অতঃপর প্রেমের আগমন গল্পের লিংক || ইরিন নাজ

অতঃপর প্রেমের আগমন পর্ব ১
ইরিন নাজ

সৎ বাবার চা’পে পড়ে আর বড় বোনের সুখের জন্য কোনোরকম মত না থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো আয়ানার। বয়স তার সবে আঠারো সম্পন্ন হলো। এই আঠারো বছরের জীবনে সে কতো কিছুই না সহ্য করেছে! সামনে আরও কতো কি সহ্য করা লাগে ভেবে কান্না পেলো তার।

এইতো ঘণ্টাখানেক আগে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা লোকের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হলো আয়ানার। আর এখন তার রুমেই ঘোমটা টেনে বসে আছে সে। স্বামী নামক মানুষটাকে একবার চোখের দেখাও দেখেনি আয়ানা। তবে তাকে যখন সাজানো হচ্ছিলো তখন কিছু মহিলাদের বলতে শুনেছে পাত্র অনেক বয়স্ক আর ব’দ’মে’জা’জি। পাত্রের ব’দ’মে’জা’জে’র কারণেই নাকি তার বিয়ে হয়নি। এসব শুনে খুব কান্না পেয়েছিলো আয়ানার। চি’ৎ’কা’র করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। চি’ৎ’কা’র করে বলতে ইচ্ছা করছিলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– “আর কতো খা’রা’প করবেন আল্লাহ তার সাথে? আর কতো? তার যে সহ্য হয় না আর…।”
আয়ানার চিন্তার মাঝে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো কেউ। আয়ানা ধারণা করলো হয়তো তার স্বামী এসেছে। ভয়ে নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নিলো সে। প্রেম, বিয়ে এসব সম্পর্কে তার ধারণা একেবারেই কম। বর্তমান যুগের মেয়েদের মতো আধুনিকতার সাথে তার পরিচয় ঘটেনি তাই হয়তো। পড়েছে গার্লস স্কুল আর গার্লস কলেজে।

সবসময় চুপচাপ থাকতো বলে তেমন কোনো বান্ধুবী ছিলো না। তবে কলেজে উঠে একটা বান্ধুবী জুটেছিলো। মেয়েটার নাম ছিলো রিয়া। রিয়া একজন ডিভোর্সি ছিলো। স্বামী অনেক অ’ত্যা’চা’র, মা’র’ধ’র করতো বলে, শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স নেয় । ওকে এসএসসি পাস করার পরপরই বিয়ে দিয়ে দেয়, ওর পরিবার।

কিন্তু স্বামী, শশুড়বাড়ির লোকেদের অ’ত্যা’চা’রে ছ’মাসের বেশি সংসার টিকেনি। এরপর থেকে জীবন যু’দ্ধ শুরু হয় রিয়ার। একটা ছোট চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা শুরু করে নতুন করে। রিয়ার বাবা মাও তাদের ভুল বুঝতে পেরে রিয়াকে সাপোর্ট করে চলেছে। এইসব থেকে বিয়ে সম্পর্কে আয়ানার যতটুকু ধারণা আছে, সবটাই নেগেটিভ।

নিজের মাকে প্রতি নিয়ত স’ৎ বাবার কাছে অ’ত্যা’চা’রি’ত হতে দেখেছে সে। এখন যদি তার স্বামীও তাকে উপর অ’ত্যা’চা’র করে, তাহলে তার কি হবে? তার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই আঠারো বছরের জীবনে কম অ’প’মা’ন, লা’ঞ্ছ’না, মা’র স’হ্য করতে হয়নি তার! এখন যদি স্বামীও এমন করে ভেবে ভয়ে চুপসে গেলো, আয়ানা।
– “এই মেয়ে ঘোমটা তোলো। এসব ফর্মালিটি করতে হবে না। আমার কথা আছে তোমার সাথে।”

কারোর গম্ভীর কণ্ঠে ধ্যান ভঙ্গ হলো আয়ানার। অন্যমনস্ক থাকায় মৃদু কেঁ’পে উঠলো সে। লোকটার কণ্ঠ দারুণ ভাবে আকর্ষণ করলো আয়ানাকে। সে মনে মনে ভাবলো,’কণ্ঠস্বরে নেশালো দ্রব্য মেশানো আছে নাকি? এতো আকর্ষণীয় লাগছে কেনো!’
আয়ানার নড়চড় না দেখে বিরক্ত হলো আদ্রিশ। কিছুটা জো’রে আওয়াজ করে বললো,

– “এই যে কথা কি কানে যায় না? বললাম না, ঘোমটা তোলো।”
ভয় পেয়ে গেলো আয়ানা। কথা না শুনলে যদি মা’র’ধ’র করে ভেবে, দ্রুত ঘোমটা তুলে ফেললো। আদ্রিশ অবাক হয়ে গেলো আয়ানা কে দেখে। নিঃস্বন্দেহে রূপবতী কিন্তু নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। চেহারায় স্পষ্ট বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছে। গাল জোড়া ফুলো ফুলো।

বিয়ের সাজে দেখতে একেবারে বাচ্চা পুতুল লাগছে। আদ্রিশ ভাবলো কোথায় সে উনত্রিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত একজন যুবক আর কোথায় এই বাচ্চা মেয়ে। বয়স বেশি হলে আঠারো কি উনিশ হবে। আয়ানার মতো সেও বিয়ের আগে হবু স্ত্রীকে দেখে নি। এমনিতেই তার প্রেম, ভালোবাসা, বিয়েতে কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। এসবের উপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে গেছে। আর বউ এতো বাচ্চা হবে জানলে সে বিয়েই করতো না যাই হয়ে যাক না কেনো।
আয়ানা একবারের জন্যও মাথা উপরে তোলে নি। আদ্রিশ বিরক্ত হলো। এই মেয়ে কে মনে হয় সব বলে বলে করাতে হবে। আদ্রিশ বললো,

– “হেই ইউ, আমার দিকে তাকাও।”
আয়ানা ভীত হলো। তার অনেকক্ষন ধরেই ইচ্ছা করছিলো এতো সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী পুরুষ কে দেখতে। ধীরে ধীরে মাথা উপরের দিকে করলো আয়ানা। চোঁখের সামনে ভেসে উঠলো একজন সুদর্শন পুরুষের মুখাবয়ব। চেহারায় গম্ভীর ভাব বিরাজমান। শ্যাম বর্ণের সুঠামদেহী পুরুষ।

গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্য সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আয়ানা আদ্রিশ কে দেখে আ’ত’ঙ্কি’ত হলো, মস্তিস্কে ছড়িয়ে পড়লো ভিন্ন চিন্তা। ওর জামাই তো বুড়ো তাহলে এই লোক কে? লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো বিছানায়। হুট করে লাফানোতে শাড়িতে পা বেঁধে পড়তে নিলে কোমর আঁকড়ে ধরলো আদ্রিশ। ভাগ্যিস সে সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো নাহলে এই মেয়ে এখনই মুখ থু’ব’ড়ে নিচে পড়তো। ভাবা যায় বিয়ের প্রথম রাতেই হাত পা মুখ সব ফা’টা’তে চলেছিল!

আয়ানা চোখ মুখ খি’চে বন্ধ করে রেখেছে। বুকটা জোরে জোরে ধুকপুক করছে। যখন বুঝতে পারলো সে নিচে পড়েনি তখন ধীরে ধীরে চোখ মেললো। দেখলো সামনের ছেলে টা তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছাড়া পাওয়ার জন্য নড়াচড়া করতেই আদ্রিশ আয়ানা কে কিছু টা উঁচু করে নিচে নামিয়ে দিলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো আয়ানা। কিন্তু আদ্রিশের ধমক খেয়ে পুনরায় লাফিয়ে উঠলো।

– “এই তোমার সমস্যা কি? মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি? এভাবে লাফিয়ে উঠলে কেনো? ভূ’ত দেখেছো? এখন নিচে পড়ে হাত, পা ভা’ঙ’লে তো দোষ আমার হতো। সবাই ভাবতো আমি তোমার উপর অ’ত্যা’চা’র করেছি। চুপ করে আছো কেনো স্টু’পি’ড? কথা বলতে পারো না?”
আয়ানা ভাবলো এবার চুপ করে থাকলে চলবে না। এই লোক কে আর তার জামাই কোথায় সবটা জানতে হবে। সে মিনমিন করে বললো,

-“আপনি কে?”
আশ্চর্য হলো আদ্রিশ! মেয়ে টা বলে কি! ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “আমার সাথে যদি তোমার বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে আমি তোমার কে হই?”
আয়ানা ফটাফট জবাব দিলো,
– “বর”
জবাব দিয়ে বে’ক্ক’ল বনে গেলো আয়ানা। কিন্তু তার জামাই এর বর্ণনা তো অন্যরকম ছিলো।
আদ্রিশ বললো,

– “তাহলে জিজ্ঞাসা করলে কেনো আমি কে? আর আমাকে দেখে এতো চমকানোর কি হলো?”
আয়ানা নিজের চিন্তার মাঝেই জবাব দিলো,
– “কিন্তু আমার জামাই তো বুড়ো। হ্যা, আপনি বদমেজাজি ঠিক কিন্তু বাকি বর্ণনা তো মিললো না।”
অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো আদ্রিশ। মনে মনে ভাবলো, শেষমেষ পা’গ’ল বউ জুটলো নাকি কপালে?পিচ্চি মেয়েটা কি বলছে এসব?
আদ্রিশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

– “এসব কি বলছো? তোমাকে এসব কে বলেছে?”
আয়ানা গালটা হালকা ফুলিয়ে বললো,
– “আমাকে সাজানোর সময় আন্টিরা বলছিলো। তখন শুনেছি।”
আদ্রিশ বুঝতে পারলো ব্যাপার টা। নিশ্চই প্রতিবেশি কূ’ট’নী টাইপ মহিলাগুলো এসব ছড়িয়েছে। তারা শুনে কম, রটায় বেশি। আর এই মেয়ে সেসব কথাই বিশ্বাস করেছে। আদ্রিশ বললো,

– “দেখো মেয়ে, তোমাকে কে, কি বললো? আমি জানি না আর জানতেও চাই না। তুমি শুধু এতটুকু জেনে রাখো, তোমার বিয়ে আমার সাথেই হয়েছে। আর তোমাকে যে বিষয়ে বলতে চাচ্ছিলাম। মন দিয়ে শোনো, আমার এই বিয়েতে কোনো মত ছিলো না। একপ্রকার জোর করে বিয়েটা করিয়েছে। আর আমি প্রচন্ড রাগী; রাগ হলে হুশ থাকে না। উল্টাপাল্টা কাজ করে বসি।

তাই আমার থেকে যতো পারবে দূরত্ব বজায় রাখবে। সেটাই তোমার জন্য ভালো হবে। যেহেতু বিয়েটা হয়েছে, তাই আমি চেষ্টা করবো তোমাকে মেনে নেওয়ার। কিন্তু তোমাকে মেনে নিতে আমার কতো সময় লাগবে বা কখনো মেনে নিতে পারবো কিনা আমার জানা নেই। আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। তাই যা বলার সোজাসোজি বললাম।”

নিজের কথা শেষ করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো আদ্রিশ। আয়ানা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। তার জীবন টা এমন কেনো? তার ভাগ্যে আর কতো খেলা লেখা আছে? কবে আসবে তার জীবনে সুদিন? সে কি দেখা পাবে না সুখের? আয়ানা ভাবতে লাগলো আজকের দিনের ঘটনা। কিভাবে তার জীবনে নতুন মোড় এলো…

~ফ্ল্যাশব্যাক~
– “এই যে মহারানী আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনাকে কি দাঁড়িয়ে থাকার কাজ দেয়া হয়েছে? যা সবাইকে জুস দিয়ে আয়। তবে সাবধান কেউ যেনো মুখ না দেখে বলে দিলাম। নাহলে জানিসই তো কি হবে। যা।”

সাহেরা বানুর ধ’মকে কেঁ’পে উঠলো আয়ানা। সাহেরা বানু সম্পর্কে আয়ানার ফুপি হয় কিন্তু আপন না স’ৎ তাই হয়তো তার সাথে এমন ব্যবহার করতে গায়ে বাধে না। চোখ জলে ভরে উঠলো আয়ানার। পরনের ওড়না দিয়ে মাথা, মুখ ভালো করে ঢেকে নিলো সে। মাথা নিচু করে সবাইকে জুস দিয়ে রান্নাঘরে ফেরত চলে আসলো। এখনো অনেক রান্না বাকি। সব যে তাকেই করতে হবে। সাহায্য করার কেউ নেই।

আজ আয়ানার বোন মীরার বিয়ে। পরেরদিন রিসেপশন হবে। কাবিন ঘরোয়া ভাবে আয়ানাদের বাড়িতেই হচ্ছে। বোনের বিয়েতে কাজের মানুষের মতো কাজ করতে হচ্ছে তার। এটাই হয়তো নিয়তি ভেবে তাচ্ছিল‍্য মাখা হাসি দিলো আয়ানা। এই হাসির মাঝেও যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে।

সব কাজ শেষ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলো আয়ানা। এতগুলো মানুষের রান্না করা মুখের কথা নয়। কাজ শেষে নিজের রুমে যাওয়ার পথে একবার বোন মীরার রুমে উঁকি দিলো কিন্তু সামনে যাওয়ার সাহস পেলো না। বোন কে সে অনেক ভয় পায়। যদিও মীরা তার আপন বোন না। এই জন্যই হয়তো এতো দূরত্ব। বোনকে দূর থেকে দেখেই চোখ জুড়িয়ে নিলো সে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে আজ তার বোনটাকে।

(আস্সালামুআলাইকুম। চলে আসলাম নতুন গল্প নিয়ে। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আর প্রথম পর্ব পড়েই কেউ সম্পূর্ণ গল্প যাচাই করবেন না আশা করি। গল্প সম্পূর্ণটাই আপনাদের রেসপন্স এর উপর নির্ভর করছে। সবাই ভু’ল-ত্রু’টি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।)

অতঃপর প্রেমের আগমন পর্ব ২