মানকলি পর্ব ৩

মানকলি পর্ব ৩
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

এই সমাজে বাবার বিয়েটা যতই সহজ মায়ের দ্বিতীয় বিয়েটা ততোটাই কুশ্রী।পূবালী আরো একটা বার বুঝে গেল মায়ের খুশির জন্য এবার তাকে নিজের খুশি ছাড় দিতে হবে।নিজের খুশী?হ্যাঁ আয়াশ তার নিজের খুশী।তার সর্বাঙ্গে লেগে থাকা ভালোবাসার সুবাস, সুখ।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে পূবালী আয়াশকে বলল,

“তবে তোমার সিদ্ধান্ত কী?আংটিটা ফেরত নিচ্ছো কবে?”
“ওটা তোমার ব্যক্তিগত জিনিস পূবা।ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছো কেন?”
“যেভাবে তুমি আমাকে হারিয়ে দিলে।”
“আমি তোমাকে হারাইনি।সময় এলে তুমি ঠিক বুঝবে।”
“হয়তো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুপাশেই দীর্ঘ নিরবতা নেমে আসতে চাইলো।কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আয়াশ বলল,
“আমার সাথে একটা বার দেখা করবে?”
পূবালী কাঠ কাঠ গলায় তাকে ফিরিয়ে দিলো।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার আগ মুহূর্তে আয়াশ বলল,
“পূবা পুরোনো দিনের খাতিরেই আমি দশটা মিনিট চেয়ে নিবো তোমার থেকে।এরপর মা ভক্ত এই ছেলেটা তোমার সামনে আর আসবে না।”

“আমি দেখা করতে চাই না।তুমি নতুন করে মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নাও।নতুন শরীরের নেশায় পড়লে আমায় মনে পড়বে না।”
“তোমার সাথে আমার শরীরী প্রেম ছিল?তুমি কি আমাকে অপমান করছো না?”
“আমার থেকে ভালো কাউকে পাও দোয়া রইল।ভালো থেকো।”
“আগামীকাল অপেক্ষা করবো।কথা দিচ্ছি এরপর আমাকে আর সহ্য করতে হবে না।”
“কেন তুমি আমাকে আরো যন্ত্রণা দিচ্ছো?”

“মনে রেখো যন্ত্রণা দানকারী ব্যক্তিটাও যন্ত্রনায় পড়তে পারে।আমি অপেক্ষা করবো।”
ফোনটা কেটে গেল।সে জানে হয়তো আয়াশের বাবা মা তাকে শর্ত দিয়েছে বিয়েটা হবে যদি পূবালী তার মায়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত বাদ দেয়।কিন্তু কেউ বুঝতে চাইছে না কেন পূবালী এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

জীবনে চলতে হলে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন।এই যে আয়াশের সাথে আগামী মাসের প্রথমে তার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কথা ছিল, সে চলে যাওয়ার পর তার মা কার সাথে থাকতো?কার সাথে কথা বলবে?ফোনে ফোনে সন্তান খোঁজ নিলেই কী দায়িত্ব শেষ? পূবালী চেয়েছে তার মায়ের কেউ একজন থাকুক, যার খোঁজ নিতেও মায়ের একটু হাটতে হবে, বিকেলের চায়ের একজন সঙ্গী, কারোর পছন্দের তরকারি রান্না কিংবা কেউ তার মায়ের জন্য চিন্তা করুক, চশমাটা খুঁজে দিক কিংবা ঔষধ নেই সেটা মনে করিয়ে দিক।সন্তান হিসেবে এটুক চাওয়াটা কী তার বড্ড বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?

মা কি রাজি হবে নিজের সুখের সংসারটা সাজাতে যার প্রতিফলনে দুটো মেয়ের সংসার শেষ হয়ে যাচ্ছে? না পূবালী জানে তার মা রাজি হবে না।তাই সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো বিয়ে ভাঙ্গার বিষয়টা আপাতত মাকে জানাবে না।কাউকেই জানাবে না।যদিও হয়তো পিউলি জেনেছে,তাকেও সে নিষেধ করবে যেন মাকে কিছু না বলে এবং আগামীকাল সে আয়াশের সাথে দেখা করবে।

আয়াশকে বলতে হবে আপাতত যেন তার পরিবার মাকে কিছু না জানায়।পূবালী বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আলমারিতে হাত দেয়।এখানে রয়েছে তার বিয়ের শপিং।এই মুহূর্তে মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মেয়েটার।মাকে কি বলবে সে?ব্যাগ থেকে খাম বের করে চাকরির ইস্তফাপত্রটা ছিড়ে ফেলল।চাকরিটা ছাড়লে হয়তো দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।বাসায় থাকলে পুরো দিন মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।

পরদিন সকালবেলা অফিসের সামনে রিক্সা থেকে নেমে ভিতরে প্রবেশ করার সময় পিছন থেকে ডাকে আয়াশ।অন্য সময় হলে পূবালীর মন খুশিতে আহ্লাদিত হতো।কিন্তু আজ তার বুকের ভিতর জ্বালাপোড়া করছে।পিছন ফিরে তাকাতেই আয়াশ হাত ইশারা করলো গাড়িতে উঠতে।হাজার খানেক না নিয়েও গাড়িতে উঠে বসলো পূবালী।বাতাসের পেট ভেদ করে, যান্ত্রিক শহরের জ্যাম ছাড়িয়ে গাড়িটা ছুটে চলল শান্ত মেঠো পথে।

“পূবা আমি তোমার কাছে কিছুই চাইতে আসিনি।কেবল আজকের সময় ছাড়া।”
“আমার তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।তোমার আমানত রয়েছে কিছু।”

হাত থেকে আংটিটা খুলে আয়াশের দিকে এগিয়ে দিলো সে।আয়াশ আংটিটা হাতে নিয়ে বুক পকেটে রাখলো।স্বল্প সময় দুজনে চুপ ছিল।ফোনের শব্দে নিরবতা কাটিয়ে গেল।অপর পাশে আয়াশের মা।কোনো একটা কারণে দ্রুত যেতে বলছে তাকে।পূবালী মনে মনে ভাবলো ‘বেশ, ছেলেটা সুখী হোক এটাই অনেক।তার জীবনে সুখ কোনো এক সময় সে কিনে নিবে চড়া দামে।আপাতত না হয় মায়ের সুখটা কিনুক ভালোবাসার দামে।”

“তোমার চোখে আমি কাপুরুষ। আমি নিজের চোখেও তাই।কিন্তু কি করবো?মা তো,জন্ম দিয়েছে। অধিকার দেখাচ্ছে। পুরো জীবন তার কথা মেনে এসেছি বলে এটাও মানবো বলে জেদ ধরেছে।তোমাকে বিয়ে না করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে অনেক।”

“সমস্যা নেই।আমি আপত্তি বা অভিযোগ কিছুই তো করছি না।এটা নিয়ে মন খারাপ করো না।”
“কিন্তু করা উচিৎ ছিল।তোমার অভিযোগ থাকা উচিৎ আমার প্রতি। আমি তোমাকে ঠকিয়েছি।”
“বিয়ে করে নাও, ঠিক হয়ে যাবে।”

“মাকে বলেছি তুমি না তো কেউই নয়।মা রাজি হয়েছে পূবা।আমি কাউকে বিয়ে করবো না।তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।তুমি না তো কেউই নয়। মন থেকে তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনেছি আমি।আমার কি মনে হয় জানো?তুমি আমার বা পাজরের বাকা হাড়।যখন তুমি রাগ করো তখন আমার ভীষণ ভালো লাগে।কিন্তু জোর করি না কারণ এমনিতেই স্বভাবে তুমি বাঁকা। জোর করলে কটাশ করে না আবার ভেঙ্গে যাও।আমি তোমাকে হারাতে দিতে চাইনি।কিন্তু সময় চেয়েছে।”

“তোমারো কি মনে হয় আমি ভুল?আমার চাওয়াটা ভুল?”
“সমাজের চোখে এই বিষয়টা একটা ট্যাবুর মতো।আমি তুমি চাইলেও পরিবর্তন হতে সময় লাগবে যে।”
“মা যদি আমাদের সুখের কথা ভাবে সন্তান কেন পারবে না?আজ মায়ের জায়গায় বাবা থাকলে তো তিন দিন পরেই বিয়ে করে নিতো। তখন তো সমাজের মানুষের এত লাগতো না।”

“আজ বিকেলে আমার ফ্লাইট।চলে যাচ্ছি আমি।”
চকিতে তার দিকে তাকায় পূবালী।দুই মাস পর তাদের একত্রে দেশ ছাড়ার কথা ছিল।কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছিল সেভাবেই।এত দ্রুত আয়াশের চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারলো না সে।কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো,আছড়ে পড়লো আয়াশের বুকে।

“কাঁদবে না তুমি।তোমার আমার পথ হয়তো আজ থেকে আলাদা কিন্তু কোনো একটা দিন এক ছিল।আমি তোমাকে ছাড়া ঠিক বেঁচে থাকবো।ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হবো।তুমিও এদিকে নতুন কারো সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন সাজিও। মা ভক্ত কাউকে এবার বেছে নিও না।

এরা ব্যালেন্স করতে পারে না।হয়তো জীবনে একটা সময় ফিরবো এদেশে। তখন তুমি অন্য কারো সংসারে ব্যস্ত থাকবে।সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে।আমার প্রতি তখন তোমার মায়া হবে?না কি পুরো জীবন এই কাপুরুষের জন্য মনে জমিয়ে রাখবে ঘৃণা?”

আয়াশ চলে যাওয়ার পর পুরো দিনটা ভবঘুরের মতো শহরে হেঁটেছে পূবালী।ভালো লাগছিল না তার। ডিসপেনসারি থেকে নাপা কিনে পর পর চারটে নাপা খেল সে।বিকেল হয়ে এলে ফিরলো বাসার সামনে।গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে তার।

রিক্সা থেকে গেটের সামনে নেমে দেখতে পেল পিউলি দাঁড়িয়ে আছে ছোটো বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পাশে রাখা তাদের কাপড়ের ব্যাগ।ভিতর ভিতরে কেমন চমকে উঠেছে পূবালী। অজানা ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে।বোনের মলিন চেহারা উস্কো শুষ্ক চুলে কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে ভড়কে গেল সে।

মানকলি পর্ব ২

নিজের সংসার ভাঙ্গার শোকটা কাটিয়ে উঠলেও নিজের বোনের সংসার ভাঙার দায়িত্ব কি সে নিতে পারবে?
এক দিকে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, মায়ের সুখ অন্য দিকে মায়ের বিয়েটা না হলে তার এবং পিউলির সাজানো সংসার।কোন দিকে যাবে পূবালী?মাকে সাজাতে গিয়ে যে বোনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

মানকলি পর্ব ৪