হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১১
তোয়া নিধী দোয়েল
সকাল সকাল অচেনা অথিতির আগমনে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয় জুবাইরা। দু-জন পুরুষ! তাঁদের মধ্যে একজনের বয়স একটু বেশি। পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। আর অন্য জনের বয়স একটু কম। পরনে নীল রঙের চেক শার্ট। ছেলেটা লম্বা করে হেসে সালাম দেয়,
-আসসালামু-আলাইকুম আন্টি।
তারপর অন্যজনের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-ভাবির মা। থুক্কু পাত্রীর মা। সালাম দেও।
লোকটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
-আসসালামু-আলাইকুম। আমি মুজাহিদ ফরাজি। এ আমার ছেলে রেজুয়ান।
সারারাত তুর্কির সাথে চ্যাঁচামেচি করে জুবাইরার মাথা এমনিতে-ই গরম হয়ে রয়েছে। তার উপর সকাল সকাল এই অচেনা মানুষের আগমনে আরও মেজাজ গরম হয়ে উঠে। সে বিরক্ত মুখে সালামের জবাব নিয়ে বলে,
-ওলাইকুমুস-সালাম। আপনারা কারা ঠিক চিনলাম না তো?
রেজুয়ান বলে উঠে,
-পরিচয়ত হওয়ার সুযোগই তো দিলেন না চিনবেন কি ভাবে?
মুজাহিদ রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
-কথা কম বল। পাত্র যদি এমন কটকট করে তাহলে মেয়ের বদলে মেয়ের জুতা দিয়ে দিবো।
-ও থুক্কু থুক্কু।
তারপর মুজাহিদ জুবাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
-আপা, আসলে আমরা আপনার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। যদি অনুমতি দেন তাহলে বলতে পারি।
-হ্যাঁ, বলুন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-মেহমান আসছে, কই আগে ঘরে ঢুকতে দিবেন। চা খেতে দিবেন; তা না করে বাইরে দাড়াঁ করে জিজ্ঞাসা করছেন, হ্যাঁ বলুন।
ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে জুবাইরার দিকে তাকিয়ে বলে রেজুয়ান। মুজাহিদ রেজুয়ানের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফিসফিসিয়ে বলে,
– আরেকটা বাড়তি কথা বলে দেখ। ভুলে জাইস না আমি এখানে তোর বাপ। তাই বাপের উপর দিয়ে বেশি মাতব্বরি করলে কান মধ্যে চড় দিমু।
-ঠিক আছে বাপের ভাই। ধুক্কু আব্বা।
মুজাহিদ রাগে কটমট করে তাকিয়ে থাকে। জুবাইরা মনে দ্বিধা নিয়ে বলে,
-দেখুন আমি তো আপনাদের চিনি না, সেই জন্য ভেতরে আসতে বলছিনা। আপনারা আগে পরিচয় দিন তারপর ভেবে দেখবো।
রেজুয়ান কিছু বলার আগে মুজাহিদ বলে,
-ফারুক কে চেনেন? দেবেন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপাল?
-হ্যাঁ।
-সম্পর্কে আমার ভাই লাগে। আসলে আমার ছেলের জন্য পাত্রীর খোঁজ করছিলাম তো। সেই আপনার মেয়ের কথা বলেছেন আর কি। তাই…
-ভাই আমার মেয়ের কথা বলছে! আচ্ছা ভেতরে আসুন।
এই বলে জুবাইরা ঘরের ভেতরে যায়।
মুজাহিদ রাগে কিরমির করতে করতে বলে,
-তোগো জন্য আমার জীবনে যে আর কত পাপ করতে হবে আল্লাহ্ জানে। আমার পাপের খাতায় নিজেস্ব পাপ বলতে একটা পাপ ও নেই। যে পাপের লিস্ট আছে সব তোগো দুই ভাইয়ের জন্য করা।
-চিন্তা করো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়েটা দিয়ে একটা ফরজ কাজ সম্পূর্ণ করে দিবো। এখন ভেতরে চলো। কালকের মধ্যে পাত্রীরে নিয়ে না জাইতে পারলে দু’জন-ই বাটাম খাবো।
রেজুয়ান মুজাহিদ ভেতরে ঢোকে। জুবাইরা বসতে দিয়ে রান্নাঘরে যায়। চা বসিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে। মুজাহিদ বিনয়ের সঙ্গে কথা আরম্ভ করে
-আমার ছোট ছেলে তামিম ফরাজি। ডাক নাম রেজুয়ান। মীম গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক।আগে আমি-ই সব সামলাতাম কিছু বছর ধরে সব ছেলের নামে করে দিয়েছি।
-অসাধারণ বাপের ভাই। চালিয়ে যাও। কিন্তু মীম কে? তোমার এক্স নাকি নেক্সট? গাল চুলকানোর বাহানায় মুখে হাত ফিসফিসিয়ে বলে রেজুয়ান। প্রত্যুত্তরে মুজাহিদ কিছু বলে না। তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে
-ফারুক…..
কথার মাঝে থামিয়ে দেয় জুবাইরা। মনে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে
-মীম গ্রুপ অব কোম্পানি এইটা আবার কোন কোম্পানি? আগে কখনো এই রকম কোনো কোম্পানির নাম তো শুনি- নি।
-আরে শুনবেন কি ভাবে! আমার মাকে বিয়ে করার তিন বছর আগে আমার বাপ চালু করছে।
অবাক হয়ে জুবাইরা প্রশ্ন করে
-কি? তুমি জানো কি ভাবে?
-আরে এই গল্প তো বাবা মাঝে মাঝে বলে তাই।
মুজাহিদ আবারও কটমট করে তাকিয়ে বলে,
-এখানে বাপ কে? তুই না আমি?
রেজুয়ান বলে,
-তুমি।
-তাহলে তুই কেন এত কথা বলস? তুই চাস, আমি এখান থেকে আমি চলে যাই?
রেজুয়ান ডানে বামে মাথা নাড়ে। মুজাহিদ আবারও জুবাইরার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
-আসলে কোম্পানি টা আমি নতুন চালু করেছিলাম। বাবার টুকটাক ব্যাবসা ছিলো তো সেই পুঁজি দিয়েই কোম্পানি-টা চালু করা আর কি।
-ও আচ্ছা। একটু অপেক্ষা করুন আমি চা-টা একটু দেখে আসি।
জুবাইরা চলে যেতে-ই মুজাহিদ রেজুয়ানের পিঠের মধ্যে দুম করে এক কিল বসায়।
-যদি তুই আরেকটা বার কথার মাঝে কথা বলছ, বিশ্বাস কর আমি উঠে চলে যাবো।
-আরে বাপের ভাই তোমারে একটু হেল্প করতেছি। যদি একা একা না পারো তাই।
-তোগো দুই ভাইয়ের সাথে মিশতে- মিশতে মিথ্যাটা খুব ভালো করেই শিখে গেছি। তাই চুপ থাক। যদি আরেকটা কথা বলছ তর এক দিন কি আমার এক দিন। ভুলে যাইস না আমি এখন তোর বাপ।
-জাহিদ মাস্টার, তুমি তো এখনো বিয়া-ই করো নাই আর তোমার পোলা হয়ে গেছে। ছি ছি! কার লগে আকাম করছো সত্যি কথা কও। কার ছেলে তোমার পেটে ছিলো সত্যি কথা বলো!
মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে রাগে ফোসতে ফোসতে বলে,
-থাক তুই গেলাম আমি। এমনিতে-ই তোগো জন্য হাজার টা মিথ্যা কথা বলা লাগতেছে আর তুই আমার পিছে লাগতেছস। থাক তুই৷ যা করার তুই একাই কর।
মুজাহিদ উঠে যেতেই রেজুয়ান হাত টেনে ধরে
-আরে বাপের ভাই কই যাও? মনে আছে তো পাত্রী নিয়ে না যেতে পারলে দু’জনের কপালেই শনি আছে। চুপ চাপ বসো
-তুই কর গা একা। তোগো সাথে আমি আর নাই।
-আরে…
রেজুয়ানের ফোন বেজে উঠে। ফোন ধরে রেজুয়ান বকা শুরু করে
-ওই তোর বঙ্গু কই তুই?
-ভাই অনেক দোকান ঘুরা লাগছে। কোন বাড়ি?
-তুই আছস কই?
রেজুয়ান বাড়ির অবস্থান জানিয়ে দিয়ে ফোন রেখে মুজাহিদকে টেনে বসায়।
-আরে চেইতো না বাপের ভাই বসো। সামনে মাসে তোমার….
-ভাই…
বাইরে থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ ভেসে আসে। রেজুয়ান মুজাহিদদের হাত ছেড়ে বলে,
-অভ্র আসছে। দাঁড়াও নিয়ে আসি।
অভ্র রেজুয়ানের বন্ধু। ওকে মিষ্টি আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। ভেতরে আসতে-ই অভ্র বলে
-চাচা তোমার সাইকেল তো পড়ে গেছে। কি ভাবে রাখছো।
রেজুয়ান অভ্রর কানে চড় দিয়ে বলে,
-সাইকেল বললি কেন? ওইটা আমার আর জাহিদ মাস্টারের পার্সোনাল বিমান। ওটা দিয়ে আমরা কত জায়গায় উড়ে বেড়ায় জানস।
-তোরা সাইকেল নিয়ে পাত্রী দেখতে আইছস?
রেজুয়ান আবারও রেগে যায়। কিছু বলতে যাবে তখন জুবাইরা চায়ের ট্রে নিয়ে উপস্থিত হয়। তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
-সাইকেল নিয়ে মেয়ে দেখতে আসছে মানে?
মুজাহিদ খুক খুক করে কেশে উঠে। রেজুয়ান ব্যাপারটা ধামা-চাপা দিতে বলে,
-কিছু না মাওই। সরি আন্টি। আপনি চা দিন।
-মাওই!
জুবাইরা অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে রেজুয়ানের দিকে। তার কাছে প্রথম থেকেই ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে লাগছে। রেজুয়ান বলে,
-মা….ওই। মানে মা। দুই দিন পর তো শাশুড়ী-ই হবেন তাই আর কি। আপনি বসুন না।
রেজুয়ান মুজাহিদদের পাশে গিয়ে বসে। মুজাহিদ শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
-যদি আর একটা বার আমার পেছনে লাগছ; এই যে আদনানের শাশুড়ীকে নিজের শাশুড়ী বললি এইটা আদনান কে বলে দেবো।
-বাপের ভাই!!
-চুপ
রেজুয়ান ঘাড় ম্যাসাজ করতে থাকে। মুজাহিদ কে আর ক্ষেপানো যাবে না। তা না হলে ওর কপালে বাটাম জুটবে। টেবিলের উপর মিষ্টির প্যাকেট দেখে জুবাইরা বলে,
-এই সবের কি দরকার ছিলো।
রেজুয়ান হেসে জবাব দেয়
-ঠিক আছে ভাইঙ্গেন না। যাওয়ার সময় নিয়ে যাম-নি।
জুবাইরা বোকা বোকা দৃষ্টি মেলে তাকায়। মুজাহিদ হতাশার দৃষ্টিতে তাকায় রেজুয়ানের দিকে। তারপর জুবাইরার উদ্দেশ্যে বলে একটু পানি দিন। জুবাইরা পানি আনতে উঠে। মুজাহিদ অনুগ্রহের স্বরে বলে,
-ক্ষমা কর বাপ। আমি যদি আর কখনো তোগো কোনো কাজে থাকছি তখন বলিস। আজ যদি মেয়ের মা-য় রাজি না হয়; আদনান তোরে কি পিটাইবো আমিই তোরে শিল-নোড়ায় নিয়ে বাটুম। কথা টা মনে রাখিছ।
পানি পান করে মুজাহিদ বলে,
-কথা আর বেশি বাড়াবো না আপা। আমার প্রস্তাব তো আপনি বুঝেছেন-ই। এখন আপনার কি মতামত?
জুবাইরা রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-হ্যাঁ, খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি আপনাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু, আমার মেয়ে তো ছোট। তার ওপর এক মাত্র মেয়ে। ওকে এখনি বিয়ে দিবো না। আর কয়েক বছর যাক ইন্টার শেষ হোক, অনার্স শেষ করুক। কোনো চাকরিবাকরি করুক। তারপর ভেবে দেখবো।
– সমস্যা নেই আন্টি। আমরা খাইয়ে-দাইয়ে লালন পালন করে বড় বানিয়ে নেবো। লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি ও দিয়ে দেবো। আপনি শুধু রাজি হয়ে যান।
জুবাইরা শুরু থেকেই রেজুয়ানের উপর একটু বিরক্ত। ছেলেটা বড্ড পাজি। আসা মাত্রই আজে বাজে কাজ কর্ম করে যাচ্ছে।
-দেখো বাবা আমাদের এক মাত্র মেয়ে। আর ওর বাবা দেশের বাইরে থাকে। তাঁকে ছাড়া এক মাত্র মেয়ের বিয়ে কি ভাবে দেবো?
-এতে-ও কোনো সমস্যা নেই আন্টি। আংকেল আসলে আবারো বিয়ের অনুষ্ঠান করবো। এক দম শুরু থেকে। আমরা আবার দেখতে আসবো। কথা-বার্তা বলবো। মানে এক দম শুরু থেকে।
-না বাবা এই ভাবে কোনো সম্বোধন হয় না। বোঝার চেষ্টা করো। আমরা বিয়ে দেবো না।
-বিয়ে দিবেন না মানে! মেয়ে তুলে নিয়ে যাবো। আমার এক মাত্র ভাই পছন্দ করছে বলে কথা। আর আমার ভাই আমার জান।
-রেজুয়ান কি করছিস কি। বস এখানে।
(রেজুয়ান উঠে হাত জোড় করে বলে) এই রকম করবেন না আন্টি প্লিজ মেয়েটা দিয়ে দেন। আমার ভাই আপনার মেয়েকে খুব পছন্দ করে। আর যদি আমরা বিয়ে ঠিক করে না যেতে পারি তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে। এই রকম করবেন না আন্টি প্লিজ!
-তোমার ভাই মানে!!
-উফ বাঁচলাম আগামীকাল তাহলে বিয়েটা হচ্ছে কি জাহিদ মাস্টার?
রেজুয়ান মুজাহিদদের পেছনের সিটে বসতে বসতে বলে। মুজাহিদ সাইকেলের পেডালে পা রেখে বললেন,
-আমি তোগো সাথে আছি আর সেই কাজ হবে না তা কখনো হইছে। তোগো জন্য আমি যে আর কত পাপ করুম আল্লাহ জানে।
-হ্যাঁ, এই জন্যই তোমারে এত ভালোবাসি।
-শোনো আম্মু, তুমি আর কোনো দিকে না তাকিয়ে বিয়ে টা দিয়ে দেও। দেশের পরিস্থিতি অনেক খারাপ। রাস্তাঘাটে একা একা চলা ফেরা করা যায় না।
-ছেলেটা মুখে মুখে কেমন কথা বলে দেখছস?,
-তাতে সমস্যা কি আম্মু? আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি কি চাও তোমার মেয়ে ফেল করে তোমার নাক কাটুক?
– তুর্কি…
-আর কোনো কথা না আম্মু প্লিজ। এই লেখা পড়ার করার চেয়ে সংসার করা অনেক ভালো। তুমি ব্যাপারটা কেনো বুঝো না?
-আমি বুঝতে চাই না। পরের বাড়ি গিয়ে গাধার মত খেটে দেখেছ কেমন লাগে।
-সমস্যা নেই, গাধাটা বিক্রি করে একটা ঘোড়া কিনে নেবো। তাহলে লাভ হবে তো আম্মু? নাকি সিংহ কিনবো?
-আমার মাথা কিন, ফাজিল কোথাকার।
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১০
রেগে চলে যায় জুবাইরা। তুর্কি আনন্দে নাচতে থাকে। ওর আর কোনো সমস্যা নেই ওই কলেজে পড়ার। ওই লোকের থেকে বেঁচে যাবে। আর ওই শাকচুন্নি মার্কা ম্যাডামের কাছ থেকে-ও। ম্যাডাম কে ও দেখিয়ে দিবে জামাই শুধু উনার একার না পৃথিবীতে সবার আছে। উনার ওই বুড়ো জামাইয়ের প্রতি ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই!