হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৬
তোয়া নিধী দোয়েল
তিমির রাতের আকাশে অর্ধচন্দ্র। তবু ও তা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। ছোট ছোট তারকারাজি চকচক করছে আকাশের বুকে। ছাদে বাতাস হালকা জোছনায় মিশে আছে। চারপাশে কেমন ঘুম ঘুম আঁচ।
আর তার মাঝে ধীর পায়ে হাঁটছে আদনান-তুর্কি।মৃদু বাতাসে তুর্কির কপালে থাকা চুল আর শাড়ির আঁচল উড়ছে। আদনানের দিকে ফিরে বলে,
-আপনি বলুন তো, সবসময় কারো পড়তে ইচ্ছে করে? অসহ্য!
কথাটি বলে চোখ ছোট করে তাকায় তুর্কি।
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। তুর্কি ফের বলে,
-শুধু কি হাঁটবেন? আসুন কোথাও বসি। দু’জন জ্যোৎস্না মাখি গায়ে!
আদনান আশে পাশে তাকিয়ে বলে,
– ঐ দিকে চলো।
তুর্কি ঘাড় নেড়ে আদনানের পিছু পিছু যায়। ছাদের এক কর্ণারে একটা লেবু গাছ আছে। গাছটার ডাল পালা বেশ ছড়ানো-ছিঁটানো। গাছটা ভরপুর লেবু ফুল। কিছু লেবু ও ধরেছে৷ রাতের স্বল্প জ্যোৎস্নায় তা দৃশ্যমান হয়েছে।
সেই গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় দু’জন। আদনান দূর থেকে একটা ছোট নষ্ট কাপড় এনে বসার জায়গা পরিষ্কার করে। তার পর দুইজন পাশাপাশি বসে। অর্ধচন্দ্রের মৃদু আলো গলে পড়ে দুজনের অঙ্গে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারিপাশে। বাতাসের সাথে ভেসে আসছে লেবু ফুলের ঘ্রাণ!
– স্যার, আমাকে একটা কথা বোঝান। আমি কষ্ট করে পড়তেছি; যাতে ভবিষ্যতে আমাকে কষ্ট করতে না হয়; এই কষ্টের জীবনে! তাহলে লাভ হলো কী?
আদনানের কোনো উত্তর না পেয়ে, তুর্কি আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে নিক্ষেপ করে। আদনান ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ও তাকাতেই আদনান মুচকি হেসে ওঠলো। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-হাসছেন কেনো?
আদনান ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে নিয়ে বলে,
-তোমাকে দুই বেণীতে বাচ্চাদের মত দেখাচ্ছে! একদম বাচ্চা-বাচ্চা সুন্দর!
তুর্কি ওর দুই বেণী ধরে অবাক কণ্ঠে বলে,
-বাচ্চা-বাচ্চা সুন্দর আবার কীভাবে লাগে?
-মানে ভীষণ আদুরে লাগছে!
তুর্কি মুচকি হেসে আদনানের বাহু চেপে ধরে বলে,
-বাহ্! আপনি আবার আমাকে পরখ ও করেন? আপনার চোখ ম্যাথ ব্যতীত আবার বউয়ের দিকে ও পড়ে!
-তুমি তো সব সময় আমার চোখেই বিঁধে থাকো!
তুর্কি অবাক কণ্ঠে বলে,
-কীইই!
-কিছু না। তারা গুনো। ঐ যে দেখো..!
আদনান আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে বলে। তুর্কি ঠোঁটের হাসি বিদ্যমান রেখে সেই দিকে তাকায়। কিছু মনে হতেই পাশ ফিরে আদনানের ফোন আর মোহনার ইয়ারফোন হাতে তুলে নেয়। আদনানের কানে একটা ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে অন্য একটা নিজের কানে গুঁজে। আদনান পাশ ফিরে বলে,
-এইটা কার?
-মোহনা আপুর। আপনার টা তো ব্লুটুথ সিস্টেম। ওয়্যার্ড ইয়ারফোনে (তারযুক্ত ইয়ারফোন) দুইজনে গান শোনা যে কত মজা আপনি জানেন না! তাই নিয়ে আসলাম।
তুর্কি ওর একটা পছন্দের গান ছেড়ে আদনানের বাহু ধরে আকাশের দিকে তাকায়। দুই জনের কানে বাজতে থাকে একটা গান—
‘তুমি আমি কাছাকাছি আছি বলেই,
এ জীবন হয়েছে মধুময় …
যদি তুমি দূরে কভু যাও চলে,
শুধু মরণ হবে আর কিছু নয়.
তোমায় ছেড়ে বহুদুরে যাব কোথায়
এক জীবনে এত প্রেম পাব কোথায়
তোমায় ছেড়ে বহুদুরে যাব কোথায়
এক জীবনে এত প্রেম পাব কোথায়’
মাঝে মাঝে আবার সুর বাজে৷ তুর্কি ওর পেটে জমে থাকা সব কথা বক বক করে আদনানকে বলতে থাকে। আর আদনান মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে সব শ্রবণ করতে থাকে।
ফুলের দোকানের সামনে রেজুয়ানের জন্য অপেক্ষা করছে মুজাহিদ। হাতে ছোট একটা কাঠগোলাপের বুকেট। মুজাহিদ যখন স্কুলে ছিলো; তখন রেজুয়ান কল করে বলেছে একটা কাঠগোলাপের তোড়া কিনে রাখতে। স্কুল ছুটি হওয়ার পর সে সোজা ফুলের দোকানে এসে একটা ছোট সাইজের বুকেট কিনে অপেক্ষা করছে।
অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করার পর ও কোনো পাত্তা নেই ওর। যতবারই কল করেছে শুধু বলছে এই তো প্রায় এসে গেছি! আরও কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর একটা রিকশা এসে থামে মুজাহিদের সামনে। মুজাহিদ এগিয়ে গিয়ে রিকশার ভাড়া দিয়ে; বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-তোর পাঁচ মিনিট শেষ হয় না?
রেজুয়ান ফুলের বুকেট টা দেখে চেতে যায়। মুজাহিদের হাত থেকে বুকেট নিয়ে ও-ও বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-কী বাল কিনছো এইটা? এই রকম প্যাকেটের মধ্যে কেন?
মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
-তাইলে কেমন তা চাইছিলি?
রেজুয়ান বুকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে,
-কাঠগোলাপের তিনটা পাতা নিয়ে আসো।
মুজাহিদ বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-পাতা পাবো কই?
রেজুয়ান সম্পূর্ণ বুকেট টা ছিঁড়ে শুধু ফুল গুলো বের করে বলে,
– চত্বরে পাওয়া যায়। বিশাল বড় গাছ আছে। ঐখান থেকে তিনটা পাতা নিয়ে আসো।
-সর। পারুম না। বাড়ি যাবো আমি। ক্লান্ত লাগতেছে।
এই বলে হাঁটা দেয় মুজাহিদ। রেজুয়ান পিছন থেকে মুজাহিদ এর পাঞ্জাবি টেনে ধরে বলে,
-এমন কইরো না বাপের ভাই। প্লিজ! কাঠগোলাপ এতক্ষণে এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি করো।
মুজাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-তুই পাতা দিয়ে কী করবি? সেটা বুঝা আমাকে।
-আরে তিন পাতা দিয়ে একিটা ঠোঙা বানাবো। ঐ ঠোঙার ভেতরে ফুল গুলো নিবো। তুমি যাও তো।
ইচ্ছা থাকা না সত্ত্বেও চত্বরে দিকে পা বাড়ায় মুজাহিদ। ফুলের দোকান থেকে চত্বর বেশি দূর নয়। দুই মিনিট এর পথ।
বেশ অনেক্ষন পর তিনটা পাতা নিয়ে দ্রুততরে হেঁটে আসে মুজাহিদ। পাতা তিনিটা রেজুয়ানের হাতে দিয়ে বলে,
-আরেকটু হলে গার্ড আমারে ধরে গাছের সাথে বেঁধে রাখতো। ফাজিল এর জাত। তোগো জন্য যে আর কত পাপ করা লাগবো আল্লাহ্ জানে!
রেজুয়ান তিন পাতা দিয়ে একটা ঠোঙা আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুল গুলো রাখে। মুজাহিদ ও-কে বিদায় জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়। রেজুয়ান ফুল গুলো হাতে নিয়ে হাঁটা ধরে স্টেডিয়ামের মাঠের উদ্দেশ্যে।
মাঠের এক কর্ণারে বসে রয়েছে উপমা। ছেলেরা মাঠে ফুটবল খেলছে। তাই নীরব দর্শকের মত উপভোগ করছে ও। রেজুয়ান পিছন থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
-কাঠগোলাপ!
উপমার হৃদস্পন্দন কিঞ্চিৎ দ্রুততর হয়! ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পিছনে৷ রেজুয়ান হাতের ফুল গুলো নিয়ে উপমার পাশে বসে৷ শান্ত কণ্ঠে বলে,
-এত জায়গা থাকতে এই মাঠে বসতে গেলে কেনো? কোনো কফিশপে চলো?
উপমা কথা বলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ জড়তা অনুভব করে। তবুও ও গলা পরিষ্কার করে বলে,
-আমার খোলা মাঠ ভালো লাগে।
-আমার ও ভালো লাগে। কিন্তু,
– থ্যাংকিউ!
রেজুয়ান মুচকি হেসে উপমার দিকে তাকায়।
-বাহ্! রেডি হয়েই ছিলে দেখি। আসবো আর বলে দিবে? যাই হোক এইটা তোমার রিটার্ন থ্যাংকস!
ফুল গুলো উপমার দিকে দিয়ে বলে৷ উপমা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমার আবার থ্যাংকস কিসের?
-আরে তুমি যদি বঁটি টা না আনতে তাহলে ঐ জা**
মুখে গালি এনে ও আটকে ফেলে রেজুয়ান। হাত দিয়ে ঠোঁট চাপে বলে,
-সরি। মাইন্ড করো না। যাইহোক এইটা রাখো৷
উপমা ফুল গুলো নিতে কিঞ্চিৎ কুণ্ঠাবোধ করে। কোনো এক জড়তা ও-কে গ্রাস করে ফেলে। ফুল গুলো নেওয়া উচিত হবে কি হবে না সেই দ্বিধায় ভুগতে থাকে। রেজুয়ান ওর দ্বিধান্বীত চেহারা দেখে বলে,
-আরে এইটা তোমার রিটার্ন থ্যাংকস। রাখো৷ তাহলে তোমার থ্যাংকস ও আমি রাখবো। বাদাম খাবে?
রেজুয়ানের কথা শুনে চোখ তুলে তাকায় ও। ওর কঠিন রূপটা কেনো ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। সেই টা ভাবছে। অন্য সময় হলে কিছু কঠিন কথা বলা যেত। কিন্তু, দেখা করার প্ল্যান টা তো ওর ছিলো। ততক্ষণে রেজুয়ান একটা ছোট ছেলেকে ডেকে কিছু বাদাম কিনে। উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-এমন একটা জায়গা চুজ করলে খাওয়ার মত আর কিছুই নেই। আপাতত বাদাম খাও। অন্য কোনো দিন দেখা হলে ভালো কিছু খাওয়াবো।
উপমা একটা বাদাম নিয়ে বলে,
-পরে ওদের ধরেছিলেন? যাঁরা রাতে অ্যাটাক করেছিলো?
রেজুয়ান বাদাম ছিলতে ছিলতে বলে,
-নাহ্! তবে ধরবো। এত দিন পা নিয়ে বেশি বের হতে পারি নি। আমার ভাই, বাপের ভাই কে আঘাত করেছে। ওদের তো এমনি এমনি ছাড়া যায় না।
এই রকম আরও অনেক কথা চলতে থাকে ওদের মাঝে। আধা ঘণ্টার মত কথাবার্তা বলে শেষে উপমা ওঠে। বিদায় জানানোর সময় রেজুয়ানের কাছ থেকে ফুল গুলো নিয়ে যায়!
প্রায় অনেক দিন পর মায়ের সাথে কথা বলে তুর্কি। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর লাইন কাটে। আদনান বাসায় নেই। লাইন কেটে যেই-না ফোন রাখতে যাবে সেই মূহুর্তে— একটা বার্তা দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় ওর। বার্তাটা বোধহয় কোহেলি পাঠিয়েছে!
ও হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে যে আইডি থেকে বার্তা টা এসেছে সেই আইডিটে ঢুকে। হ্যাঁ, ওর ধারণা ঠিক! বার্তাটা কোহেলির-ই। ও ভেবেছিলো হয়তো কলেজ এর কোনো বিষয় নিয়ে। কিন্তু না! কোনো একটা পিক নিয়ে ইনবক্সে এসে কমেন্ট করেছে। বার্তাটা এই রকম—
‘Your profile picture is superb. But I’m suprised— after falling under the influence of a cheap girl, you’re using such a profile!’
( তোর প্রোফাইল পিকচারটা দারুণ হয়েছে। কিন্তু অবাক লাগছে— একটা সস্তা মেয়ের পাল্লায় পড়ে এমন একটা প্রোফাইল পিকচার দিয়েছিস!)
তুর্কি বার্তাটার অর্থ বুঝে, দ্রুত আদনানের প্রোফাইলে ঢুকে। প্রোফাইল পিক দেখে একটু অবাক হওয়ার সাথে ঠোঁটে ফুটে চমৎকার হাসি। সেই দিন অজান্তে যে পিকটা ক্লিক হয়েছিলো— দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে; সেই পিকটা আদনান; হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইল হিসেবে ব্যবহার করছে!
প্রোফাইল টা দেখা মাত্র ও ওঠে একটা লাফ দেয়! এ তো মেঘ না চাইতেই জল! ও আরও মনে মনে ভেবছিলো আদনানের কোনো একটা একাউন্ট দিয়ে ওদের পিক ডে দিয়ে ক্যাপশনে লিখবে— হ্যাপিনেস! আর সেখানে আদনান তো প্রোফাইলে-ই ব্যবহার করছে ওদের পিক দিয়ে।
তবে কোহেলির বার্তাটা মনে হতে লাফালাফি বন্ধ করে রাগে ফুঁসে ওঠে ও। কত্ত বড় সাহস! ওর জামাইয়ের ইনবক্সে এসএমএস করেছে। তাও আবার ও-কে চিপ বলছে! কলেজ এর কোনো ব্যাপার নিয়ে কথা বলতো তা-ও মানা যায়। আর কলেজ এর ব্যাপার হলে ও তা কলেজে না বলে এসএমএস কেনো করবে? অন্য কেউ সহ্য করলেও তুর্কি সহ্য করার পাত্রী নয়! ও লাফালাফি বন্ধ করে বিছানায় বসে কোহেলিকে কল করে। কয়েকবার বাজতেই ওপাশ থেকে কল ধরে কোহেলির কণ্ঠ ভেসে ওঠে,
-কিরে? তোর তো কোনো খবর-ই নেই।
-কেনো? কোষ্টকাঠিন্যে ভুগছেন নাকি? যে আমার জামাইকে কল দিয়ে খোঁজ নিতে হবে?
তুর্কি কথা শুনে গা জ্বলে ওঠে কোহেলির। ও দাঁতে-দাঁত চেপে বলে,
-হে ইউ। মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ! কী বলছো এই সব?
তুর্কি বেশ রসিকতার স্বরে বলে,
-আরে, রায় বাঘিনী নন্দিনী! এত হাইপার হচ্ছেন কেনো? ভাবি হিসেবে আপনার সাথে এই টুকু মজা তো আমি-ই করতেই পারি? আফটার-ওল কলেজের বাইরে তো আমাদের সম্পর্ক তো তাই দাঁড়ায়। তাইনা?
-এই, তোমার সাহস হলো কীভাবে আমাকে কল করার? ম্যানারলেস কোথাকার।
-আরে আরে, এই রাত-বিরেত অন্যের জামাইকে ইনবক্সে এসএমএস করে; তাঁর বউয়ের সম্বন্ধে তাঁর-ই কাছে আজে-বাজে মন্তব্য করা; এই গুলো খুব ম্যানাসের মধ্যে পড়ে? তাইনা নন্দিনী?
-সাট্ ইউর মাউথ্! আই ডোন্ট টক টু ইউ। ফোন রাখো।
-ওয়েট্ ওয়েট্! আমার ও আপনার সাথে টক করার কোনো ইচ্ছে নেই। ব্যাস্! একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন; আমি আপনাকে খুব সম্মান করি। হয়তো সেটা আপনার প্রোফেশোনের জন্য। তবে, সেটা শুধু প্রোফেশোনের ক্ষেত্রে। অন্য ক্ষেত্রে নয়। আমি কিন্তু এত ভালো মেয়ে নয়। আমি আমার জামাই নিয়ে ভীষণ পসেসিভ!
আমার জামাইয়ের দিকে যে তাকাবে, সে মিনিস্টারের মেয়ে হোক কিংবা প্রাইম-মিনিস্টারের মেয়ে, আমি কিন্তু তা গুনতে যাবো না। হতে পারে তাঁর সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে। সো বি কেয়ারফুল। আল্লাহ্ হাফেজ!
এই বলে তুর্কি মুখের ওপর কল কেটে দেয়। যেহেতু আদনানের প্রতি ওর দূর্বলতা আছে; সেহেতু ওর থেকে দূরে দূরে রাখাই ভালো। যুগ টা ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খারাপ কাজে জোড়াচ্ছে মানুষ। আর পরকীয়া তো প্রায় ঘরে ঘরেই। কোন দিক দিয়ে ঢুকে পড়বে জীবনে বলা তো যায় না।
বিছানায় ফোন ফেলে ওড়না নিয়ে আয়নার সামনে যায় তুর্কি। নিজেকে দেখতে দেখতে নিজে নিজে বিড়বিড় করে— খুব এসেছিলো ও-কে ম্যানাস শিখাতে! তাও আবার জামাই নিয়ে। জামাইকে প্রোটেক্ট করতে হলে ও শতবার ম্যানারলেস হতে পারে। তবুও জামাইয়ের প্রোটেকশন নিয়ে নো-কম্প্রোমাইজ।
আদনান ঘরে ঢুকে দেখে তুর্কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচ্ছে। ও এক ভ্রু উঁচু করে বলে,
-পড়া বাদ দিয়ে নাচা-নাচি করছো কেন?
আদনানের কথা শুনে মুখে বিরক্তির ছাপ পড়ে তুর্কির। ও ওড়না গায়ে জড়িয়ে আদনানের দিকে ঘুরে বলে,
-আপনার মুখে পড়া ব্যতীত আর কিছু আসে না? একটু সুন্দর করে ডাকতে পারেন না? ‘ওগো শুনছো এই দিকে আসো’!
শেষ বাক্যটা একটু সুরেলা কণ্ঠে বলে তুর্কির। আদনান ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
– ওগো শুনছো, মাননীয় চিন্তামুক্ত অতিরিক্ত উত্তেজিত নাগরিক, আপনার ১ তারিখ থেকে পরীক্ষা! আপনি অনুগ্রহ করে নাচানাচি থামিয়ে পড়তে বসুন!
তুর্কি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে একই স্বরে বলে,
-মাননীয় আনরোমান্টিকতা-বিষয়ক অন্তঃপ্রাণ সংবেদনশীল নাগরিক, বউয়ের পড়ালেখা নিয়ে আপনি যে উৎসাহী, তা প্রশংসনীয়। তবে, বাচ্চা-কাচ্চা দের নামতা শেখানোর বয়সে বউকে এত পড়াশোনা নিয়ে চাপ দিচ্ছেন এইটা নিন্দনীয়! তাই অনুগ্রহ করে, আগে বাচ্চা-কাচ্চার কথা ভাবুন।
আদনান ধীর পায়ে হেঁটে এসে তুর্কির সামনে দাঁড়ায়। ওর কানে একটা ফুল গুঁজে দিয়ে স্বভাবতঃ নাকে টোকা দিয়ে বলে,
-বেশি উড়ছো। রিল্যাক্স! এক্সাম টা শেষ হোক। কত পুচকু কে নামতা শেখাতে পারো দেখা যাবে!
তুর্কি ঠোঁট টিপে এসে দুই হাত দিয়ে আদনানের গলা জড়িয়ে বলে,
-জি না। আমি কোনো নামতা-টামতা শেখাতে পারবো না। সব শিখাবেন আপনি। আমি ও দেখবো মানুষ কে কত পড়াতে পারেন আপনি!
তুর্কির কাজে আদনান ঠোঁট উল্টায়। রসিয়ে রসিয়ে বলে,
-সেই দিন তো লজ্জা পেয়ে ছুটে পালালে। আর এখন?
তুর্কি আদনানের গলা ছেড়ে বলে,
-তখন তো নতুন ছিলাম। বিয়ের এত দিন পরেও যদি আমি লজ্জাই পেয়ে যাই; তাহলে আপনার মত নিরামিষাশী লোকের সাথে কীভাবে চলবো? আপনি চাইলে সে দিন যে জিনিসটা বাকি রেখেছিলেন; সেটা নিতে পারেন!
আদনান তুর্কির হাত ধরে বলে,
-পরে। আসো এখন। অনেক গল্প হয়েছে৷ আজ ‘জটিল সংখ্যা’ শেষ করবে।
আদনানের কথা শুনে তুর্কির বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ ফেলে। এই লোক এমন কেনো? কত সুন্দর একটা মূহুর্ত ছিলো! এখন সাত দিন বিশ্রামে যাবে। এই লোক একটা রোমান্টিক কথা বললে সাত দিনের অবসরে যায়!অসহ্য লাগে!
হুমাইরার হাতে হাতে সাহায্য করছে তুর্কি। রচনাকে কোথাও দেখা গেলো না। কয়দিন যাবৎ সে চুপ-চাপ। হুমাইরা তরকারির আনতে রান্নাঘরে যায়। ওপর থেকে ধুপধাপ পায়ে হেঁটে আসে রেজুয়ান। তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভাবিজান, কী অবস্থা? আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না।
তুর্কি প্লেট সাজাতে সাজাতে বলে,
-আপনার ও তো দেখা পাওয়া যায় না। আর পাওয়া যাবেই কীভাবে? আপনার মত লয়াল মানুষ আজ-কাল দেখাই যায় না! কী বলেন?
রেজুয়ান দাঁত বের করে হেসে উপরে নিচে মাথা নাড়ায়৷ আনন্দিত কণ্ঠে বলে,
-তা আপনাকে কে বললো আমি এত লয়াল?
তুর্কি রেজুয়ানের দিকে না তাকিয়েই বলে,
-মীম, সুমাইয়া, ঘুমাইয়া, সাদিয়া, নাদিয়া, পাদিয়া, নুসরাত, ফাতেমা আরও অনেকেই বলেছে! আপনি যে কত লয়াল, তা তো পৃথিবীর সবাই জানে। তাইনা?
ওপর থেকে বেশ শব্দ করে হাসির শব্দ আসে। মুজাহিদ হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে নামে। রেজুয়ানের পাশে বসতে বসতে বলে,
-এক দম ঠিক বলেছো বউ-মা। ও একটু বেশই লয়াল!
রেজুয়ান মুজাহিদের বাহু চেপে ধরে বলে,
– মজা নিচ্ছো বাপের ভাই?
আদনান এসে বলে,
-মজা নেওয়ার কী আছে? যা সত্যি তাই তো বললো।
ধীরে ধীরে টেবিলে আসতে থাকে সবাই। নিত্যদিনের মত হাসি আড্ডায় জমে উঠে রাতের খাওয়ার বৈঠক। সবাই খেতে আরম্ভ করে। তবে, মুমিনুল বেশ দেরি করে নামে। হুমাইরা চেয়ার টেনে বলে,
-রচনা কই? শরীর খারাপ নাকি? সারা দিন নামলো না।
মুমিনুল মুচকি এসে বিষয় টা এড়িয়ে যায়। আলামিন এর দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভাই, একটা কথা ছিলো।
-কী কথা? আগে খেয়ে নে।
মুমিনুল একটু কুণ্ঠাবোধ করে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৫
-না ভাই। এখনই বলি?
আলামিন ভাতের লোকমা মুখে নিয়ে বলে,
-বল।
মুমিনুল গলা ঝেড়ে বলে,
-ভাই, আমার মনে হয় আমাদের সংসার এখন আলাদা করা উচিত!