হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২
তোয়া নিধী দোয়েল
হুমাইরা ফরাজি চায়ের কাপ এনে মুজাহিদ ফরাজির মুখের সামনে ধরলো। মুজাহিদ বৈঠক খানায় চেয়ারে হেলান দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। চায়ের কাপ মুখের সামনে ধরায় সে একটু বিরক্ত হলেন। খবরের কাগজ ভাজ করে ডান হাত দিয়ে চায়ের কাপ নিলেন। মুজাহিদ কিছু বলার আগে-ই হুমাইরা গমগম করে উঠলেন,
-দেখো জাহিদ, আমি আর তোমার ফাই-ফরমাস শুনতে পারবো না। এবার আমাকে মুক্তি দেও। এই বাড়িতে যে দিন থেকে এসেছি তারপরের দিন থেকে আজ অব্দি; তোমার ফাই-ফরমাস খাটতে খাটতে আমার অর্ধেক জীবন চলে গেলো। এখন দয়া করে আমাকে রেহাই দেও।
হুমাইরার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো মুজাহিদ। তার হাসির দরুন হাতে থাকা কাপ নড়ে উঠলো। হুমাইরা চোখ ছোট ছোট করে কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুজাহিদ হাসি থামিয়ে বললো,
-কাল, পশু, তার পরের দিন, তার পরের দিন এবং তার পরের দিন ও রেডি হও ভাবি আমার ফাই-ফরমাশ শোনার জন্য।
চায়ে এক চুমুক দিয়ে আবার বলে,
– আর কি এমন কাজ করাই তোমাকে দিয়ে? এইতো সকালে চা, নাস্তা, লাঞ্চ, ডিনার, জামাকাপড় ধোঁয়া, ব্যাগপত্র ঘুছিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে একটু খাবার খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি…।
হুমায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-এই কাজ গুলা কি তোমার কাছে কম মনে হয়, হ্যাঁ! আমাকে বোঝাও, তোমার মত দামড়া বুড়ো ষাঁড়ের যাবতীয় সব কাজ কেনো আমি করবো? আমি কি তোমার দাসী?
মুজাহিদ চায়ে আবারো চুমুক দিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-আহ্, অমৃত।
বাঁকা চোখে তাকিয়ে আবার ও বলে,
-তুমি আমাকে বুড়ো বলতে পারলে? আর তুমি আমার দাসী হবে কেনো? তুমি তো আমার মা।
-একদম নাটক করবে না। তোমার এই নাটক দেখতে- দেখতে, আর এই ডাইলগ শুনতে-শুনতে আজ প্রায় ঊনত্রিশ-ত্রিশ বছর পাড়ি দিলাম। আমি আর কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। আমাকে এখন এই কাজ থেকে মুক্তি দেও। এই সব কাজ যার করার কথা তাকে এনে আমাকে উদ্ধার করো। আমি আর সইতে পারছি না।
রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায় হুমাইরা। আজ তার অনেক কাজ। বাড়ির বড় ছেলের বৌ-ভাত আগামীকাল। হুট করে ছেলে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে সবাই একটু বিভ্রান্ত হলে-ও ; পরপরই আনন্দে মেতে উঠেছে মাস্টার বাড়ি।
নুরু ফরাজি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে বাড়ির নাম হয়েছে মাস্টার বাড়ি। শুধু তিনি একাই পেশায় মাস্টার না। তাঁর দুই ছেলে আলামিন ফরাজি ও মুজাহিদ ফরাজি পেশায় মাস্টার। আর এক ছেলে মুমিনুল ফরাজি মানিকগঞ্জ টাউনের সহ চেয়ে বড় জুয়েলারি দোকানের মালিক।
মানিকগঞ্জ সদর থানার মত্ত গ্রামের সব চেয়ে প্রভাবশালী লোক এই ফরাজি বংশের লোক। প্রভাবশালী বলতে এখানে শুধু অর্থ সম্পদের কথা বোঝানো হচ্ছে না। শিক্ষার দিক থেকে ও এদের জুড়ি মেলা ভার। তবে অর্থ সম্পদের দিক থেকে এদের প্রভাবশালী বলা ওতো মানায় না। কারণ এরা ভীষণ কিপটে! এত এত অর্থ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এদের নাকি কিছুই নেই। এই যে সকাল থেকেই আলামিন ফরাজি খাবারের মেনুর হিসেব করছে। এতে তার ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে গেছে। বিয়ে করেছে তাঁর ছেলে। কি দরকার ঘটা করে এত মানুষদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর! মাথায় হাত দিয়ে হুমাইরার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন।
-রাজের মা.. রাজের মা…কই গেলে তুমি? এই দিকে আসও। তাড়াতাড়ি আসো…
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।
হুমাইরা রান্নাঘরে ছিলেন। পেছন থেকে রচনা ফোন হাতে নিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলে,
-ভাবি…বড় আপা তো ফোনই ধরছে না! কখন থেকে কল করছি। কিছু-তেই ধরছে না।
হুমাইরা খিচুড়ি নাড়তে-নাড়তে বলেন,
-আরে দিতে থাক। এক সময় না এক সময় ধরবেই।
পরক্ষনেই উপর থেকে ভেসে আসে আলামিনের চিৎকার। রচনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে,
-বড়ভাইয়ের কি হলো? এমন করে চিৎকার করছে কেনো?
-রচনা দেক দেখি খিচুড়ি টা। আমি শুনে আসি কোন দরকারে আবার ডাকছে।
রচনা ফোন রেখে পাতিলের কাছে যায়। রচনা মুমিনুলের সহধর্মিণী।
মুজাহিদ হাতের কাপ টেবিলের উপর রেখে খবরের কাগজ আবারো মুখের সামনে ধরে। আজ তাঁর স্কুল নেই। এক পা আরেক পায়ের উপর দিয়ে দোলাতে থাকে। বয়স চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ। তবে এখনো সে পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। এই নিয়ে বাড়ির মানুষের হাজারটা অভিযোগ। তবে সে সবে পাত্তা দেয় না। এই যে এখন তার ছোট ভাতিজা তার পাশে বসে গুন গুন করছে,
-দয়া করো আমার উপর
মাথায় চড়ায় একটা টপর
সারাজীবন আধবুড়ো ভাত পেটে সবে না না না না
বাবা আমার কি বিয়ে হবে না,
বাবা আমার কি বিয়ে হবে না…
ভাতিজার খোঁচা মারা গান কানে পৌঁছানো মাত্রই মুজাহিদ আড়চোখে রেজুয়ানের দিকে তাকায়। রেজুয়ান চোখ বন্ধ করে এক স্বরে গেয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর মুজাহিদ হাতের পেপার দিয়ে রেজুয়ানের মাথায় ধাম করে বাড়ি মারে। রেজুয়ান বাড়ি খেয়ে চোখ মুখ কুঁচকে পিট পিট করে তাকায়।
-আ আ আ বাপের ভাই মারেন কেন?
-মসকরা হচ্ছে? তুই জানিস আমি সম্পর্কে তোর কাকা লাগি?
রেজুয়ান খুক খুক করে কেশে উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে বলে
-সেইদিন না দুইজনে মিলে আকবর চাচার রান্নাঘরের বেড়ায় মু*তে এলাম। আর এখন তুমি আমার চাচা হয়ে গেলে? বাহ্ কিয়া বাত হে!
মুজাহিদ চোখ মুখ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১
-তবেরে হারামজাদা। আমি তোর থেকে কম হলে ও পাঁচ ছয় বছরের বড়। আর তুই…..
মুজাহিদ কে তেড়ে আসতে দেখে; রেজুয়ান এক দৌড়ে উঠে পালিয়ে যায়। এ তাদের নিত্য দিনের কাজ। রেজুয়ান আদনানের ছোট ভাই৷ মুজাহিদদের সম্পর্কে যাই হোক, তা সে গ্রাহ্য করে না। হুমাইরা যখন এই বাড়িতে এসেছে তখন মুজাহিদদের বয়স তিন কি সাড়ে তিন বছর। শাশুড়ী মারা যাওয়ায়; ছোট থেকেই মুজাহিদ মানুষ হয়েছে হুমাইরার কাছে। বিয়ের দুই বছর পর আদনানের জন্ম হয়। আর আদনানের দুই বছরের ছোট রেজুয়ান। এই ভাবে এক সাথে বেড়ে উঠেছে তিনজন। কিন্তু, রেজুয়ান কোনো দিন ও মুজাহিদ কে চাচার চোখে দেখে নি। যেনো সমবয়সী বন্ধু। সব সময় আদা-জল খেয়ে পেছনে পড়ে থাকে।