হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৫
তোয়া নিধী দোয়েল
আদনান মসজিদ থেকে আসার পথে, কাদের বাড়ির আঙিনায় থেকে যেনো বেলি ফুল তুলে এনেছে। হুমাইরার কাছ থেকে সুই-সুতা নিয়ে, পকেট থেকে একটা একটা করে ফুল বের করে মালা গেঁথে যাচ্ছে। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। রুম অন্ধকার। তুর্কি কি ঘুমিয়ে পড়েছে! ও রুমে ঢুকে সুইচ-বোর্ডে আঙুল চালিয়ে লাইট অন করে। নাহ্,! তুর্কি ঘরে নেই। ও কপালে ভাঁজ ফেলে রুম থেকে বের হয়। মোহোনা সূচনার ঘরে গিয়ে ও খোঁজ নেয়। না ওই খানেই ও নেই। ও কিছু ভেবে ছাদের দিকে আসতে থাকে। পকেট থেকে একটা একটা ফুল বের করে, মালা গাঁথার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
তারকাখচিত আকাশ। তবে চন্দ্রহীন। হাজার হাজার নক্ষত্ররাজি, নিকষ কালো আকাশের বুকে জ্বল জ্বল করছে। মৃদু বাতাস বইছে চারিপাশে। ছাদের গাছ গুলো মাঝে মাঝে ভীষণ ভাবে মাথা দোলাচ্ছে। ছাদের রেলিং এ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্কি। রাতের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে।
ঐ লোক ঘুমানো না পর্যন্ত ও রুমে ঢুকবে না। ওর পরনের শাড়ির, লম্বা আঁচল ছাদের মেঝে ছুঁই ছুঁই। লম্বা চুল গুলো, কাটার যাঁতাকল থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। তাঁরা বাতাসের দরুন নিজেদের মত উড়ছে।
হঠাৎ কারো পদশব্দ কানে ভেসে আসতে তুর্কি না দেখে জিজ্ঞাসা করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-এখানে কী চাই?
আদনান ধীর কণ্ঠে বলে,
-রাতের বেলা, এই ভাবে চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
স্বভাবতঃ তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দেয়,
-তাতে আপনার কী?।
আদনান দূরে দৃষ্টি মেলে আবার ও শুধায়,
-ওই দূর রাস্তায় হাঁটতে যাবে?
তুর্কি আড়চোখে আদানানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-নাহ্।
এই বলে আদনানের পাশ থেকে সরে দোলনায় গিয়ে বসে। ওর লম্বা শাড়ির আঁচল ছাদের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। মৃদু ভাবে দোলানায় ধাক্কা দিয়ে দুলতে থাকে। আদনান তুর্কির দিকে ঘুরে, ধীর পায়ে হেঁটে ওর দিকে আসে। তুর্কির সামনে, ছাদের মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসে। হাতের বেলি ফুলের মালা পাশে রাখে। আদনান ওর লম্বা শাড়ির আঁচল উঠিয়ে নিজের ডান হাতে প্যাঁচ দেয়। বাম হাতের সাহায্যে, ডান হাতে শাড়ির আঁচল গিট দেয়। তুর্কি অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-কি করছেন?
আদনান শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমার সব ভুলের জন্য সরি। আমার তখন ঐ রকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-কোন রকম?
-ওই ছেলেটার সামনে, ঐ ভাবে সিনক্রেট করা উচিত হয়নি। আসলে…
-হয়েছে। আমি আর শুনতে চাই না। শাড়ির আঁচল ছাড়ুন।
মুখ ঘুরিয়ে বলে তুর্কি। আদনান ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস, ওদের ছুঁয়ে যায়। আদনানের মাথার চুল, সেই বাতাসে তিরতির করে উড়তে থাকে। তুর্কি আদনানের চাওনি দেখে অস্বস্তি বোধ করে। ও দুই পা দোলনার উপর উঠিয়ে বসে। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর আদনান শান্ত কণ্ঠে বলে,
-দুঃখিত।
-আমার কাছে কেনো চাচ্ছেন? আপনার এক্স এর কাছে চান।
আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-আমার এক্স মানে?
তুর্কি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
-জানিনা।
-আচ্ছা এইটা নিয়ে তোমার রাগ?
তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না।
আদনান আবার বলে,
-কোহেলি আমার এক্স এই কথা কে বলেছে?
তুর্কি মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বলে,
-আপনার ভাই।
-মীম!
প্রত্যুত্তরে তুর্কি কিছু বলে না। আদনান, দীর্ঘ শ্বাস নেয়। আজ রেজুয়ানের এক দিন কি ওর এক দিন। তাহলে ওকে ক্ষেপিয়েছে বলে ও তখন ঐ রকম পাগালামী করেছে। আর তুর্কিকে ওই ভাবে দেখে ওর মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো। যার জন্য ও ও-ওর তালে তাল দিয়ে ঐ রকম ব্যবহার করেছে।
-সেই জন্য তখন ঐ রকম পাগলামি করেছো?
-কিসের পাগলামি? আপনি বিয়ের পর ও এক্স এর সাথে রং করেবেন, পরিক্ষার গার্ড আছে বলে, মিথ্যা কথা বলে ঘুরবেন, আর আমি কিছু করলে দোষ?
কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে শুধায় তুর্কি। আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-এই সব মীম বলেছে?
তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না। তার মানে এই সব উল্টা-পাল্টা রেজুয়ান বুঝিয়েছে। আজ ওর খবর আছে। আদনান শান্ত কণ্ঠে বলে,
-আচ্ছা শোনো। কোহেলি হচ্ছে, আমার ফুপাতো বোন। কলেজে এক সাথে পড়েছি। তবে, ভার্সিটি দুজনের ভিন্ন।
মানুষের তো পছন্দের তালিকা থাকে। তাইনা? তো কোহেলির পছন্দের তালিকায় আমি ছিলাম। যার জন্য ফুপু বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। তবে মা-র ঘোর আপত্তি ছিলো।
-আপনি ও তো পছন্দ করতেন।
বাজখাঁই কণ্ঠে বলে তুর্কি।
-আগে শেষ করতে দেও।
আমি বলেছি ও আমাকে পছন্দ করতো। আমি না। যার জন্য এই বিয়েতে আমি ও রাজি ছিলাম না। যার জন্য বিয়েটা হয়নি।
-তাহলে আপনার ভাই কেনো বললো, উনি আপনার এক্স?
আদনান মৃদু হেসে বলে,
-ও তোমাকে ক্ষেপিয়েছে। আমাদের মধ্যে এমন কিছুই ছিলো না।
-তাহলে তখন উনার ব্যাগ নিয়ে; ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো?
-ওর হিলের বেল্ট খুলে গেছিলো। ব্যাগ থাকার জন্য লাগাতে পারছিলো না। সেই জন্য আমার হাতে দিয়েছিলো।
তুর্কি আবারও কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বলে,
-এত মানুষ থাকতে আপনাকেই পেলো ব্যাগ হাতে দেওয়ার?
-ঐখানে আর কেউ ছিলো না।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে। আদনান উঠে আবার ওর ফেরানো মুখের দিকের সামনে গিয়ে বসে।
– ওকে, আই আম সরি। আর কখনো ঐ রকম হবে না।
আদনানের অবস্থা দেখে তুর্কির আবারও ভীষণ হাসি পায়। তবে এইবার ও হাসি চেপে রেখে বলে,
-সরুন।
আদনান তুর্কির কোলে রাখা হাত স্পর্শ করে বলে,
-এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বললাম, সত্যি আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। শুধু ও কেনো, বিয়ের আগে কখনো কোনো মেয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না।
তুর্কি হাত সরিয়ে নেয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
-হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। দেখুন, আমি আপনাকে নিয়ে মোটেও জেয়ালার্স না। কিন্তু, আপনাকে অন্য কারো পাশে দেখলে, অন্য কারো সাথে কথা বলতে দেখলে, আমার আপনাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করে। মনে চায় আপনাকে পিস পিস করে ফেলতে।
তুর্কির কথা শুনে আদনান শব্দ করে হেসে উঠে। তুর্কি আদনানের হাসির শব্দ শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
-হাসছেন কেনো আপনি? হাসির কি বললাম?
আদনান হাসি থামিয়ে বলে,
-আচ্ছা!
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে,
-ওরা সব রাজনীতির পোলাপান, ভীষণ পাজি। তোমাকে ওই ছেলে গুলোর সামনে দেখে অস্থির হয়ে গেছিলাম। সেই জন্য ঐ রকম সিনক্রেট করে ফেলেছি। আই আম সরি।
– হয়েছে, হয়েছে।
আদনান মেঝে থেকে ফুলের মালা উঠিয়ে, তুর্কির হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
-আর কখনো ঐ রকম পাগলামি করবে না। রাগ হলে আমার উপর দেখাবে, আমাকে কথা শোনাবে।
-ওহ্, তাহলে আপনি জেয়ালার্স ফিল করেন। আমি কারো সাথে কথা বললে?
আদনান ওর চুল ছেড়ে ওর দিকে, এক পাশ হয়ে ঝুঁকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-সেটা কি তোমাকে বোঝাতে হবে?
আদনানের কণ্ঠস্বর শুনে ভড়কে যায় তুর্কি। অন্ধকারের মধ্যে আবছা আবছা দেখতে পায় আদনানের মুখ। ও ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলে,
-নেক্সট টাইম, আমি ব্যতিত অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলে, রাস্তায় যতগুলো ছেলেকে পাবো, সবাইকে ফ্রেন্ড বানিয়ে নেবো। মনে থাকে যেনো।
আদনান ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,
-থ্রেট করছো?
তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-না না, থ্রেট করবো কেনো। এই সব মুখে বলা কাজ আমি করি না। যেটা বলি সেটা করার চেষ্টা করি।
আদনান ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ করে। দোলার ডান পাশে হেলান দিয়ে বসে। তুর্কি ও নড়েচড়ে, দোলনার বাম পাশে হেলান দিয়ে বসে। মৃদু ভাবে দুলতে থাকে দোলনা। রাতের নিস্তব্ধতা দুজনের মাঝে বিরাজ করে। আদনানের হাতে তখন ও তুর্কির লম্বা আঁচল বাঁধা। দু’জন মূক হয়ে রাতের আকাশ, স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করে। বেলি ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসতে তুর্কি লম্বা চুলের বেনি সামনে আনে। মালায় হাত দিয়ে বলে,
-মালা কই পেলেন?
-মসজিদ থেকে আসার সময়; দূর্গা পিসির বাড়ির আঙিনায় থেকে ফুল নিয়ে এসেছিলাম। তারপর আমি নিজেই গেঁথেছি।
তুর্কি চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-চুরি করে?
আদনান তুর্কির দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
-বউয়ের জন্য কিছু চুরি করলে, সেটা চুরি করা হয় নাকি? সেটা তো বিশাল পূণ্যের কাজ। তুমি বোধহয় জানো না।
তুর্কি মৃদু হেসে বলে,
-তাহলে প্রতিদিন আমার জন্য কিছু না কিছু চুরি করে আনবেন। ওকে।
আদনান ও মৃদু হেসে বলে,
-জানো ছোট বেলায়, আমি, বাপের ভাই আর মীম মসজিদে যাওয়ার সময়, রাস্তায় যে ফলের গাছই দেখতাম সেই গাছ থেকে ফল পারতাম। মীম ছোট-খাটো ছিলো বলে ওকে সব সময় গাছে উঠাতাম। বাপের ভাই পাহারা দিতো আর আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে, দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে চুরির জন্য মাফ চেতাম। তারপর ফল পেরে দৌড়ে মসজিদে গিয়ে, নামাজ পড়ে আবারও আল্লাহ’র কাছে মাফ চেতাম।
আদনানের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠে। আদনান ও মৃদু হাসে। তুর্কি হাসি থামিয়ে বলে,
-আপনাদের তিনজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ডিং তাইনা। আমার খুব ভালো লাগে। শুধু আপনার বজ্জাত ভাইকে ছাড়া।
-হুম। ছোট বেলা থেকে বাপের ভাইয়ের সাথে বড় হয়েছি। ফ্রেন্ড বলতে ওকেই জানতাম। যা করতাম সব এক সাথে। খাওয়া, ঘুম মানে সব।
-হুম বুঝেছি।
দু’জনের মধ্যে আবারো স্তব্ধতা নেমে আসে। দু’জন আবারো পরিবেশ দেখায় নিমজ্জিত হয়। দোলনা মৃদু দুলছে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস ওদের ছুঁয়ে দিচ্ছি। তুর্কি আকাশ দেখার পাশাপাশি আড়চোখে আদনানকে দেখছে। আদনান আকাশ দেখায় ব্যস্ত। তুর্কির মনে মনে কিছু একটা অনুভব করে। নিজের করা উলটা পালটা কাজের জন্য! আজ ও তো করলো। অথচ লোকটা ওকে কত সুন্দর মানিয়ে নিলো। কেমন যেনো অস্বস্তি অনুভব করে ও। ওর কি একবার সরি বলা উচিত? কিন্তু, কণ্ঠে কোনো এক জড়তা কাজ করছে। হুট করে আদনান ওর দিকে তাকায়। তুর্কির দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে যায়। ও যে আদনানের দিকে তাকিয়ে ছিলো সেটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। ও আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার, আমি না এশারের নামাজ আদায় করিনি। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। চলুন ঘরে যায়।
আদনান দোলনা থেকে উঠে বলে চলো। তুর্কি ও উঠে হাঁটতে থাকে। আদনানের হাতে তখন ও বাঁধা তুর্কির আঁচল। হয়তো দুজনের কেউই খেয়াল করে নি। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির কাছে পৌঁছায়। তুর্কি আগে আগে হাঁটতে থাকে। আর আদনান পেছন পেছন। হঠাৎ তুর্কি দাঁড়িয়ে আদনানের দিকে ঘুরে। খুব দ্রুত বলে উঠে,
– স্যার, সরি। তখন, ঐ রকম করার জন্য। তবে, সেটা শুধু আজকের জন্য। অন্য দিন যদি দেখি আপনি কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেছেন, তাহলে আবার করবো।
এই বলে তুর্কি আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় না। ছুটে নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। তবে, ওর খেয়াল নেই আদনানের হাতে বাঁধা ওর শাড়ির আঁচল। আঁচল বাঁধা হাতে টান পড়তেই, আদনান ও পিছু পিছু ছুটে নামতে থাকে। লম্বা আঁচলে ছোট এক কিশোরী ছুটে চলেছে। আর সেই আঁচলে বাঁধা পড়ে তাঁর স্বামী ও ছুটে চলেছে।
লম্বা বারান্দার পাড় হওয়ার সময় ঘর থেকে বের হয় রেজুয়ান। ওদের এই ভাবে ছুটে আসতে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তুর্কি রেজুয়ানের সামনে এসে থেমে যায়। রেজুয়ান আফসোসের স্বরে বলে,
-হাই আল্লাহ্! কত রোমান্টিক। ইসসস! আজ একটা বউ নেই বলে, এই ভাবে শাড়ির আঁচলে হাত বেঁধে দৌড়াতে পারি না। হে মাবুদ! এই এতিম কে একটু দেখো। একটা মেয়ে জুটিয়ে দেও কপালে।
তুর্কি রেজুয়ানের কথা শুনে দ্রুত পেছনে তাকায়। ওর শাড়ির আঁচল যে, আদনান নিজের হাত বেঁধেছিলো তা ওর একটু ও খেয়াল নেই। ও দ্রুত আদনানের হাত থেকে খুলে ছুটে ঘরে চলে যায়। আদনান রেজুয়ানের দিকে ক্রোধ নিয়ে তাকায়। আজ এই ফাজিলের এক দিন কি ওর এক দিন। এই ফাজিলের জন্যই ওর বউ ক্ষেপেছিলো।
রেজুয়ান তুর্কির যাওয়া দেখে বলে,
-সরি, ভাই তোদের রোমান্টিক মুহূর্তে বাধা দিলাম।
আদনান ওর দিকে এক পা এক পা এগোতে এগোতে বলে,
-আজ তোর এক দিন কি আমার একদিন। তুই আমার বউকে কি বলেছিস? কোহেলি আমার এক্স। ওর সাথে আমার রিলেশন ছিলো। পরিক্ষার গার্ডের কথা বলে, ওর সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছি?
রেজুয়ান ঢোক গিলে বলে,
-না ভাই….।
আদনান ওকে ধরতে গেলে ও ছুট লাগায় মুজাহিদের ঘরে। আদনান ও ওর পিছু পিছু ছুটতে থাকে।
মুজাহিদ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পিয়ানো মুছিলো। তাঁর ভীষণ ভালো-লাগার জিনিস এইটা। বছরে কয়েকটা স্পেশাল তারিখে, সে এই পিয়ানো বাজায়। কাল একটা স্পেশাল তারিখ। তাই সেই প্রস্তুনিচ্ছে।
রেজুয়ান ‘বাপের ভাই, বাপের ভাই। বাঁচাও!’ বলতে বলতে রুমে ঢোকে। পেছন থেকে আদনান ধাওয়া করতে করতে আসে। রেজুয়ান মুজাহিদের পেছন লুকায়। মুজাহিদ মুখে ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে,
-তোরা এই রাতের বেলা, এই ভাবে দৌড়া-দৌড়ি করতেছস কেন?
-বাপের ভাই, সরও। ওকে আমার হাতে তুলে দেও। ও ভীষণ ফাজিল হয়ে যাচ্ছে।
-বাপের ভাই, বাপের ভাই, বিশ্বাস করো আমি কিছু করি-নি।
মুজাহিদ রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-তোকে বিশ্বাস করার চেয়ে, পেঁপে গাছের কাঠ দিয়ে খাট বানানো ভালো।
রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– পেঁপে গাছের আবার কাঠ হয়!
-পেঁপে গাছের কাঠ না হলে ও, আজ তোকে তক্তা বানানো। বাপের ভাই সরও।
-কি করছে আগে বল। তাহলে ওরে মারতে আমি ও সাহায্য করি।
আদনান রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে, রাগে কটমট করতে করতে বলে,
-এই ফাজিলে, আমার বউয়ের কাছে বলছে, কোহেলি নাকি আমার এক্স। ওর সাথে নাকি আমি প্রেম করছি। আজ পরিক্ষার গার্ড আছে, এই মিথ্যা বলে ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। আর আমার বউকে তো চিনোই, কেমন ক্ষ্যাপা ধরনের। ওর ওই কথা শুনে রাগের মাথায়, কাকে যেনো প্রোপজ করতে গেছিলো। বলো ওকে এখন কি করা উচিত।
রেজুয়ান মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-বাপের ভাই, আমার বিয়েতে যত টাকা যৌতুক আনবো, তাতে থেকে ফিফটি পার্সেন্ট তোমাকে দেবো। তবু ও আমাকে আজ বাঁচাও।
মুজাহিদ আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
-আদনান, তোকে আমার বিয়ের সময়, আনা যৌতুকের ফিফটি দেবো। তুই আগে ওকে ধোলাই দে।
এর পর মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘাড় ধরে সামনে আনে। আদনান মুজাহিদক ইচ্ছামত ওকে ধোলাই দেয়। রেজুয়ান পিঠ বাঁকা করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
-উ রে..। আর কোনো দিন ভাবির পিছনে লাগবো না। আল্লাহরে!
মুজাহিদ আবারো নিজের কাজে মন দেয়। আদনান পাশে চেয়ার টেনে বসে। রেজুয়ান আবার বলে,
-বাপের ভাই, তুমি কেনো মারলা? ভাই তো বউয়ের জন্য মারলো।
-তুই সব সময় আমার বিয়ে করা নিয়ে মাথা ঘামাস তাই।
-সব মীরজাফরের বংশধর। এত সাহায্য করি তবু ও আমাকে এই ভাবে মারলা।
রেজুয়ানকে উপেক্ষা করে, আদনান মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-হঠাৎ পিয়ানো পরিষ্কার করছো?
-কাল ১৪ ফেব্রুয়ারী।
আদনান কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-ভালোবাসা দিবস?
মুজাহিদ মৃদু হেসে বলে,
-ববিতার জন্মদিন!
আদনান বিষ্ময় কণ্ঠে বলে,
-ওহ্! ভুলে গেছিলাম।
রেজুয়ান ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
-বা*লের কপাল আমার। ভাইয়ের বউ আছে বলে, কাল ওদের জন্য ভালোবাসা দিবস। বাপের ভাইয়ের এক্স আছে বলে, এক্স এর জন্মদিন দিবস। আর আমার বা* কপালে বউ তো দূর, একটা এক্স পর্যন্ত নাই। তাই, আমার জন্য কাল, কুত্তা মরা সিংগেল দিবস।
মুজাহিদ পিয়ানো মুছতে মুছতে বলে,
-কেন? তোর কাঠগোলাপের কি হইছে?
রেজুয়ান দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
-আর কাঠগোলাপ, তার তো দেখাই পাইনা।
আদনান বলে,
-তোর কপালে, আমার লাত্থি ছাড়া আর কিছুই নাই। যদি আর কোনো দিন কোনো উল্টা-পাল্টা কিছু আমার বউয়ের কানে দেস, তোর বিয়ে করা কানা করে দেবো।
ফজরের কিছু আগ মুহূর্ত। আদনান ফ্রেশ হয়ে টেবিলের উপর টাওয়েল রাখে। দৃষ্টি পরে তুর্কির উপর। রেজুয়ানের কথা শুনে ওদের মাঝে আর কথা হয়নি। মেয়েটাকি লজ্জা পেলো? এত চঞ্চল মেয়ে আবার লজ্জা ও পায়।
তুর্কি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আদনান স্ট্যাডি টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। ড্রয়ার থেকে একটা লাল রঙের পেজ বের করে। পেন-হোল্ডার থেকে একটা কলম নিয়ে কিছু লিখতে শুরু করে।
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই, লেখা শেষ করে। কাগজ টা ভাজ করে ড্রয়ারে ভেতর রাখে। নিত্য দিনের মত তুর্কিকে ডেকে তুলে, ও মসজিদে চলে যায়। তুর্কি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে আসে। নামাজ আদায় করে পড়ার টেবিলে বসে। এখন আর নামাজ আদায় করার ঘুম পায় না। তবে, পড়তে ও বসতে ইচ্ছা করে না। পড়া লেখা এত বেদনাদায়ক কেনো? ও ভেবে পায় না। ও বই খুলে, কলম মুখে নিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে।
বেশ অনেক্ষণ পর, নামাজ শেষ করে ঘরে আসে আদনান। হাতে নাম না জানা একটা ফুলের ডাল। তুর্কিকে টেবলের সামনে বসে থাকতে দেখে ফুলের ডালটা নিয়ে সেখানে যায়। খোলা বইয়ের উপর আদনান, ফুলের ডালটা রাখে। তুর্কি অবাক চোখে তাকিয়ে আবার আদনানের দিকে তাকায়। আদনান পরনের পাঞ্জাবি খুলতে থাকে। তুর্কি মৃদু হেসে ফুলের ডালটা হাতে নিয়ে বলে,
-কী ফুল এটা?
-জানিনা।
আদনান পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে তুর্কির পাশে থেকে কিছু পেপার নিতে নিতে বলে,
– সকাল সকাল একটা পুণ্যের কাজ করলাম।
তুর্কি ঠোঁট টিপে হাসে। আদনান পেপার গুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে,
-আমি এই পেপার গুলো দিয়ে আসছি।
আদনান ঘর থেকে বের হতেই তুর্কি পড়া ছেড়ে উঠে। এই ঘোড়ার ডিমের পড়া লেখা ওর একটু ও ভালো লাগে না। কিন্তু, এইটা আদনানকে বোঝাতে হবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদনানের বেরিয়ে যাওয়া পরখ করে। তার পর ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়।
তুর্কি চায়ের কাপ হাতে মুজাহিদের ঘরে আসছে। বিশাল বারান্দা পেরিয়ে মুজাহিদের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। মনের মাধুর্য মিশিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইছে। মুজাজিদের ঘরে, তুর্কি অনুমতি না নিয়ে যায় না। তবে, আজ অনুমতি চাওয়া প্রয়োজন বোধ করলো না। ভিড়ানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো।
মুজাহিদ বিশাল জানালার সামনে বসে, বাইরের দিকে তাকিয়ে, আঙুল দিয়ে পিয়ানোর চাবি চালাছে। আর এক মনে গেয়ে যাচ্ছে,
‘মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন…
লুকালে না পাই অন্বেষণ,
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন..
লুকালে না পাই অন্বেষণ,..
আমি কালারে হারায়ে তেমন
আমি কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে….
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে..
আমার মনের মানুষের সনে..
আমার মনের মানুষের সনে…!
এইটুকু গেয়ে আবার, পিয়ানোর চাবি চালিয়ে সুর তুলতে থাকে। তুর্কি ধীর পায়ে হেঁটে মুজাহিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চায়ের কাপ টেবিলের উপর রাখে। মুজাহিদ এক মনে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। সে হয়তো খেয়াল করেনি তুর্কি-কে।
রেজুয়ানকে ঘরে ঢুকতে দেখে, তুর্কি সেই দিকে তাকায়। রেজুয়ান অদ্ভুত হাসি দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। তুর্কি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। রেজুয়ান বিছানার পাশ থেকে মশারি হাতে পেচিয়ে, কালকে ওদের দৌড়ানোর অভিনয় করতে থাকে। রেজুয়ানের অভিনয় দেখে তুর্কি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কত অসভ্য এই ছেলে। তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মুজাহিদ আবার পরের কলি গাওয়া শুরু করে,
‘যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়-
যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়-
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
এইটুকু বলে একটু থামে। একটু সুর তুলে পরের টুকু গাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই, অন্য এক পুরুষালী কণ্ঠ থেকে পরের টুকু ভেসে আসে
‘ঐ প্রেম যে করে সে জানে..
ঐ প্রেম..
যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে…।’
পরিচত কণ্ঠস্বর কানে আসতেই তুর্কির বুক ধক করে উঠে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আদনান এইটুকু গাইতে গাইতে মুজাহিদের দিকে আসছে। তবে, দৃষ্টি ওর দিকে স্থির। আদনানের দৃষ্টি দেখে তুর্কি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত অন্য দিকে তাকয়ে মৃদু হাসে। দুই চাচা-ভাতিজা এক সাথে গেয়ে উঠে,
‘মিলন হবে কত দিনে…
মিলন হবে কত দিনে….
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে..
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে..!’
দুইজনে এইটুকু বলে শেষ করে। তবে, আদনানের দৃষ্টি তুর্কির উপর। মুজাহিদ পিয়ানোর চাবিতে শেষ চাপ দিয়ে সুর শেষ করে। রেজুয়ান সিলিং এর দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠে,
‘ঐ প্রেম কেনো আমার কপালে নাই….
ঐ প্রেম কেনো আমার কপালে নাই
আমার কেনো মনের মানুষ হয় নাই..!’
সবাই ওর উল্টা-পাল্টা গানকে উপেক্ষা করে। মুজাহিদ আদনানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
-আরে বাচ্চা, অনেক দিন পর সুর তুললি।
আদনান তুর্কির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুজাহিদকে আলিঙ্গন করে, ফিসফিসিয়ে বলে,
-তোমার না পাওয়া মানুষটার জন্মদিনের শুভেচ্ছা, বাপের ভাই।
মুজাহিদ মৃদু হেসে ওর পিঠে চাপড় দেয়। তুর্কি এগিয়ে এসে বলে
-অসাধারণ চাচু! আপনি এত সুন্দর গান গাইতে জানেন।
মুজাহিদ মৃদু হেসে বলে,
-ওই একটু একটু, মাঝে মাঝে গাই।
বিছানা থেকে রেজুয়ান হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,
-লাইফে একটা বউ, একটা এক্স থাকলে আমি ও গাইতে পারতাম। ইসসস! কবে যে হবে।
আদনান রেজুয়ানের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
-কাল রাতের মার গুলাতে বোধহয় তোর হয়নি। আরও কিছু দিতে হবে তাইনা?
রেজুয়ান এক লাফে, বিছানার এক দম কর্নারে গিয়ে বলে,
-তোমরা কেনো যে আমার দুঃখটা বুঝো না। বুঝবা কি ভাবে, আমার মত সিংগেল তো আর তোমাদের থাকতে হয় না।
-হুম। মাসে মাসে গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ করা মানুষ সিংগেল! এইটাই তো দুঃখ তাইনা।
এই বলে বিছানা থেকে একটা বালিশ উঠিয়ে, রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়।
কলেজে যাওয়ার জন্য আদনান রেডি হচ্ছে। তুর্কি ও খাবার শেষ করে ঘরে আসে রেডি হওয়ার জন্য। আয়নার দিকে চোখ পড়ে আদনানের উপর। তুর্কি বোরকা হাতে নিয়ে খুস খুস করে কেশে; আদনানের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। আদনান আয়না থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। তুর্কি সেফটিপিন খোঁজার বানায় অন্য দিকে ফিরে বলে,
– স্যার, আপনি এত সুন্দর গান পারেন?
আদনান মৃদু হেসে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
-একটু একটু।
-কই আমাকে কখনো শোনালেন না তো।
আদনান টেবিলের উপর থেকে সেফটিপিনের বক্স নিয়ে তুর্কির সামনে ধরে।
-সব সময় ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করো। কখন শোনাবো?
তুর্কি আদনানের হাত থেকে বক্স নিয়ে আয়নার সামনে যায়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-যুদ্ধ যেনো আমি একাই করি। আপনি যেনো করেন না।
আদনান দুই পকেটে হাত গুঁজে, তুর্কির দিকে তাকায়। আয়নায় দুজনের দৃষ্টি মিলন হলে, আদনান বলে,
-ওকে। কখনো সময় হলে শোনাবো। এখন ফাস্ট করো। লেট হয়ে গেছে।
কলেজ শেষে আদনান তুর্কি বের হয় তৃপ্তি প্লাজারের উদ্দেশ্যে। তুর্কির কিছু জিনিস লাগবে সেই গুলো কিনতে যাবে। কলেজের সামনে থেকে ওরা একটা রিকশায় উঠে। দেবেন্দ্র কলেজ থেকে তৃপ্তি প্লাজার বেশি দূরে নয়।
রিকশা এসে থামে তৃপ্তি প্লাজার সামনে। ভাড়া চুকিয়ে কসমেটিকসের দোকানের দিকে যায়। কসমেটিকসের প্রায় দোকানে মেয়ে বিক্রেতা। তাই দোকানের দিকে যেতে যেতে, তুর্কি আদনানকে ফিসফিসিয়ে বলে,
-আমি বলা না পর্যন্ত দোকানের ভেতরে ঢুকবেন না ওকে।
-কেনো?
তুর্কি বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-আমি বলেছি তাই।
আদনান আর কিছু বলে না। ও পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রোল করতে থাকে। তুর্কি দোকানের ভেতর গিয়ে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজতে থাকে। আবার আড়চোখে আদনানকে দেখতে থাকে।
তুর্কি কিছু লিপস্টিকের শেড দেখতে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানকে ডাকে।
– স্যার, একটু এই দিকে আসুন তো।
আদনান ফোনের উপর দৃষ্টি রেখে ওর কাছে যায়। তুর্কি কয়েকটা লিপস্টিক নিয়ে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার, আপনার হাতটা একটু দ্যান তো।
আদনান তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-কেনো?
-আরে লিপস্টিকের শেড দেখবো। দ্যান।
আদনান হাত মুঠ করে তুর্কির দিকে দেয়। তুর্কি একটা একটা লিপস্টিক বের করে, আদনানের হাতের কবজির উপরে একটু একটু দিয়ে শেড দেখতে থাকে। আদনান অন্য হাত দিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে থাকে। বেশ কয়েকটা শেড হাতে দেওয়ার পর তুর্কি আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যার, দেখুন তো। কোন শেড টা বেশি সুন্দর।
আদনান ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকায়। কয়েকবার দেখে একটা গাঢ় লাল টকটকে শেড পছন্দ করে।
-এইটা নেও।
তুর্কি ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আল্লাহ্! এত লাল? আপনার এত লাল জিনিস পছন্দ কেন?
আদনান তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-কেনো সুন্দর না? বাপের ভাই বলে, সুন্দর মানুষদের লাল জিনিসে বেশি সুন্দর লাগে।
দোকানে থাকা মেয়েটি ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
– হ্যাঁ, ম্যাম। স্যারের চয়েস আছে। এই শেডে আপনাকে খুব সুন্দর লাগবে।
আদনানের মুখে ‘সুন্দর মানুষ’ কথাটা শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জা পায় তুর্কি। খুস খুস করে কেশে বলে,
-আচ্ছা আপু, এইটাই দেন।
মেয়েটা লিপস্টিক প্যাক করতে যায়। তুর্কি আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
-আপনাকে সবার সামনে সুন্দর বলতে বলেছে কে?
আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কেনো? সমস্যা কি?
তুর্কি অন্য দিকে তাকিয়ে বলে,
– না। কিছু না। এমনি।
তুর্কি দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে নেয়।
-ঐ গুলা কি?
আদনান তুর্কির পাশে তাকিয়ে, ঝোলানো কিছু পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলে। তুর্কি আদনানের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকয়ে বলে,
-কোন গুলা?
আদনান ওর পাশ থেকে একটা পায়েল বের করে। তুর্কি পায়েলটা দেখে বলে,
-পায়েল।
আদনান ভ্রু কুঁচকে পায়েলটাকে দেখতে দেখতে বলে,
-দেখা যায় নুপুরের মতো।
– হ্যাঁ। এই গুলাও পায়ে পড়ে।
– এটা ও নেও। আমার এইটা ভালো লেগেছে ।
আদনান ওইটা তুর্কির হাতে দিয়ে আরেকটা বের করে। তুর্কি বাধা দিয়ে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৪
-পায়েল তো এক পায়ে পড়ে।
-কেনো? দুই পায়ে পড়লে সমস্যা কি?
তুর্কি আদনানের দিকে হতাশার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। এই লোককে কিছু বোঝানো দায়। তাই, তুর্কি আর কোনো কথা বাড়ায় না। ও জানে এই লোককে বললেও শুনবে না। আদনান ওর পছন্দ মত পায়েল দুইটা তুর্কির হাতে দিয়ে বলে,
-প্যাক করতে বলো।