হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৩
তোয়া নিধী দোয়েল
এই বৃষ্টিভেজা পরিবেশে, সবাই আর্জি জানিয়েছে, রাতের খাবারে গরম গরম সবজি খিচুড়ি, সাথে বেগুন আর ডিম ভাজি খাবে। সেই আবদার পালন করতে, রান্নাঘরে দুইটা টর্চ জ্বালিয়ে আয়োজন করছে হুমাইরা আর রচনা। রচনা মেঝেতে বসে ফুলকপি কাটছে। আর হুমাইরা মুগ ডাল ভাজছে।
মুজাহিদ রেজুয়ান রান্নাঘরের দিকে আসছে। আদনান যখন থেকে মুজাহিদ কে দুই কাপ চা বানিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে, তখন থেকে রেজুয়ান মুজাহিদকে টিপ্পনী কেটে যাচ্ছে। শতবার ক্ষেপাচ্ছে। এ যে রান্নাঘরের দিকে আসতে আসতে এখনো ক্ষেপিয়ে চলছে,
-হে মাবুদ! তুমি কারো মনে একটু লজ্জা শরম দেও। ছেলে বউ নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করবে, আর বাপ হয়ে তাদের জন্য চা বানাবে। এই কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না।
মুজাহিদ রেজুয়ানকে যথাসম্ভব পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত হাঁটা ধরে। রেজুয়ান ও মুজাহিদের হাঁটার তালে তাল মিলিয়ে, তাঁর গলা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে। মুখ কানের কাছে নিয়ে বলে,
-আরে বাপের ভাই, এত তাড়াতাড়ি যাও কেন?
-সর এখান থেকে। গলা ছাড়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-বুচ্ছো বাপের ভাই, তোমার জন্য মাঝে মাঝে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। কষ্টে, দুক্ষে বুকের ভেতরে নাড়ি, কলিজা, কিডনি সব প্যাঁচ লেগে; হৃদয়ের সাথে ধাম ধাম করে বাড়ি খায়। কি যে ব্যথা করে বুকের ভেতর! উফফফফ! তোমাকে কি ভাবে বুঝাই! তবু ও তোমাকে একটা বিয়ে করাতে পারি না। যত বুইড়া হচ্ছো, তত তোমার পাওয়ার কমে যাচ্ছে। তবু ও একটা মেয়ে তোমার কপালে জোটে না।
মুজাহিদ রেজুয়ানের কান টেনে বলে,
-তোর কান আজ ছিঁড়ে ফেলবো, ফাজিল। আমার কপালে মেয়ে জোটে না, তাতে তোর কি? তোর এত কষ্ট লাগে কেন?
-আ আ আ ও মা…..
-আমাকে আরেকটা বার কিছু বললে, তুই কালা কুত্তার গু খাস।
রেজুয়ান মুখ কুঁচকে বলে,
-তুমি বোধহয় আগে ট্রায় করছো, তাই জানো তাইনা?
-তোকে আগে ট্রায় করাবো ফাজিল।
মুজাহিদ কান ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। এই ফাজিলকে পরে দেখবে। আগে চা বানানো শেষ হোক।
মুজাহিদ রান্নাঘরে গিয়ে দেখে হুমাইরা রচনা রান্না করছে। মুজাহিদ চা বানানোর কথা বললে হুমাইরা বলে, সে বানিয়ে দিবে। কিন্তু, মুজাহিদ বলে সে পারবে।
রেজুয়ান রান্না ঘরে এসে রচনার পাশে কেটে রাখা টমেটো থেকে, এক পিস উঠিয়ে মায়ের পাশে যায়।
-মা, তোমার বুইড়া ছেলেরে বিয়ে করাও না কেন?
-তুই করা গা।
-একটা পাত্রী খুঁইজা দেও।
-পাত্রী পাইলে কি আর তোর অপেক্ষায় থাকি?
-যে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলবো, সে কালা কুত্তার গু খায়।
সবাই এক সাথে নাক সিঁটকায়। রেজুয়ান মুজাহিদের কাছে এসে বলে,
-যে বিয়ে করতে না চায়, সে সাদা কুত্তার গু খায়।
হুমাইরা রেজুয়ানের কান টেনে বলে,
-খাচ্চরের দল। বের হো এখান থেকে। এখানে একটা কিছু রান্না করতেছি, আর ওরা গু নিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি বের হো।
বজ্রপাত চলমান। বৃষ্টির বেগ যেনো ক্রোমশ বেড়েই চলেছে। চিলেকোঠার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জন। আদনান হাতের ছাতা বন্ধ করে পাশে দাঁড় করায়। পাঞ্জাবির পকেটে থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ অন করে। ফোন, মোম, ফুলের ডাল তুর্কির হাতে দেয়। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে চিলেকোঠার, কাঠের দরজা খুলে।
বাতাসের দরুন তুর্কির চুল প্রায় খুলে পিঠের উপর পড়েছে। ধীরে ধীরে চুলের কাটা খুলে পড়ে যায়। চুলের প্যাঁচ ঘুরতে ঘুরতে আলগা হয়ে কোমড়ে গিয়ে থামে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের ফোন পেছনে নিয়ে দেখার চেষ্টা করে, চুলের কাটাটি কই পড়েছে। আদনানের উদ্দেশ্যে বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
– স্যার, দেখুন তো আমার চুলের কাটা কই পড়লো।
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-পড়ুক। তুমি এই দিক ধরো।
তুর্কি মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করে আদনানের দিকে ধরে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আপনার জন্যই তো পড়লো। এখানে আসতে বলেছে কে হ্যাঁ? অসহ্য।
আদনান তালা খুলতে খুলতে বলে,
-আমার জন্য!
-হ্যাঁ! তা নয়তো কী? অসভ্য মার্কা লোক।
আদনান দরজা খুলে। ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়। আদনান তুর্কির হাত থেকে ফোন নিয়ে ভেতরে যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য রেজুয়ানকে কল করে দিয়াশলাই এর কথা জানায়।
ফোনের আলোয় তুর্কি আশে পাশে দেখতে থাকে। অনেক পুরানো জিনিস। টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। নিদারুণ তাঁর শব্দ!
আদনান কিছু দূরে একটা জানালার সামনে গিয়ে থামে। জানালার খিল খুলে দুই পাল্লা টেনে খুলে। জানালার মাঝে কোনো লোহার শিক নেই। এক দম ফাঁকা৷ এই জায়গা থেকে আকাশটা খুব কাছে লাগছে। আকাশের কালো মেঘ, বিদ্যুতের ঝলকানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আদনান পুরানো কাঠের টেবিলের পাশ থেকে, কাঠের কারুকার্য করা দুইটা চেয়ার নিয়ে এসে, জানালার সামনে রাখে। টেবিলের উপর থেকে পুরানো ন্যাকড়া দিয়ে, চেয়ার দু’টি ভালোভাবে মুছে। এরপর তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে,
-এখানে কী একা থাকতে ভয় পাবে? আমি দিয়াশলাই আর চায়ের কাপ নিয়ে আসছি?
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আমাকে কি নিজের মত ভীতু মনে হয়? যে বউকে আই লাভ ইউ বলতে ভয় পায়?
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এত সাহস যখন, তাহলে সকালে ওই ভাবে ছুটে পালিয়ে গেছিলে কেনো?
তুর্কি খুস খুস করে কেশে বলে,
-আপনি..আপনি, ওই ভাবে আমার পেছনে ছুটেছিলেন কেনো?
আদনান, ন্যাকড়া টেবিলের উপর রেখে ধীর পায়ে হেঁটে তুর্কির দিকে এগোতে থাকে। তুর্কি ঢোক গিলে এক পা পিছিয়ে যায়। টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ। তুর্কি ভয় পেতে না চায়তে ও এক অদ্ভুত কোনো অনুভূতি ওকে গ্রাস করে। আদনান তুর্কির সামনে এসে ওর বাম হাত বাড়িয়ে দেয়। মৃদু হেসে বলে,
-ওয়েলকাম টু মাই ডিফ্রেন্ট ওয়ার্ল্ড। এখানে ভয়ংকর সুন্দর কিছু স্পৃহা আছে।
তুর্কি আদনানের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আদনান ওর খুব নিকটে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বিদ্যুতের ঝলাকানি দেয়। তাঁর কিছু আলো জানালা দিয়ে আসে। তুর্কি আদনানকে ভালোভাবে পরখ করে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-যেমন?
আদনান মৃদু হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পরপরই ওর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-বুঝবে না।
-হুম। বুঝবো কীভাবে? আমি তো আর ফিজিক্স এর টিচার নই!
একটু থেমে আবার বলে,
-আমরা তো ফোনের আলোয়ই গল্প করতে পারি। অযথা, মোম জ্বলাতে হবে কেনো?
আদনান মৃদু হেসে তুর্কিকে অপেক্ষা করতে বলে চলে যায়। তুর্কি চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ভাবে,
-এ কেমন বর জুটলো ওর কপালে! এই আনরোমান্টিক লোককে নিয়ে ও কীভাবে সারা-জীবিন কাটাবে?
মুজাহিদের হাতে দুইটা চায়ের কাপ। আর রেজুয়ান এক হাত দিয়ে ছাতা ধরে রেখেছে। অন্য হাত দিয়ে টর্চ ধরেছে। মুজাহিদ আদনানের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বলে,
-লজ্জা লাগে না ন্যা? বাচ্চা মানুষ প্রেম করবি। আবার তোগো থেকে বয়সে বড় হয়ে, তাকে খাটাবি।
-চিন্তা করো না। তুমি যখন প্রেম করবা তোমাকে ও সাহায্য করবো।
-লজ্জা-শরম সব বিসর্জন দিছস। বয়সে বড় হই তোগো।
-আরে আসো তো বাপের ভাই। আমার পিচ্চি বউ অপেক্ষা করছে। একা রেখে এসেছি, ভয় পাবে।
আদনান একটা চায়ের কাপ নেয়। অন্য হাতে ছাতা ধরে রেখেছে। আসার সময় তো আলো ছাড়া আসা গেছে। কিন্তু, যাওয়ার সময় দুইটা চায়ের কাপ নিয়ে যাওয়া যাবে না। তার উপর ছাতা ধরতে হবে। তাই মুজাহিদ কে ওইটা নিয়ে আসতে বলে। রেজুয়ান পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে আদনানের পকেটে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-বাপের ভাই, তোমার তো গোপন সমস্যা আছে তাই বিয়ে করো না। আমার ভাইয়ের তো কোনো সমস্যা নেই। তো তোমার জন্য কি ও বিয়ে করা বাদ রাখবো? প্রেম করা বাদ রাখবো?
মুজাহিদ দাঁড়িয়ে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
-ওরে কিছু বলবি? ও কখন থেকে আমার পেছনে লাগছে।
-ভুল কিছু তো বলে নাই, বাপের ভাই?
-ধর তোগো চা, তোরা নিয়া যা। তোগো জন্য এত পাপ করি, অথচ তোরা এক পয়সার দাম ও আমারে দেস না। ধর।
-আরে বাপের ভাই, চেইতো না। আসো আসো।
রেজুয়ান মুজাহিদের গলায় হাত দিয়ে বলে,
-ঠিক আছে যাও, আমি কালকেই তোমাকে আমার পয়সা দিয়ে, কলিকাতা হারবাল কিনে এনে দেবো। যাতে তোমার গোপন সমস্যা দূর হয়ে যায়। তবুও রাগ করো না।
মুজাহিদ চোখ মুখ শক্ত করে ওর দিকে তাকায়।চিলেকোঠার সামনে গিয়ে আদনান ছাতা বন্ধ করে। অন্য হাত দিয়ে চায়ের কাপ নিতে গিয়ে, টর্চের আলোয় দরজার কাছে কিছু একটা দেখতে পায়। ও সেটা উঠিয়ে পকেটে ভরে।
তারপর মুজাহিদের হাত থেকে চায়ের কাপ নেয়। মুজাহিদ রেজুয়ানের হাত থেকে ছাতা নিয়ে ওকে এক লাথি মেরে বৃষ্টির মাঝে ফেলে দেয়। রেজুয়ানের শরীরে বৃষ্টির পড়তে থাকে। ও ছাতার ভেতর আসতে গেলে মুজাহিদ ছাতা নিয়ে দৌড় লাগায়।
-আরে বাপের ভাই, কর কী! ভিজে গেলাম।
-তুই বৃষ্টির পানিতে ভিজে পবিত্র হো, ফাজিল। এই বৃষ্টির পানিতে তারেক গো বাড়ির মুরগীর গু*য়ের পুকুরের পানি ও আছে। তুই ভিজে ভিজে পবিত্র হো। পারলে উপর দিকে তাকিয়ে একটু খাইস।
-বাপের ভাই, আমি একা ভিজবো না। তোমাকে ও ভেজাবো।
-আগে ধর আমাকে।
রেজুয়ান দৌড় দিতে গেলে মুজাহিদ ছাদের দরজা বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণে রেজুয়ান ভিজে চুপচুপে হয়ে যায়। আদনান নাক-মুখ কুঁচকে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
-তোরা যাবি এখান থেকে। অসভ্যের দল।
-ভাই, দরজা খুলতে কোও। তা না হলে তোমাদের ঐখানে যেতে দেও।
-এখানে আসলে মাইর খাবি। তুই সব সময় জাহিদ মাস্টারের পিছনে লাগছ কেন? ফাজিল। ভিজ এখন।
তুর্কি বাগানবিলাসের ডাল হাতে নিয়ে বসে আছে। আদনানের, গলা পরিষ্কারের শব্দ শুনে দ্রুত ফুল রেখে দেয়। আড়চোখে আদনানকে দেখে স্বভাবতঃ মুখ বাঁকায়। আদনান চায়ের কাপ দুটি জানালার সামনে রেখে, পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে। দিয়াশলাই কাঠি বের করে, দিয়াশলাই এর প্যাকেটের সাথে ঘসে আগুন জ্বলায়। এর পর ফোনের ফ্ল্যাশ অফ করে পাশে রাখে। তুর্কির দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে ও পাশের চেয়ারে বসে। তুর্কি ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ হাতে নেয়। আদনান তুর্কির উদ্দেশ্যে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-এই বৃষ্টিঘেরা পরিবেশ, উপভোগ করার জন্য আরো অনেক পদ্ধতি আছে। এই ধরো— কোনো বিশাল সাজসজ্জায় ঘেরা রেস্টুরেন্টে। কিংবা রুমে কোনো আর্টিফিশিয়াল লাইট জ্বলিয়ে।
কিন্তু, কয়জন একটা পরিত্যক্ত টিনের ঘরের পুরানো জানালার সামনে বসে, একটা সাধারণ দশটাকায় কেনা মোমবাতির হলুদ আলোয়, দুই কাপ ধোঁয়া উঠা চা হাতে, গল্প-গুজব করতে করতে ঝুম বৃষ্টি আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখবে? আর, আমি তো আগেই বলেছি, আমার ইচ্ছে গুলো ভীষণ অদ্ভুত। সবার থেকে আলাদা। বুঝলেন বেগম সাহেবা?
তুর্কি অপলক চোখে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। আদনান কথা শেষ করে তুর্কির দিকে দৃষ্টি স্থির করে। দুই জনের হাতে থাকা চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর বজ্রপাত। মাঝে মাঝে বাতাস এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে আগুনের শিখা কে।
দু’জনের দৃষ্টি সংযোগ হলে, তুর্কি মুখ আরেকটু বাড়িয়ে, আদনানের চোখে ফুঁ দেয়। আদনান চোখ বন্ধ করে ফেলে। তুর্কি ঠোঁট টিপে হাসে। আদনান চোখ খুলে। তুর্কি চায়ের কাপের দিকে ইশারা করে বলে,
-ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
তারপর নিজের টা পান করার জন্য ঠোঁট বরাবর তোলে। আদনান মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। ঠোঁটের কাছে কাপ নিতে গেলে, তুর্কি নিজের কাপ নিয়ে আদনানের কাপে টোকা লাগায়। আদনান ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে ওর দিকে তাকায়। তুর্কি চোখ টিপে বলে,
-এই ভাবে খেতে হয়, অসভ্য লোক। রোমান্টিকতার তো কিছু জানেন না।
আদনান ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তুর্কি ও মৃদু হেসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
মূহুর্ত টা ভীষণ সুন্দর। তুর্কি আগে কখনো এই রকম কোনো মূহুর্ত কোথায় দেখেছে কিংবা শুনেছে কিনা ওর জানা নেয়। টিনের চালে এই ঝুম ঝুম শব্দ! সাথে বিশাল পুরনো জানালার সামনে বসে ধোঁয়া উঠা চা পান। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। আর ভারী বর্ষন।
আচ্ছা সোফিয়ার তো বয়ফ্রেন্ড আছে, ওরা কি এই ভাবে কখনো বৃষ্টি বিলাস করেছে?
দুজন মৌন থেকে, বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা শেষ করে। শুধু টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আর বজ্রপাতের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। তুর্কি চা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। মোমবাতির পাশে এক হাত রেখে, আরেক হাত দিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করে। হাতের তালুতে বৃষ্টি সংগ্রহ করে। এর পর ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার।
-হুম।
-উঠুন। আমার হাতের নিচে হাত পাতুন।
আদনান চায়ের কাপ রেখে উঠে তুর্কির পাশে দাঁড়ায়। তুর্কি ইশারা করে তুর্কির হাতের নিচে হাত দিতে। আদনান সোজা করে হাত পাতে। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আরে আমি যে ভাবে করেছি, এই ভাবে করুন।
আদনান ওর হাত, তুর্কির হাতের মত করে। তুর্কি ওর হাতে সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানি, আদনানের হাতে ঠেলে দেয়। আদনান ও ওর হাতে পড়া পানি হাত কাত করে ফালে দেয়। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে হতাশ কণ্ঠে বলে,
-আরে আপনি ফেললেন কেনো? আমি আবার আপনার হাতের নিচে হাত দিতাম। এই ভাবে এক সময় পানি পড়ে যেত।
আপনি রোমান্টিকির কিচ্ছু বুঝেন না। ট্রেনিং করাতে চাই তাও শিখতে চান না। আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমাকে তোমার আনরোমান্টিক মনে হয়?
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে, কিছু পানি সংগ্রহ করে আদনানের দিকে ছিঁটিয়ে দেয়। এরপর বলে,
-মনে হওয়ার কী আছে? আপনি তো আলট্রা-প্রো-ম্যাক্স আনরোমান্টিক।
আদনান মোমবাতি হাতে নেয়। তুর্কি আবারও এক হাত বাইরে দেয়। আদনান ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। পুরও ঘর অন্ধকারে ঢেকে যায়। তুর্কি কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায়। ও ঢোক গিলে হাত ভেতরে আনে। ওর বুক ধুকপুক করে উঠে। আদনান হাতের মোমবাতি জায়গা মত রেখে অন্ধকারে তুর্কির দিকে তাকায়। আকাশে বিদ্যুৎ
চমকে উঠলে, সেই আলোয় আদনানের দৃষ্টি দেখে আরও ভয় পায়। ওর কণ্ঠে কাঁপে। গলার স্বর দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। আদনান এক পা এগোলে তুর্কি এক পা পিছায়। আদনান তুর্কির দিকে বাম হাত বাড়িয়ে দেয়। ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলে,
-তোমার তো ভীষণ সাহস। তাহলে আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত রাখো।
তুর্কি ভয়ে ঢোক গিলে। আদনান মৃদু হেসে আবারও বলে,
-কি বেগম সাহেবা, ভয় পেয়ে গেলে? আমি জানি, তুমি ভীতু নয়। তাহলে…?
তুর্কি সাহস সঞ্চার করে ওর কাঁপা ডান হাত আদনানের হাতের তালুতে রাখে। আদনান হাত মুঠো করে, ওর হাত শক্ত করে ধরে। তুর্কির ভয়ে কেঁপে উঠে। বুকের ভেতরে থাকা যন্ত্রটি ভীষণ শব্দ তুলতে থাকে।
আদনান ওর হাত টেনে উলটো ঘুরে ছুটতে থাকে! তুর্কি হতবাক হয়ে যায়! তুর্কি ও ওর তালে তাল দিলে ছুটতে থাকে। ওরা এক সাথে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়।
ছাদের ঠিক মাঝখানে গিয়ে, আদনান তুর্কির বাম হাত ও ধরে। দুইজন দুইজনের হাত ধরে, মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁকা জায়গা রেখে, দুইজন দুইদিকে হেলে আকাশ মুখি হয়।
ভারী বর্ষন ওদের দুজনকে ভিজিয়ে দেয়। দুইজন চোখ বন্ধ করে থাকে। টুপটুপ বৃষ্টি ওদের মুখে পরে। ধীরে ধীরে পুরোপুরি ভিজে যেতে থাকে। তুর্কি ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত, অপরুপ মূহুর্ত অনুভব করে। ওর লম্বা চুল বাতাসের দরুন উড়তে ও থাকে। ওর ধারণার বাইরে ছিলো এই মূহুর্ত!
বজ্রপাতের আওয়াজ হলে তুর্কি ভয় ‘আ’ বলে চিৎকার করে উঠে। আদনান ওকে এক টানে নিজের কাছে আছে। তুর্কি আদনানের বুকে চোখ মুখ খিঁচে থাকে। বজ্রপাতের আওয়াজ শেষ হলে, তুর্কি পিটপিট করে চোখ খুলে, আদনানের বুক থেকে, মুখ উঁচু করে আদনানের মুখের দিকে তাকায়। আদনান মুখ থেকে পানি পড়ছে। পরিবেশ অন্ধকার। সাথে ভারী বর্ষন। সাথে মাঝে মাঝে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়া। এই অন্ধকারের মধ্যে ও আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আদনান মৃদু হেসে বলে,
-ভয় পেও না, বেগম সাহেবা। আমি থাকতে অন্য কিছুতে ভয় পাওয়া, তোমাকে সাজে না।
তুর্কি বোকা বোকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আদনান তুর্কির বাম হাত ছেড়ে দেয়। ডান হাত উপরে উঠিয়ে, ওকে ঘোরাতে থাকে।
তুর্কির ভেজা চুল ওড়না ঘোরার তালে তালে ঘুরতে থাকে। দুজনের মনে এক অন্য রকম অনুভূতি সঞ্চর হয়। আদনান তুর্কিকে ঘোরাতে ঘোরতে বলে,
-বিয়ে জিনিসটা খুব পবিত্র বন্ধন, বেগম সাহেবা। ভীষণ সুন্দর, স্নিগ্ধ একটা জিনিস। যেখানে প্রতিটি মূহুর্তে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা, সংযম, আস্থা, বিশ্বাস আর একে উপরের প্রতি দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু, একটা মেয়ের, একটা অচেনা ছেলেকে নিজের মত করে বুঝতে, চিনতে, আপন করে নিতে অনেক টাইম লাগে। তাই যতক্ষন পর্যন্ত, ( তুর্কিকে ঘোরানো শেষ করে, টান দিয়ে নিজের কাছে আনে) তুমি আমাকে তোমার মত করে না বুঝছো, না চিনতে পারছো, আপন করে নিতে না পারছো ততক্ষণ পর্যন্ত (তুর্কির কানের কাছে মুখ নিয়ে) তুমি যা ভাবছো তা হবে না। শুধু জমিয়ে ঝাল,টক,মিষ্টি, প্রেম করে যাবো।
তুর্কি চোখ বন্ধ করে ফেলে। আল্লাহ্! ওর মাইন্ডটা এত খারাপ কেনো হয়েছে? আর হলে ও এই লোকটা ধরলো কি ভাবে? তুর্কি চোখ পিটপিট করে খুলে আমতা আমতা করে বলে,
-কিছুই… ভাবিনি আমি।
-সত্যি?
তুর্কি আদনানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-ঘোড়ার ডিম ভেবেছি। অসভ্য মার্কা খারাপ লোক।
এই বলে ছুটে ছাদ থেকে বেরিয়ে যায়। আদনান মুচকি হেসে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই হাত দিয়ে মুখের পানি মুছে।
তুর্কি ছাদের সিড়ি পেরিয়ে, ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান রেখে, ছুটে চলে ঘরের দিকে।
তুর্কি ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। হুমাইরা নিচে খাবারের টেবিল সাজাচ্ছে৷ তুর্কিকে নিচে নামতে দেখে হেসে বলে,
-কিরে মা এতক্ষণ কই ছিলি? আয় এই দিক।
তুর্কি নিচে নেমে হুমাইরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। হুমাইরা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কিরে শরীর ঠাণ্ডা কেনো? এই রাতে গোসল করেছিস?
তুর্কি কি বলবে ভেবে না পেয়ে, আমতা আমতা করে বলে,
-নাহ, ওই যে বৃষ্টিতে একটু ভিজেছি।
হুমাইরা তুর্কিকে ঘুরিয়ে চেয়ারে বসায়৷ নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর চুল মুছতে থাকে। উপর থেকে আদনান এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়। পরপরই চমৎকার করে হেসে নিচে নামে। একটু হিংসাত্মক কণ্ঠে বলে,
-মা, আমার চুল ও ভেজা। আমার চুল ও মুছে দেও।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
-দূরে সরুন। এত দিন আপনার মা ছিলো। এখন শুধু এইটা আমার মা। সব আদর আমি একা খাবো।
হুমাইরা তুর্কির ও তুর্কির তালে তাল মিলিয়ে বলে
-হ্যাঁ, এত দিন তোর মা ছিলাম। এখন ওর মা। তাই দূরে সর তোরা।
-মানে! ছেলের বউ পেয়ে এখন আমাকে ভুলে যাবে?
উপর থেকে রেজুয়ান নামতে নামতে বলে,
– মাতাশ্রী…..। এইটা ঠিক না। তুমি তোমার বড় ছেলের বউ পেয়ে, আমাকে ভুলে যেতে পারও না। আমার ও চুল ভেজা মুছে দেও।
মুজাহিদ বিদ্রোহী কণ্ঠে বলে,
-ভাবিজান, আমি তোমার সব চেয়ে বড় ছেলে। তাই সবার থেকে, আমার অধিকার সব চেয়ে বেশি। তাই তোরা দূরে সর।
হুমাইরা সবার উদ্দেশ্যে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-তোরা সবাই এখন বুইড়া হয়ে গেছিস। আমার এখন শুধু একটা মাত্রই মেয়েই৷ তাই তোরা দূরে যা।
-ভাবিজান…
-বাপের ভাই, তোমাকে আমি ছাড়বো না। তুমি আমাকে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছো।
রেজুয়ান মুজাহিদকে ধরতে গেলে মুজাহিদ ছুটে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২২
-আমাকে যে ছুঁবে সে কালা কুত্তার গু খায়। আর তারপর ও যদি ছোঁবে, তারেক গো বাড়ির পুরান পায়খানার গু খায়।
– আজ এই সব কিছু দিয়ে স্পেশাল রেসিপি করে তোমাকে খাওয়াবো। দাঁড়াও আজ।
-তুই কোন আকাম করে, গোসল করছস আর আমার নামে অপবাদ দিতাছস? তুই তো শুধু গু না সাথে গোবর খাওয়ার ও যোগ্য।