মানকলি গল্পের লিংক || সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

মানকলি পর্ব ১
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

“বড় ভাবীর সংসারটা ভেঙ্গে যাচ্ছে দুটো কারণে। প্রথমত মায়ের অভিযোগ, বড় ভাবী মায়ের খেয়াল রাখে না আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে বড় ভাবীর মায়ের বিয়ে।আমার কী মনে হয় জানিস?বড় ভাবীর মায়ের বিয়েটাই ভাবীর সংসার ভাঙ্গার জন্য যথেষ্ট কারণ।

প্রথম যেদিন মা জানতে পারলো ভাবীর মায়ের বিয়ের কথা চলছে সেদিন মা বেশ কড়া ভাষায় বলে দিয়েছিল ভাবীকে। এই বয়সে তার মা যেন বিয়ের কথা চিন্তাও না করে।ছেলে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, দুদিন পর ছোটো মেয়ের বিয়ে। এই মুহুর্তে সে জীবনের অন্তিম পর্বে রয়েছে।এখন বিয়ে করলে লোকে কী বলবে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভালো কথাতেও যখন ভাবীর বাড়ির লোক মায়ের কথার পাত্তা দিলো না সেই মুহুর্তে মা নেমে এলো নিম্ন স্তরের ভাষায়।সেসব ভাষা শুনে ভাবী কেবল আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদে।একটা সময় এর সাথে যোগ হলো মায়ের মানসিক অত্যাচার। ভাইয়াও ইদানীং তার সাথে তেমন কথা বলে না।একবার ভেবে দেখেছিস যদি ভাবী এসব সহ্য না করতে পেরে মরে যায়?

কী হবে তখন তার ছোটো ছোটো তিনটা সন্তানের? তার নিজের বোন মায়ের বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে অন্য দিকে আমাদের পরিবার রাজি নয়।কেউ কী জানতে চেয়েছে ভাবী কী চাইছে?না তুই আর না আমি।আমরা কেবল একজন সাধারণ গৃহিণীর উপর নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছি।স্বল্প শিক্ষিতা ভাবীটা তাই মেনে নিয়ে গুমরে গুমরে দিন পার করছে।”

ভাইয়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল চৈতি শাহামাত।ওড়না আংগুলে প্যাঁচিয়ে পুনরায় খুলছিল সে।ছোটো ভাইকে দেখে প্রচন্ড ভয় পায় মেয়েটা তবুও বড় ভাবীর জন্য তার বেশি মায়া হয়।এই যে ভাবী এতো মন খারাপের মাঝেও তার চুলে তেল দিয়ে দেয়, আদর করে ভাত বেড়ে দেয় এসবের জন্যও তো তাকে ভালোবাসা যায়।

“এখানে এসে বোস,তোর না পায়ে লেগেছে?এখানে আয়।”
ছোটো ভাইয়ের ডাকে তার বিছানায় গিয়ে বসে চৈতী।আজ চার বছর পর দেশে ফিরেছে রাদ।বাইরের দেশেই সেটেল্ড হয়েছে।বাবার মৃত্যুর পর থেকে ভাইয়া কেমন বদলে গেছে।খুব প্রয়োজন না হলে কারোর সাথে কথা বলে না।হয়তো বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে।

আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই মা তাকে এই মুহুর্তে আসতে বলেছে।মায়ের অবস্থা তেমন ভালো নয়।খবরটা শোনার পর ভাইয়াও দেরি করেনি।সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে বড় ভাবীর সাথে কুশলাদি বিনিময় অবধি করার সুযোগ দেয়নি তাদের মা।দুই ছেলেকে নিয়ে সেই যে বসেছিলেন, কথার ঝুড়ি যেন ফুরোচ্ছে না।

সেখানে অধিকাংশ কথাই ছিল বড় ভাবীর জন্য তার হাত কেটেছে।ভাবী তার খেয়াল রাখে না, নিজের হাতে কাজ করতে হয়।ডায়বেটিস আছে তার, ঠিক সময় মতো খাবারটাও ভাবী দেয় না।এই বৌ বাড়িতে থাকলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।যদি মা কে বাঁচাতে চায় তবে যেন বড় ভাবীকে তার বাবার বাড়ি দিয়ে আসে।

দুই ছেলে মায়ের সেই কথাতেই রাজি হয়েছে।হয়তো আগামীকাল ভাবীকে তার বাবার বাড়িতে রেখে আসবে। চৈতী চায় না তার বড় ভাবী এই বাড়ি থেকে চলে যাক।বড় ভাইয়াকে বলে লাভ নেই তাই সে ছুটে এসেছে ছোটো ভাই রাদের কাছে।

বোনের পা দুটো খাটের উপর তুলে দিতে দিতে রাদ জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? পুরোটা বল।”
“আম্মার হাতের কাটা দেখলে বুঝবি সেটা গ্লাস থেকে কাটার দাগ না ভাই।খুব সূক্ষ্ম হাতে আম্মা ব্লেড দিয়ে হাতটা কেটেছে। যাতে ভাবীর উপর দোষ চাপানো যায়।আম্মার যেহেতু ডায়বেটিস আছে তাই আম্মার হাতের ক্ষত সারতে সময় লাগবে।এটাই ছিল বিয়ে আটকানোর শেষ সুযোগ ছিল মায়ের কাছে।”

“ভাবীর মায়ের বিয়েটাও কী এই মুহুর্তে খুব প্রয়োজন ছিল?”
“পূবালী আপুর সম্পর্কে তো তুই জানিস।আপু সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্টির বিয়ে দিবে।আজ থেকে আরো পনেরো বছর আগে আংকেল মারা গেছেন।এই মুহুর্তে সবাই যার যার সংসারে ব্যস্ত হলে আন্টির কী হবে?সে একা কীভাবে থাকবে,এসব চিন্তা করেই আপু আন্টির বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”

পূবালীর নাম শুনে রাদ থমকালো।ভিতরে ভিতরে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।দুদিন আগে সে জানতে পেরেছে পূবালী বিয়ে করতে চলেছে।ছেলে বেশ ভালো। উচ্চ বংশ, স্মার্ট তাছাড়া পূবালী যেমন চায় ঠিক তেমন। পূবালী জীবনের বাকীটা পথ চলতে কারোর উপর নির্ভরশীল নয় একজন সঙ্গী চায়।মুক্তমনা স্বভাবের মেয়ের এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে মনে মনে বেশ পুলকিত হলো রাদ।সে জানে একবার যেহেতু মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পিছু হটবে না।

ভাইকে চুপ থাকতে দেখে চৈতী পুনরায় বলল,
“ভাবীর কোনো দোষ নেই ভাই।তাকে বের করে দিস না।আজ যদি ভাবীকে বের করে দিস তোরা, আগামীকালকেই মা বায়না ধরবে বড় ছেলের বিয়ের জন্য।”
“ভাবীর কয়েক দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন।”

“কীসের বিশ্রাম?আজ যদি ভাবীর জায়গায় আমি থাকতাম?মেনে নিতে পারতিস তোরা?”
“আমরা তো আর মা কে বিয়ে দিতে চাইছি না।যতোই হোক এই সিদ্ধান্ত সমাজে খুব একটা ভালো দেখায় না।”
চৈতী হতাশ হলো। তার দুই চোখ উপচে পানি পড়তে চাইছিল।নিজের মনকে শান্ত করে সে বেরিয়ে আসার সময় তার ভাইকে বলল,

“কী অদ্ভুত মানবজীবন তাই না?সবাই চায় নারী এক পুরুষেই জীবন পার করুক অথচ স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের সময়কাল ধরে মাত্র তিন দিন।তিন দিনেই পরিপূর্ণ হয় পুরাতন স্ত্রীর জায়গায় নতুন স্ত্রী।নারীদের নিয়ে কেবল পুতুল পুতুল খেলাটাই খেলে গেল সবাই।কেউ তাদের জীবনটাই বুঝলো না।”

কথাটা শেষ করার পূর্বেই চুলে হ্যাঁচকা টান অনুভব করে চৈতী। তার মা বেশ কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় মেয়ের শরীরে।বিলাপের সুরে বলতে থাকে সে কতবড় ভুল করেছে পূবালীকে এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়ে।ভালো মনে ভেবেছিল অন্যের কাছে প্রাইভেট পড়ার থেকে পূবালীর কাছেই পড়ুক মেয়েটা।অথচ সে কি জানতো পড়ানোর নাম করে এসব বাজে বাজে কথা ঢুকিয়ে দিবে মেয়েটার মস্তিষ্কে?

রাদ দৌড়ে গিয়ে মাকে সামলায় ততক্ষণে বড় ভাবী পিউলি চলে এসেছে।কোলের বাচ্চাটাকে সোফায় বসিয়ে ননদকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে।হিঁচকি তুলে কাঁদছে চৈতী। মেয়েকে মেরে অস্থির হয়ে গেছে রাশেদা বেগম।ছোটো ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমি কী পাপ করেছিলাম বাজান?আমার ঘরেই কেন এসব?এই মেয়ের মাথাটা পূবালী নষ্ট কইরা দিছে। আজ আসতে দে ওরে।বড়টারে সহ বাসা থেকে বের করে দিবো।”

ঠিক সেই মুহুর্তে কলিংবেলের শব্দটা কানে এলো সবার।ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলো পিউলি।নিশ্চয়ই পূবালী এসেছে চৈতীকে পড়াতে।তার বোনটার প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ।আজকে এখানে কোনো রকম অপমান হলে সে মেনে নিবে না।যে মেয়ে নিজের মায়ের সুখের জন্য এত মানুষের কথা শুনতে পারে, নিজের বিয়েটা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে সেই মেয়ে অপমান সহ্য করবে না।তর্কে লেগে যাবে।মনে প্রাণে পিউলি চাইলো দরজার ওপাশে পূবালী না হোক।

পূবালী ভিতরে প্রবেশ করতেই রাশেদা বেগম সপাটে থাপ্পড় মেরে দিলেন পূবালী গালে।আকস্মিকতায় মেয়েটা পড়ে যাচ্ছিলো,তাকে হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো রাদ।মায়ের এমন ব্যবহারে দুঃখ পেলেও পূবালীকে এভাবে আঘাত করাটা মেনে নিতে পারলো না।

রাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা বলতে যাবে পূবালী সেই মুহুর্তে তার বোন জামাই তাকে বলল,
“আমার মায়ের সাথে তুমি নূন্যতম বেয়াদবি করলে আমি তোমার বোনকে এই মুহুর্তে মুখে মুখে তিন তালাক দিবো।”

মানকলি পর্ব ২