শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬১

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬১
নূরজাহান আক্তার আলো

পরেরদিন সকালবেলা,
নতুন এক দিনের সূচনা। বেলা কতই বা হবে এ সাতটা কি সাড়ে সাতটা! অন্য দিন ভোরের আজানের পরপরই চৌধুরী নিবাসে একে একে সবাই উঠে পড়েন। দৈনন্দিন কাজ শুরু করেন। রান্নাঘরে হুটোপুটি লেগে যায়।
কিন্তু আজ নীরাবতায় ছেয়ে আছে চৌধুরী নিবাস। ভোরের দিকে বাড়ি ফেরায় কেউ উঠতে পারে নি। তবে একজন মানুষ ঘুমানো তো দূর স্থির হয়ে বসতে অবধি পারেন নি৷ বুকের ভেতরটা আফসোসে দুঁমড়ে মুঁচড়ে যাচ্ছে উনার। নামাজে বসে অঝরে কেঁদেছেন। বুকটা যেন তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। দীর্ঘদিন চেপে রাখা আফসোস
নতুন করে ক্ষত দগদগে করে তুলেছে। আর উনার আফসোসের আরেক নাম ইয়াসির। হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই উনার আফসোসের নাম ইয়াসির। আগে তার জন্য যতটা না আফসোস হতো আজকে তার থেকেও বেশি হচ্ছে।

বাবা তো দূর নিজেকে ব্যর্থ একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। ছেলে আজ উনাকে বাবা বলে ডেকেছে তাও প্রথমবার। তাও কেন বলেছে? কারণ উনিই তার কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। শুদ্ধ-শীতল কবুল বলার মুহূর্তে অসহায় চোখে বার বার তাকাচ্ছিল ছেলেটা। ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কাঁপিয়ে কান্না আঁটকানোর চেষ্টা করছিল। তার চোখ যেন চিৎকার করে অভিযোগ করে বলছিল, ‘ওদের থামাও বাবা! থামাও!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু সেটা আর সম্ভব ছিল না। ইয়াসির যেমন জেদি তার থেকেও শুদ্ধ একরোখা। সেই মুহূর্তে যদি পুনরায় বাঁধা সৃষ্টি করতো তাহলে ইয়াসিরের জীবনআয়ু সেখানেই শেষ করত। বলা বাহুল্য, উনি ছোটো ছেলের তীক্ষ্ণ
রাগকে ভীষণ ভয় পান। কেননা ছেলের রাগের মাত্রা উনি দেখেছে। আর
যেখানে অসুস্থ শীতল চাচ্ছিল সেখানে কিছু করার ছিল। আরেকটা কথা না বললেই নয়; সায়ন উনার রক্ত নয় তবে সায়নের ক্ষমতা নেই উনাকে উচ্চবাক্য করার। স্পর্ধা নেই উনার মুখের উপর না বলার। সবার সামনে
ছোটো করার। এজন্যই এতকিছুর পরও সায়নকে ধমকে ধামকে হলেও
বাড়ি ফেরাতে পেরেছেন। কঠিন সত্য জেনেও বুঝদার সায়ন ভেঙ্গে পড়ে উনাকেও ভেঙে ফেলে নি। ছেড়ে গিয়ে বুকের উপর পাথর তুলে দেয় নি।

বলতে লজ্জা নেই সায়নের মতো করে আজ ইচ্ছে করছিল ইয়াসিরকেও থামাতে। সেও তো উনারই ছেলে। ইলিয়ানার দেওয়া শেষ আমানত। মন চাচ্ছিল, মান-অভিমান, ঠিক-বেঠিকের হিসাব ভুলে যেতে। উনার ছেলে বলে সারা পৃথিবীর কাছে পরিচয় করাতে। আফসোসে ভরা বুকে পাপী ছেলেকে বুক আগলে নিতে কষ্ট হতো না। একটুও হতো না! কিন্তু উনি জানেন ইয়াসির উনার ডাক শুনত না। লাগামছড়া, বাঁধনহারা ছেলেটা
শুনলে আগেই শুনতো উনার কথা। কিন্তু সে শোনে নি। বারবার পিছলে গেছে। মোদ্দাকথা, যে বাঁধনে বাঁধা পড়তে চায় না তাকে কিভাবে বেঁধে রাখবেন? শেষ চেষ্টা হিসেবে স্বার্থপরের মতো ভেবেওছিলেন শীতলের
তার বিয়ে দিয়ে কাছে রেখে দিতে। তাকে ভালো পথে আনার সর্বেশেষ সুযোগটুকু কাজে লাগাতে। এই ভেবে বলেছিলেন,পাপাচার কমালে সে চৌধুরী নিবাসের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটা দিবেন। কারণ উনার মনে মতো শীতলের চঞ্চলতায় পারবে দুষ্টু রাজকুমারের পাথর মনে ফুল ফোটাতে। তার পাপের পথ আগলে ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনতে। শীতলের মধ্যে এই আশ্চর্য জাদুকরী ক্ষমতা আছে। কিন্তু কে জানত শুদ্ধ-শীতল একে অপরকে পছন্দ করে। সেই পছন্দ পছন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই সকলের দৃষ্টির আড়ালে দিনকে দিন সেটা ভালোবাসার রুপ নিয়েছে। একথা তো উনি জানতেনও না। জানলে অবশ্যই ভুলেও ইয়াসিরকে কথা দিতো না।

এখন এমন একটা অবস্থা উনি আজকের পর থেকে শুদ্ধর চোখে চোখ রেখেও তাকাতে পারবেন না। ছেলেটা হয়তো উনাকে জঘন্য বাবা বলে মনে মনে ঘোষনা করেছে। করাটা স্বাভাবিক যদিও। আজ বলতেই হয়,
এতদিন নিজের নৈতিকতা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠাচার নিয়ে গর্ব ছিল উনার। কিন্তু আজ একনিমিষেই শেষ। অন্যেরা কি বলবে পরের হিসাব,
এখন নিজের মনই চিৎকার করে বলছে, ‘তুমি বাবা হিসেবে খুব খারাপ
শারাফাত চৌধুরী, খুব খারাপ। তুমি না পারলে ইয়াসিরকে সঠিক পথে আনতে, না পারলে ছেলেটার মুখে হাসি ফোটাতে। শেষ মুহূর্তে যা চেষ্টা করলে সেটাও আরেক ছেলের হাসি কেড়ে নেওয়া ঘৃণিত কাজও করতে যাচ্ছিল। আর সায়ন? তাকে তো তুমি শাষণে রেখেছে সবসময়। ভীষণ শখ করে ছেলেটা রাজনীতি করতে চেয়েছিল। সেটাতেও তোমার বাঁধা।

তুমি বাবা হওয়ার যোগ্য না শারাফাত, বাবারা অন্তত এইরকম আচরণ করে না।’
নিজের মনের কথা শুনে শারাফাত চৌধুরী মলিন হাসলেন। না চাইতেও চোখের পানি ঝরঝর করে ঝরে গেল। ক্লান্ত শরীরে এলিয়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ঘূর্ণায়মান সিলিংয়ের দিকে। এরপর মনে মনে বিরবির করলেন,
-‘আমার আল্লাহ জানে আমি আমার সায়নকে কখনো আলাদা চোখে দেখি নি। কখনো বাকি দুই সন্তানের সাথে তুলনা করি নি। তুলনা করবই বা কেন, ও তো আমার ছেলে। আমার আরেক সন্তান! হ্যাঁ ওর রাজনীতি করা পছন্দ না একথা ধ্রুবসত্য। শখের বশে কিছু করতে হলে অন্যকিছু করুক, রাজনীতি কেন? রাজনীতি শখের বশে করা জিনিসও না।

আর কে চায় সন্তানের রক্ত দেখতে? ক’দিন পরপর আহত হয়ে বাড়িতে ফেরে এসব দেখতে কার ভালো লাগে? আমি মানি আমি খুবখারাপ বাবা কিন্তু খারাপ বাবাদের মনে ভয় হয়,, সন্তান হারানোর ভয়। ছেলের লাশ কাঁধে নেওয়ার ভয়। সেক্ষেত্রে আমি খারাপ বাবা খারাপই থাকব।’
একথা ভাবতে ভাবতে উনার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াতে লাগল।
একফোঁটা,, দুফোঁটা করতে বালিশ ভিজতে থাকল। উনার পাশে ঘুমানো সিঁতারার অজানায় রয়ে গেল প্রিয় স্বামীর বুকচাপা কিছু কষ্টের কারণ।
যেগুলো দগ্ধ করছে উনার বুক পাঁজর!

বেলা বাড়ার সাথে সাথে চৌধুরী নিবাসের সদস্যরা জেগে উঠল। সকলে আগে শীতলের খোঁজ নিতে শুদ্ধকে লাগাতার কল দিতেই থাকল। কিন্তু কল রিসি়ভ হচ্ছে না। আবার কিছু হলো না তো? সবার মুখে চিন্তা ছাপ। সিমিন অস্থির হয়ে কল দিতে দিতে কলটা কেটে যাবে সেই মুহূর্তে কল রিসিভ হলো। উনি চিন্তিত সুরে হ্যালো বলার আগে শীতলের কন্ঠ শোনা গেল,

-‘হ্যা..হ্যালো আম্মু!’
-‘শীত..ল? কেমন আছিস মা? শরীর ঠিক আছে? শুদ্ধ কই? কল ধরছে না কেন ছেলেটা?’
-‘আম্মু, শুদ্ধ ভাই ঘুমাচ্ছে। ক্লান্ত লাগছে দেখে ডাকি নি পাশ থেকে ফোন নিয়ে আমি রিসিভ করেছি।’
-‘ওহ। তুই ঠিক আছিস?’
-‘হুম।’
-‘নার্স এসেছিল? আর স্যালাইন দিয়েছে? সাবধান ক্যানোলাতে রক্ত উঠে যায় না যেন।’
-‘উঠবে না। আসবে না তোমরা?’
-‘এইতো সকালের নাস্তা বানিয়েই যাব আমি।’
-‘তাড়াহুড়ো কোরো না ধীরে-সুস্থে এসো আমি ঠিক আছি।’
-‘ঠিক আছে।’
শীতলের কথা শুনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ওদিকে একজন নার্স কেবিনের দরজায় নক করামাত্রই শীতল নিচু স্বরে জানতে চাইল কে এসেছে। নার্স বলল,

-‘ম্যাম আপনার স্যালাইন শেষের পথে ওটা খুলে দিতে হবে। ‘
একথা শুনে শীতল একবার তাকাল ঘুমন্ত শুদ্ধর দিকে। উপুড় হয়ে কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে তার বিশুদ্ধ পুরুষ। মূলত তার ঘুমটা ভাঙতে চাচ্ছে না বলেই কত কষ্ট করে ফোনটা কাছে টেনে কল রিসিভ করল। এজন্য গুলি লাগা হাতেও ব্যথা পেয়েছে। এদিকে আবার এই নার্স এসে হাজির।
এদিকে স্যালাইনও শেষের দিকে খুলতে হবে দেখে সে নিচু স্বরে বলল,
-‘শব্দ না করে নিঃশব্দে আসুন।’

একথা শুনে নার্স নিঃশব্দে কেবিনে প্রবেশ করল। দুটো বেড একসাথে দেখে বিষ্ময় নিয়ে তাকাল ঘুমন্ত পুরুষটার দিকে। বলা বাহুল্য পুরুষটা দেখতে বেশ। তাকে ওভাবে তাকাতে দেখে শীতল ফিসফিস করে বলল,
-‘ওটা আমার স্বামী! ঘুমাচ্ছে ঘুমাক শব্দ করবেন না, প্লিজ। আসলে ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে। বলতেও লজ্জা লাগছে, আসলে হয়েছে কী আমার শশুর বাড়ির বংশগত রোগ এটা। সব সময় রাগে না তবে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে মেজাজ চড়ে যায়। তখন যাকে সামনে পায় তাকে ধরে কামড়ে দেয়।’
একথা শুনে অল্প বয়সী নার্স মেয়েটা আরেকদফা অবাক হয়ে তাকাল শুদ্ধর দিকে। এমন সুদর্শন পুরুষের মাথায় সমস্যা? দেখে বোঝাও যায় না। আহারে সবই কপাল,,রোগ তো আর বলে কয়ে আসে না। রোগের কাছে সবাইকে কাবু হতেই হয়। এসব ভেবে শীতলের স্যালাইন দেওয়া হাত মুক্ত করল। নিঃশব্দে ক্যানোলার মাধ্যমে দুটো মেডিসিন ধীরে ধীরে ইনজেক্ট করল। শীতল ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। কি মেডিসিন কে জানে, রগে যাচ্ছে তো জ্বালাপোড়া করতে করতে।তবুও সে কোনো শব্দ করল না। ডাক্তার নাকি মুখে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে স্যালাইনটা বন্ধ আপাতত। একথা বলে ক্যানোলার মুখবন্ধ করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
উনি যেতেই শুদ্ধ চোখ খুলে শীতলের দিকে তাকিয়ে রইল। শীতল ওর তাকানো দেখে মিষ্টি করে হাসল। বলল,

-‘গুড মনিং শোয়াইব শুদ্ধ। বিয়ের প্রথম সকালে অনেক অনেক ফুলের শুভেচ্ছা রইল। ‘
শুদ্ধ কিছুই বলল না সেভাবেই তাকিয়ে রইল। আবার তাকে জ্বালানোর কাজে লেগে পড়েছে। কি যেন বলল? সে নাকি পাগল যাকে তাকে ধরে কামড়ে দেয়। ব্যাঙাচির ঘরে ব্যাঙাচি আর ভালো হবে না। শীতল ভাবল
এক্ষুণিই ধমকে উঠবে কিন্তু শুদ্ধ সেটা করল না। বরং গড়ন দিয়ে চলে এলো শীতলের খুব কাছে। বিনাবাক্যে শীতলের গলায় ডুবিয়ে বলল,
-‘ জ্বালাতে খুব ভালো লাগে তাই না?’
হতভম্ব শীতল কোনো কথা বলতে পারল না। লজ্জায় পেল বটে। তবে
কিছু একটা উচিত ভেবে বিরবির করে বলল,

-‘খুব।’
-‘আমি জ্বালালে সহ্য করতে পারবি?’
-‘ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খাব।’
একথা শুনে শুদ্ধ চট করে মুখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। এদিক ওদিক দেখে ফোন খুঁজে কল করল কাউকে। নাস্তা আনতে বলে নিজেও উঠে পড়ল।
মিনিট পাঁচেক পর হাসান নাস্তা নিয়ে আসলে দুজন মিলে বেড আরেক অবস্থানে রাখল। হাসান সারারাত হসপিটালে ছিল এখন ফিরবে বিধায় বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। শুদ্ধ শীতলকে যতটুকু পারল ফ্রেশ হতে হেল্প করল। তারপর নিজেও খেলো শীতলকেও খাইয়ে দিলো। এর কিছুক্ষণ পর সিমিন, সিতারক, স্বর্ণ আর সায়ন এলো। শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে ইশারা করে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণে ফিরে এসে শীতলকে বলল,
-‘ একটা কাজে যাচ্ছি ফিরতে লেট হবে।’

একথা বলে সে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, সেসব কিছুই বলল না। সারাদিন কোনো খোঁজও পাওয়া গেল না। ফিরল একেবারে মধ্যেরাতে তখন শীতল ঘুমাচ্ছিল। বিকেলের দিকে সাফওয়ান চৌধুরী এলে সিমিন আর সিতারাকে উনার সাথেই বাড়ি পাঠিয়ে দিলো সায়ন।সে আর স্বর্ণ হসপিটালে থাকল। শুদ্ধ ফিরলে তারা দু’জন বাইকে করে নিজের মতো সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরল। এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় চারদিন পর শীতলকে রিলিজ দেওয়া হলো। ভালোই ভালোই শীতলও মুক্ত পাখির ন্যায় এক আকাশ সমান খুশি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। তবে মেডিসিন চলছিল চলবে।
প্রচলিত কথায় আছে সময় হচ্ছে বহমান স্রোত। যা চলে নিজস্ব গতিতে। সেই সময়ের অংক কষতে কষতে পেরিয়ে গেল একটামাস। একটু দূর্বল
হয়েছে একের পর এক ধেড়ে আসা ঝড়। মলিন হয়েছে হারানোর কিছু ব্যথা। কিছু সত্য উন্মোচিত হয়েও বন্ধন হয়েছে আরো দৃঢ়। বলা বাহুল্য,

এই একমাসে পূর্বের মতো চাঙা হয়ে উঠেছে চৌধুরী নিবাস। মুছে গেছে হতাশার গ্লানি। স্মৃতির পাতায় যত্নে-অযত্নে বন্দী হয়েছে কিছু মিষ্টি মুহূর্ত ও কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। এখন চৌধুরী নিবাসও খুনশুটিতে মুখোরিত।
রুটিন মাফিক সবাইকেই ব্যস্ত হতে হয়েছে দৈনন্দিন কাজে। তবে শীতল বাড়ি ফেরা পর শুদ্ধকে বাড়িতে খুব কম সময় পেয়েছে। সে কখন আসে কখন যায় বলা মুশকিল। তার কিসের এত ব্যস্ততা কে জানে! সারাদিন কোথায় যায় কি করে তাও বলে না। খুব জোর করলে মলিন হেসে বলে ‘দোয়া কর যা হারিয়ে়ছি সব যেন ফিরে পায়। আমার কষ্টের ফল যেন আমারই কাছে ফিরে আসে।’

তার কঠিন কঠিন কথার মানে কিছু বোঝে না সে। তাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুদ্ধ হাসে। আসলে ল্যাবে চুরি হওয়ার কথা সে কাউকে জানায় নি। কি দরকার শুধু শুধু দুঃচিন্তা করবে। চিন্তা করে তো লাভের লাভ কিছুই হবে না। মোদ্দাকথা, চুরি হওয়া সেই ল্যাব বন্ধ করে দিয়েছে। চোর যখন একবার গেরোস্তের বাড়িতে চুরি করার সুযোগ পায় তখন সে বারবার ফিরে আসে। নিজে না আসলেও অন্যকে পাঠায় কাজ
উসুল করতে। আর এই সুযোগ কাউকে দেওয়া যাবে না। এরপর সে ওই ল্যাব কী করেছে সায়ন আর তার ফ্রেন্ডরা ছাড়া কেউ জানে না। আজও সারাদিন পেরিয়ে রাতে ফিরল শুদ্ধ। সবার সাথে ডিনার সারল। শীতল অভিমানী চোখে কয়েকবার তাকালেও কিছু বলল নি শুদ্ধ। আর তাদের বিয়ে হওয়ার পরও একরুমে থাকা না থাকা নিয়ে কেউ কিছু বলেও নি। ওদের মর্জির উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কেন জানি শুদ্ধও শীতলকে তার রুমে থাকার আহ্বান জানায় নি। অগত্যা পূর্বে যেমন ছিল এখনো তেমন চলছে। তবে কয়েকদিনে শীতলের মতো বড্ড অভিমান জমেছে।

কেন জানি মনে হচ্ছে শুদ্ধ তাকে ইগনোর করছে। নয়তো এত কিসের কাজ তার? একটু সময় দিলে কি হয়? আগের কথা এখানকার কথা কি এক নাকি? এখন মনে রাখা উচিত না তার ঘরেও একটা বউ আছে। বউ তাকে ভীষণ মিস করে। সঙ্গ চায়। জ্বালাতে চায়। অহেতুক বকবক করে কান-মাথা ঝালাপালা করে দিতে চায়। তা না খালি কাজ আর কাজ! এসব নানান কথা ভেবে রাতে খেয়ে শীতল মলিন মুখে উপরে যাচ্ছিল।
তখন সিঁতারা তাকে দাঁড় করিয়ে বলল,
-‘শীতল, উপরে যাচ্ছিস মা?’
-‘হুম, কিছু বলবে বড় মা?’
-‘খেতে বসে দেখলাম শুদ্ধ বার বার কপালে হাত দিচ্ছে। ছেলেটার মাথা ব্যথা করছে বোধহয়। কফি করে দিচ্ছি ওর রুমে পৌঁছে দিস তো মা।’
-‘দাও।’

একথা বলে সে পাশে এসে সিঁতারার পাশে দাঁড়াল। সিঁতারা আড়চোখে
শীতলকে একবার দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-‘কাজের চাপ বেড়েছে তাই সময় দিতে পারছে না। কষ্ট পাস না মা।’
একথা শুনে শীতল ধরা গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ কিন্তু কষ্ট হচ্ছে বড় মা। তোমার ছেলে ইচ্ছে করে আমাকে ইগনোর করছে।’
-‘কেন করছে জিজ্ঞাসা করেছিস?’
-‘না।’
-‘ গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।’
একথা বলে সিঁতারা শীতলের হাতে কফির ধরিয়ে দিলে শীতল যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সিঁতারা তাকে ধরে থামিয়ে দিলো। গলা খাঁকারি দিয়ে
আমতা আমতা করে বলল,
-‘আগে তো শাড়ি টাড়ি পরতি এখন পরিস না কেন? শাড়ি পরলে তোকে কিন্তু ভালোই লাগে।’
-‘কফি ঠান্ডা হয়ে গেলে খ্যাচ খ্যাচ করবে দিয়ে আসি।’
-‘যা।’

একথা বলে শীতল মুখ ভোঁতা করে চলে গেল। সিঁতারা স্বর্ণকে ইশারায় কাছে ডেকে কিছু বলে তাকে দ্রুত উপরে পাঠিয়ে দিলো। স্বর্ণ দ্রুতপায়ে গিয়ে শীতলের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে তাকে রুমে যেতে বলল। শীতল ধরা গলায় বলল,
-‘আমি দিয়ে আসি না আপু? প্লিজ আমাকে দাও।’
-‘তুই আমার রুমে যা আমি আসছি।’
একথা বলে স্বর্ণ শুদ্ধকে কফি দিয়ে শীতলকে লাল ও কালো মিশেলের
জর্জেট শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিলো। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলো। টানা টানা চোখে কাজল দিয়ে দিলো। হাতে দিলো একগোছা লাল ও কালো মিশেলের চুড়ি। কপালে ছোট সাদা পাথরের টিপ। তারপর বোনকে ধরে শুদ্ধর রুমের সামনে দাঁড় করিয়ে দরজা নক করে দ্রুতপায়ে সরে পড়ল।

শীতল এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখছিল বোনের কাহিনি। যখন সে বুঝল ততক্ষণে শুদ্ধর দরজা খুলে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এত রাতে
তার সাজগোছ দেখেও কিছু বলল না বরং দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। শীতল ধীর পায়ে রুমে ঢুকলে দরজা আঁটকে তাকিয়ে ই রইল শীতলের দিকে। এগিয়ে এসে দাঁড়াল শীতলের মুখোমুখি। সে কিছু বলছে দেখে শীতলই আমতা আমতা করে বলল,
-‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন শুদ্ধ ভাই? আমার মুখে কি কিছু লেগে আছে? দেখি সরুন যেতে দিন আমায়।’
কম্পিত সুরে বলা শীতলের কথাটা শুনল শুদ্ধ। তবে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। বরং সে হিমশীতল চাহনিতে পকেটে হাত গুঁজে এগিয়ে এলো দেওয়ালের সাথে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শীতলের দিকে।

হাত রাখল শীতলের কান বরাবর যেন কোনোভাবে পালাতে না পারে৷
তার মতিগতি বুঝে শীতলের গাল দুটো লালবর্ণ ধারণ করল। জীবনে
কম সিনেমা তো আর দেখে নি। তবে কিছু একটা আন্দাজ করে তার
গলা শুকিয়ে এলো। হাতের তালু ঘামতে থাকল৷ এর আগে সেই শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরেছে, কানের নিচে চুমু খেয়ে ভালোবাসার আবদার জুড়েছে, ঘুমন্ত শুদ্ধর বুকে মাথা রেখেছে, বুকে নাক ডুবিয়ে তার শরীরের ঘ্রাণও নিয়েছে। কিন্তু শুদ্ধ কখনোই তাকে অযাচিত স্পর্শ করে নি। যা করেছে সীমাবদ্ধতা রেখে। এবং তাতে তার নোংরা কিংবা গা ঘিনঘিনে অনুভূতি অনুভব হয় নি কখনো। আজকে হঠাৎ তার এমন রুপ দেখে যারপরনাই বিষ্মিত শীতল। যেতেও দিচ্ছে না আবার কিছু বলছেও না দেখে পুনরায় বলল,

-‘রুমে যাব।’
-‘কেন?’
-‘ঘুমাব।’
-‘তাহলে এলি কেন আমি কি ডেকেছি?’
-‘ভুল করেছি আর আসব না।’
একথা বলে যেতে গেলে শুদ্ধ ওর পথ আঁটকে দাঁড়াল। পাশ কাটিয়ে যেতে গেলে পুনরায় পথ আঁটকাল। বেশ কয়েকবার একই কাজ করাতে শীতল অধৈর্য্য হয়ে বলল,
-‘শুধু শুধু দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কেন? সরুন না, যেতে দিন প্লিজ।’
-‘ শুধু শুধু না তো।’
-‘তবে?’

শুদ্ধ ফিচেল হাসল। তার চঞ্চল অভিলাষী তার নিষিদ্ধ অভিলাষ বুঝেও না বোঝার ভান করছে দেখে মজা পেল। লজ্জায় রাঙা গালদুটো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে ঠোঁটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থমথমে সুরে বলল,
-‘প্রতিশোধ নিতে।’
-‘কিসের প্রতিশোধ?’
-‘সময় সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার প্রতিশোধ, কানের নিচে চুমু খাওয়ার প্রতিশোধ, বুকে মুখ ডুবানোর প্রতিশোধ। মোদ্দাকথা আমার সঙ্গে যখন যা করেছিস আমিও এখন সেসবের প্রতিশোধ নিবো, প্রস্তুত হোন ওয়াইফি ?’
বিশুদ্ধ পুরুষের মুখে এমন অশুদ্ধ কথা শুনে শীতল হতবাক হয়ে গেল। মুখ কাচুমাচু করে পালানোর পথ খুঁজল। গাঁইগুঁই করে ছেড়ে দেওয়ার বাহানা দেখাল। শুদ্ধ থমথমে মুখে তার সব তাল বাহানা দেখল, বুঝল।
এরপর আচমকা শীতলের দুই গাল চেপে ধরে ঠোঁট ঠোঁট বসিয়ে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ছেড়ে দিলো। শীতল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই পুনরায় শক্ত করে তার ঠোঁটে, গালে, গলায় চুমু খেয়ে বলল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬০

-‘তোকে এভাবে কখনো আদর করেছি?’
শুদ্ধর থমথমে কন্ঠস্বর আর ঘটে যাওয়ার ঘটনা বেচায় শকড্। সেই অবস্থায় শুদ্ধ ধমকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলতে পারল না। তখন শুদ্ধ তাকে তৃতীয়বারের মতো একইভাবে চুমু এঁকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-‘এভাবে কখনো আদর করি নি আর করবোও না। আমার এত লোভও নেই। তবে ভদ্র আছি থাকতে দে নয়তো অনুষ্ঠানের অপেক্ষা আর করা হবে না।’

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here