোই কোনো ভাই-বোনের কান্না সহ্য পারে না।

কেউ কাঁদলে ইচ্ছে করে যত কষ্টই হোক সব আবদার পূরণ করে হাসি ফোটাতে। কিন্তু এ মুহূর্তে রুবাবের হাসি ফোটাতে অক্ষম সে। ওর হাসিরকারণ যে বেডে শুয়ে ছটফট করছে। শুদ্ধ ইচ্ছে করে ঐশ্বর্যকে দেখতে গেল না। কারণ এই অবস্থা তার কাছে যাওয়াও ঠিক হবে না। তবে দূরে থেকে দেখতে গিয়ে ঐশ্বর্যের চোখে চোখ পড়ে গেল। ঐশ্বর্য রুবাবকেই খুঁজছিল কিন্তু শুদ্ধকে থেকে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল। দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল কারণ সে শুদ্ধর এতদিনের পরিশ্রম রক্ষা করতে পারে নি। পারে নি শুদ্ধর ল্যাবটা আমানত হিসেবে পেয়ে সেই আমানত রক্ষা করতে। তাকে কাঁদতে দেখে শুদ্ধ ঠোঁটে হাসি আঁটল। ঠোঁটের কাছটায় দুই আঙুলের সাহায্য হাসতে ইশারা করল। কাঁদতে বারণ করল। ধৈর্য্য ধরতে বলল। ইশারায় বোঝাল আবার নতুন করে তৈরি করবে।

ঐশ্বর্য বুঝল সবই তবে তার কান্নার বেগ বাড়ল। তাকে ব্যাকুল সুরে কাঁদতে দেখে শুদ্ধ পুনরায় বোঝাল, সে সর্বদা আছে তার পাশে। ভাইয়ের মতো এতদিন খেয়াল রেখেছে প্রাণ থাকা অবধি সেভাবেই দেখবে। সে যেন না কাঁদে। ল্যাবের জন্য না কষ্ট পায়। তার সুস্থ হতে হবে,, রুবাবের মুখের হাসি ফোটাতে হলেও তাকে কষ্ট সামলে উঠতে হবে। শুদ্ধ যতটুকু পারে বোঝাল ঐশ্বর্যকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের ল্যাবে একজন বোবা ছেলে কাজ করতো। ট্যালেন্ট থাকলে প্রতিবন্ধকতা কোনো ব্যাপার না। ছেলেটা তার কাজ দিয়ে সেটাই দেখিয়েছিল। মিশুক প্রকৃতির ছেলেটা সবার সাথে মিশতে চাইত,..,কিন্তু কেউ তার কথা বুঝত না দেখে এড়িয়ে যেতো। কিছু বলতে গেলে বিরক্ত হতো। পরে শুদ্ধরা তার সঙ্গে ইশারায় কথা বলাটা রপ্ত করে ফেলেছে। আজকে সেটা কাজে লাগল। অতঃপর
শুদ্ধ ঐশ্বর্যের থেকে বিদায় নিয়ে সরে গিয়ে রুবাবের কাছে গেল। আস্তে করে কাঁধে হাত রাখতেই রুবাব অশ্রুভেজা লালবর্ণ চোখে তাকাল। এই সময় শুদ্ধকে দেখে রুবাব ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াল। তারপর কি ভেবে চট করে শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-‘মাফ করে দে ভাই আমরা তোর আমানত রক্ষা করতে পারিনি। আমার ঐ..ঐশ্বর্য ভালো নেই ভাই। ওকেও মাফ করে দে।’
শুদ্ধ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সে রুবাবের কষ্টটা ফিল করতে পারছে। একই পথের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন। কিন্তু যা হয়েছে সেটা ধরে বসে থাকারও সময় নেই। বরং এক একটা মুহূর্ত এখন অনেক দামী। সে রুবাবকে বুক থেকে সরিয়ে বলল,
-‘ঐশ্বর্যকে নিয়ে চলে যা।’
রুবাব ভেজা চোখে তাকাল শুদ্ধর দিকে৷ এই অবস্থায় কোথায় যাবে?
কিছুই বুঝতে পারল না সে। ভাইয়ের মনোভাব বুঝে শুদ্ধ ছোট করে উত্তর দিলো,
-‘দুই ঘন্টার মধ্যে দেশ ছাড়বি তোরা, প্রস্তুত হো।’
একথা বলে শুদ্ধ তাকাল শতরুপা চৌধুরী দিকে। তারপর উনার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে উনার হাত দুটো ধরে বিনয়ী সুরে বলল,

-‘ছেলের বিপদে যদি মা পাশে না থাকে তাহলে কে থাকবে বলো তো? এতিম মেয়েটার পৃথিবীতে কেউ নেই। তুমি তো মা,,তোমার শক্তিশালী দোয়ায় মেয়েটা বেঁচে ফিরতেও পারে। ফুপী,, তুমিও যাও ওদের সাথে।’
শতরুপা চৌধুরী মলিন হেসে শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কপালে চুমু এঁকে দিলেন। দূরে থাকলেও বাড়ির সব ঘটনা উনার কানে পৌঁছায়।
সবই জানেন তিনি। শীতলের মরণদশায় শক্তপোক্ত ছেলেটার হাল দেখে কেন জানি খুব করে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করল,
-‘এতদিন এত ভালোবাসা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি আব্বা? একদিনে এ কি হাল তোর? নিজের বুকে লাভা জমিয়ে ছোট ভাইয়ের বুকের ব্যথা কমাতে ছুঁটে এসেছিস? তার পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়াচ্ছিস? অসুস্থ মেয়েটা
যে ক্ষণে ক্ষণে বাঁচার হাল ছেড়ে দিচ্ছে দূরে দাঁড়িয়েও এভাবে মনোবল বাড়াচ্ছিস? এক শরীরে কত রুপ দেখাবি বাবা? এত ধৈর্য্যশক্তি কোথায় পেলি? ছোট শুদ্ধটা এত বুঝদারই বা কবে হলো? সিঁতারা চৌধুরী সত্যিই রত্নগর্ভা রে।’
এ পরিস্থিতিতে এসব কথা বড্ড বেমানান তাই কথা বাড়ালেন না। শুদ্ধর ফোনে কল এলে সে কল রিসিভ করতেই অর্ক বলল,

-‘আব্বু-আম্মু বর্তমানে বিডিতে আছে। সিঙ্গাপুরের বাসাটা ফাঁকা পড়ে আছে। আম্মুর শখের বাড়ি, ছাদ-বাগান ভাড়াটিয়ারা যদি নষ্ট করে দেয় তাই ভাড়া দিয়ে আসে নি। টেক কেয়ারের জন্য শুধু দুজনকে রেখেছে।
ফুপি মা ওখানে গিয়ে আমাদের বাড়িতে থাকবে। তুই উনাদের পাঠিয়ে দে। আলাদা করে হোটেল ফোটেলের ঝামেলায় যেতে হবে না। তাছাড়া হসপিটাল আমাদের বাসার কাছে তা তো জানিসই।’
-‘তবুও..।’
-‘কাহিনি করিস না যা বলছি শোন। আমি যেভাবেই হোক চাবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর রুবাবকে বল আমরা সবাই আছি ভেঙে পড়লে হবে না। ও ভেঙে পড়লে ঐশ্বর্য হাল ছেড়ে দেবে।’

-‘হুম।’
-‘শীতল?’
-‘ভালো নেই,, দ..দোয়া করিস।’
একথা বলে শুদ্ধ কল কেটে রুবাবের কাঁধে একবার হাত রেখে দোতলায় চলে গেল। গিয়ে দেখে সায়ন হুলস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেছে। তাকেও থামিয়ে শান্ত করল। তারপর ইমার্জেন্সিভাবে ঐশ্বর্যকে দেশের বাইরে পাঠানোর বন্দব্যস্ত করে ফেলল। সব ঠিকঠাক করতে করতে ঘন্টা দুই পার হয়ে গেল। অতঃপর রুবাব সবার দোয়া নিয়ে পাড়ি জমাল দেশের বাইরে।

_’বাবা? বা…বাবা? ঠিক আছো তুমি? হসপিটালের আসতে পারবে? কষ্ট করে হলেও এসো না বাবা….প্লিজ! তোমাকে যে আমার ভীষণ দরকার বাবা।’
ফোনকলে শুদ্ধর ভেজাকন্ঠ শুনে শারাফাত চৌধুরী শোয়া থেকে হুড়মুড় করে উঠে বসলেন। কাঁচা ঘুম ভাঙায় চোখে ঝাপসা দেখছেন। নিজেরও শরীরটা ভালো না। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। এখন রাত আড়াইটা। রাত এগারোটার দিকে স্বপরিবারে সবাই বাড়ি ফিরেছিলেন তাও শুদ্ধর কথায়। তখন শীতল একটু ভালো ছিল। তাহলে কি আবার খারাপ হয়ে গেছে? শুদ্ধ কাঁদছে কেন এভাবে? অকারণে কাঁদার ছেলে তো শুদ্ধ না।

বিপদে না পড়লে দুই ছেলের কেউ কখনো এভাবে ডাকে না। শারাফাত চৌধুরী যেভাবে ছিলেন সেভাবেই গাড়ির চাবি নিয়ে নামতেই পা সড়কে গেল। আসবাবপত্রে ব্যথা পেলেন। সেই ব্যথাকে তোয়াক্কা না করে রুমের বাইরে আসতেই দেখে এখনো কেউ কেউ জেগে আছে। উনাতে এভাবে আসতে দেখে সিঁতারা, সিরাত, সিমিন, সাফওয়ান চৌধুরী কিছু বলার আগেই উনি বললেন হসপিটালে যাচ্ছে। একথা শুনে সকলে তড়িৎ উঠে দাঁড়াল।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৫

এতরাতে যাচ্ছে মানে আবারও কিছু ঘটেছে। শারাফাত চৌধুরী মানা করলেও কেউই শুনলেন না বরং শখ স্বর্ণকে ঘুমন্ত সাম্য সৃজনের দিকে খেয়াল রাখতে বলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। গেটে থাকা দারোয়ানকে আদেশ করে গেলে চোখ কান খেলা রাখতে। শুদ্ধকে কেবিনের বাইরে না দেখে সকলে ধীরে ধীরে কেবিনে ঢুকতেই হতবাক হয়ে গেলেন। কারণ কেবিনে শুধু শুদ্ধ ‘ই না মাফিয়া কিং ইয়াসির খানও উপস্থিত! কথা হচ্ছে, সে এখানে কেন?

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here