শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ শেষ পর্ব
আলিশা
পুলিশ স্টেশন থেকে সোজা যেতে হলো হসপিটালে। আজ স্মরণের হসপিটাল থেকে ফিরে আসার দিন। বাবার ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সে বুকের ক্ষতের অবস্থা রফাদফা করেছিল যার দরুন একদিন বেশি থাকতে হলো তার। যদিও বাসা থেকে ট্রিটমেন্ট নিতে চেয়েছিল তবে অঙ্কন বাঁধ সেধেছে। হসপিটালে থাকলে তার সমস্যা কোথায়? আর বাসায় কি হসপিটালের যন্ত্রপাতি আছে নাকি?
স্মরণ অঙ্কনের যুক্তির কাছে হার মানে। হসপিটালের থেকে বাসায় ফিরে স্মরণ ভাত ঘুম দিলো। এই সুযোগ প্রিয়া কাজে লাগালো ষোলো আনাায়। সে ম্যাসেজে আমার থেকে স্মারণের খোঁজ খবর নিয়ে বিশ মিনিটের মাথায় আমার রুমে এসে উপস্থিত। আমি যেন ভুত দেখার মতো করে চমকে উঠলাম ওকে দেখে। প্রিয়া তড়িঘড়ির ওপরে আমাকে তৈরি করে নিয়ে রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আমি বাবাকে বলে বেরিয়ে পরলাম ওর সাথে। যেন বহুদিন পর পৌছালাম ভার্সিটিতে। প্রিয় বন্ধুদের মুখ দেখলাম অতি কাছ থেকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আবারও চিরচেনা ক্যান্টিন। পাঁচ জনের কোলাহল, ধোঁয়া ওঠা কফির মগ সামনে রেখে আড্ডা। কফির ধোঁয়া নিরসন হয়ে যাবে, গরম কফি শীতল হবে তবুও আমাদের আড্ডা শেষ হবে না। প্রিয়ার দুরন্তপনা, সজিবের খেয়াল রাখা, শান্তর অশান্ত ভাব, নীলিমার রেগে যাওয়ার মুদ্রা দোষ সবই স্মৃতি হয়ে আঁটকে রবে মনে। একদিন নিজ নিজ সংসারের ভারে আটকে যাবো আমরা। কোনো এক সন্ধেবেলায় হয়তো কুচকে যাওয়া চামড়ার হাতে এক কাপ চা নিয়ে বেলকনিতে বসে শুনবো, ” কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” গানটা। ভাবতেই চোখের কোনে জল এলো আমার। শান্ত কফিতে চুমুক দিয়েই বলে উঠলো
— দেখ খেয়া কাঁদছে। নীলিমার রাগ ভাঙানোর বদলে ওই উল্টো রাগ করে বসে আছে।
রেগে থাকা নিলীমা ছুটে এলো আমার নিকট। আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরে বলল
— না বাবু কাঁদে না। আমি রাগ করিনি। তুই যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছিস আমার উচিত ছিলো তোর বেশি বেশি খোঁজ খবর নেওয়া তা তো পারিনি। আমই সরি। শশুর বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
ওরা শান্ত ও প্রিয়ায় মুখে সব শুনে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আমি নিজের স্বভাব নিয়ে মৃত সাগরে যেন পরলাম। অল্পতেই চোখে জল চলে আসার স্বভাব আর গেলো না। ভাবনার মাঝেই সামনে বসে থাকা শান্তর কুটিল বাঁক আমাকে ক্ষুব্ধ হতে বাধ্য করলো।
— ওর ব্যাগটা দে তো প্রিয়া। ও এক টাকার ট্রিটও দিলো না। আমি ওর জন্য তিনদিন নাচ গার্ডেনে বন্ধ ছিলাম। তারপরও আমাকে ট্রিট দিলো না।
আমি খপ করে নিজের ব্যাগটা কোলের মাঝে রাখে বললাম
— সারাদিন না প্রেম, প্রেমিকা বলে চিল্লাও। মেয়েদের মাঝে রেখে আসছিলাম এটাই তো তোমার বড় ট্রিট। আর কি চাও।
— শান্ত ছিহ, তোকে অপমান করলো।
পাশ থেকে প্রিয়া একথা বলতেই আমি সকলকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়ার ব্যাগটা শান্তর দিকে ছুড়ে দিয়ে বললাম
— দোস্ত তোর ট্রিট।আমার পক্ষ থেকে।
প্রিয়া কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। শান্ত এরমাঝে টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যাগ ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আমি আলগোছে বসা থেকে উঠে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা দিলাম। প্রিয়াও হাঁটার গতি দৌড়ের কাছাকাছি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার একটা ইতিহাস হবে আমাদের মাঝে।
বন্ধুদের সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর পর মনে হলো খাইরুনের কথা। তার সঙ্গে একবার আমার দেখা করা যেন আবশ্যক। মনের কথা মেনে রেখে চলে গেলাম খাইরুনের কাছে ওর দাদাজানের বাড়িতে। আমি সেখানে যেতেই দাদাজান, দাদিজান অস্থির হয়ে পরলেন আমাকে আপ্যায়ন করার জন্য। আমি তাদের ব্যস্ত হতে মানা করে খাইরুনের সঙ্গে কিছু নীরব সময় কাটালাম। মেয়েটা মিতভাষী। খুচরোকথা যেন একেবারেই বলে না। উঠোনের পেয়ারা গাছের নিচে টুলে বসে দু’জনে যেন দু’জনকে অনুত্তর কৃতজ্ঞতা জানালাম। আমিই দুএকবার ‘নাচ গার্ডেন’ নিয়ে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম বাকি মেয়েরা এখন মুক্ত। কেউ বাসায় চলে গেছে। কেউ গেছে দলবেধে একটা আস্তানা খুঁজতে। তাদের তো কোনো ভবিষ্যত নেই। তবুও তারা মুক্ত হতে পেরে খুশি। খাইরুনকে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হলো না। সে কষ্ট পাবে ভেবে মনের কৌতুহল মনেই দাবিয়ে রাখলাম।
বাসায় ফিরলাম দুপুরের পর। দুপুরের খাবার দাদিজান না খাইয়ে বাসায় ফেরত আসতে বিশেষ ভাবে না করেছিলেন। বাসায় ফিরতেই ছোঁয়া আমাকে হাত ধরে টেনে প্রথমে সোফায় বসালো ড্রয়িং রুমে। অতঃপর এক গ্লাস পানিসহ আমার সামনে দাড়িয়ে আমাকে শাসিয়ে বলে উঠলো
— এটা খাও। আর তুমি বাবুকে নিয়ে এতো ঘোরাঘুরি করবে না। বাবুর এতোক্ষণ বাইরে থাকতে সমস্যা হয়।
আমি পানি পান করার মুহূর্তে অবাকের দরুন কাশিতে মত্ত হলাম। ছোয়াকে শুধালাম
— তুমি কি বাবুর সঙ্গে কথা বলেছো? এতোকিছু কিভাবে জানলে?
— টিভিতে দেখে শিখেছি।
আমি মুচকি হাসলাম। দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা বাবা মেয়ে জিজ্ঞেস করে বসা থেকে উঠে গেলাম নিজের ঘরে। ছোঁয়া অপেক্ষায় রইলো আমি ফিরে আসার। ও নাকি বাবুর সঙ্গে কথা বলবে আমার কোলে শুয়ে।
বাবুর সঙ্গে ওর কথা হলো। নাম ঠিক করা হলো তার। ভাই হলেও নাম রাখবে ছুঁই। বোন হলেও নাম রাখবে ছুঁই। ‘ছোঁয়া’ থেকে উৎপত্তি এই নামের। আমি ছোঁয়ার কথায় হেঁসে যেন কুল পেলাম না। মা মেয়ে হাসি তামাশার পর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
ঘুম ভাঙলো আছরের ওয়াক্তে। ছোঁয়ার ঘুম তখনও বিরাজমান। আমি নামাজ আদায় করে আজ রান্না ঘরে যেতেই জয়নব খালা খুন্তি দেখিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। নতুন অতিথিকে নিয়ে তার সমুদ্রসম ভাবনা চিন্তা। আমি বললাম ঠিক আছে। কেবল বসে বসে রান্না দেখবো। খালা রাজি হলেন। আজ হঠাৎ তিনি তার মনের কথা ব্যক্ত করতে শুরু করলেন আমার কাছে। বললেন
— স্মরণ বাবা আমারে কোনোদিন অবহেলা করে নাই বুঝছো বউ। তোমার শশুরও বড় ভালো মানুষ। অথৈও আমাকে অনেক আদর করছে। ওগোর মতো তুমিও হইছো। ভাবছিলাম ঘরের দুই নাম্বার বউ হয়তো ভালো হয় না। আসলে তা না। কথা হইলো মানুষ বুইঝা। মানুষ ভালো হইলে সবখানেই সে ভালো। এতো ঝড় গেলো তারপরও তুমি ভালোই রইলা। দোয়া করি মা সুখে সংসার করো। অনেক বাড়িতে কাজ করছি। কাজের লোকের লগে মানুষ ওইভাবে মিশতে চায় না৷ কিন্তু তোমরা আমার লগে অনেক ভালো ব্যবহার করো। আমার কপালডাই ভালো।
খালার কথার পিঠে আমি বললাম
— আপনি ভালো বলেই এবাড়ির মানুষরা আপনাকে ভালোবাসে। আপনার কারণেই আপনাকে ভালোবাসে খালা।
সাঁঝ বেলায় চায়ের কাপ, বাবা আর ছোঁয়াকে সঙ্গে নিয়ে বসে ছিলাম বাড়ির বাইরে বাগানের মধ্যে। ছোঁয়া গন্ধরাজ, বেলি আর কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে খেলা করছিলো। তাকে দেখলাম এই সময়ে ঘরে ফিরলো দু’টো লোক নিয়ে। প্রায় এক ঘন্টা বসে থাকার পর বাদ মাগরিব আমরা ঘরে ফিরলাম। বাবা এখান থেকেই গেলেন মসজিদে। আমি আমার ঘরে ফিরে নামাজ আদায় করলাম।
অতঃপর ঘর থেকে বেরিয়ে বেডরুমে উঁকি দেওয়ার কথা ভাবতেই দেখলাম রুমের দরজা বন্ধ। নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। বহুকাল পর যেন বই হাতে নিলাম। মন বসতে চাইলো না। জোর করে বইয়ের পাতায় মন বসিয়ে একটু পড়ালেখা করালাম। এরইমাঝে কখন যে রাত দশটা বেজে গেলো বুঝতে পারলাম না। কেউ আমাকে খাবারের জন্য ডাকলোও না? আমিও গড়িমসি করে পার করে দিলাম আরো একটা ঘন্টা। বাড়ি তখন শুনশান, নীরব। পড়ার টেবিল ছেড়ে ছোঁয়ার খোঁজ নেওয়ার জন্য বেডরুমে আরো একবার উঁকি দেওয়ার জন্য দরজা খোলার চেষ্টা করতেই হঠাৎ দু’টো হাত আমাকে ঘরে ঢুকে নিলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপন করে কোমড় পেচিয়ে নিয়ে কানে মুখ লাগিয়ে বলল
— কংগ্রাচুলেশন বাবুর আম্মু
জমে যাওয়া হাত পা নিয়ে পেছন ঘুরতে চাইলেই বলা হলো আমাকে
— আমাকে দেখার জন্য সারাজীবন পাবে আপাতত সামনে সাজানো ক্যান্ডেল দেখো। গলে যাচ্ছে ওরা।
সামনে চাইলাম আমি। ক্যান্ডেল দিয়ে লেখা হয়েছে ” congratulation”। লেখাটা পুরো মেঝে জুড়ে। আমি আরো একটু খেয়াল করে দেখলাম আমি দাড়িয়ে আছি গোলাপের পাপড়ির ওপরে। চোখ গেলো বিছানার সাজসজ্জাতে। বেডসাইডের টেবিলে ক্যান্ডেল। ছোঁয়া হাতে একটা লাভ বেলুন নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে অগোছালো ভাবে। তার পাশে রাখা আছে কিছু শাড়ি। একবক্স চকলেট ও একটা ট্রেতে কিছু আইসক্রিম। স্মরণ পেছন থেকে বলে উঠলো
— শুভেচ্ছা জানাবে বলে মেয়ে এসেছিল কিন্তু ঘুমিয়ে গেছে।
আমি কিছুসময় মৌন হয়ে তার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে বলে উঠলাম
— এসবের দরকার ছিলো না।
স্মরণ ব্যস্ত হয়ে বলল
— খেয়া রাগ করে থেকো না। আমি সরি।
আমি তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম
— থাক। বাদ দিন। কয়েকটা ক্যান্ডেল, কিছু শাড়ি, কিছু চকলেট আর আইসক্রিম দিয়ে অন্য কারো ব্যাথা ভোলাতে পারলেও আমার ব্যাথা ভোলাতে পারবেন না।
— সেদিনের ঝগড়ার জন্য এতো রাগ? খেয়া আমি কি মিথ্যা বলেছিলাম? অথৈ সেরকম না এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম… যাই হোক, সরি। অনেক গুলো সরি। এভাবে রাগ করে থেকো না। আমাকে এভয়েড কোরো না।
— আমিও তো মিথ্যা বলিনি। আমিও তো জানতাম না অর্থি অথৈয়ের জমজ বোন।
স্মরণ চুপ করে রইলো। কিছু সময় আমার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। অতঃপর আলগোছে বেরিয়ে গেলো অভিমান সঙ্গে নিয়ে নয়তো রাগ করে। আমি ঠাঁই দাড়িয়ে ক্যান্ডেলের পানে তাকিয়ে রইলাম। অতঃপর বিছানা থেকে শাড়ি, চকলেট, আইসক্রিম সরিয়ে ফ্রিজে রেখে আসলাম। ক্যান্ডেলের আলো নিভিয়ে শুয়ে পরলাম বিছানায়।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। তাকে দেখলাম ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে আছে। আমি নিচে জগ হাতে পানির জন্য যেতেই সে চোখ মেলে তাকিয়ে উঠে বসলো। আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম
— এখানে থাকার কোনো মানে দেখলাম না। দরজা তো সারারাত খোলাই ছিলো। কেউ ঘরে গিয়ে ঘুমালেই পারতো।
সে কোনো জবাব দিলো না। ঘরে ফিরলো বিনাবাক্যে। আবার পাঞ্জাবি পরে টুপি হাতে নিয়ে প্রস্থান করলো নিরুত্তরে।
সেদিন দুপুর গেলো নিরুত্তরে, সাঝ নামলো নীরবে, রাত কাটলো ওভাবেই মৌন হয়ে। কেউ কারো সঙ্গে শব্দ বিনিময় করলাম না। চাপা রাগ, অভিমান জয়ী হলো। এভাবে কেটে গেলো একটা মাস। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেউ কারো সঙ্গে কথা বললাম না।
দেখতে দেখতে আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পৌঁছে গেলাম। তখন প্রিয়ার ছয় মাস। দু’জনে ফোনে সুখ দুঃখের আলাপ করি। অঙ্কনের ধরাবাঁধা নিয়ম প্রিয়া মানতে মানতে যেন তিক্ত হয়ে উঠেছে। আর এদিকে আমি তার অল্পভাষীতার দরুন এদিক থেকে বেঁচে গেছি ভাবলে ভুল হবে। সে এখন একটা কথা বলে যা স্বাভাবিক কথার দশ কথার সমান। সে ইদানীং রাত জাগা শুরু করে দিয়েছে। আমার আশপাশে থাকার প্রচেষ্টা আমি ঠিকই বুঝি। একদিন রাত দু’টোয় আমার ঘুম ভাঙলো। পানির পিপাসা পেয়েছিল। জগ ঠক শব্দ করতেই সে দেখলাম উঠে বসলো। জগে পানি ছিলো না। সে আলগোছে পানি এনে আমার সামনে রাখতে রাখতে বলল
— ডাকলে মনে হয় কারো অনেক বেশি ক্ষতি হবে না।
আমিও বলেছিলাম
— মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস। এখনই রাত জাগার দরকার নেই। আর আমি চাই না আমার জন্য কারো ঘুম নষ্ট হোক।
— আমার বয়েই গেছে ঘুম নষ্ট করতে।
সেদিন তার জটিল স্বীকারোক্তি দেখে আমি মুখ চেপে হেঁসেছি। দোতলা থেকে নামার কষ্ট হয় বলে ছয় মাসে সে নিচ তলায় নেমে এলো। নিচের সেই ঘরে ছিলো বিশাল বেলকনি। সবচেয়ে প্রশান্তির জিনিস হলো সে ঘরখানা ছিলো ফুলের বাগানের কাছেই। রাতে জানালা খুলে বসে থেকেছি। নাম না জানা ফুলেদের গন্ধে ঘর মৌ মৌ করতো। আমি যখনই জানালা খুলে বসতাম তখন সে পানি খাওয়ার অযুহাত দিয়ে উঠে পরতো। জেগে থাকতো। নয়তো বলতো
— ঠান্ডা হাওয়া আসছে। নাকে ঢুকলে আমার ঠান্ডা লাগবে।
আমি হাসতাম। জানালার ধারে বসে থাকি আমি। আর হাওয়া নাকে লাগে তার। জেদ করে কখনো কখনো ঠাঁই বসে থাকতাম। সে এসে গরম চোখে আমাকে দেখে জালাল বন্ধ করে। এভাবে দেখতে দেখতে কাটলো আমার আটমাস। তখন কনকনে ঠান্ডা। আমার হঠাৎ একদিন ইচ্ছে হলো আমি স্নোফল দেখবো। কেন যেন ভীষণ রাগে থাকি আমি। সে বলল
— তোমার ঠান্ডা লাগবে। আর এই অবস্থায় আমি তোমাকে কোথাও নিয়ে যাবো না। বাইরের দেশে তো নাই।
আমি চিৎকার চেচামেচি করলাম। এইসময়ে আমাকে কিছু না দিলে আমার অসম্ভব রাগ হয়। সে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। বিকেল হলো। গোধূলিতে মেয়ের সঙ্গে বাগানে হাঁটতে বের হলাম শীতের পোষক পরে। তখন হঠাৎ দেখি বরফের টুকরোর মতো কি যেন উড়ে উড়ে পরছে। আমি আনন্দে যেন আত্মহারা হলাম। যদিও দেখলাম দোতলার জানালার ধারে কি যেন রাখা। সেখান থেকে স্নোফলের মতো কিছু উড়ে উড়ে আমার দিকে আসছে।
এভাবে শেষ হলো আমার ও আমার সন্তানের একটা যাত্রা। ঘনিয়ে এলো যাকে ঘিরে সকলের অপেক্ষা তার ভূমিষ্ট হওয়ার সময়। স্মরণ এখন যেন আরো আঠার মতো লেগে থাকে আমার পিছে। আমার মেজাজ এখন কেন জানি না চড়াও থাকে অধিকাংশ সময়ে। সে সয়ে যায় আমার বায়না, পাগলামি। রয়ে যায় আমার পাশে। ছোঁয়া পর্যন্ত আমার খেয়াল রাখে। আমাকে বোঝে। আমার পাশে থাকে। প্রিয়ার ইতিমধ্যে মেয়ে বাবু হয়ে গেছে। নাম রেখেছে আয়রা। ভীষণ মিষ্টি। বাবার মতো শান্ত। এসেছিল আমাদের বাসায়৷ তিনজনের মিষ্টি একটা পরিবার। প্রিয়া একটুও পাল্টায়নি। সেদিন ছেলেমানুষী ভাব যে ও বজায় রেখেছে তা প্রমাণ দিয়ে আমাকে বলে গেলো
” বাচ্চা হওয়ার পর আমি একটু কেমন যেন হয়ে গেছি তাই না রে?”
আমি বেললাম
” কই তুই তো সেই আগের মতোই আছিস। এখনো পাগলামি করিস, ঝগড়া করিস।”
” আরে ধুর, তোকে পার্সোনালিটির বর্ণনা দিতে বলি নাই। আমার চেহারার বর্ণনা দিতে বলছি। জীবনে যাই হয়ে যাক। বুড়ো হওয়া যাবে না। বাচ্চা হ’য়েছে তো কি হয়েছে। আমাকে তো ইয়াংই থাকতে হবে।”
একথা বলতে বলতেই আবার দুঃখী সুরে বলল
” আয়রার বাবা এখনও আগের মতোই আছে। আমিই কেমন বুড়ো হয়ে গেছি।”
আমি দস্যি মেয়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না।
পবন হিমেল, ঘরে হিটারের সামনে গিয়ে বসে থেকেও যেন আমি তরতর করে ঘেমে উঠলাম। একটু আগেও ভালো ছিলাম। ওয়াজিয়াহ, চাচিআম্মা এসেছিল আমাকে দেখতে। তাদের সাথে কথা বলে ঘরে ফিরেই আমার অবস্থা নাজেহাল হতে লাগলো। ছোঁয়া খেয়াল করে ডেকে নিয়ে আসলো স্মরণকে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না এহেন হওয়ার কারণ। মাঝে মাঝে পেটে লাথি দেয় সে। তবে তার পরিমাণ যেন আজ বেশি। স্মরণ এসে আমার এহেন অবস্থা দেখেই ফোন করলো হসপিটালে।
অতঃপর ডাক্তারের পরামর্শ মতো দ্রুত রওনা হলো আমাকে নিয়ে হসপিটালে। হসপিটালের বেডে শুয়ে যখন আমি ছটফট করছিলাম। ডাক্তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ওটিতে নেওয়ার। তখন ছোঁয়া আমার পাশে বসে কাদছিলো প্রচুর। ওকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আমার ছিলো না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমি বুঝি আর বাঁচবো না। স্মরণ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল
— আমি হয়তো তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। আমি হয়তো ভালো স্বামী না। তোমার মনের মতো না। তাই বলে কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না।
বলতে গিয়ে তার গলা ধরে এলো। আমাকে নেওয়া হলো সিজারের জন্য।
সময় পেরিয়ে গেছে কতক্ষণ তা বলা মুশকিল। আমি তো চোখ খুললাম বাবুর কান্নার শব্দে। হাত নাড়াতে গিয়ে অনুভব করলাম আমার হাতটা বদ্ধ। কেবল এক হাত নয় দু-হাতই বদ্ধ। তাকিয়ে দেখি একহাত স্মরণ ও অপর হাত ছোঁয়ার হাতে বদ্ধ। মাথার পাশে একটা ছোট দোলনায় শুয়ে কাঁদছে বাবু। স্মরণ ও ছোঁয়া দু’জনেই ঘুমের সঙ্গে সন্ধি করেছে। নার্স এলো। হাসি মুখে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল
” আপনার ছেলে বাবু হয়েছে। আপনার স্বামী তো অস্থির। জ্ঞান ফিরছিলো না বলে হসপিটাল মাথায় তুলেছিল। অঙ্কন স্যার মেবি ওনার ফ্রেন্ড। উনি এসে শান্ত করে। অবশ্য কি বলবো। অঙ্কন স্যারও তো তার ওয়াইফের বেলাতে কেঁদে একদম শেষ। আপনার স্বামীও সেইম।”
আমি গলা খাকড়ি দিলাম। এগুলো তো লজ্জাজনক। ব্যাথা হয় বউদের আর কেঁদে ফেলে স্বামীরা। জ্ঞান না ফেরার জন্য এতো কান্নাকাটি করার কি আছে। আমার ভাবনার মাঝে স্মরণ উঠে পরলো। বাবুকে আমার বুকের ওপর দিতেই বাবু খামচে ধরলো আমার নাক। এমন সময় আগমন ঘটলো প্রিয়ার, অঙ্কনের। অঙ্কন এসেই বাবুকে জামাই বাবা বলে কোলে তুলে নিলো। স্মরণের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। অনেক দিন পর যেন দেখলাম তার হাসি। আমাদের রাগ অভিমানের ইতি হলো। দু’জনে দু’জনের চোখে চোখ রেখে হেসে উঠলাম। স্মরণ প্রিয়ার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল
— আমার বউমা। কিন্তু সিনিয়র হয়ে গেলো যে।
অঙ্কন বলে উঠলো
— তো? সবসময় কি সিনিয়র প্রেম হবে নাকি। জুনিয়র প্রেমের ইতিহাসও হওয়া উচিত।
প্রিয়া বলে উঠলো
— এই ছেলে তো খুব খচ্চর। কার মতো হয়েছে রে?
ওর প্রশ্নের উত্তর মিলল না। কে জানে কার মতো? একাই হয়তো অন্যরকম হলো।
বাড়িতে এখন সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেলো। বেশ শান্ত থাকা বাড়িটা পরিণত হলো অশান্ত হাউজে। ছোঁয়া ভাইকে পেয়ে অনেক খুশি। স্মরণ এখন যেনো আরো প্রাণোচ্ছল হয়েছে। ওহ হ্যা, বাবুর নামটা বলা হলো না। বাবুর নাম ছুঁই রাখা হয়েছে তবে বাবুর আরো একটা বিশাল নাম রাখা হয়েছে। ” সাফওয়ান আহমেদ শিশির”। শিশিরের বয়স তিনমাস হতে চলল। তখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। ছোঁয়া আগের চাইতে বুঝ-বুদ্ধিতে আরো খানিকটা বড় হয়ে গেছে। শীত চলে গিয়ে বসন্ত চলছে। অঙ্কনের কিছু ঝামেলা পোহাতে হ’য়েছে কিছুদিন আগে। সে বিদেশে যে গিয়েছিল প্রিয়াকে নিয়ে। ইচ্ছে ছিলো বিদেশে স্থায়ী হবে।
তবে প্রিয়া তা মানতে নারাজ। অবশেষে বিদেশ থেকে ঝামেলা চুকিয়ে আবারও দেশে ফিরলো।বিসিএস দিলো। অতঃপর এখন কিছুদিন পর সে নতুন করে মেডিকেল অফিসার হিসেবে জয়েন করবে চাকরিতে। এই খুশিতে সে প্রস্তাব রাখবো কোথাও ঘুরে আসা যাক। বাচ্চা নিয়ে বেশি দূর যাওয়া হবে না। আমাদের সমুদ্র সৈকতে ঘুরে আসবো আমরা। ব্যাগপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে আজ আমরা দুই পরিবার সমুদ্র সৈকতে চলে গেলাম। ক্লান্তি মিটিয়ে চলে গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে। বিশাল ঢেউ। অস্থির, চঞ্চল তারা। ছোঁয়া আমাকে ধরে দাড়িয়ে রইলো। স্মরণ শিশির কে কোলে নিয়ে। অঙ্কন প্রিয়া আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ঢেউ এসে সিক্ত করলে আমাদের চরণ। আর্দ্র বালিতে নামের অদ্যক্ষর লেখলো ছোঁয়া। এই ফাঁকে স্মরণ আমার কানে কানে বলে উঠলো
— থ্যাঙ্কিউ খেয়া। শেষ বিকেলে আমার পাশে থাকার জন্য। শেষ বিকেলে দেখা দেওয়ার জন্য।
আমি তার হাতটা ধরে ফিসফিস করে বললাম
— আমি আপনার পাশে থেকে যেতে আমৃত্যু। আর আপনাকেও ধন্যবাদ আমার বিবর্ণ জীবনে শেষ বিকেলে আলো হয়ে আসার জন্য। এতোটা ভালোবাসার জন্য।
স্মরণ বলে উঠলো মিষ্টি হেসে
— ভালোবাসি অনেক বেশি।
আমি জবাবে বললাম
— আমিও ভালোবাসি। সমুদ্র সম ভালোবাসি।
বলতে বলতে তার কাঁধে মাথা রাখলাম। সূর্য আকাশে রঙিন হলো। একটু পরই অস্ত যাবে। তার শেষ আলোটুকু ছুঁয়ে গেলো আমাদের চারজনকে। ছোঁয়ার হাতটা আমি শক্ত করে ধরলাম। ছোঁয়াও আমাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। অথৈ মনের কোণে ভেসে উঠলো। যেন বলে গেলো আমার কানে কানে
শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৮
” দেখো রেখো আমার মেয়েটাকে”
আমি মনে মনে কথা দিলাম তাকে।
আজ সব আনন্দ এসে আমাদের ছুঁয়ে গেলো যেন। সমুদ্র তীরে এক অনবদ্য স্মৃতি গড়লাম আজ। মনে যেন কেবল শান্তি আর শান্তি । বুকের মাঝে কোনো আফসোস নেই। স্বপ্ন বুনলাম আগামী দিনগুলো নিয়ে। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা সুন্দর, চঞ্চল পরিবার।

