মানকলি পর্ব ৪

মানকলি পর্ব ৪
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

বাসার ভিতরে প্রবেশ করে মায়ের সাথে বেশ নরম সুরেই কথা বলছে পিউলি।নিজের জীবনের সঙ্গে হয়ে যাওয়া উথাল-পাথাল গল্পটা হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলল।ওড়নায় ঢাকা গেল তার গলায় থাকা দাগটা।আজ সহ্যের ক্ষমতার অধিক হয়েছে বাসায়।

সকাল বেলা বড় ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাবে বলে দ্রুত কাজ করছিল সে।গতরাতে সে বলেছে টিফিনে একটু বিরিয়ানি করে দিতে। তার কয়েক জন বন্ধুও ভালো ভালো খাবার নিয়ে আসবে এবং সবাই মিলে একত্রে খাবার খাবে।ছেলের আবদার অনুযায়ী সকাল সকাল মাটন বিরিয়ানি বসিয়েছিল চুলোয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছেলেকে দেওয়ার সাথে সাথে বাড়ির মানুষও যেন সকালের খাবার খেতে পারে সে পরিমাপে রান্না করেছিল।বিপত্তিটা হলো সকালের নাস্তার টেবিলে।যখন রাহেলা বেগম নাস্তার টেবিলে এসে দেখলেন যে মাটন বিরিয়ানি করা হয়েছে সবার জন্য এবং তার জন্য রুটি সবজি সে ক্ষেপে গেলেন।চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই ছুড়ে ফেললেন পিউলির দিকে।পিউলি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।রাহেলা বেগম রাগে ফুঁসছে।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,

‘কীসের আনন্দ করছিস আমার ছেলের টাকায়?তোর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের না কি আমি মরে যাবো তার খুশিতে?’
‘আম্মা আপনি এমন কেন বলছেন?আমি কি করেছি?’
‘কে বলেছিল বিরিয়ানি রান্না করতে?আমি খেতে পারবো না বলে রান্না করেছিস?’
‘আম্মা আপনার ডায়বেটিস, খাশির মাংস আপনার জন্য ক্ষতি।’

‘তাতে তোর বাপের কি?তুই কামাই করিস?তোর টাকায় আমি খাই?আমাকে শুকনো রুটি দিয়ে রেখেছিস।’
‘আম্মা আপনি ভুল বুঝতে পারছেন।’
‘আমি ঠিক বুঝেছি।তুই রান্না করলি ক্যান?’
‘কারণ আমার ছেলে খেতে চেয়েছে। আমি আপনার জন্যও রান্না করে দিবো পরে। আপনার খাওয়া নিষেধ এজন্য আমাকেও আপনি খেতে দেন না মেনে নিয়েছি।আমিও খাই না অথচ আপনার ছেলেদের পাতে সেই খাবার ঠিক তোলা থাকে।’

‘আমার ছেলেরা কামাই করে ওরা খাবে না তো কে খাবে?’
‘আপনার ছেলেরা খেতে পারলে,আমি তাদের জন্য রান্না করতে পারলে আমার ছেলের জন্য পারবো না?’
‘ওর বয়স কত?ওর এই বয়সে এসব খেতে মন চাওয়ার তো কথা নয়? নিশ্চয়ই শিখিয়ে দিয়েছো তাই বলেছে।’

পিউলি শত দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলল।তার ছেলে এ বছর ওয়ানে পড়ছে।সাত বছর বয়সী বাচ্চার আবদার সম্পর্কে খুব ভালো ভাবেই জানে রাহেলা বেগম।দুদিন পর পর তার পছন্দের খাবার রান্না হয় বাসায়।না হলে চৈতী বাইরে থেকে খাবার কিনে আনে ভাইয়ের বাচ্চাদের জন্য।তারা খুব যে খায় তা কিন্তু নয়।দুই এক বার মুখে দিয়ে রেখে দেয় কিন্তু আবদার তো করে।

রাদ নিজের রুম থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো। ডায়নিং টেবিলের কাছে তার ভাবী নিচু হয়ে টুকরো টুকরো কাঁচ বেলচায় তুলছে।অসাবধানতার কারণে এক টুকরো কাঁচ তার আংগুলে সূচের মতো ফুঁটে গেল।ওড়নার কোণায় আংগুল প্যাঁচিয়ে রাহেলা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,

‘আম্মা বিরিয়ানি বেড়ে দিবো?লেবু কাটা আছে।নাকি শশা টক দইয়ের সালাদ বানিয়ে দিবো?’
রাদ চেয়ারে বসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘মা আপনার জন্য খাশির গোস্ত কিন্তু ঠিক না।’
‘আমি কি খেতে চেয়েছি না কি?’
‘তবে কেন ভাবীর সাথে তর্ক করছেন?’

‘শোন এই এক টেবিলে বসেই তোরা খাবার খাবি আমার ইচ্ছে করে না?তোর মনে আছে?ছোটো বেলায় একবার কোরবানি ঈদে তোর জন্ডিস হয়েছিল।আমি গরুর মাংস ঈদের দিনও রান্না করিনি।কেবল তুই খেতে পারবি না বলে।আমার কষ্ট লাগছিল আমার বাকী সন্তানেরা মাংস খাবে অথচ তুই খেতে পারবি না। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবি,তোর মন খারাপ হবে।আর আজ আমি খেতে পারছি না অথচ তোরা একই টেবিলে ঠিক মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছিস।একবার ভেবে দেখেছিস?আমারো তো খেতে ইচ্ছে হতে পারে?’

পিউলি, রাদ এবং চৈতী তিনজনেই চুপ হয়ে গেল।এভাবে সত্যি কখনো তারা ভেবে দেখেনি।একজন রোগী খেতে পারবে না বলে তাকে দেওয়া হয় না।অথচ তার সামনে সেসব খাবার খেলে তার মনে কষ্ট লাগাটা স্বাভাবিক। সে যতই মুখে বলুক না কেন খাবো না তোমরা খাও কিন্তু তার মনেও ইচ্ছে হয়।

পিউলি কথা না বাড়িয়ে টক দইয়ের সালাদ বানিয়ে এনে দিলো।রাহেলা বেগমকে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছিলো।কিন্তু বিপত্তি ঘটালো দুপুরের দিকে।হুট করেই গ্যাসের সমস্যা হলো রাহেলা বেগমের।আঘাত পাওয়ার অংশে ড্রেসিং এর সময় হরহর করে বমি করলো সে।ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ সব মিলিয়ে কয়েক ঘন্টার মাঝেই তার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল।উপায় না পেয়ে তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। বার বার বমির কারণে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল রাহেলা বেগম।

রাহেলা বেগমের সংসারে তার ভাইদের কথার মূল্য অনেক।বিশেষত তার স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাইদের পরামর্শ ছাড়া সে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না।চার ভাইয়ের একমাত্র বোন বলে তারাও বোনকে যথেষ্ট ভালোবাসে।রাহেলা বেগম হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে ভাইদের কাছে কল দিয়ে সবটা বললেন।

কেবল ভাইদের নয় কল দিলেন নিজের ভাইঝি, ভাইপুত সবাইকে।একমাত্র ফুপু ছেলের বউয়ের অত্যাচারে এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে শুনেই দেখতে এলেন তারা।তাদের দেখে যেন বিছানার সাথে মিইয়ে গেছেন রাহেলা বেগম।হাত ইশারায় দেখালেন তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

ডাক্তার এসে অক্সিজেন স্যাচুরেশন রেট চেক করা হলে ডাক্তার জানালেন সব স্বাভাবিক আছে কিন্তু তবুও রাহেলা বেগমের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।প্রয়োজন না থাকা স্বত্বেও তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হলো এবং এর সব দোষ পড়লো পিউলির উপর।সবাই মিলে চটে গেল তার উপর। রাদ গিয়েছিল এটিএম থেকে টাকা তুলতে, চৈতী একা পিউলির ঢাল হয়েও হতে পারলো না।

পিউলির স্বামী স্ত্রীর হয়ে দুটো কথা বলতে যাওয়ার আগেই তার বড় মামা তাকে ধমকে দিলো।এতোটা অসহায় বোধ কখনো হয়নি পিউলির।ছোটো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।বাড়ি না ফিরে সে চলে এসেছে মায়ের কাছে।অন্তত একটা রাত না হয় শান্তিতে ঘুমাবে সে।

কিন্তু সেটাও সম্ভব হলো না।নিকট আত্মীয় কল দিয়ে তাদের মা কে জানিয়ে দিলো পূবালীর বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছে আয়াশের পরিবার।কেবল মাত্র পূবালী, পিউলি তার মায়ের বিয়ে দিতে চায় বলে।

মানকলি পর্ব ৩

ফোন কানে রেখেই তীব্র বুক ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন পিউলির মা।দ্রুত দুই মেয়ে তার কাছাকাছি এলেও তিনি বললেন,
‘তোদের মনে হয় আমি এতো স্বার্থপর?দুই মেয়ের সংসার শেষ করে নিজের সংসার সাজাবো?’

মানকলি পর্ব ৫