হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২১
তোয়া নিধী দোয়েল
‘ভূত ভূত’ বলে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করছে তুর্কি। কারও শক্তপোক্ত দু’টি হাতের বাহু ওর ছোট ছোট থাবায় শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। মাথা ঠেকে শক্ত বক্ষস্থলে। আটা-য় আটা-য় মাখামাখি হয়েছে উভয়ের চুল শরীর। তুর্কি চোখ মুখ খিঁচে সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে যাচ্ছে,
– ভূত ভূত! আমার রুটি বানানো শেষ হয়নি! তুমি আমাকে খেয়ে ও না! রুটি বানানো শেষ হলে তোমার যত ইচ্ছে নিয়ে যেও! তবু ও আমাকে খেয়ে ও না!
চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে কপালে দুই তিনটা ভাঁজ পড়ে আদনানের। এই মেয়ে বলে কী? দিনের বেলা ভূত আসবে কই থেকে! এই মেয়ের কি সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হলো! হৃষ্টপুষ্ট হাত দিয়ে তুর্কির দুই বাহু চেপে ধরে। শান্ত কণ্ঠে বলে,
-শান্ত হও! কিসের ভূত! কী আবল-তাবল বকছো?
চেনা কণ্ঠ কানে আসে তুর্কির। তবু ও চোখ বন্ধ করে সন্ত্রস্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
_ ওই যে; ওই যে হিজল গাছ থেকে! ওই যে হিন্দু বাড়ির বউটার আত্মা! আল্লাহ্!
আদনান আরেক দফা আশ্চর্য হয়! তুর্কির দুই বাহু ধরে বক্ষস্থল থেকে উঠানোর চেষ্টা করে। যৎসামান্য বিষ্ময় কণ্ঠে বলে,
-শান্ত হও বেগম সাহেবা। কিসের ভূত!? এই দিনের বেলা ভূত আসবে কই থেকে?
বিদিত কণ্ঠস্বর শুনে বক্ষস্থল থেকে বদন তোলে তুর্কি। পিটপিট করে নেত্র পল্লব খোলে। আদনানের মাথা সহ ঘাড়ে সাদা আটা লেগেছে। তুর্কি কিছু না বলে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে ওই প্রেতাত্মার হাত খুঁজেতে থাকে৷ আদনান তুর্কির বাহু ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘাড় হাতের মাধ্যমে ঝাড়তে থাকে। তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-এখেন ভূত আসবে কই থেকে? আর রান্নাঘরে আসতে বারণ করেছিলাম?
তুর্কি জানালার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– স্যার, এখানে ওই বউটার হাত ছিলো। বোধহয় রুটি চাচ্ছিলো। হাতটা কই গেলো?
আদনান তুর্কির দিকে এক পা এগিয়ে আসে। তুর্কির দৃষ্টি জানালাতে স্থির। আদনান তুর্কির ডান হাতের বাহু চেপে ধরে। তুর্কি যৎসামান্য বিষ্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। আদনান তুর্কির শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মুখের আটা মুছে দেয়।
-কিসের বউয়ের হাত? এখানে কোনো হাত নেই।
-আরে ছিলো। আমি আটা রাখতে গেছিলাম তখন আমার হাতের পাশে ছিলো।
আদনান মৃদু হেসে জবাব দেয়
-ওই টা আমার হাত ছিলো বোকা। তুমি বয়ামটা রাখতে পারছিলে না বলে; তাই হেল্প করছিলাম। কিন্তু, তুমি যে ভাবে চিৎকার দিলে..আমি তো ভেবেছি কী না কী।
তুর্কি বিষ্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলে,
-এখানে কোনো ভূত নেই?
-কিসের ভূত?
-আরে আপনার ভাই তখন বললো; এখানে নাকি একটা বউ ভূত আছে। একা একা রান্না করলে তাঁর ঘাড় মটকায়? সে নাকি শুধু খাবার চাই।
আদনান ভ্রুকুঞ্চন করে বলে,
-মীম বলেছে?
তুর্কি উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। আদনান যৎসামান্য রাগ নিয়ে শুধায়,
-ও-কে বলছি তোমাকে পাহারা দিতে। আর ও এই সব আজগুবি গল্প শোনাচ্ছে তোমাকে। আজ ওর এক দিন কি আমার এক দিন। ওই ভূতের সাথে আজ ওর বিয়ে দেবো।
তুর্কি আবারো সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে,
-এই গুলা কি সত্যি?
আদনান ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-উপরে চলো শরীরে আটা লেগে আছে।
তুর্কি কোমড়ে হাত দিয়ে কিঞ্চিত রাগী স্বরে বলে,
-যেমন আপনি, তেমন আপনার ভাই৷ এখানে এসেছেন কেনো আপনি? আপনার জন্যই তো আটার বয়াম টা পড়লো। আপনি হাত না বাড়ালে তো আমি ভয় পেতাম না। অসভ্য লোক। বের হোন। যান এখান থেকে।
-উপরে যেতে বলেছি।
-যাবো না। আপনি বের হোন।
রান্নাঘর থেকে তুর্কির আর্তচিৎকার শোনে রচনা ছুটে আসে রান্নাঘরে। সাথে রেজুয়ান, মোহনা, সূচনা আসে। তুর্কির কিছু হলে আদনান ওকে পিটাবে। বার বার বলেছে তুর্কিকে পাহারা দিতে। ও ভেবেছিলো ওই রকম ভূতের গল্প শোনার পর তুর্কি যাবে না রান্না ঘরে৷ কিন্ত, মেয়েটা রান্নাঘরে গিয়ে ঐ ভাবে চিৎকার করলো কেনো? ভূতটা সত্যি সত্যি আসেনি তো!
-শরীরে আটা লেগে আছে। পড়ে চুলকাবে। ফ্রেশ হয়ে নেও।
– তাতে আপনার কী? আপনার শরীর? বের হোন এখান থেকে। অসভ্য মার্কা লোক।
-ঝগড়া পরে করবে। আগে ফ্রেশ হতে বলেছি।
-আপনি না আসলে আটা তো পড়তো না। কেনো এসেছেন এখানে?
-উপরে চলো।
রচনা রান্নাঘরে উঁকি দেয়। দৃষ্টিগোচর হয় আদনান কে। লম্বা-চওড়া, হাড়-চওড়া মাংসল দেহধারী আদনানের দরুন তুর্কিকে দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে, বোঝা যাচ্ছে আদনান তুর্কির সামনে। কারণ, ওর শাড়ির আঁচল কিঞ্চিৎ উড়ছে। রচনা অন্য কিছু আন্দাজ করে দ্রুত রান্নাঘরের দরজা চাপিয়ে দেয়। রেজুয়ান, মোহনা, সূচনার উদ্দেশ্যে বলে,
-তোরা ঘরে যা। এখানে…এখানে তোদের থাকার দরকার নেই।
রেজুয়ান সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে,
-খালাচাচি সরো। ভাবির কিছু হলে ভাই আমারে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমাকে পাহারা দিতে বলেছিলো। দেখি সরো কি হলো।
রচনা দুই ভ্রু যুগল কুঁচকে বলে,
-তোরে বললাম না, ভেতরে যেতে। যা।
-আরে..
-ও রচনা। বউমা ওই ভাবে চিৎকার করলো কেনো? বাগান থেকে শুনে আমার আত্মা কেঁপে উঠছে। দেখি সর। মেয়েটা কোনো বিপদে পড়লো নাকি।
হুমাইরা এসে দরজা খুলতে গেলে রচনা বাধা দেয়।
-ভাবি ভাবি। দরজা খোলা যাবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।
-আরে কাজে যাবো মানে? কী বলছিস তুই? ভেতরে তুর্কি একা। রান্নাঘরের ব্যাপার। সর।
-আরে ভাই। ভেতরে এখন যাওয়া যাবে না। ওই খানে অন্য কিছু হচ্ছে।
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে এক সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে।
-অন্যকিছু মানে?
রচনার অবস্থা যাঁতায় কাটা সুপারির মত হয়। সে হুমাইরার হাত থেকে বাঁধাকপি নিয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
-মানে…মানে ভেতরে আদনান আছে।
হুমাইরা বোকা হয়ে প্রশ্ন করে,
-রাজ ভেতরে মানে?
রচনা আবারো হেসে বলে,
-আদনান ভেতরে মানে আদনান ভেতরে। ভেতরে বলে আদনান ভেতরে। তুমি..তুমি যাও তো। দেখো উঠান ঝাড়ু দেওয়া হয় নি।
হুমাইরার মাথা এমনিতেই ঘুরছে। তার ওপর রচনার অগোছালো কথা শুনে আরও ঘুরে। সে কিছু বলার আগেই রচনা তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। রেজুয়ান দরজার কাছে গিয়ে বলে,
-হায় হায়! ভাই ভিতরে কি করে! বা* আজ আমি গেছি। ভাবির কিছু হলে, আমারে ঘ্যাচাং ফু করে দিবো।
রচনা রেজুয়ানের হাত টেনে বলে,
-তোরে ভেতরে যেতে মানা করছি না? যা সর। এখানে আর থাকা যাবে না। তাড়াতাড়ি উপরে যা। মোহোনা সূচনা, যা উপরে যা।
-আরে দাঁড়াও আগে…
-যেতে বলছি। কিছু হয়নি৷ তোরা যা।
সবাইকে এক প্রকাশ ঠেলেঠুলে ভেতরে পাঠিয়ে দেয় রচনা।
-আপনি কেনো এসেছেন এখানে? আবার ঝগড়া করছেন? আপনার জন্যই তো পড়লো।
আদনান এক পা এগোলে তুর্কি ঢোক গিলে। ও এক পা পিছায়।
-বলেছি তো ঝগড়া করবো৷ কিন্তু, আগে ফ্রেশ হবে তার পর।
তুর্কি রাগী স্বরে বলে,
-আমার কোনো শাড়ি নেই। এই শাড়িটা আম্মুর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। আর আপনার জন্য নষ্ট হয়ে গেলো। ফাজিল লোক। অসভ্য লোক।
রাগে গজগজ করতে করতে তুর্কি রান্নাঘর থেকে বের হয়। পেছন পেছন বের হয় আদনান।
দ্বিতীয় বারের মত গোসল সেরে বের হয় তুর্কি। তবে পরনে এই বার নীল রঙের থ্রি-পিস। কত শখ করে শাড়িটা পরেছিলো। ওর থ্রি-পিস পরতে বেশি ভালো লাগে না। সব চেয়ে বেশি পছন্দ শাড়ি৷ তবে বিয়ের আগে মায়ের জন্য পরা হতো না। আর এখন অসভ্য মার্কা জামাইয়ের জন্য। ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুচ্ছে। জালানা দিয়ে সূর্যের কিরণ উঁকি দিচ্ছে। সূর্যের কিরণ ঘরের আসবাবপত্রে এসে পড়ছে।
ধীর পায়ে হেঁটে তুর্কির পাশে এসে দাঁড়ায় আদনান। হাতে ছোট একটা প্যাকেট। আয়নায় দু’জনের দৃষ্টি মিলন হলে তুর্কি মুখ বাঁকায়। আদনান দুই হাত পেছনে মুড়িয়ে আয়নায় দৃশ্যমান হওয়া পুতুলটিকে অবলোকন করে। চুল মুছতে মুছতে; তুর্কি ও আয়নায় অবলোকন করে দৃশ্যমান হওয়া গম্ভীর পুরুষটিকে। যে ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে আয়নায় দৃশ্যমান হওয়া ওকে নিষ্পলক নয়নে দেখছে। আদনানের কাছে তুর্কি জীবন্ত ছোট পুতুল! আর তুর্কির কাছে আদনান বুড়ো, আনরোমান্টিক, রাগী, গম্ভীর একজন লোক।
আদনান এই পুতুলটিকে কতটা ভালোবাসে কোনো দিন কী বুঝবে? কি ভাবে বুঝবে? তার ভালোবাসা যে অন্য রকম! ভীষণ কঠিন! ভীষণ প্রগাঢ়!
কিছুক্ষণ এই ভাবে দুইজন দুইজনকে পরখ করতে থাকে। একজনের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। অন্যজনের দৃষ্টিতে ক্ষুব্ধ। তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-এই ভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? কী চাই?
আদনান শোধবোধ ফিরে পেয়ে পাশে থাকা চেয়ার টেনে বসে। হাতে থাকা ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে বলে,
-এখানে একটা শাড়ি আছে। একজনের জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু, সে খুব ছোট। (হাতের ইশারায় দেখায়)
এই যে এই রকম ছোট। ভেবেছিলাম এত ছোট মানুষ শাড়ি-টাড়ি সামলাতে পারবে না। আরেকটু বড় হোক পরে দেবো।
কিন্তু হঠাৎ, সে একদিন শাড়ি পরে আমার সামনে এলো। এত ছোট্ট মানুষটাকে শাড়িতে এত সুন্দর লাগে তা দেখে বিমোহিত হয়ে যাই! মুগ্ধ নয়নে শতবার অবলোকন করতে থাকি! তাই, ভাবলাম আমার কেনা এই লাল শাড়িতে হয়তো তাঁকে আরো সুন্দর লাগবে। তাই, তাঁকে দিয়ে দেই।
কিন্তু, একটু আগে তোমার একটা শাড়ি নষ্ট করলাম। তুমি যে রণচণ্ডী! শাড়ির জন্য আমাকে কি না কি করে ফেলো। তাই, ভাবলাম তোমারটা আগে দেই পরে তাঁকে দিয়ে দেবো।
তুর্কি রাগী স্বরে বলে,
-হ্যাঁ, আমাকে তো আপনার রণচণ্ডী, ঝগুটে, বেশি রোমান্টিক আরো কত কি। অন্য সবাইকে ভালো লাগে।
আমি জানি কোয়েল ম্যাডাম ব্যতীত; ওই মীম নামে মেয়েটি ও আপনার গার্লফ্রেন্ড। যত ভাব শুধু আমার সামনে। দূর হোন। আপনার শাড়ি আমার লাগবে না। আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কাছ থেকে আরেকটা শাড়ি নিয়ে নেবো।
এই বলে তুর্কি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। চুল ঝাড়া পড়ায় কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়ে আদনানের শরীরে। ও মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়।
-শাড়িটা কিন্তু, ভীষণ সুন্দর! এক দম লাল টুকটুকে।
-তাতে আমার কী? যাঁর জন্য এনেছেন তাকে দিয়ে আসুন। অসভ্য লোক। বউয়ের সাথে একটা রোমান্টিক কথা বলে পেট জ্বলে। আবার, অন্য মেয়ের জন্য শাড়ি কিনে বউকে দেখাতে এসেছে।
-রেখে গেলাম। ভালো লাগলে পরও।
-বয়েই গেছে আমার। আপনার শাড়ির পরার।
সাথে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়। আদনান শাড়ি পাশে রেখে চলে যায়। তুর্কি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে শাড়ির প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। কত বড় সাহস! অন্য একজনের জন্য শাড়ি কিনেছে। আবার, সেই শাড়ি ওর জন্য নিয়ে এসেছে। ও দৃষ্টি সরিয়ে আয়নায় নিবদ্ধ করে। আবার আড়চোখে প্যাকেটের দিকে তাকায়। প্যাকেটা একবার খুলে দেখা উচিত। ওই অসভ্য লোক কার জন্য কি রকম শাড়ি কিনেছে। ও চিরুনি রেখে প্যাকেটে হাত দেয়। আবার হাত সরিয়ে নেয়। ওই অসভ্য লোকের দেওয়া কোনো জিনিস ও ছোঁবে না।
কয়েক বার চুল আঁচড়িয়ে আবার ও আড়চোখে প্যাকেটের দিকে তাকায়। নাহ্ এক বার দেখা উচিত। ওর সাথে কথা বলতে গেলে যার পেট জ্বলে। সে আবার অন্য জনের জন্য শাড়ি কেনে!
তুর্কি সোজরে চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে শাড়ির প্যাকেট হাতে নেয়। প্যাকেটের ভেতর আরেকটা বক্স। ও বক্স বের করে প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বক্সের উপরের খাপ খুলে দেখে গাঢ় লাল টুকটুকে একটা শাড়ি। এত গাঢ় লাল দেখে তুর্কির ভ্রু কুঁচকে যায়। এত লাল কি ভাবে হয়! ও শাড়ির আঁচল বের করে মাথায় দিয়ে আয়নায় তাকায়। একে তো অন্যের জন্য কিনেছে ,তার উপর এই রকম গাঢ় লাল। ও যৎসামান্য রাগান্বিত স্বরে বলে,
-মানুষের পছন্দ এত খারাপ কী ভাবে হয়? এত লাল শাড়ি কেউ কি ভাবে কিনতে পারে। তাও আবার কাউকে উপহার দেওয়ার জন্য।
তারপর ছুঁড়ে টেবিলের উপরে রাখে।
-অসভ্য লোক! বউয়ের সাথে একটা রোমান্টিক কথা বলতে পারে না। বউকে কিছু দিতে পারে না। আবার অন্যের জন্য এই রকম টকটকে লাল শাড়ি কিনে। দাঁড়া ব্যাটা আজ তর এক দিন কি আমার এক দিন!
দরজার আড়ালে থাকা এক জোরা দৃষ্টি সরে যায় তুর্কির উপর থেকে। মুজাহিদের ঘরে যেতে যেতে আদনান যৎসামান্য চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজে নিজে আওড়ায়,
-শাড়িটা কি বেশি লাল হয়ে গেছে? লাল দেখেই তো আনেছিলাম। জাহিদ মাস্টারই তো বললো লাল শাড়ি পড়লে ওকে সুন্দর লাগবে। কিন্তু, ওর তো পছন্দই হলো না। জাহিদ মাস্টারকে ধরতে হবে। বাপের ভাইয়ের জন্য আমার ছোট্ট বউটার মন খারাপ হয়ে গেলো।
রচনা বাঁধাকপি দিয়ে ছোট ছোট আলু টুকরো করে ভাজছে। সাথে ডিম ভাজি। সবার সকালের চায়ের পর্ব শেষ করেছে। এখন নাস্তার পালা। শুক্রবার হওয়ায় সবার ছুটি। তাই, নাস্তা একটু দেরিতে বানানো হচ্ছে। কিন্তু, হুমাইরা রেজুয়ানকে কখন আটা আনতে পাঠিয়েছে এখনো আটা নিয়ে আসছে না।
আদনান তুর্কি রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার পর; রচনা ঠুকে দেখে মেঝেতে আটার ছড়াছড়ি। তাহলে তুর্কি আটা ফেলে দেওয়ার জন্যই চিৎকার করছিলো?
বৈঠক খানায় চেয়ারে বসে রেজুয়ানকে কল করছে হুমাইরা। তুর্কি কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে তার পাশে এসে বসে। হুমাইরা ফোন কানে দিয়ে বলে,
-কী হয়েছে মা? মন খারাপ কেনো?
তুর্কি গান ফুলিয়ে হুমাইরাকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। কাধে মাথা রেখে কৃত্রিম ফোঁপানোর আওয়াজ করে বলে,
-আমি তোমার ছেলের সাথে আর থাকবো না। আমাকে আজই বাপের বাড়ি দিয়ে এসো।
হুমাইরা দ্রুত কান থেকে ফোন নামিয়ে এক হাত দিয়ে তুর্কির পিঠে বুলাতে থাকে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
-এ কী কথা মা? কী হয়েছে? ঝগড়া হয়েছে দু’জনের মধ্যে?
তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়ায়। চোখ কচলে কচলে ভেজা বানিয়ে মাথা তুলে। ফোঁপানো বিদ্যমান রেখে বলে,
-না আম্মু, কিছু হয়নি। আসলে তোমার ছেলের, আমাকে আর ভালো লাগে না।
-কী হয়েছে বলবি তো। কি করেছে আমার ছেলে?
তুর্কি হুমাইরা দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলে,
-কী করেনি বলো। তোমার ছেলে, এত দিন হয়ে গেছে আমার সাথে সুন্দর করে কথা পর্যন্ত বলে না। কোনো গিফট তো দূর, আমি কোনো ভালো কথা বলে ও দুর্ব্যবহার করে। আর, আজ অন্য একজনের জন্য শাড়ি এনে আমাকে আবার দেখাচ্ছে। বলো এই ভাবে কি থাকা যায়?
হুমাইরা ভ্রু যুগল ভাঁজ করে বলে,
-কী? ও নিজে তোকে পছন্দ করে আনছে। আর এখন এই সব করছে?
-এক জিনিসের উপর পছন্দ আর কত দিন থাকবে বলো। তুমি তোমার ছেলেকে কিছু বলো না। আমি…আমি বাড়ি থেকে চলে গেলে ভালো হবে।
-তুই যাবি মানে? আমার নিজের কোনো মেয়ে নেই। তুই আমার মেয়ে। চল তুই আমার সাথে। আজ ওর এক দিন কি আমার এক দিন। কত বড় সাহস আমার মেয়েকে কষ্ট দিছে। আজ ওকেই বাড়ি থেকে বের করবো। চল তুই আমার সাথে।
-মাতাশ্রী, এই যে আটা।
রেজুয়ান এসে আটার প্যাকেট দেয় হুমাইরার হাতে। হুমাইরা কিঞ্চিৎ রাগ ওর উপরে ও দেখায়।
-আটা আনতে জাহান্নামে গেছিলি? ফাজিল, একটা আটার প্যাকেট আনতে দিছি তাই এতক্ষণ লাগে?
রান্নাঘরে রচনার কাছে দিয়ে আয়।
রেজুয়ান কপাল ভাঁজ করে মায়ের কথা শুনে। সকাল সকাল মায়ের হলো কী? হুমাইরা তুর্কিকে অপেক্ষা করতে বলে কয়েকটা ডিম আনতে যায়। রেজুয়ানের চোখ তুর্কির উপর পড়তে তুর্কি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
হুমাইরা ডিম নিয়ে এসে বলে,
-আটার প্যাকেট যদি ফাটে না, পেটের মধ্যে পাড়া মারুমনি একটা। ফাজিল কোথায়কার৷ ভদ্র মত নিয়া যা।
-আরে যাইতেছ, মা জননী। এত চিল্লাইও না।
মুজাহিদের গলা পেছন থেকে হাতের বাহু দিয়ে চেপে ধরেছে আদনান। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
-বাপের ভাই, তোমাগো দিয়ে একটা কাজ হয় না। ওইটা কী শাড়ি পছন্দ করছো?
-কেন বাচ্চা? কী হয়েছে?
– কী হয়নাই তাই বলো। মীম এর বাচ্চারে বলছি আমার বউ টা কে পাহারা দিতে। ও পাহারা বাদ দিতে ভূতের গল্প শুনিয়ে ওকে ভয় পাইয়ে দিছে। আর, তোমাকে নিয়ে শাড়ি কিনতে গেলাম, তুমি বললা এই শাড়িটা নে। ওকে ভীষণ সুন্দর লাগবে।
-আরে বাচ্চা, শাড়িতে সমস্যা হয়ছে কি সেটা বল। এত সুন্দর শাড়ি পছন্দ করে দিছি।
-ওই রকম লাল্টু পাট্টা শাড়ি আমার বউয়ের পছন্দ হয় নাই। বার বার বললাম কালো শাড়ি নেই শুনলা না।
-আরে, লাল শাড়িতে মেয়ে দের বেশি সুন্দর লাগে। তোর বউয়ের কোনো চয়েসই নেই। সর।
-চয়েস নাই দেখেই তো আমার ভাইয়ের মত জামাই পাইছে। তা না হলে আরো সুন্দর জামাই পাইতো।
রেজুয়ানের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে যায় আদনান। এই ফাজিলকেই তো খুঁজছে। ওকে ধরতে এলে ও এক লাফে বিছানায় গিয়ে মুজাহিদের পেছনে লুকায়।
-তুই আজ এই দিক আয়। তোকেই তো খুঁজছি। তোকে কি বলেছিলাম? আর তুই কি করছিস?
রেজুয়ান মুজাহিদের কাঁধ ধরে বলে,
-ভাই ভাই। আমি আসলে বলতে চাইছি চয়েস আছে দেখেই আমার ভাইয়ের মত জামাই পাইছে। তা না হলে রাজমিস্ত্রী জুটতো কপালে। কিন্তু, কি ভাবে যেনো ওই টা বলে ফেলছি।
-হুম। এই দিকে আয়। আজ তোর এক দিন কি আমার এক দিন।
-ওই বাপের, ভাই তোমার সামনে এই ছোট মাসুম বাচ্চাটাকে মারতে আসতেছে৷ তুমি কিছু বলো না কেন?
-বাচ্চা, ওরে নিয়ে যা তো। নিয়ে ইচ্ছা মতো ধোলাই দে।
-বাপের ভাই…।
-তোকে বলছি, ওকে পাহারা দিতে; আর তুই ওরে ভূতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখাইছস।
আদনান আশে পাশে তাকিয়ে রেজুয়ানকে মারার জন্য কিছু খুঁজতে থাকে। টেবিলের উপর থেকে স্কেল নিয়ে তেরে আসে।
-ভাই ভাই, শোন। তোর বউ খুব ডেঞ্জারাস। এত বার করে বলার পর ও আমার কথা শুনে নাই। তাই ওই রকম গল্প শুনাইছি। কে জানে সত্যি সত্যি ভয় পাবে।
-হুম। আজ ওই ভুতের সাথে যদি তোর বিয়ে না দিছি….জাহিদ মাস্টার বিয়ে পড়ানো শুরু করে।
মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘাড় ধরে এনে সামনে বসায়।
-কোনো কথা বলবি না। এখন ভূতের সাথে তোর বিয়ে পড়ানো হবে।
-বাপের ভাই, আমি বিয়ে করলে কাঠগোলাপের কী হবে। এমন কইরো না।
আদনান রেজুয়ানের পিঠে স্কেল দিয়ে বাড়ি মেরে বলে,
-তোর কাঠগোলাপের বাচ্চা। তাড়াতাড়ি কবুল বল। তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম। আমার বউয়ের কিছু হলে তোর খবর আছে।
-এমন কইরো না ভাই। কাঠগোলাপকে না পেলে আমি শেষ। ওই বাপের ভাই থামাও না কেন?
-ওই বাচ্চা, দেনমোহর হিসেবে ওর হাড্ডি, মাংস, রক্ত ধার্য করি? কি কস।
-হুম তাই তো করবা।
রেজুয়ান পাশ থেকে কোলবালিশ এনে বলে,
-ভাই, কোলবালিশের সাথে বিয়ে দেও। তবু ও, ভূতের সাথে বিয়ে দিও না। প্রতি রাতে আমার রক্ত চুষে খাবে।
আদনান কিছু বলতে গেলে; বাইরে থেকে হুমাইরার কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে। আদনান স্কেল রেখে দরজার কাছে যায়। রেজুয়ান বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে। এই পাহারাদারের কাজ ও ছেড়ে দিবে। ভাইয়ের বউয়ের জন্য ওর জীবনটা প্রায় শেষের পথে। আজ তো ভূতের সাথে বিয়ে হতে হতে হলো না। কিন্তু, কাল… ও আনমনে গান গেয়ে উঠে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৯+২০
-ভালা মানুষ পাগল হইলাম,
ভালা মানুষ পাগাল হইলাম,
ভাবি ঘরে আইন্না।
ভাইরে বিয়া করাইলাম গো না জাইন্না।
বিয়া করাইলাম গো না জাইন্না।