শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬০

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬০
নূরজাহান আক্তার আলো

ইয়াসির কথাটা বলে ধীরে ধীরে প্রস্থান করল। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
পায়ের ব্যথার সাথে মনের ব্যথাও যেন আন্দোলন করতে শুরু করেছে।
তাছাড়া এখানে থাকার মেয়াদ ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে সম্পর্কের দোহায় দেওয়ার কারণ-বারণ। এমনিতেই পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে বরাবরই তার প্রাপ্তি শূন্যের খাতায়৷ আজও তাই।

বলা বাহুল্য কেউ যখন একের পর এক প্রাপ্তি পায় তখন শেষবারেও প্রাপ্তির আশায় রাখে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে আবার উল্টো কিছু ঘটে। কেননা জন্মের পর থেকে তার জীবনে বিয়োগের উপস্থিতি একটু বেশিই বলা চলে। এই যেমন প্রথমে জন্মদাতা
পিতাকে হারাল। মাও ডিভোর্সি হলো। প্রতিনিয়ম নেইবারদের কটু কথার আঘাত,ফ্রেন্ডদের কথার খোঁচা, মাকেও তো কাজের জন্য কাছে পাওয়া হতো না। উনি বিজনেস উইমেন কাজই উনার সব। উনাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই কারণ উনার কারণেই তাদের জীবন ভালোভাবে চলত। ভালো খাওয়া, পড়া সবই হতো। এরপর নতুন বাবার আগমন ঘটল। দিনের পর
দিন মায়ের সঙ্গে উনাকে দেখে মন বিষিয়ে উঠত। যত ভাবত ততো যেন ক্ষীপ্ত হয়ে উঠত উনার প্রতি। অসহ্য লাগত। একপর্যায়ে উনার উপস্থিতি অসহ্যের মাত্রা ছড়াল। ইচ্ছে করে বল ছুঁড়ে আঘাতও করেছিল বহুবার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবুও মানুষটা কিছুই বলতেন না মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতেন। শান্ত হতে বলতেন। হাজিবাজি বোঝাতে চাইতেন। মায়ের কথা ভেবে উনাকে বাবা নয় বরং ফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহন করতে বলতেন। আর এটা ওর কাছে ছিল আরো বিরক্তিকর ব্যাপার-স্যাপার। এমনও হয়েছে কথায় কথায় আঘাত করার পরও বারবার সখ্যতা গড়তে চেয়েছেন। সেই বরং এড়িয়ে গেছে। কারণ তার কাছে সখ্যতা মানে পিছুটান। ওসব পিছুটানের মায়া রাখতে চাইলে সায়নের আগে ওর ঠাঁই হতো চৌধুরী নিবাসে।শারাফাত চৌধুরীর
বড় পুত্র হিসেবে বড় হতো। চৌধুরীদের রক্ত না হয়েও বড় হতো তাদের শিক্ষায়। আপন রক্তের দেওয়া শেষ পদবিও বদলে যেতো এক নিমিষে।

ইয়াসির খান থেকে হয়ে যেতো ইয়াসির চৌধুরী। চৌধুরীদের নাম আবার শ, স দিয়ে হয়। হয়তো তার নামটাও স,শ দিয়েই রাখা হতো। ইয়াসিরের নাম মুছে যেতো জীবন থেকে অথচ তার মা ইয়াসির নাম শখ করে নাকি রেখেছিল। ইয়াসির নামের অর্থ সৌভাগ্যবান। ইলিয়ানা চেয়েছিল উনার একমাত্র ছেলে সৌভাগ্যবান পুরুষ হোক। ভালোবাসায় ভালো থাকুক।
কিন্তু দুঃভাগ্যবশত ওর জীবনের ধারা নামের ধারে কাছেও যায় নি। বরং সর্বদা উল্টোটাই ঘটেছে। এ নিয়ে ভাবতে গেলেও তার ভীষণ হাসি পায়।
এবং হাজার কথার এক কথা, শুরু থেকে শারাফাত চৌধুরীকে সে বাবা হিসেবে মানতে পারত না। তার মা মারা যাওয়ার আগে তাকে শারাফাত চৌধুরীর কাছে আমানত হিসেবে রাখা তাকে আরো বেশি কষ্টকর ছিল।
কারণ সে পুরুষ তার মাকে বিয়ে করল কিন্তু সংসার করতেই পারল না।
তার কাছে তাকে আমানত হিসেবে রাখতে চাওয়াটা কি ঠিক ছিল? আর শারাফাত চৌধুরী মুমূর্ষু সহধর্মিণীর কথা রাখতে হয়তো রাজি হয়েছিল।

কিন্তু কারো দয়ায় বাঁচতে চায় নি সে এজন্যই মূলত লুকিয়ে বেড়াতো। সব যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। তবুও কিভাবে যেন শারাফাত চৌধুরী ঠিকই তাকে খুঁজে বের করত। কাজের নামে বাইরের দেশে গিয়ে তার সঙ্গেই দেখা করতে যেতো। কিন্তু সে দেখা করত না তবুও ভদ্রলোক হাল ছাড়তেন না। আর উনার এ কাজে তার রাগের মাত্রা আরো বাড়ত। ইচ্ছে করত মানুষটাকে মেরে ফেলে ঝামেলামুক্ত হতে। পরে এমনভাবে গা ঢাকা দিলো যে বছরের বছর শারাফাত চৌধুরী কোনো খোঁজই পেল নি। ততদিনে স্বেচ্ছায় মাফিয়া জগতে পা দিয়েছে। প্রাণের মায়া কোনো
কালেই ছিল না তার। আর গ্রাণী (নানী) মারা যাওয়ার পর পিছুটান ছিল না।

ইচ্ছে মতো লাইফ লিড করত। সেই ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই আজ মাফিয়া কিং নামে পরিচিত। আগে কেউ মাফিয়া কিং বললে গর্ব হতো। ভীষণ খুশি লাগত। সেই খুশিতে সহিংসতা আরো বাড়াত। পাপের রাজ্যে সুখ পেত। তবে আজ কেন জানি এই নামের ওজন অনেক বেশি ভার লাগছে। চৌধুরীদের মতো ভালো মানুষদের আশেপাশে ছিল বলে এই পরিবর্তন নাকি? এজন্য সে ভালো মানুষদের দেখতে পারে না। এরা নিজেদের ভালো গুনের আলো অন্যের মাঝে ছড়াতে চায়। এটা করা কি উচিত? মোটেও না! কারণ সবাই ভালো হলে পাপী কমে যাবে আর পাপ
কমে গেলে বেঁচে থাকাটাও পানসে মনে হবে। ইয়াসির মুখ কুঁচকে নানান কথা ভাবতে ভাবতে হসপিটাল থেকে বের হতেই দেখে তার গাড়িটা সেই সকালে রেখে যাওয়া জায়গাতেই আছে। তবে গাড়ির দরজা খুলে বুরাক বসে আছে। তাকে দেখামাত্রই একপ্রকার ছুটে এলো বুরাক।

অস্থিরকন্ঠে কীসব বলল। ইয়াসিরের আপাদমস্তক দেখে মলিন মুখে তাকিয়ে রইল ইয়াসিরের দিকে। শীতলকে গুলি করেছিল বিধায় তার মুখ বরাবর এক ঘুষি মেরেছিল ইয়াসির। এজন্য তার ঠোঁট কেঁটে ফুলে এখনো লাল হয়ে আছে। ইয়াসির তাকে দেখে বলল,
-‘আমি মেরেছি বলে কি আমাকেই মেডিসিন লাগিয়ে দিতে হবে?’
-‘না মানে স্যার টেনশনে ভুলে গেছি। সমস্যা নেই।’

ইয়াসির কথা বাড়াল না গাড়িতে বসে ইশারা করা মাত্রই ড্রাইভার গাড়ি
স্টার্ট করল। বুরাক মুখ কাঁচুমাচু করে পানির বোতল এগিয়ে দিলে সেও নিলো। থেমে থেমে পানি পান করল। পানি খাওয়ার একটুপর তার চোখ জোড়া আপনাআপনিই ভার হয়ে আসতে লাগল। কষ্ট করেও চোখ টেনে
খুলে রাখতে পারছে না। অগত্যা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজতেই গলার কাছে সূচ ফুটানোর মতো ব্যথা অনুভব করল। এরপরই কর্ণকুহুরে কেউ যেন ফিসফিসিয়ে বলল ,
-‘আ’ম সরি, স্যার, এক্সট্রিমলি সরি।’

এদিকে ইয়াসিরের কথা শুনে সায়ন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিঁতারার দিকে। মায়ের কান্নায় আজ বলে দিচ্ছে অনেককিছু৷ তার বুকের ভেতর জ্বলছে ভীষণ। কষ্টরা হুল ফুটানোর মতো ফুটছে বুক পাজরে তবুও সে
কথা বাড়াল না। তাছাড়া শীতলের অবস্থার কথাও ভাবা উচিত। বেচারা শুদ্ধও না পারছে কিছু বলতে না পারছে আপাতত টপিক চেঞ্জ করতে।
সে শুধু বারবার শীতলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাচ্ছে। পাজি শীতলটা মেডিসিনের প্রভাবে এ পরিস্থিতিতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে শুদ্ধকে জেদ
করে বিয়ে করার পরপরই যেন তার পৃথিবী সুখে ভরে গেছে। আর কিছু লাগবে না তার। সে সুখী। আর সেই সুখ নৃত্য করতে করতে তার চোখে ঘুম হয়ে ধরা দিয়েছে। মেয়েটা অনেক ধকল সহ্য করেছে এখন ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। হিসাবের খাতাটা পরেও খোলা যাবে। একথা ভেবে সে কান্নারত মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু মলিন হাসল। সিঁতারা ছেলের হাতে পাগলের মতো চুমু খেল। তবে মুখে কিছু বলতে পারল না। সায়নও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা না করে পা বাড়াতে যাবে তখনই গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর কর্ণকুহুরে এসে পৌঁছাল। থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেও। শারাফাত চৌধুরী তখন গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-‘ ছোট্ট বাচ্চা যখন ছিল একটু একটু করে বড় করেছি। এ বুকে আগলে রেখেছি। আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে। যখন যা প্রয়োজন নিজে সেটা
এনে দিয়েছি। ভুল করলে যেমন শাসণ করেছি তেমন ভালোবাসতেও কমতি রাখি নি। দুই কানে যখন শুনেছি কাউকে পছন্দ করে তখন বাবা হয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমি পালন করব। এখন কে কার
থেকে কী শুনে আমাকে বাবা ভাবল কী ভাবল না তা দেখার সময় নেই। এতদিন কাউকে আমার ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছি মরার আগ অবধি সেই পরিচয়ই বহন করতে হবে তাকে। এটাই আমার আদেশ! আর কেউ যদি আমার শাসণকে অবহেলা ভেবে থাকে তাহলে বলব ভুল সে। আমি শারাফাত চৌধুরী জেনে বুঝে কখনো অন্যায় করি নি, কারো হক মারি নি, আমি আমার ছেলেদেরও আমার শিক্ষায় দিয়েছি। আমার নীতিতে তাদের বড় করেছি। সিঁতারা তাকে বলে দাও রং ঢং না করে যেন সোজা বাড়িতে যায়। আমাদের সাথেই যেন যায়।’
এইটুকু বলে তিনি থামলেন। তারপর শুদ্ধর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ
ফিরিয়ে পুনরায় বললেন,

-‘শীতল সুস্থ হলেই দুই জোড়ার বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে ফেলব। এরমধ্যে
কেউ যদি ভেবেও থাকে বাড়ি ছাড়বে, পরিবার ছাড়বে, এতিমের রোল প্লে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে তাহলে সে যেন আমার বুকের উপর পাড়া দিয়ে যায়। আমিও দেখি তার কত বড় স্পর্ধা! আমার আদেশ অমান্য করার সাহস আদৌ তার বুকে জন্মেছে কী না! মেডিসিনের ইফেক্টে তো
শীতল ঘুমাচ্ছে বাকিটা শুদ্ধই সামলাতে পারবে। গাড়িতে ওয়েট করছি, এসো তোমরা।’
একথা বলে শারাফাত চৌধুরী চলে গেল। সায়ন তখন সিঁতারা চৌধুরীর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল,

-‘শুনলে তোমার স্বামীর কথ, শুনলে? উনার বুকে পাড়া দিয়ে চলে যেতে বলল অথচ উনিও খুব ভালো করে জানে যেতে পারব না। নিজেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো আবার নিজেই ডাকছে। যাব না আমি,আমার কি আত্মসন্মানবোধ নেই নাকি?’
একথা বলতে দেরি কিন্তু দরজার কাছ থেকে শারাফাত চৌধুরীর বলতে দেরি হলো না,
-‘ কেউ বাবা হোক। ওর মতোই লাফাঙ্গা ছেলে তারও হোক। তখন বাবার আসনে দাঁড়ালে বুঝবে বাবাদের যন্ত্রণা। দেরি হচ্ছে এবার আসা হোক।’
বাকিরা তাদের কথা শুনে চোখভর্তি জল নিয়েও হাসছে৷ এ ঘটনা নতুন নয় তারা বাবা-ছেলে এভাবেই ঝগড়া করে। তাদের ঝগড়ার ধরন এমন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সবাই ভেবেছিল সায়ন হয়তো ভেঙে পড়বে। খুব কষ্ট পেয়ে পাগলের মতো আচরণ করবে। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না বরং শারাফাত চৌধুরীর সাথে তালে তাল মিলিয়ে ধরা গলায় বলল,

-‘পরে যাব।’
-‘আমি এক্ষুণি যেতে বলেছি।’
এবার সায়নও জেদ দেখিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলো,
-‘ যাব না মানে যাবই না। কেন আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল?’
-‘বললেই যেতে হবে কেন?’
-‘ আমি কি ছোটো আছি নাকি যে ভুল করলেই বের করে দিতে হবে? কেউ কী জানে না আমি বাড়ি ছাড়া থাকতে পারি না। কারো মনে রাখা উচিত ছিল আমিও এখন বড় হয়েছি, আমারও আত্মসন্মানবোধ জাগ্রত হয়েছে।’
-‘যে ছেলে বাপের কাছে শর্ট প্যান্ট ধার চাইতে আসে সেই ছেলেকে বড় লাগে কোনদিক দিয়ে? সে কী ভুলে গেছে মাস খানিক আগেও ধরেবেঁধে চুল দাঁড়ি কাটিয়ে এনেছি। নাকি একথা ভুলে গেছে, দামড়া ছেলে হয়েও জ্বর কাতরাচ্ছিল দেখে কোলে করে হসপিটালে নিয়েছি। ভাত খেয়ে যে পর্দায় হাত মুছে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারে তাকেও এখন বড় হয়েছে বলে মান্য করতে হবে? হ্যাঁ খুব বড় হয়েছে এজন্যই তো আমায় এখনো এটা-ওটা নিয়ে গাল-মন্দ করা লাগে।

একথা শুনে সায়ন মুখ ভোঁতা করে তাকিয়ে রইল দরজা দিকে। সবার সামনে একথা বলা কি উচিত হলো? এরপর আর কিছু বলল না সায়ন সিঁতারার কাঁধ জড়িয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। তাকে
আসতে দেখে শারাফাত চৌধুরী গটগট করে হেঁটে গেলেন পাকিং লটে।
বাকিরাও শুদ্ধর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। স্বর্ণকে এখানে দেখে শারাফাত চৌধুরী ভ্রুঁ কুঁচকালেও কিছু বললেন না। নয়তো পাগল আবারও ক্ষেপতে পারে। উনারা গেলে শুদ্ধকে একটু বিশ্রাম নিতে বলে
অর্করাও কাজিকে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ দ্রুত পায়ে সায়ন পুনরায় কেবিনে ঢুকল। শুদ্ধ তখনো দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। কেন জানি মন বলছিল সায়ন আসবে তার ভাবনা প্রমাণিত করে সত্যি সায়ন এলো। জড়িয়ে ধরল ভাইকে। তারপর ফিসফিস করে বলল,

-‘ভাগ্যিস মেজর সাহেব আমাদের আগেই জানিয়েছিল নয়তো আজকে
নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যেতো। মানুষ বলে শত্রু খারাপ। আসলে শত্রুরা না থাকলে কঠিন সত্য সহজে জানা যায় না। তাছাড়া জানা সত্য
তিতা হলেও গ্রহন করতে কষ্ট কমই লাগে। আমি ঠিক আছি ভাই। এবার
রেস্ট কর। বোন দিয়েছে যত্নের কমতি যেন না হয়।’
একথা বলে সায়ন শুদ্ধকে ছাড়তে গেলে শুদ্ধ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। কিছুক্ষণ কেউ কোনে কথায় বলল না। তবে দু’জনেরই ছলছল চোখ। এ কঠিন সত্যি শুদ্ধ সায়ন জেনেছিল তিন থেকে চার বছর আগে।
সেদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন শাহাদত চৌধুরী। ছুটিতে এসে শুদ্ধ সায়নকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন একটা কাজে। সেদিন হঠাৎ পরিচিত এক মানুষের সাথে দেখা হয়েছিল। সেই ব্যক্তিকে দেখামাত্রই শাহাদত চৌধুরী এড়িয়ে যেতে গেলে ওই মানুষটা উনার পথ আঁটকে দাঁড়ান। হলুদ দাঁত বের করে
হাসতে হাসতে সায়নকে দেখে বলে ফেলে,

-‘শারাফাত ভাইয়ের পালক ছেলে না এইটা?সিঁতারা ভাবিরই তো আপন ভাইয়ের ছেলে ছিল বোধহয়। সম্পর্কে ভাবি তো হচ্ছে এর আপন ফুপি। এর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার শর্তে বিয়ে করেছিল সিঁতারা ভাবি।
ছেলে কিন্তু ওর আপন বাপের মুখের আদল পেয়েছে। এর বাপও ভালো মানুষ ছিল। ওরা ছিল শিকদার বংশের।’
ব্যস, এই একটা কথায় ছিল তিক্ত কথা জানার সুত্রপাত। হঠাৎ নিজের পরিচয় নিয়ে যখন এমন কথা শুনেছিল তখন সায়ন যেন উন্মান কোনো পাগল। শাহাদত চৌধুরী সেদিন অনেক কষ্টেই সায়নকে সামলেছিলেন। উনি কান্নারত সায়নের হাত ধরে নিজেও অঝরে কাঁদতে কাঁদতে ওয়াদা করিয়েছিলেন, সায়ন এই কথা জানে কখনো যেন কারো কাছেই প্রকাশ না করে। যদি করে সবচেয়ে কষ্ট পাবে সিঁতারা চৌধুরী। এবং এও বলেন সিঁতারা চৌধুরী সায়নের আপন না তবে আপন ফুপি। আর ফুপি হয়েও তিনি মায়ের কাজ করেছে।

জন্ম না দিয়েও নিজের সন্তানের মতো করে ভাইয়ের আমানত বুকে আগলে বহুকষ্টে বড় করেছেন৷ সায়ন শারাফাত চৌধুরীর রক্ত নাহলেও সিঁতারার মায়ের বংশের ছেলে সায়ন। সিঁতারার বংশের রক্ত সায়নের গায়ে। সে এতিম নয়। কুড়িয়ে আনা পালক সন্তান নয়। সে শুদ্ধর ভাই। সত্যিই ভাই।ধরতে গেলে মামাতো ভাই কিন্তু তাদের সম্পর্ক এমন যে মামাতো বলে কিছুর ধার ধারে নি ওরা। তাদের একটাই কথা, সায়ন, শুদ্ধ, শখ এরা সিঁতারার তিন ছেলে-মেয়ে, শুদ্ধ- শখের বড় ভাই সায়ন। আর এটাই হচ্ছে সায়নের একমাত্র পরিচয়। আজ আবারও সেসব ঘেঁটে কষ্ট লাগলেও সায়ন মেনে নিয়েছে হাসিমুখে। কারণ এতিম নয় তার ফুপিমা হচ্ছে তার মা।শুদ্ধর নীরাবতা বুঝে সায়ন মুচকি হাসল। তখন শুদ্ধ বলল,

-‘ আগেও বলে়ছি আজও বলছি তুমি আমার ভাই। কার রক্ত, কোন বংশ সেসব বাদ।’
সায়ন হাসল। তারপর শুদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে চটাস করে শুদ্ধর গালে চুমু দিতেই শুদ্ধ নাক মুখ কুঁচকে নিলো। তা দেখে সায়ন হো হো করে হাসতে লাগল। শুদ্ধ এটা মোটেও পছন্দ না দেখে সায়ন আরো বেশি করে করে।
একটু রাগিয়ে দেয়। তবে আজ শুদ্ধ রাগ দেখাল না মৃদু হাসল। এরপর
বলল,
-‘বাড়ি গিয়ে তোমাদের দুজনের অভিমানও গুঁড়ো গুঁড়ো করবে। বিপদ এসেছিল কেটেও গেছে, আলহামদুলিল্লাহ। রুবাবও হাসি মুখে ফিরবে, ইনশাআল্লাহ। এখন যাও সবাই ওয়েট করছে।’
একথা শুনে সায়ন হঠাৎ শুদ্ধকে পাশের বেডের দিকে ইশারা করে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলল,

-‘একসাথে করে দিবো নাকি? উহুম, উহুম কিছুটা সুবিধা হতে পারে।’
-‘দিবো নাকি আবার কি কথা, ধর।’
ভাইয়ের কথা শুনে সায়ন পুনরায় ফিক করে হেসে ফেলল। এরপর দুই
ভাই মিলে দুটো বেড টেনে একসাথে করল। এরপর সায়ন মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। সে যেতেই শুদ্ধ কেবিনের দরজা লক করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গেল। হাত-মুখ মুছে শীতলের স্যালাইন, এই হাত, ওই চেক করে সব ঠিকঠাক দেখে একটু উঁকে ঝুঁকে শীতলের সারা মুখে চুমু এঁকে বিরবির করে বলল,
-‘ ‘শুদ্ধ ভাই আমি আপনার বউ হবো’ বলে হেদিয়ে মরছিল। বিয়ে করল বউও হলো, তারপর ঘুমিয়েও গেল? এখন বাসর টা কি আমি বালিশের সাথে সারব?’
একথা বলে বকতে বকতে পাশে শুয়ে পড়ল। ব্যাঙাচিটার সারা শরীরে ব্যথা নয়তো একটু জড়িয়ে ধরা যেতো। ধরলে হয়তো তার বুকটা শান্ত হতো। কিন্তু কী আর করার মেনে নিতেই হবে ভেবে শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে নিলো।

শারাফাত চৌধুরীরা বাড়ি পৌঁছে যে যার রুমে চলে গেছে। সকলে ক্লান্ত বিধায় কেউ কোনো কথা বাড়ায় নি। সায়নও শাওয়ার নিয়ে বের হতেই কেউ তার বুকে স্বজোরে ধাক্কা মারল। আচমকা ধাক্কায় বিছানায় বসে পড়েছে সে। আরেক ধাক্কা মারতেই সায়ন সামনের মানুষটার হাত ধরে নিলো। থমথমে মুখে বলল,
-‘ কেউ যেন আমাকে না ছোঁয়।’
-‘ছুঁলে কি হবে?’
-‘ফোসকা পড়বে।’
-‘তবুও ছুঁবো।’
-‘বারণ করছি বারণ শোনা হোক।’

একথা শুনে স্বর্ণ নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই সায়ন খপ করে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। সে এবার নিজেই স্বর্ণকে ছুঁড়ে দিলো নরম বিছানার মাঝখানে। এগিয়ে এলো ধীরে-ধীরে। চোয়াল শক্ত করে আরো কাছে আসতেই স্বর্ণ খাবলে ধরল সায়নের পরনের শুভ্র তোয়ালের গিট্টু। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি এঁটে হুমকিস্বরূপ বলল,
-‘ছাড়বে নাকি টান দেবো?’
সায়ন স্বর্ণের কথা পাত্তায় দিলো না বরং চোখে চোখ রেখে ওষ্ঠজোড়া দখলে নিলো। প্রথমে ধীরে তারপর তার সমস্ত রাগটুকু যেন উগলে দিতে থাকল স্বর্ণের ঠোঁটের ভাঁজে। শক্ত কামড়ে রক্তাক্ত করে তবে ক্ষান্ত হলো সে। এরপর নিজেও হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করল,

-‘গেলিই যখন ফিরলি কেন?’
স্বর্ণের নিচের ঠোঁট কেটে জ্বলছে খুব। তবে তার উন্মাদ প্রেমিক পুরুষের রাগ কমানোর জন্য এটুকু সহ্য করা যায়। কাটা ঠোঁট নাড়িয়ে সে জবাব দিলো এবার,
-‘ভালো থাকতে এবং রাখতে।’
সায়ন বলল,
_’যার মনে ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও নেই তার কাছে ভালো থাকার কারণ খোঁজা বোকামি হয়ে যায় না?’
-‘কে বলল আমার মনে ভালোবাসা নেই?’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৫৯

-‘আমি বলছি। ভালোবাসলে অন্তত ফেলে যেতে পারতি না।’
-‘ভালোবাসি বলেই ভালোবাসার মানুষদের কাছে রেখে গেছি; ছেড়ে যাই নি। আর যাবই না কোথায়? আমার শেষ গন্তব্য তো আপনিই শাহরিয়ার চৌধুরী। ‘

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here