মানকলি পর্ব ২

মানকলি পর্ব ২
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

সরু জলের স্রোত নেমে এলো পূবালীর বাম চোখ বেয়ে।এক দিকে নিজের আত্মসম্মান অন্য দিকে বোনের সংসার।রাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে মুখোমুখি হলো নিজ বোন জামাই শুভর সামনে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলো,

“আমার বোনকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা কেন উঠছে?”
“তোমার জন্যই উঠছে।”
“আপনাকে ভাই ডেকেছিলাম।বিয়ের পর ভাইয়া ডাকটা আপনার পছন্দ ছিল না।বিয়ের দুদিন পর আমায় বলেছিলেন রাদ ভাই কিংবা চৈতীর মতো আমিও যেন ভাই ডাকি।ভাইয়া ডাক পর লাগে।অথচ আদৌও কি আপনি আমাদের আপন করে নিতে পেরেছিলেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি দায়িত্ব পালন করেছি। কখনো অবহেলা করিনি।”
“ধরে নিন আমিও দায়িত্ব পালন করছি।আর আপু আজ যদি তুই তিন জন সন্তানের মা না হতি এই মুহুর্তে আমি তোকে নিয়ে যেতাম।কিন্তু বাবা ছাড়া বেঁচে থাকাটা কতোটা লড়াইয়ের সেটা তুই আর আমি জানি।তবুও বলছি চলে আয় আমার সাথে।কোনো প্রয়োজন নেই এমন সংসারের যেখানে সম্মান পাওয়া যায় না।”

চকিতে আরো একটা চড় মারলেন বাড়ির কত্রী।শুভ এবার মাকে বেশ জোরে ডাক দিয়ে তাকে ধরল।পূবালী এক মুহুর্ত দেরি না করে ভদ্রমহিলার কাটা হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“মাওইমা, আমি আপনাকে সম্মান করি কিন্তু তাই বলে নিজেকে অসম্মান করি না।আপনার এই বেয়াদবির বদলে আমি যদি আপনার গালে ঠিক একই ভাবে দুটো চড় মেরে দেই নিশ্চয়ই ভালো হবে না।তাই না?”

এক মুহুর্তে থামে না মেয়েটা।বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। তার পিছন পিছন হাঁটতে থাকে রাদ।সন্ধ্যে হবে বলে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে।নিশ্চয়ই পূবালী ছাতা নিয়ে বের হয়নি।বরাবর মেয়েটার অভ্যেস ছাতা ভুলে যাওয়া।গেট পার হতেই রাদ তাকে পিছন থেকে ডেকে বলল,

“পূবালী দাঁড়াও।তোমার কিন্তু ঝামেলা মায়ের সাথে হয়েছে আমার সাথে নয়।”
“রক্ত কখনো বেঈমানী করে না।আপনিও তার রক্ত।”
“কেন?আমার বাবার কথা বুঝি তোমার মনে নেই?”
“আজ তাওই বেঁচে থাকলে আমার বোনের তালাক শব্দটা শুনতে হতো না।”

“চলো তোমাকে দিয়ে আসছি।”
“প্রয়োজন নেই।আমি যেতে পারবো।”
রাদ স্থির হলো।থেমে গেছে পূবালীর পা দুটোও।কিছুটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রাদ বলল,
“শুনেছি বিয়ের কনেদের উপর জিনের বেশ নজর থাকে।তাদের গায়ের হলুদের গন্ধে তারা পিছু নেয়।আফসোস হচ্ছে।”

“কেন?জিন না হয়ে জন্মানোর জন্য?তাছাড়া আমি এখনো বিয়ের কনে নই।হলুদ হয়নি আমার।”
“আর মাত্র কয়েক দিন বেয়াইন সাহেবা।এরপর তো পরের বাড়ির বৌ হয়ে যাবেন।তখন কি মনে পড়বে আপনার এই আলাভোলা বেয়াইয়ের কথা? যাকে আপনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে পুকুরের পানিতে ডুব খাইয়েছিলেন?”
ধীরেধীরে বৃষ্টির ফোঁটা যেন বড় হচ্ছে।একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে এবার ছাতা বের করলো পূবালী।এখন আর ছাতা আনতে ভুলে না সে।অন্তত তার প্রিয় মানুষটা ভুলতে দেয় না তাকে।ছাতা ফুঁটিয়ে রাস্তায় নেমে যাওয়ার সময় পূবালী বলল,

“অতীত যেমনি হোক না কেন, অতীত সবসময় অতীত থাকে।আমরা বাঁচি ভবিষ্যতে আশায় অথচ বর্তমানটা কতোই সুন্দর।”

বাড়িতে প্রবেশ করতেই পূবালী মুখোমুখি হলো মায়ের।তিন কামড়ার ফ্ল্যাট তাদের। সহায় সম্বল বলতে এই ফ্ল্যাটটা আর বাড়িতে কিছু চাষের জমি।বাবা যখন মারা যায় তখন বড় আপার বয়স তেরো কি চৌদ্দ, ভাইয়ার বয়স বারো আর নিজের বয়স দশ বছর ছিল।এক্সিডেন্টে বাবার মৃত্যুর পর শুরু হলো তাদের যুদ্ধ।মা সেলাইয়ের কাজ জানতেন।

দিন রাত লেগে পড়লেন কাপড়ে ফুল তুলতে৷ শীতের দিনে চাদরে নানান রঙের সুতোর কাজ করতেন,গরম কালে জামায়।কত রাত পার হয়েছে মায়ের এসব করতে করতে তার হিসেব নেই।জমানো টাকাটা খরচ হতো তাদের লেখাপড়ায়।ধীরে ধীরে টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছিলো মায়ের যুদ্ধ যেন আরো ভারী হচ্ছিলো।বড় আপার লেখাপড়াটা কলেজের পর আর হলো না।আপা নিজেই ছেড়ে দিলেন।

ততদিনে আত্মীয়দের রূপ দেখা হয়ে গেছে।কেউ তাদের তেমন একটা খোঁজ খবর নিতো না, পাছে আবার ভদ্রতার খাতিরে সাহায্য করতে হয় কী না! একমাত্র ছোটো মামাই ছিল তাদের ভরসার হাত।প্রতিমাসে বাজার খরচের সম্পূর্ণটা সে দিতো যতদিন অবধি না তাদের নিজস্ব ইনকামের একটা ব্যবস্থা হয়।

কিন্তু এটাও ছিল মামীর থেকে লুকিয়ে দেওয়া।মামী হয়তো না করতেন না কিন্তু ভালো ভাবেও যে নিবে না এটাও বুঝতে পেরেছিল পূবালীরা।ধীরে ধীরে তাদের মায়ের কাজের অর্ডার বাড়তে লাগলো।দুজন মহিলা নিয়ে পুরো দমে কাজ চলতে চলতে আজ তার মায়ের অধীনে ২০ জন মহিলা কাজ করে এবং তারা স্বাবলম্বী। যে সুঁইয়ের কাজ করলে তার বাবা রাগ করতো সেই সুঁই সুতোর কাজ করেই তিন ছেলে মেয়েক নিয়ে বেঁচে রইলো পূবালীর পরিবার।

খুব অল্প সময়েই বিধবা মা এবং দুই বোনের দিকে তাকিয়ে মুদি দোকানের লোক থেকে শুরু করে ময়লা নিতে আসা লোকেদের আফসোসের সুরটাও চিনতে শুরু করেছিল তারা।পিউলির বিয়ের পর ভাই নাবিল স্কলারশিপ হয়, সে বর্তমানে দেশের বাইরে সেটেল্ড হয়েছে। এখন তাদের টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই।ভয়ে ভয়ে একটা জিনিস ব্যবহার করতে হয় না।

একটু বেশি ব্যবহার করলে পরবর্তীতে কি খাবে সেটার চিন্তা নেই।নাবিল ওদেশেই থাকবে। এইতো দুই বছর হলো বিয়ে করে স্ত্রী সমেত রয়েছে সেখানে।খুব অনুরোধ করেছিল মা কে সাথে যেতে কিন্তু পূবালী তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।মেয়েকে ফেলে যাবে কি করে?তাছাড়া এই যে ছোট্ট বুটিকটা,২০ জন নারী কর্মী তাদের ছেড়েও যেতে চায়নি ভদ্রমহিলা।

বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে পূবালী গা এলিয়ে দিলো সোফায়।এই মুহূর্তে মাকে ও বাড়ির কথা কিছু বলা যাবে না।চা হাতে সাফিয়া বেগম এসে বসলেন মেয়ের পাশে।পুরো দিন কি কি হয়েছে সেসব বলতে লাগলেন মেয়েকে।ঠিক পনেরো দিন আগে হলেও পূবালী মাকে কিছুটা ধমকে দিয়ে বলতো

“পুরো দিন বাইরে কাটিয়ে এসে তোমার এসব শুনতে ভালো লাগে না মা।চুপ থাকবে তুমি?একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
কিন্তু এখন সে এ কথা বলে না।সে ছাড়া মায়ের আর কথা বলার কেউ নেই।বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছে সেদিন, যেদিন আয়াশ এবং ওর বিয়ে পাকা হয়।পরদিন ভোরবেলা পূর্ব প্ল্যান অনুযায়ী তারা পুরো দিন ঘুরে বেড়ায়।

সেই মুহুর্তে আয়াশের জরুরী কল এলে তাকে একা রেখে কথা বলছিল ফোনে।একটা লঞ্চের ছাদে, একা একা ভীষণ অসহায় লাগলো পূবালীর।হুট করেই মায়ের ফোন এলো।মায়ের সাথে কথা বলে অনুভব করতে পারলো একা বাড়িতে মায়ের কেমন লাগছে।নিশ্চয়ই তারও ইচ্ছে করে কারোর সাথে গল্প করতে কিংবা সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে? বিগত ১৫ বছর বাবা নেই, নেই তো মায়ের কোনো বন্ধুও।দিন শেষে আমাদের প্রত্যেকের কি একজন ব্যক্তিগত মানুষের প্রয়োজন পড়ে না?

দুচোখ ভিজে এলো তার। মানস্পটে ভেসে উঠলো বাবা মায়ের সেই হাসি হাসি আবছা অবয়ব। মা তখন কি সুন্দর করে হাসতেন যখন বাবা তার পাশে বসে থাকতো।সেই হাসিটা নেই আজ পনেরো বছর।সেই মুহুর্তেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল পূবালী। মায়ের মুখের হাসিটা আবার ফিরিয়ে আনবে।যদি এতে ভাংগতে হয় সমাজের চিরায়ত নিয়ম তবে তাই হোক।তবুও মায়ের সুখী সুখী মুখটা সে দেখতে চায়।

মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে দু চোখ লেগে এসেছিল পূবালীর।তন্দ্রা কেটে গেল আয়াশের ফোনকলে।ভণিতা ছাড়াই আয়াশ তাকে বলল,

মানকলি পর্ব ১

“আমাদের বিয়েটা সম্ভব নয় পূবা।বড় আপার শাশুড়ি মাকে কল দিয়ে কি বলেছে জানি না।মা চাচ্ছেন না আমাদের বিয়েটা হোক।তুমি তো জানো আমি নিতান্তই মা ভক্ত ছেলে।তার বিরুদ্ধে যেতে যে বড্ড ভয় করে আমার।”

মানকলি পর্ব ৩